এক সুন্দর শীতের সকাল, মিঠে রোদে হিমেল হাওয়া রাত্রির গালদুটো স্পর্শ করে যাচ্ছে, যেন তার ঠোঁটের হাসিটাকে আরো বেশি উদ্ভাসিত করে তুলছে । অষ্টম শ্রেণীতে অঙ্ক প্রতিযোগিতায় দ্বিতীয় পুরষ্কার নিতে এসেছে সে। মাঠে চারিদিকে শতসহস্র কলরোল, তার মাঝেই পুরষ্কার বিতরণীর নাম ঘোষণা চলছে। অষ্টম শ্রেণীর প্রথমজনের নাম ঘোষণা করতেই তার সমস্ত মনোযোগ মঞ্চে চলে গেল, --- আকাশ, যার বুদ্ধিমত্তা তাকে বরাবর আকর্ষণ করেছে। দেখতে থাকল মুগ্ধ দৃষ্টিতে, সমস্ত চেতনা দিয়ে। ঠিক সেসময় আকাশও তার দিকে পূর্ণ দৃষ্টিতে দেখল। সেই চোখের মধ্যে কি ছিল কে জানে, তার চেতনা কোথা থেকে কোথায় উড়ে গেল, তার সামান্য খবরটুকু তার কাছে পৌঁছাল না, শুধু অলস শূণ্যদৃষ্টিতে দেখতে থাকল--- দেখতেই থাকল। যখন চেতনা ফিরে এল দেখল কোথায় কি, কেউ কোথাও নেই। তার মধ্যে কখন যে তার নাম ঘোষনা হয়ে গেছে ,সে খেয়ালই করে নি। হঠাৎ মনের মধ্যে যতরাজ্যের লজ্জা এসে উপস্থিত হল, কিন্তু কেন জানিনা, মনের মধ্যে একটা আকুতি রয়েই গেল সেই চোখদুটো আবার দেখার।
তারপর কেটে গেছে প্রায় দুই বছর। তার জীবনে অনেক পরিবর্তন এসেছে। শারীরিক অসুস্থতার মধ্যে ভালোভাবে পড়াশুনো করাটাই তার কাছে এখন চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। আজ নতুন স্কুলে ক্লাস ইলেভেন-এর প্রথম ক্লাস। ক্লাসরুম-এ ঢুকেই তার চোখটা আবার আটকে গেল - ওই তো সেই চোখদুটো। এবার তবে রোজ দেখা হবে! মনটা হয়ত একটু খুশিতে ভরে উঠল। সেই চোখের দিকে যখনই তাকাত, কোথায় যেন হারিয়ে যেত, সত্যি বলতে ওই চোখদুটোতে হারাতে মন্দ লাগত না। দেখলে এত আপন মনে হত, যেন কতদিনের চেনা, কত গভীর,তার
তল পেত না, শুধু ডুবে যেতে ইচ্ছা হত । মনে হত, এ হল সেইজন,যার সাথে যুদ্ধ করা যায়, যার বিরুদ্ধে নয়। সবাই বলত,'এবার রাত্রি আর আকাশের মধ্যে রেষারেষিটা ভালোই হবে'। কিন্ত সে যে তখন নিজের সাথে নিজের লড়াই-এ ব্যস্ত, নিজেকে টিকিয়ে রাখার লড়াই-এ।
এ সময় আকাশকে কোনোদিন তার প্রতিদ্বন্দ্বী হিসাবে নয়, এক পরম বন্ধু হিসাবে পাশে পেতে চেয়েছে, কিন্তু পাওয়া হয়নি। কি এক সঙ্কচতায় তার সাথে কোনোদিন সাধারণ কথাবার্তাও বলতে পারেনি, যদিবা বলেছে, তাও তৃতীয় ব্যক্তির মধ্যস্ততায় । শারীরিক অসুস্থতা, পারিবারিক ঝামেলায় সে ক্রমশ জর্জরিত হয়ে যাচ্ছিল। সে সময় আকাশ ছিল তার প্রেরণা, তাকে দেখে নতুন করে পড়তে ইচ্ছা করত। সে স্কুলে না আসলে, সারাদিন বড্ড ফাঁকা ফাঁকা লাগত । স্কুলে সেবার তাদের সরস্বতি পূজার ভার, একসাথে দলবেঁধে হাতে হাতে কাজ, আলপনা দেওয়া, প্যান্ডেল সাজানো,লুকিয়ে লুকিয়ে ওই চোখের দিকে তাকানো , যেন তার ভালোলাগাকে বহুগুন বাড়িয়ে তুলেছিল।
কত না-বলা কথা বাতাসে ভেসে বেড়াচ্ছিল, তার ইয়ত্তা নেই। সেদিন অন্ধকারের মধ্যে আরতির প্রদীপের আলোয় আকাশকে দেখে মনে কি যে শিহরণ জেগেছিল , তা বলে বোঝানোর নয়।অপরিণত বয়সের প্রথম ভালোলাগা, বন্ধুদের ঠাট্টা ইয়ার্কিতে কখন ভালোবাসা হয়ে গেছে,মন জানতে পারেনি, জানতে চায়ওনি। কিন্তু মন জানতে না চাইলেও, সময় তাকে অনেক কথা জোর করে জানিয়ে দেয়। আর সেই সময়ই একদিন মনকে বলে দিল, আকাশের সাথে তার বিচ্ছেদের সময় এসে গেছে। জয়েন্ট পরীক্ষার দিন তাকে দেখেছিল পিছন থেকে, চলে যেতে- ভেবেছিল এই হয়ত শেষ দেখা। রাত্রি অপেক্ষা করেছে, যদি সে একবার, শুধু একবার ফিরে তাকায় । না, সেদিন সে ফিরে তাকায়নি। অজান্তেই রাত্রির দু'চোখ জলে ভরে উঠেছিল সেদিন, মনটা ভারী হয়ে গিয়েছিল ।
রাত্রির বরাবরের স্বপ্ন ছিল, সে এক বড় ডাক্তার হবে। কিন্তু মানুষ যা চায় তা কি সবসময় হয়? ক্রমে সেই প্রতীক্ষিত ক্ষণ এল- রাত্রি জয়েন্টে ডাক্তারি পড়ার সুযোগ পেল না। তাই রাত্রি কে অনিচ্ছা স্বত্তেও ইঞ্জিনীয়ারিং পড়তে যেতে হল, আর আকাশ গেল ডাক্তারি পড়তে। দু'জনার গন্তব্য আলাদা হয়ে গেল । আর কোনোদিন হয়ত দেখা হবে না, হওয়ার কথাও নয়। কি কঠিন পথ, বৃথা মনোরথ, বিফল অভিসার। একে নিজের স্বপ্ন হারানোর ব্যথা, তার উপর যাকে সে দেখে জীবনে লড়াই করার প্রেরণা পেত, সেও কোথায় হারিয়ে গেল। দু'চোখ অকারণে জলে ভেসে গেছে কতদিন। কত রাত নিজের স্বপ্ন হারানোর ভয়ে, ওই চোখদুটো দেখতে না পাওয়ার ভয়ে জেগে বসে বিছানায় কেঁদেছে। কিন্তু কেন? আকাশ তো তাকে কোন প্রতিশ্রুতি দেয়নি। তবু মন শুনতে চাইত না। শুধু চোখ বন্ধ করলেই তার চোখের সেই গভীর দৃষ্টির কথা মনে পড়ত। সবই কি ভুল ছিল?কত কঠোর, কত নীরব সে অপেক্ষা।
সেই অপেক্ষার অবসান একদিন হল। হঠাৎ করেই তার কাছে একটা ফোন এল, গলাটা শুনেই রাত্রির মনের চাঞ্চল্য গেল স্তব্ধ হয়ে---আকাশ। কোন অচেনা দুঃখে নয়, অজানা সুখে নয়, এক অদ্ভুত অনুভূতিতে মনের এদিক থেকে ওদিক উথাল-পাথাল হয়ে গেল। শুধু হৃদয়ের স্পন্দনটুকু ধিকিধিকি করে নড়তে লাগলো, নড়তেই লাগলো। তবে কি সে ফিরে এসেছে? সে ফিরে এসেছে হয়ত রাত্রির ভালোবাসা নিখাদ ছিল বলে, বা হয়ত রাত্রির থেকেও আকাশ তাকে বেশি ভালোবেসেছে বলে। রাত্রির মনে হল, সত্যিই সে ভালোবাসতে পেরেছে। শুরু হল ফোনালাপ। টুকরো টুকরো কথা । কিন্তু একে কি সত্যি বন্ধুত্ব বা ভালোবাসা কোনোটাই বলা যায়? রাত্রি যতটা না উৎসাহ নিয়ে ফোন
করত, আকাশের ঠিক ততটাই যেন অনীহা, এড়িয়ে যাওয়া। আবার রাত্রি দু'দিন ফোন না করলে, আকাশই তাকে নিজে থেকে ফোন করত। কখন তাকে এমন কথা বলত রাত্রির মনে হত সেও তাকে তততাই মনে মনে ভালোবাসে। আবার কখনও বা এমন কথা বলত যে তার মত একঘেয়ে, বোরিং মেয়ের সাথে বন্ধুত্ব ত দূর, কথাও বলতে তার ভাল লাগে না। সারারাত বিভিন্ন লোকের সাথে আকাশ কথা বলে কাটাত, আর অনেক রাতে রাত্রিকে ফোন করেই ঘুমিয়ে যেত। কখনও আবার বকতে বকতে রাত পার করে দিত। মাঝে মাঝে রাত্রির বড় অদ্ভুত লাগত।
এমনি একরাতে গল্প করতে করতে রাত্রি জানতে চাইল,-
-তোর কোন মনের মানুষ আছে, যাকে তুই সব কথা বলতে পারিস?
-আছে ত।
-কে সে? আমি কি তাকে চিনি?
-না তুই তাকে চেনার কথা না।
-কি নাম তার?
-বৃষ্টি ।
-ও তাই? আলাপ করাবি না।
-না আলাপ করানোর মত কিছু নেই। আমিই তাকে ভালোবাসি, কিন্তু সে আমাকে দাদা মনে করে। তবে আমরা এত ভালো বন্ধু যে সব কথা আমাদের মধ্যে হয়। কতদিন তাকে কবিতা শোনাতে শোনাতে ঘন্টার পর ঘণ্টা কেটে গেছে। তার গল্পটাও না খুব দুঃখের। সে একজনকে পাগলের মত ভালোবাসে, কিন্তু সেই ছেলে তাকে গুরুত্ব দেয় না। মাঝে মাঝে মনে হয় যদি ওর কষ্টটা একটু কম করতে পারতাম।
-কিরকম কষ্ট বল শুনি।
-সে সূর্যকে ভালোবাসে।
- কে সূর্য? আমাদের সাথে একই ক্লাসে যে পড়ত?
- হাঁ সে ই।
-ত দুঃখটা কি?
-সূর্য ওকে ভালোবাসে না, ও একটু অন্য রকমের ছেলে তো তাই। আমি ওকে বৃষ্টির কথা বোঝাতে চেয়েছিলাম, কিন্ত ও কিছু শুনতেই চাইলো না।
-হুম, বুঝলাম।
-জানিস একটা মজার কথা। আমি একদিন সূর্যকে জিজ্ঞাসা করেছিলাম, আমাদের ক্লাস -এর কাউকে তোর পছন্দ?
- কি বলেছিলো?
-বলেছিল তোকে ওর খুব পছন্দ।
-আমাকে?????
-হাঁ তোকে। তুই জানতিস না?
-না কোনোদিন না। মানে এসব কিছুই আমার কাছে একেবারে আশ্চর্যের। দাঁড়া দাঁড়া, তুই এটা ভাবছিস না তো যে আমার জন্য সূর্য বৃষ্টি কে স্বীকার করছে না?
উল্টোদিক থেকে কোনো আওয়াজ এলো না। অনেকক্ষন চুপচাপ। রাত্রি আবার বলল,
-তুই কি আমার সাথে এই জন্য বন্ধুত্ব করেছিস যদি আমাকে বুঝিয়ে সুঝিয়ে ওদের মাঝখান থেকে সরানো যায়?
উল্টোদিক থেকে আবারও কোনো আওয়াজ এলো না। রাত্রি একটা বড়সড় আঘাত খেল। তবু মন শক্ত করে সে বলল,
-প্রথম কথা আমি এসব কিছু জানি না, আর সূর্য এর জন্য আমার কোনো ফিলিংস নেই। এই কথাটা তুই প্রথম দিন ই বলে দিতিস, এত দেরি করলি কেন? কি ভাবলি আমি কষ্ট পাব? আমার কষ্ট নিয়ে কার কি যায় আসে। তোর বৃষ্টি কে বলে দিস, আমি না কোনদিন ওদের মাঝে ছিলাম, আর না তো কোনদিন আসব। রাখছি।
রাত্রি ফোনটা কেটে প্রথমে খানিক চুপ করে বসল, দেখল, আকাশ আবার তাকে ফোন করেই যাচ্ছে, সে আবার ফোনটা কেটে দিল। তারপর এতদিন আকাশের যত মেসেজ যত্ন করে সেভ করে রেখেছিল, সব ডিলিট করল, তারপর ফোন সুইচ অফ করে সারারাত বালিশে মুখ গুঁজে কাঁদতে লাগলো।
ওদিকে আকাশ ওকে ফোনে না পেয়ে রাত্রির রুমমেট কে মেসেজ করে জানালো, 'রাত্রি কেমন আছে, ফোন সুইচ অফ বলছে। আমাকে একটু জানিও প্লিস। ওকে একটু দেখে রেখ। ওর মনটা একটু খারাপ। আর রাত্রিকে বোলো আমি সারাজীবন ওর বন্ধু থাকব' ।
এ সময় তার রুমমেট তার পাশে থেকে তাকে বুঝিয়েছে, 'ভালোবেসে কোনোদিন আফসোস করিস না। তুই এটা ভেবে নিশ্চয়ই ভালোবাসিস নি যে ও ও তোকে ভালোবাসবে। তোর ভালোবাসা তো ছিল নিখাদ, নিঃশর্তের। তুই ভালোবেসেছিস বলে আকাশকেও তোকে ভালবাসতে হবে তার তো কোন মানে নেই। আর সে মেয়ে তো কোনোদিন জানলই না, অনুভবই করল না ওর ভালোবাসাকে, যার স্বাদ তুই পেয়েছিস। তবে দুঃখ কিসের? কাঁদছিস কেন?- কার জন্য কাঁদছিস ? যার জন্য কাঁদছিস, সে যেদিন তোর চোখের জলের উপযুক্ত হবে, সেদিন তোকে আর কাঁদতে দেবে না। আর আমি যতটুকু বুঝেছি, ওর মত বন্ধু খুব কমই পাবি এ জীবনে। '
এ কদিন রাত্রি নিজের মনের সাথে অনেক যুদ্ধ করল,তারপর realise করল, সে কি ভুল করেছে। আকাশ যদি তার ভালোবাসার জন্য এতদূর আসতে পারে, তবে সে কেন পারবে না? তার ভালোবাসা এতটা ঠুনকো হতেই পারেনা যে, আকাশকে তার পরিস্থিতিতে ফেলে চলে আসবে। হলই বা শুধু বন্ধু, দূর থেকেই নাহয় তাকে ভালোবেসে যাবে। আর সত্যিই তো ভালোবাসার কি অধিকার আছে তার? কি জানে ও আকাশ সম্পর্কে? ওর সুখ, দুঃখ, জীবনের বাধা, বিপত্তি, সমস্যা, মন, শরীর, কোনটার খবর সে রাখে? সে তো এটুকুও জানে না ওর কি ভালো লাগে, ও কি চায়, কোন গান, কোন রঙ ওর সবচেয়ে প্রিয়। দৈনন্দিন জীবনযাপন, ওর বন্ধুবান্ধব, কিছুই না। মনের গভীরে সযত্নে লুকিয়ে রাখা গোপন কথা তো দূর অস্ত। সে যেখানে বন্ধুত্বই তৈরি করতে পারেনি, সেখানে ভালোবাসার গুরুত্ব কতটুকু? তার এই realisation টার দরকার ছিল। সে তো infatuation কে ভালোবাসা বলে ভুল করতে বসেছিল। ভালোবাসা মানে তো শুধু চোখে চোখ রেখে হারিয়ে যাওয়া নয়, ভালোবাসা মানে হারিয়ে গিয়ে বুকে পাথর চাপা দেওয়া নয়, ভালোবাসা মানে তাকে তার অবস্থায় ফেলে রেখে দূর থেকে বিদায় দেওয়া নয়। love is a responsibility- একটা responsibility তাকে আনন্দে রাখার, তার পাশে থাকার, তার দুঃখকে
নিজের করে নেওয়ার।
এরপর ধীরে ধীরে রাত্রি আকাশের সাথে বন্ধুত্ব করেছে । জেনেছে ওর ছোট ছোট চাওয়া পাওয়া, পছন্দের কথা। বন্ধুত্ব যত গাঢ় হয়েছে তত বুঝেছে ওর মনের কথা, মনের মধ্যে লুকিয়ে রাখা সেই মনের ধনকে।আজ আকাশের সবথেকে কাছের বন্ধু রাত্রি। একে অপরের হাত ধরে মুক্তি পেয়েছে তাদের বন্দীদশা থেকে। রাত্রি ছিল খুব introvert, কথা কম বলত, share কম করত, তাই দুঃখও বেশি পেত। একটা ঘটনাকে আঁকড়ে ধরে জীবনে থমকে যাওয়া, জর্জরিত একটা মানুষ। আকাশের হাত ধরে সে আজ প্রাণখোলা, হাসিখুশি। আকাশ তাকে শিখিয়েছে কিভাবে সিন্দুক না খুলেও মনের দরজা সবার জন্য খুলে দেওয়া যায়। আর আকাশ? যে একদিন bright student ছিল, কলেজে এসে তার উচ্চাকাঙ্খা politics-এ তোড়ে ভেসে গিয়েছে আর তাতে ইন্ধন জুগিয়েছে কিছু খারাপ বন্ধুসঙ্গ। রাত্রির সংস্পর্শে এসে সে আবার নিজের career নিয়ে ভাবতে শুরু করে । একটু একটু করে আবার পড়াশুনা করে, এই সঙ্গ থেকে বেড়িয়ে আসার চেষ্টা করে। কিন্তু Politics ছেড়ে বেরনো অতসহজ নয়। রাতের পর রাত প্রাণ হাতে করে প্রায় লুকিয়ে রুম চেঞ্জ করে পালিয়ে পালিয়ে বাঁচা । প্রচুর pressure-এর মধ্যে দিন কেটেছে , আর সেই সময় তাকে সবসময় mental support আর সাহস জুগিয়ে গেছে রাত্রি। আজ দু'জনেই সেই কালো রাত পেরিয়ে নতুন সূর্য দেখছে। আর এই সময় কোনোদিন রাত্রি আকাশের মধ্যে হারিয়ে যায়নি। আজ রাত্রির কোন দুঃখ নেই, সে গর্ব করে বলতে পারে সে
আকাশকে ভালোবাসে। একদিন আকাশ হারিয়ে গিয়েছিল, তাই রাত্রি পারেনি হারিয়ে যেতে, না ওর চোখে, না ওর ভালোবাসায়, না বুকে হাত রেখে অন্য জগতে। আজ ও ফিরে এসেছে, নিজের পথ খুঁজে পেয়েছে। তাই আজ রাত্রি হারিয়ে যেতে কোন বাধা নেই। "কোথাও আমার হারিয়ে যাওয়ার নেই মানা মনে মনে..."।
আজ আকাশ honours নিয়ে ডাক্তারি পাশ করেছে। আকাশ খুব খুশি। খবর পেয়েই আকাশ রাত্রিকে ফোন করল। তার খুশির খবরটা তাকে দিল। রাত্রিও খুব খুশি হল। তারপর বলল,
-congrats. তাহলে তো খুব খুশির ব্যাপার, আনন্দ কর।
-সে তো করবই, তবে তোকে নিয়ে করব।
-আমাকে নিয়ে? আমাকে কোথায় পাবি তুই?
-তুই চলে আয়?
-কোথায়? পাগল হলি নাকি ?
-পাগল হব কেন? সত্যি বলছি।
-আমি যেতে পারব না রে। তোরা মজা কর।
-কেন? তোর কোন কাজ আছে?
-না সেরকম বিশেষ কিছু না।
-তবে?
-সে আছে, আমি যেতে পারব না।
বলে রাত্রি ফোনটা কেটে দেয়। আকাশ তাকে বারবার ফোন করতেই থাকে, রাত্রি প্রত্যেকবারই ফোনটা কেটে দেয়। তখনকার মত আকাশ রাত্রিকে একা ছেড়ে দেয়। রাতে রাত্রিই আকাশকে ফোন করে। বলে,
-কি রে কেমন enjoy করলি?
-ওই করলাম।
-কি হয়েছে এভাবে কথা বলছিস কেন? রাগ করেছিস যাইনি বলে?
-আমি রাগ করলে তোর কি?
-sorry রে। রাগ করিস না রে। আসলে problem টা আমার। আমি তোকে face করতে পারব না।
-মানে?
-দেখ আজ আর বলতে কোনো বাধা নেই। তুইও নিশ্চয়ই বুঝিস। তখন বয়স অল্প ছিল, ভালোলাগা, ভালোবাসা কি পরিষ্কার করে কিছু বুঝতাম না। ভাবতাম, তোকে আমি ভালোবেসেছি। কিন্তু যত তোকে জেনেছি, এটুকু বুঝেছি, তোর ভালোবাসার মানুষের নয়, একটা বন্ধুর খুব দরকার। তাই এতদিন ভালো বন্ধু হবারই চেষ্টা করে গেছি, আশা করি সফল ও হয়েছি। আজ আমরা অনেক পরিণত, তাই একটা কথা বলছি, আমি আজও তোকে ভালোবাসি, শুধু বন্ধু বলে ভাবতে পারি না। তোকে সামনে দেখলে আমার আরো কষ্ট হত। এতে তোর কোন দায় নেই। এই দায় সম্পূর্ণ আমার। আর একটা কথাও বলার ছিল, তোর ত এখন bright future সামনে । আমাকে আর তো কোন দরকার নেই, আমাকে এবার ছুটি দে।
আকাশ একচোট খুব হাসল। রাত্রি বলল,
-তোর হাসিটা পাচ্ছে কিসের?
-এই যো তুই বললি, তুই আমাকে অনেক জেনে গেছিস। কি জানিস তুই আমার সম্পর্কে?
-কি জানার কথা বলছিস তুই?
-কিছুই কি জানিস তুই? এখন আমার পরিস্থিতি কি? জানলে তুই এভাবে চলে যেতে পারতিস না।
-আচ্ছা বেশ বল, শুনছি।
-থাক, চলেই যখন যাবি, তখন আর শুনে কি করবি?
-আচ্ছা যাব না। এবার বল।
-কিছু বলার নেই।
-আবার রাগ করে। sorry বাবা। বললাম তো যাব না। এবার বল।
-কি বলব?
-প্রথম থেকে বল।
-প্রথম থেকে? ধরে নে আমি এই জন্মালাম--------------
হঠাৎ আকাশ চুপ করে গেল। কোনো কথা নেই। রাত্রি জিজ্ঞাসা করল,
-কি হল? আকাশ?
-জানিস একটা আশ্চর্যের ঘটনা ঘটল। তোকে বললাম না, ধরে নিতে আমি এই জন্মালাম। সাথে সাথে আমার চোখটা ঘড়ির দিকে চলে গেল। আজ এই সময় আমার birthday, original. ঠিক এই সময়। কেউ জানে না, তুই একমাত্র জানলি, কিচ্ছু না জেনে কেউ যে এটা আমাকে মনে করিয়ে দিতে পারে আমি সত্যি কখন ভাবিনি। কেউ এই দিনটার কথা জানে না, আর আজ থেকে এটা শুধু তোর আর আমার মধ্যেই থাকবে। ঠিক তো?
-একদম। happy birthday, many many happy returns of the day.
-একটা কথা বলব, আচ্ছা আমরা এই বন্ধুত্বটাকে আর এক ধাপ এগিয়ে নিয়ে যেতে পারি না?
সেদিন সারারাত তারা গল্প করল। এমনভাবেই তাদের আরো এক মাস কেটে গেল। নতুন বন্ধুত্বে, গল্পে, আনন্দে।
শুধু মাঝে মাঝে রাত্রির খুব মন খারাপ থাকলে আকাশ জিজ্ঞাসা করত,
-কি হয়েছে রে তোর?
-কই কিছু না তো।
-আমাকেও বলবি না।
-কিছু কিছু দুঃখ থাকে জানিস, যেগুলো একান্তভাবে নিজের, কাউকে বলা যায় না।
-তবে থাক বলতে হবে না।
রাত্রির চোখদুটো জলে ভরে ওঠে, কাকে বোঝাবে, তার কিসের দুঃখ। যাকে বোঝাতে চায়, সে তো শুনতে চায় না, বুঝতে চায় না, হয়ত বা বুঝেও এড়িয়ে যায়।
রাত্রির কলেজে strike ছিল, যে কারণে সারাদিন কলেজে বন্দী। কিচ্ছু পেটে পরেনি। সন্ধ্যেবেলা ফিরে তার মাথাটা ধরেছিল। তাই তাড়াতাড়ি খেয়ে শুয়ে পড়েছিল। খানিক পরে আকাশ ফোন করল।
-কি ব্যাপার, সারাদিন পাত্তা নেই যে ।
-আমি খুব ক্লান্ত, ঘুম পাচ্ছে।
-কেন কি হয়েছে?
-কলেজে strike ছিল, সারাদিন খাওয়া হয়নি, মাথা ধরেছে,ঘুমাতে দে তো ।
-সেই তো, আমি কিছু বললেই তোর মাথা ধরে, আমার কথা শুনবি কেন?আমি ফোন রাখছি। আমি কিন্তু আর ফোন করব না, বাজি রইল, দেখি কে আগে ফোন করে । ফোন কেটে দিল আকাশ। রাত্রি খুব ভালো করে জানে এখন আকাশকে থামানো যাবে না, এমনিতেও তো প্রত্যেক বাজি রাত্রিই হারে । তাই সে আর মাথা না ঘামিয়ে ঘুমিয়ে পড়ল।
একটু পর আবার ফোনটা আবার বেজে উঠল---আকাশ। রাত্রি ফোন ধরে বলল,
-আবার কি হল? আর তুই কি একটা বাজি ধরেছিলিস না?
-হুম, আজ আমিই না হয় বাজি টা হারলাম। তোর সাথে কথা বন্ধ করে থাকতে পারছিলাম না। তোকে আমার কিছু কথা বলার ছিল। জানি, অনেকটা দেরী করেছি, তোকে অনেক অপেক্ষা করিয়েছি, কিন্তু জানিস তো আমি সব decision অনেক ভেবেচিন্তে নিই, বিশেষ করে নিজের জীবনের ব্যাপারে। সেদিন যখন তুই কোনোকিছু না জেনেই আমার জন্মদিনটা মনে করিয়ে দিলি, সেদিনই বুঝেছিলাম,......
সবটুকু আর শোনা হল না, তার আগেই রাত্রি ঘুমিয়ে পড়ল। আকাশ কি যে বলল, কখন যে ফোন কাটল, কিছুই জানে না। সকালে ঘুম ভাঙতেই গতকাল রাতের কথা মনে পড়তে সে আকাশকে ফোন করল। আকাশ যেন তার ফোনের অপেক্ষাতেই ছিল। ফোনটা রিং হবার আগেই ধরল।
-শোন না কাল না আমি ঘুমিয়ে গেছিলাম। তুই কিসব বলছিলিস, খুব দরকারি কিছু কি?
-সে তো হবেই, তা শুনবে কেন? আমার কথা তোমার শোনার দরকার কি?
-প্লিস রাগ করিস না। কাল না আসলে খুব tired ছিলাম।
-বললাম তো তোমাকে শুনতে হবে না। পারলে আরো ঘুমাও। আমার দরকার নিয়ে তোমায় মাথা ঘামাতে হবে না।
-তুই আমাকে আজ হঠাৎ তুমি বলছিস কেন?
-সেটা কাল রাতে বলেছি। আজ আর বলতে পারব না।
রাত্রি বুঝতে যে একেবারে পারছে না তা নয়, একটা সন্দেহ তো হয়েই ছিল, তবে বিশ্বাস করতে ভয় ও করছে। বুকের মধ্যে কে যেন হাজার দামামা পেটাচ্ছে। কিন্তু মনটা ভয়ে ধুকপুক করছে না, অচেনা, অজানা এক পুলকে ভরে ভরে উঠছে। অনেকক্ষন চুপ থাকার পর, আকাশ বলল,
-তাড়াতাড়ি ready হয়ে hiland park চলে এস , ঠিক 10 টার মধ্যে।
ফোন টা কেটে দিল টুক করে। রাত্রি বুঝল, সে তার জীবনের সবথেকে আনন্দময় মুহূর্তটাই miss করে গেছে, যার জন্য সে এতদিন অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করেছে। রাত্রি হতভম্ভের মত খানিক বসে রইল। আজ আর আকাশ কে না করার সাহস বা সুযোগ কোনোটার অবকাশই তো আকাশ তাকে দিল না।
আবারও একটা সুন্দর শীতের সকাল, মিঠে রোদে হিমেল হাওয়া রাত্রির গালদুটো স্পর্শ করে যাচ্ছে, যেন তার ঠোঁটের হাসিটাকে আবারও উদ্ভাসিত করে তুলছে । চারিদিকে সানাই-এর আওয়াজ, আকাশ আর রাত্রির বিয়ে। ফুলশয্যার ঘরে আকাশ আর রাত্রি মুখোমুখি। রাত্রি বলল,
-খুব তো ফাঁকিবাজির মত সেদিন আমার ঘুমের সুযোগ নিয়ে propose টা করেছিলে। কত অধীর আগ্রহে আমি অপেক্ষা করেছিলাম জান ওই কথাগুলো শোনার জন্য? আজ আর একবার propose কর না।
-কেন না শুনলে কি হয়েছে? এত কিছু হয়ে গেল।
-তাও শুনতে ইচ্ছা করে না বুঝি আমার?
আকাশ এসে রাত্রি কে আয়নার সামনে এনে দাঁড় করাল। তারপর পিছন থেকে জড়িয়ে ধরে বলল, 'এই হল আমার রাত্রি। যে আমাকে ভালোবেসেছিলো।' তারপর নিজের দিকে ঘুরিয়ে বলল, 'আর এই হল সে যাকে আমি আমার জীবনসঙ্গিনী হিসাবে বেছে নিয়েছি। তুমি কি পারবে আমাকে রাত্রির থেকেও বেশি ভালবাসতে? পারবে রাত্রির আকাশে একমুঠো রোদ্দুর ছড়িয়ে দিতে? '
রাত্রি সত্যিই আজ বাক্রুদ্ধ। তার কাজলকালো চোখদুটো জলে ভরে উঠল। আকাশ চোখ মুছিয়ে বলল ,
-কাঁদছ কেন পাগলী মেয়ে ? আজকের পর আর কান্না নয়। ফেলে আসা দিনগুলো ছিল আমাদের জীবনের কিছু কালো অধ্যায়। সেগুলো আর কোনোদিন মনে করতে চাই না।
-খুব ভয় করছে যদি আবার সব হারিয়ে ফেলি?
- কি হারানোর ভয় তোমার? এই তো আমি তোমার কাছেই আছি। আর দেখ তোমার স্বপ্নটাও হারিয়ে যায়নি। ভগবান তোমার থেকে স্বপ্নটা নিয়ে আমাকে দিয়েছেন, আর আমাকে তোমার হাতে তুলে দিয়েছেন। এস আজ থেকে আমরা দু'জনে মিলে নতুন করে স্বপ্নটাকে আবার সাজাই। '
ছলছল চোখে সে আকাশের বুকে মাথাটা গুঁজে দিল, আর আকাশও তাকে গাঢ় আলিঙ্গনে নিজের সাথে বেঁধে নিল।
Comments & Reviews (0)
No comments yet :(