Story

"মহালয়া" | Kathamala - read, write and publish story, poem for free in hindi, english, bengali

"মহালয়া"

2 years ago

0

                 নরম কুয়াশায় ভরা আকাশ,  মৃদুমন্দ বাতাসে সানাইয়ের সুর।  ফুরফুরে আগতপ্রায় নিঃস্ব জীবনে পরিশ্রান্ত,পরিক্লান্ত অথচ  পরম শান্তির, পরম নিশ্চিন্তের নিঃশ্বাস। আজ নিরুপমা -র বিয়ে। পরম আদর যত্নে লালিত আমার নিরুকে তারই ভালোবাসার মানুষের হাতে সমর্পন করলাম। নিরুর মুখটা উষ্ণ আনন্দে উদ্ভাসিত হয়ে উঠলো। 

                 শ্বশুরবাড়ি শহরাঞ্চলে,বাড়ির কাছেই , অতি সম্ভ্রান্ত পরিবার। দান ধ্যান করেন বলেও সুখ্যাতি আছে। পূজাঅর্চনাও হয় ধূমধাম করে। সারা পাড়ার লোক নিমন্ত্রিত থাকে। একডাকে  রায়বাড়িকে সবাই চেনে। বড় নিশ্চিন্ত হয়েছিলাম এই সম্মন্ধটা হয়ে।আর আমার নিরুও কি যে সে নাকি। পড়াশুনা, গান, বাড়ির কাজে তার জুড়ি মেলা ভার। আমাকে তো লোকে বলত,' মেয়ে হলে এমন ই হওয়া উচিৎ।' গর্বে আমার বুকটা ফুলে যেত। 

                  শ্বশুরবাড়িতে আত্মীয়স্বজনও বৌ দেখে খুব খুশি। কেউ বললেন, ' বাঃ বৌমার মুখশ্রী তো ভারী সুন্দর, হাঁটাচলা কথাবার্তা কত নম্র ভদ্র '।  কেউ বা বললেন, ' হবে না , কত পড়াশুনা জানে কত ভালো চাকরি করে'। রান্নার ও সুখ্যাতি হল একচোট।  কিন্তু বিধাতা যে কিসে রুষ্ট হন কেউ বলতে পারে না। এতো প্রশংসা বুঝি শাশুড়ির সহ্য হলো না।   রায়গিন্নির ইচ্ছা ছিল, সাধারণ ঘরের একজনকে বাড়ির বউ করে আনবেন, যাকে নিজের মত শিখিয়ে পরিয়ে নেবেন। কিন্তু ছেলের পছন্দ! বাধাও দিতে পারেননি। নিরু হয়ে উঠলো তাঁর চক্ষুশূল।  নানা কথাবার্তায় কাজেকর্মে বোঝাতে চেষ্টা করলেন মেয়ের কি কি খামতি।  'গায়ের রং এতো চাপা , লোকে বলছে, কি কালো।  বেসন , সর মাখবে আজ থেকে। '  কাজে এতটুকু ত্রূটি  হলে বলতেন ,' ধর্ম কর্মে তো এতটুকু মতিগতি  নেই দেখেই বোঝা যায় । '  রাতে এতো জোরে পা ফেলে হাঁটো যে নিচে ঘুমাতে পারি না, অলক্ষ্মী কোথাকার '। আরো কত কি। কাজের লোক কে ডেকে খাওয়াতেন , তবু বাড়ির বৌ কে একবার খেতে বলতেন না। নিদেনপক্ষে তার সাথে কেউ কথা  পর্যন্ত বলত না। ঘরের  মধ্যে থেকেও নিরু একঘরে হয়ে গেছিল। বিকাল গড়িয়ে যেত, খাওয়া জুটতো না।  খিদের চোটে মেয়েটা কতদিন না খেয়ে ঘুমিয়ে পড়েছে কেউ তার খবর নেয়নি।  দেখতে দেখতে নিরুর শরীর ভাঙতে লাগলো।  শাশুড়ি বলতো , ' ছিরি হচ্ছে দেখো না যেন পোড়াকাঠ।  এ সব-ই ওর ন্যাকামি ।  লোকে বলবে শাশুড়ির নজর লেগেছে। ' 

                   বাড়িতে একবার বড় করে পূজা হল। আমাদের ও নিমন্ত্রন ছিল। কেউ একবার কথাও বলল না, দেখেও দেখল না। সবাইকে প্রসাদ দেওয়া হল, আমাদেরকে দেওয়া হল না। একবার খেতে পর্যন্ত ডাকা হল না। ওদিকে শাশুড়ি ঠাকুরের সামনে কেঁদে আকুল হচ্ছেন, ঠাকুরমশাই-এর পা ধোওয়া জল খাচ্ছেন, দান ধ্যান করছেন । বিধাতা কি অলক্ষ্যে একবার হাসলেন? বুঝলাম লোকে শুধু বাইরেটা  দেখেই এত সুখ্যাতি করে,  ভিতরে ত সব-ই ভাঁওতা, ভোজবাজি।  এসব ভণ্ডামি ছাড়া আর কি।  

                   বিয়েতে অনেকদিন ছুটি নেয়ার জন্য জামাই কাজে যোগ দিয়েছে।  অনেকদিন ছাড়া এক রাতের জন্য ফেরে। শাশুড়ি ছেলেকে ডেকে বলেন,' তুই তো অন্ধ, তোকে মোহের জালে বশ করে রেখেছে, বুঝিস না। আর কাজের কি ছিরি, সকালে উঠতে 

উঠতে আমার সব কাজ শেষ হয়ে যায় ।'   একদিন নিরু তার শাশুড়িকে বলল, 'মা, তুমি আমায় মেয়ে বলে ভাবতে পার না?' শাশুড়ি তাচ্ছিল্যের হাসি হেসে বললেন,' এ কথা বলার সাহস কি করে হয় তোমার? তোমার সাথে আমার কিসের সম্পর্ক?' নিরু বুঝতেই পারতো না তার অপরাধটা কি , কি এমন করেছে সে।  তার পরদিন থেকে নিরু-মা এর সেই হাসিটা আর কোনোদিন দেখিনি।  

                    বিয়ের পর নিরুর প্রথম পূজা। তত্ত্ব নিয়ে গেলাম। কেউ ভালো করে কোনো কথা বললেন না। ভাবছিলাম চলে আসব কিনা। তারপর থালা ভরে খেতে দিলেন। খেতে শুরু করলাম, বললেন, 'দেখুন, আমাদের এসব জামাকাপড়ের উপর কোনো লোভ নেই,এসব ফেরত নিয়ে যান, আমরা এসব পছন্দ করি না। আমরা অন্য জগতের লোক, আপনারা বুঝবেন না'।  না পারছি গিলতে, না পারছি ফেলতে।  নিরুর দিকে তাকালাম। ও বলল,' আর কোনোদিন তোমরা কোনো কিছু এবাড়িতে এনো না'। আসার  সময় নিরুকে বললাম,' ওরা এত অপমান করতে পারল?'  নিজের অপমানের বোঝায় নিরুর চোখের দিকে তাকাতেই ভুলে গেলাম। সে রাতে নিরুর উপর দিয়ে কি ঝড় বয়ে গাছে জানি না। লজ্জায়, অপমানে সে মরমে মরে যাচ্ছিল। ফোন করেছিলাম- দেখলাম জ্বরের ঘোরে ভুল বকছে আর কাঁদছে। কোনো কথা শোনার অবস্থায় নেই। হায়রে দুর্ভাগা দেশের অভাগিনী মা- মেয়ের মাথায় একটু  হাত বুলিয়ে দেব, ছুট্টে গিয়ে বুকে টেনে নেব, তারও উপায় নেই।

                   ' সত্য সেলুকাস , কি বিচিত্র এ দেশ , তার থেকেও বিচিত্র মানুষের মন ' ।  এমন মানুষ ও পৃথিবীতে আছেন যারা ধর্মকর্মের নামে ভণ্ডামি করেন ।  নিজে দান ধ্যান করেন অথচ লোকের দেয়া জিনিস গ্রহণ করেন না। উনি বোঝেন না যার ভুরি ভুরি আছে সে-ই দান করতে পারেন কিন্তু গ্রহণ করতেও একটা বিরাট মন লাগে।  বাইরের লোককে ডেকে খাওয়ান অথচ বাড়ির লোক অভুক্ত থাকে।  কারণ বাইরের লোকের কাছে নাম আছে , ভিতরের লোককে দমিয়ে রাখলেই হলো।  Inferiority complex এ ভোগেন। বউমাকে কাজ করতে দেন না পাছে লোকে তার প্রশংসা করে। লোকের সাথে কথা বলতে দেন না পাছে তাঁর নামে নিন্দা করে। 

                     কদিন পর পূজার সময় নিরু আমার বাড়ি এল, চোখে একরাশ শূন্যতা নিয়ে। কোনো প্রশ্ন করতে পারিনি সেদিন। তার নীরব চাহনিই বলে দিচ্ছিল কত কান্না, কত অপমান লুকিয়ে আছে তার মনের মধ্যে।সান্ত্বনা দেওয়ার কিছুই ছিল না। শুধু নিরুর মাথায় হাত বুলিয়ে বললাম,' মা রে, আজকালকার দিনে সম্পর্কগুলো বড়ই ঠুনকো। ভাঙা যতটা সহজ, গড়া বা ধরে রাখা ততটাই কঠিন। দুপক্ষই যদি কিছুটা করে মানিয়ে নেয়, তবে হয়ত এত nuclear family তৈরি হয় না। তবে মানিয়ে ততটাই নেবে যতটায় নিজের মান, সম্মান অটুট থাকবে। সংসার করা মানে যেমন শুধু হাঁড়ি ঠেলা , বাচ্চা মানুষ করা নয়, তেমন ই নিজের এতদিনের সমস্ত জ্ঞান, শিক্ষা বিসর্জন দেওয়াও নয়। তবে কোন কিছুর সাথে লড়াই করার জন্য আগে নিজেকে প্রস্তুত করতে শেখ। এমনভাবে তৈরি কর, যেন তোমার চোখের দিকে তাকিয়ে কেউ অপমান করার সাহস না পায়। নিজের সম্মান নিজেকেই অর্জন করে নিতে শিখতে হয়। মনের  ভিতরের এই কষ্টের আগুনে নিজেকে পুরিয়ে খাঁটি সোনা তৈরি কর।' 

                      সেই কবে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর 'দেনাপাওনা'-এ নিরুপমার দুর্দশা বর্ননা করেছিলেন। আজও এদেশের হাজার হাজার 'নিরুপমা'রা দিনে রাতে মানসিক, শারিরিক ভাবে নির্যাতিত হচ্চে। এদেশ আর কবে শিক্ষিত হবে? কিন্তু আর না।  নিরুপমাদের উঠে দাঁড়ানোর সময় হয়ে গেছে। তারা আর পড়ে পড়ে মার খাবে না, ধর্মের নামে ভন্ডামি করে আর কতদিন মানুষের মুখ বন্ধ রাখবে। এইসব অসুরদের নিধন করতে তাদের মা দুর্গা হয়ে অস্ত্র তুলে নিতেই হবে।

                      আজ মহানবমী। রায়বাড়িতে মহাধূমধাম। আজও গোটা পাড়ার লোক নিমন্ত্রিত। আজ সেখানে ঘটা করে 'কুমারী পূজা'। শুনলাম উনি নিজে 'কুমারী'কে সাজাবেন, পূজা করবেন।  নিরুকে জিজ্ঞাসা করলাম, 'তুই কি একবার যাবি?' নিরুর চোখটা দেখলাম একবার দপ করে  জ্বলে উঠে আবার জলে ভরে গেল। সাথে সাথে মাইকে 'মা'-এর আগমনির সুর ভেসে এল।

Comments

To comment on content, please Login!

Comments & Reviews (0)

No comments yet :(