Story

লক্ষ্মীপূজার রাত | Kathamala - read, write and publish story, poem for free in hindi, english, bengali

লক্ষ্মীপূজার রাত

2 years ago

0



আমার মামারবাড়ি তোকিপুরে, তারকেশ্বর থেকে খানিক ভিতরের দিকে যেতে হয়। যখনকার কথা, তখন তা প্রত্যন্ত গ্রাম, বিদ্যুৎ আসেনি। আমার মায়ের মুখে শোনা গল্প, মা তখন অনেক ছোট। মায়ের দাদু, মানে আমরা যাঁকে বড়দাদু বলে ডাকতাম, তিনি ছিলেন খুবই সাত্ত্বিক মানুষ, গ্রামের মোড়ল। একবার বড়দাদুর ব্যবসায় খুব বড়সড় ক্ষতি হয়, দিশেহারা হয়ে যান, সেই সময় একদিন  রাতে মালক্ষ্মী স্বপ্নে দেখা দিয়ে বলেন, " বলাই, তুই আমার পূজা কর,তোর সব সমস্যা মিটবে"। ধূমধাম করে সেবছর লক্ষ্মীপূজা করলেন। সত্যিই, সেদিনের পর থেকে সংসারে কোনোকিছুর অভাব  ছিল না। সকলে বলত, আমার মামারবাড়ির উপর নাকি মা  লক্ষ্মীর আশীর্বাদ আছে।


সে বছর লক্ষ্মীপূজার ঠিক আগেই কি হল, বন্যায় গোটা গ্রাম গেল ভেসে। নীচু জমিতে বাড়ি থাকার জন্য সবার বাড়িতেই জল থইথই অবস্থা। আমার মামারবাড়িটাই যা একটু উঁচু জমিতে, তাই গ্রামের সব মানুষ তাদের গৃহপালিত পশুদের নিয়ে এসে জমা হল সেখানে। বৃষ্টি থামার কিন্তু কোনো নাম নেই, আঝোরধারায় ঝরেই চলেছে। সন্ধের দিকে বৃষ্টি আরো বাড়তে লাগল, দামোদরের বাঁধ গেল ভেঙে। হুহু করে জল ঢুকতে শুরু করল। অত উঁচু জমিতেও নীচতলার ঘরগুলোতে জল ঢুকতে শুরু করল। মানুষ, পশু সবাই মিলে ভয়ে শোরগোল ফেলে দিল। ভয়ে সবাই দো'তলায় উঠে পড়ল। ধীরে ধীরে রাত বাড়তে লাগলো, জলও বাড়তে লাগল। সবাই ভয়ে তটস্থ, ছেলে থেকে বুড়ো সবাই যেন কোন ভয়ঙ্কর মৃত্যুর প্রতীক্ষা করছে।  রাত্রি যেন শেষ হতেই চায় না, শোঁশোঁ করে হাওয়া বইছে, যেন কোন দৈত্য দাপিয়ে বেড়াচ্ছে। সবাই মালক্ষ্মীর জপ করতে লাগলো। ক্রমে সেই কালো রাত শেষ হল, আর নতুন সূর্য ওঠার সাথে সাথে বৃষ্টিও কমতে লাগলো। সবার যেন স্বস্তির নিঃশ্বাস পড়ল। এবার পেট তো চোঁচোঁ করছে, গতকাল সারারাত কারো খাওয়া হয়নি। সবার খাবার ব্যবস্থা তো করতে হবে, তাই বিরাট বড় হাঁড়ি করে খিঁচুড়ি  বসল। যে'কদিন জল নামতে সময় নিল, সে'কদিন রোজ মামারবাড়িতে ভোজ হত। দামোদরের সব মাছ ডাঙ্গায় উঠে এসেছিল, সবাই উঠনে জলে পা ডুবিয়ে বসেই নাকি ছিপ নিয়ে মাছ ধরত। কি দিন গেছে সব। যা হোক ধীরে ধীরে সবাই একে একে যে যার বাড়ি ফিরে গেল। 


এদিকে লক্ষ্মীপূজার সময় এগিয়ে এলো। কিন্ত, হাত যে একেবারে খালি হয়ে গেছে এতদিন গ্রামের সবাইকে ভোজ খাওয়াতে গিয়ে। তাই বড়দাদু ঠিক করলেন, এবছর আর লক্ষ্মীপূজাটা করবেন না, অত টাকা কোথায়।  মন খুবই খারাপ, কিন্তু করারও কিছু নেই। সেইদিন রাতে ঘটল এক অবিশ্বাস্য ঘটনা। বড়মামা যেই ঘুম থেকে উঠে বাথ্রুম যায়, শোনে উপরের সিঁড়িতে কে যেন পায়ে নূপূর পড়ে হাঁটছে, ছম ছম। বড়মামা ছিলো বেজায় সাহসী, পা টিপে টিপে উপরে উঠে গেল। যেন কানের পাশ দিয়ে একটা দমকা হাওয়া বয়ে গেল। বড়মামা তবু দমল না, নূপুরের শব্দ অনুসরণ করে চলতে লাগলো। হঠাৎ পায়ের আওয়াজ উপরের ঠাকুরঘরের কাছে এসে থমকে গেল। বড়মামা দেখলেন এক অপরূপা বাচ্চা মেয়ে কি সুন্দর সাজে তাঁর দিকেই ফিরে তাকিয়ে হাসছে। হাতে মালক্ষ্মীর কলস। সেসব দেখে বড়মামা অজ্ঞান হয়ে যায়। ধপ করে শব্দ হয়, আর সবাই ঘুম ভেঙে ছুটে আসে দোতলায়। জ্ঞান ফিরলে বড়মামার থেকে সবটা শুনে বড়দাদু কেমন যেন গম্ভীর হয়ে রইলেন, মুখে কিছু বললেন না। পরেরদিন বড়দাদু সন্ধ্যায় দাওয়ায় শুয়ে আছেন, ভড় সন্ধ্যেবেলা, মা মামারা সবাই লণ্ঠনের আলোয় একটু দূরেই পড়তে বসেছে। হঠাৎ কোত্থেকে এক বিরাট বড় ধবধবে সাদা রঙের পেঁচা এসে বসল ঠিক বড়দাদুর মাথাগোড়ায়, কপালে এই এত্ত বড় লাল সিঁদুরের টিপ। সবাই তো দেখে হকচকিয়ে গেল। বড়দাদু তখন হাতজোড় কাঁদোকাঁদো হয়ে বললেন, "মা রে আমি ভুল বুঝতে পেরেছি, তোর পূজার কোনো অন্যথা হবে না।" তারপর পেঁচাটা উড়ে চলে গেল। সবাই শাঁখ বাজাতে লাগল। 


যাহোক, লক্ষ্মীপূজাটা ভালভাবেই হয়ে গেল। অন্যবারের মত অত ঘটা করে না হলেও মন্দ হয়নি। সবাই খুব খুশি। সেই খুশিতে ঠিক হল, স্কুলমাঠে রাত ১০ টা থেকে যাত্রা দেখতে যাওয়া হবে। মা ,মামারা মিলে মোট সাতজন যাবে। বড়দাদু কিন্তু বাধা দিয়েছিলেন, কিন্ত সে বাধা আর কে মানে। বড়দাদু ঘুমিয়ে পড়লে সবাই চুপিচুপি ঘর থেকে বেরিয়ে এলো। আসলে যাওয়ার রাস্তাটা ঠিক সুবিধের ছিল না। মাঝে একটা ছোট বাঁশবন পড়ত, তার পাশে ছিল একটা পুকুর। রাতে ওই রাস্তা দিয়ে গেলেই চোখে পড়ত কে যেন ছিপ নিয়ে পুকুরে বসে মাছ ধরছে। বাঁশগাছগুলো অকারণে ভীষণ দুলতে থাকত, অথচ কোথাও কোনো হাওয়া নেই। আর যার সামনে একটা বাঁশ পড়ত, তার আর ঘরে ফেরা হত না। কে যেন ওখানে নানা রূপ নিয়ে লোককে ভয় দেখাত। তাই রাতে ওই রাস্তা সবাই এড়িয়েই চলত। এ হেন রাস্তা দিয়ে সবাই মিলে যাত্রা দেখতে গেল। যাওয়ার সময় সব স্বাভাবিক, সবাই মনে খুব সাহস পেল, আসলে সবার বয়সই তো কম ছিল। ঠিক হয়েছিল, তাড়াতাড়ি ফিরে আসবে একটু দেখেই। কিন্তু, সবাই যাত্রা দেখতে এতই মশগুল হয়ে গিয়েছিল যে ফিরতে ফিরতে প্রায় ভোররাত হয়ে গেল। কথায় বলে না,"যেখানে ভূতের ভয়, সেখানেই সন্ধ্যে হয়"। চারদিকে ঘুটঘুটে অন্ধকার, সাথে ভয়ঙ্কর নিঃস্তব্ধতা। সবাই একটু ভয়ে ভয়েই পথ চলতে শুরু করল। বাঁশবনে হঠাৎ করে ঝড় শুরু হল, কি তার দাপট। অথচ আকাশ কিন্তু পরিষ্কারই ছিল। বাঁশগাছগুলো ভীষন জোরে জোরে দুলতে থাকল।  যেন সবকিছু উলোটপালোট করে দেবে। বড়মামা বললেন,"তাড়াতাড়ি পা চালাও।" মালক্ষ্মীর নাম জপতে জপতে লাইন করে যাচ্ছে সবাই। হঠাৎ ঘেউ ঘেউ শব্দে  চমকে সবাই পিছনে তাকালো। কোথা থেকে একটা কুকুর এসে তাদের পাশে পাশে যাচ্ছে। মামা বলল, "দেখ, এটা দেখতে অনেকটা আমাদের টমির মত না? কিন্তু ও এখানে কি করে এলো? মনে হয় আমাদের পথ দেখাতে এসেছে"। টমি ছিল বড়দাদুর খুব পছন্দের পোষা কুকুর। কিছুদিন আগেই এক অজানা রোগে টমি মারা যায়, অনেক চিকিৎসা করিয়েও টমিকে বাঁচানো যায় নি।  


হঠাৎ কুকুরটি সামনে এসে পথ আটকে ঘুরে দাঁড়াল। তারপর সামনের দু'পায়ে ভর দিয়ে দাঁড়িয়ে লম্বা হতে হতে মাথার উপর দিয়ে ধনুকের মত হয়ে সবাইকে ঘিরে ধরল, ভয়ে তো ছোটমামা মূর্ছাই গেলেন, বাকিরাও ভয়ে চিলচিৎকার জুড়ে দিল। হঠাৎ কারো  গলার আওয়াজে সবাই তাকিয়ে দেখে, বড়দাদু দাঁড়িয়ে আছে, হাতে মালক্ষ্মীর ঘট। বড়দাদু সেই ঘট থেকে একটু জল নিয়ে কুকুরটির গায়ে ছিটিয়ে দিতেই সেটি আবার তাঁর আগের অবস্থায় ফেরত এসে ছুট্টে কোথায় অদৃশ্য হয়ে গেল। কারো মুখে কোন কথা নেই। বড়দাদু গুরুগম্ভীর হয়ে বললেন, "জানতাম তোমরা এই ভুলটাই করবে, এবার বাড়ি চল"। সবাই মাথা নীচু করে বাড়ি ফিরে এলো।  


পরদিন সবাই মিলে বড়দাদুকে ধরল,"আচ্ছা ওই বাঁশবনে কি আছে, আর তুমিই বা ওখানে ওই সময় পৌঁছালে কিভাবে? "

বড়দাদু এরপর যা বললেন, তা শুনে সবার গায়ের লোম খাঁড়া হয়ে গেল, "আজ তোরা যে ফেরৎ এসেছিস, তা কেবল আমার মা লক্ষ্মীর আশীর্বাদে। আমি তো ঘুমচ্ছিলাম, হঠাৎ দেখি মা আমার স্বপ্নে দেখা দিয়ে বলছেন বলাই, তোর নাতি-নাতনিদের যে বড় বিপদ, ওদের বাঁচা। আমার ঘটটা নিয়ে যাস, মনে সাহস রাখিস, আমি সবসময় তোদের সাথে আছি। তাই তো ঠিক সময়ে গিয়ে তোদের বাঁচাতে পারলাম। নাহলে আজ যে কি হত। ওই বাঁশবনের পাশেই একটা বাড়িতে একটি বউ থাকত, সে তুকতাক, ঝাড়ফুঁক করত। এ বছরের মতই একবার বন্যা হয়েছিল, তা প্রায় বছর পাঁচেক আগে, সেবারও কি প্রবল বর্ষণ, বাঁশবনের পাশের পুকুরটা দেখেছিস? তার জল আর রাস্তার জল এক হয়ে গেছিল, বুঝতে না পেরে কাদায় পা ফস্কে ওই পুকুরে পড়েই বউটি মারা যায়, আসলে তাঁর আত্মা তো শান্ত হয়নি। নাঃ অনেক হয়েছে, এবার এটার একটা কিছু ব্যবস্থা করতেই হবে।"  


তারপর ওঝা ডেকে রীতিমত যজ্ঞ করে ওই বাঁশবন কেটে ফেলা হয়। এখন আর কাউকেই দেখা যায়না। তবে যারা এ কাহিনী জানে, ওই বাঁশবনের রাস্তা দিয়ে গেলে তাদের এখনও গাটা ছমছম করে ওঠে। 


  

Comments

To comment on content, please Login!

Comments & Reviews (0)

No comments yet :(