Story

পেরিয়ার জঙ্গলে এক রাত | Kathamala - read, write and publish story, poem for free in hindi, english, bengali

পেরিয়ার জঙ্গলে এক রাত

2 years ago

0


# একটি ভ্রমনকাহিনী



এবারের শীতের শেষ আমেজটা আরেকটু উপভোগ করার জন্য কদিন ধরেই ফন্দি আঁটছিলাম। সাথে একটু অ্যাডভেঞ্চারের নেশাও চেপেছে। যেমন ভাবা, তেমনি কাজ। পাড়ি জমালাম দক্ষিণ ভারত - kerala। পাহাড়, সমুদ্র, জঙ্গল সবের একত্র সমাহার এই kerala। 

সোজা উড়ে গেলাম kochi, the queen of Arabian Sea। শুনেছিলাম,  kerala নাকি  God's own country।  এখন দেখলাম। মাথার উপর ঘন নীল আকাশ, পায়ের তলায় আরবসাগরের ঢেউ, গায়ে শেষ শীতের চাদর জড়ানো দিগন্ত বিস্তৃত চা-বাগান, রাস্তার ধারে সারি দিয়ে দাঁড়ানো ইউক্যালিপটাস গাছ, কোথাও শ্বেত ও রক্ত চন্দনের জঙ্গলের মন মাতাল করা সুবাস, কোথাও আবার রকমারি মশলার তীব্র ঝাঁঝালো গন্ধ। যেখানে চোখ বন্ধ করে এককথায় স্বীকার করা যায় কবির সেই উপমা- The Bliss of Solitude। তবে শুধু এই সৌন্দর্য দেখাই আমার উদ্দেশ্য ছিল না, চেয়েছিলাম একটু thrilling ব্যাপারও। তাই এবারের গন্তব্য- The Great Periyar Wildlife Sanctuary -Tiger Reserve Area । kochi থেকে প্রায় ২০৭ কিমি দূরে Cardamom পাহাড়ের উপর Thekkady তে ৯২৫ বর্গ কিমি এলাকা জুড়ে এই জঙ্গল বাঘ আর হাতি সংরক্ষণের জন্য বিখ্যাত। মাঝে ২৬ বর্গ কিমি এলাকা নিয়ে রয়েছে  Periyar Lake । তারই  core area -র মধ্যে 'ARANYA NIVAS' -এ এক রাত্রিযাপন। এটিই  core area-র একমাত্র lodge, এবং তা সরকারি। 


রাতেই  kochi airport পৌঁছে গেছিলাম। cab বুক করাই ছিল। তবে জঙ্গলের রাস্তা, তাই সকাল পর্যন্ত অপেক্ষা করতেই হল।  Airport- এর কাছেই একটি হোটেলে রাতটুকু কাটিয়ে সকাল সকাল রওনা হলাম। চিরহরিৎ পথের শোভা তো আগেই মন কেড়ে নিয়েছিল। এরপর উপরিপাওনা হিসাবে দেখা মিলল, 

  • Ernakulam Shiva Temple, 
  • Indo Portuguese Museum- বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন church থেকে আনা artefacts এর একটি সংগ্রহশালা ।
  • Mundakayam- rubber গাছের বন, তার পাশ দিয়ে কলকল করে বয়ে চলেছে Manimala নদী  ।
  • Valanjanganam জলপ্রপাত, 
  • Peerumeedu- রকমারি মশলার বাগান,  coffee, white pepper, cocoa, black pepper,ginger, turmeric, elaichi,যেগুলো খেয়েতোছি, কিন্তু এবার গাছে ফুটে থাকতে দেখলাম।  এখানে একটি tree-house -ও দেখলাম। 
  • Vandiperiyar- black pepper আর চা এর ফ্যাক্টরি। কিছু ভাল চা, কফি কালেক্টও করে নিলাম।  



ইতিমধ্যে সূর্য মধ্যগগন পার করে দিয়েছে। আর দেরি করা উচিৎ নয় কারন বিকেল ৫ এর পর জঙ্গলে আর ঢুকতে দেবে না। তাড়াতাড়ি জঙ্গলের পথে রওনা দিলাম।  ঢোকার মুখেই দেখলাম খানকয় হাতিমহারাজ বসে আছেন জঙ্গল সাফারির জন্য। জঙ্গলের অভিজ্ঞতা আমার এই প্রথম। তাই আলাদাই thrilling ব্যাপার। চারিদিকে security guard বন্দুক নিয়ে ঘুরে বেরাচ্ছে , ভীত সন্ত্রস্ত্র পরিবেশ। কিচকিচ আওয়াজে উপরে তাকিয়ে দেখি কত  বাঁদর , কতগুলো তো আমাদের দেশী, কিন্ত তার মধ্যে আবার কালো কালো খুব লম্বা ল্যাজওলা 

অনেক রয়েছে, নাম জানলাম Nilgiri langurs। গাড়ি থেকে নেমে খানিক হাঁটতে হাঁটতে এগোলাম এই জঙ্গলের একাকীত্বকে আর একটু কাছ থেকে উপলব্ধি করার জন্য। সবাই সাবধান করল জিনিসপত্র সাবধানে রাখার, কারন বাঁদরদের চোরের বদনাম কারো অজানা নয়। পড়ন্ত বিকালে জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে হাঁটাটা বেশ উপভোগই করছিলাম। রাস্তার দু'ধারে গভীর পরিখা কাটা, কাঁটাঝোপের বেড়া। সেই বেড়ার বাইরেও দেখি ছোটো ছোটো ঘুমটি ঘরে কিছু লোক বাস করে। সত্যি মানুষকে জীবনযাপনের জন্য কত বিপদের ঝুঁকিই না নিতে হয়। এখানেও দেখা মিলল কিছু শ্বেত ও রক্ত চন্দন গাছ, আম, জাম, কাঁঠাল, তেঁতুল গাছ আর বেশিরভাগই নাম-না-জানা গাছের সারি। হাঁটতে হাঁটতে কখন যে lodge-এর কাছাকাছি চলে এসেছি খেয়ালই নেই। দেখি সামনেই periyar lake- ওধারে গভীর জঙ্গলের সারি, শেষ  boat টি সাফারির জন্য তৈরি হচ্ছে, ঘড়িতে দেখলাম ৩.৩০ বাজে। আজ আর নয়, এসময় হয়ত বেঙ্গল টাইগারটি ভাতঘুম দিচ্ছে- এখন তার দেখা মেলা ভার, তার উপর সারাদিনের পরিশ্রমে ক্লান্ত। শুনেছি এখানে নাকি প্রায় ৪০টির কাছাকাছি  বেঙ্গল টাইগার আছে, তাই কাল ভোরের প্রাতরাশের সময়ই অন্তত একটি বেঙ্গল টাইগারকে ক্যামেরায় capture করার প্ল্যান করলাম। আসলে সবে একটু একটু গরম পড়তে শুরু করেছে, তাই এই সময় টায় জঙ্গলের পশুরা জল খেতে আসে আর তাদের দেখার সৌভাগ্য হলেও হতে পারে, তবে সবই luck ।


lodge-এর ব্যবস্থা সত্যিই আশাতীত, বড় বড় ঘর, সাথে লাগোয়া কাঁচঘেরা বারান্দা, সেখানেও বসার সুবন্দোবস্ত- রাতে শুয়ে শুয়েই যাতে প্রকৃতির শোভা পূর্ণ উপভোগ করা যায়। ঘরে গিয়ে একটু ফ্রেশ হতেই দেখি সন্ধ্যে গড়িয়ে গেছে। বারান্দায় এসে একটা জুতসই জায়গা বেছে বসে গেলাম, চোখ কাঁচের বাইরে সাঁটা। জানালার ঠিক নীচেই একটা বিরাট বাঁধানো গাছ, দূরে আলো জ্বলছে,  একটি security guard কেও দেখলাম। বসে আছি, চারদিক নিস্তব্দ। হঠাৎ দেখি একটি হাত ছয়েক লম্বা বড় ইঁদুরের মত কোনো জানোয়ার গাছের নীচটাতেই যেন ঘুরে বেড়াচ্ছে, এত বড় ইঁদুর আবার হয় নাকি?একটু আলোর সামনে সরে আসতেই দেখি ও মা, এত ইঁদুর নয়, গায়ে বিরাট বিরাট খাঁড়া কাঁটা------ চেঁচিয়ে উঠলাম, সজারু। হঠাৎ উত্তেজিত হয়ে নীচে দৌড়ালাম। দেখি security guard টিও এগিয়ে এসেছে, তাকে খেতে দিচ্ছে। জানলাম, এটিই এই জঙ্গলের একমাত্র সজারু, রোজ খাবারের লোভে আসে। এত সামনে থেকে এত বড় সজারু দেখে খুব ভাল লাগল, অনেক ছবিও তুললাম। অন্ধকারে দাঁড়িয়ে আছি , দেখি দুটি সম্বর হরিণ গুটি গুটি পায়ে এসে ঘাস খাচ্ছে। তাদেরও ছবি তুললাম। গাছের উপর আলো ফেলে একটা পেঁচার মত পাখি দেখলাম, guard টি বললেন, ওটি একটি Sri Lankan frogmouth। ঘুরছি,  খানিকক্ষণ ধরেই নাকে একটা খুব খারাপ গন্ধ পাচ্ছিলাম, সেটা ক্রমশ বাড়ছে, কিছু পর আবিষ্কার করলাম, দূরে কিছু বন্য শুয়োর গোঁতাগুঁতি করছে। গন্ধের জন্য তাদের কাছে গিয়ে আর ছবি তুলতে ইচ্ছা হল না। রাত বাড়তে লাগল। খেয়েদেয়ে ঘরে চলে এলাম। আজ আর চোখে ঘুম নেই। বারান্দায় জানলায় চোখ রেখে টান টান উত্তেজনা নিয়ে বসে গেলাম। 


কি জানি কি দেখছি। কি দেখতে চাইছি? কারই বা অপেক্ষায় আছি? সেই বনের রাজা বেঙ্গল টাইগার এর? সত্যিই আবার সে আসে নাকি? আর আসলেও কি আমি খুব খুশি হব? তবু মন চাইছে সে আসুক, আগুনঝরা চোখে একবার তাকাক, এই জানলার কাঁচে থাবা বসাক, নখের আঁচড় দিক। একটা জোরে হুঙ্কার দিক। তার অপেক্ষাতেই বুঝি এই রাত্রিযাপন। আকাশে আজ পূর্ণিমার গোল থালার মত চাঁদ, চারিদিক জোছোনায় ভরে গেছে, তবু সেই গভীর জঙ্গলের একটা পাতাও নজরে পড়ছে না। নিঃঝুম, নিঃস্তব্ধ।  দীর্ঘ এক অপেক্ষা। ঘড়ির কাঁটা আর এগোচ্ছে না। এই আঁধারের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে একটা সময় এই রাত্রির প্রেমেই পড়ে গেলাম। বুঝলাম, সৌন্দর্য কেবল দিনেরই থাকে না, রাতেরও থাকে। রাতের যে কি ভয়ঙ্কর সৌন্দর্য আছে, তা না দেখলে বোঝা যায় না। মনে হয় ডুবে যাই, মরি মরি কি অপরূপ তার রূপ। এই জঙ্গল যেন চাঁদের জোছোনা মেখে রাতমোহনায় পর্যবসিত হয়েছে। তারই কোন গহনে মা বাঘ তার সন্তানদের পরম আদরে 

গা চেটে দিচ্ছে, আর গাছেরা অতীন্দ্র প্রহরীর মত জেগে পাহারা দিচ্ছে। কান পাতলে বাতাসে তাদের ফিসফিস কথা বলার আওয়াজ পাওয়া যায়। মাঝে মাঝে নাম-না-জানা পাখিরা শিষ দিয়ে উঠছে। এতই নিঃঝুম যে নিজের বুকের আওয়াজও বুঝি শুনতে পাচ্ছি। সেই দিকে মুগ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকতে থাকতে কখন যে ঘুমিয়ে পড়েছি জানি না। ঘুমের মধ্যেই দেখলাম, চাঁদের আলোয় দুটি বাঘ শিশু আপন মনে তার মায়ের ল্যাজ নিয়ে খেলা করছে, মা বাঘ শুয়ে তাদের খেলা দেখছে। কিছু দূরে টিলার উপর বাঘরাজা বসে তাদের পাহাড়া দিচ্ছে। হঠাৎ চোখের উপর ভোরের আলো এসে সুন্দর স্বপ্নটা ভেঙে খানখান করে দিল। 


দেখি ৬.৩০ বেজে গেছে। তাড়াতাড়ি রেডি হয়ে নিলাম, ৭.৩০ টায় আমাদের সাফারি। যথারীতি ঘাটে এসে হাজির হলাম। হাতে কিছুটা সময় এখনও বাকি। দেখি Binocular rent এ দিচ্ছে, ৫০ টাকা দিয়ে একটি কব্জা করলাম। ঘাটে দাঁড়িয়েই দূরে জঙ্গলের দিকে তাকালাম। তিনটি ছাগলকে দেখলাম জল খাচ্ছে। Binocular-এ চোখ লাগিয়ে বুঝলাম, খালি চোখে যেগুলোকে ছাগল ভেবেছিলাম, সেগুলো অনেকটা ছাগলের মত দেখতে হলেও মাথায় বড় বড় শিং।  guide কে জিজ্ঞাসা করে জানলাম ওগুলো নাকি Nilgiri tahra। হঠাৎ কোত্থেকে দুটি কুকুরছানা ছুটতে ছুটতে এসে খেলা করতে শুরু করে দিল। ভটভট করে boat এসে হাজির হল, সাথে সাথে দেখলাম, কুকুর ছানা গুলো দৌড়ে জঙ্গলে ঢুকে গেল। হঠাৎ একটা খারাপ লাগা মনটাকে ঘিরে ধরল। ফলাও করে বলছি এটা একটা  অভয়ারণ্য, কিন্তু পশুরা কি সত্যি অভয়ে থাকতে পারছে, সারাদিনে অন্তত ৫ বার এই ভটভট করে boat সাফারি, তার মধ্যে মানুষের কোলাহল। আমাদের এই  thrills-এর নেশা হয়ত ওদের শান্তিটুকু কেড়ে নিয়েছে, তাই সহজে তারা মানুষের কাছে ধরা দেয় না, বনের গভীরেই লুকিয়ে থাকে। কখনও সখনও পথের মাঝে পড়ে যায়, এই আরকি। দেখা যাক, আমাদের ভাগ্যে কি লেখা আছে। 


আমাদের সাফারি শুরু হল। Binocular এ চোখ লাগিয়ে বসে রইলাম। Lake-এর মধ্যেই দাঁড়িয়ে আছে কয়েকশ মরা গাছ , তার উপরে বাসা করেছে Malabar grey hornbill পাখিরা। এই পাখির আধিক্যই এখানে বেশি। প্রায় প্রত্যেক গাছেই এইরকম পাখি বসে আছে, প্রায় ৫০-৫৫ সেমি. লম্বা তো হবেই, বিরাট তাদের ঠোঁট, আর কি তীক্ষ ডাক। মাঝে দু-একটা blue-winged parakeet, Nilgiri wood pigeon উড়ে গেল, অনেকটা আমাদের টিয়া আর পায়রারই সমগোত্রীয়। জঙ্গলের দিকেই তাকিয়ে ছিলাম, ভিতরে কিছুই দেখা গেল না। এত গভীর যে এই দিনেরবেলাতেও একফোঁটা সূর্যের আলো জঙ্গলের মাটি স্পর্শ করে না। হঠাৎ boat টি দাঁড়িয়ে গেল। দেখি খানিক দূরে একপাল হাতির দল এসে জলকেলি করছে। তার মধ্যে আবার একটি বাচ্চা হাতিও আছে। কি সুন্দরভাবে তার ছোট্ট শুঁড় দিয়ে জল ছুঁড়ছে। তারা একে একে সার দিয়ে চলেছে, তারপর বাচ্চাটি তার মায়ের লেজ ধরে গুটি গুটি পায়ে, আর সব শেষে বাবা হাতিটি। একটু পরই তারা জঙ্গলের মধ্যে ঢুকে গেল।  boat আবার চালু হল। দূরে পাথরের উপর একটা বাচ্চা কুমীর শুয়ে থাকতেও দেখলাম। ১.৩০ ঘন্টা যে কোথা দিয়ে কেটে গেল বুঝতেই পারলাম না।


ফেরার পথে সে আর এক বিপত্তি। জুতো খুলতে গিয়ে দেখি, কখন এই বড় জোঁক পায়ের মধ্যে যেঁকে বসেছে। ভাগ্যিস সাথে নুন ছিল, তাই সাথে সাথে জোঁকটিকে ছাড়ানো গেল। আমার দেখাদেখি অনেকেই তাদের জুতো check করে জোঁক বার করলেন। এরা ওখানকার ভিজে মাটিতে লুকিয়ে, গাছের পাতার উপর থেকে টুপ করে পড়ে কখন যে আক্রমণ করে টের পাওয়াই যায় না। 


জঙ্গল সাফারি শেষ, এবার ওখান থেকে ফেরার পালা। তবে একটিও বেঙ্গল টাইগার দেখার সৌভাগ্য আমার হল না। মনটা একটু খারাপ হল। কিন্তু, কথায় আছে না, তুমি যদি ১০০ বার জঙ্গলে যাও আর ১ বার তাঁকে দেখ, বাকি ৯৯ বার সে কিন্তু তোমাকেই দেখেছে। তার উপর ভরসা করেই দূর থেকে রাজামশাইকে বিদায় জানালাম।  










Comments

To comment on content, please Login!

Comments & Reviews (0)

No comments yet :(