শিবাইচন্ডী গ্রাম। রামবাবু আর যদুবাবু দুই অভিন্নহৃদয় বন্ধু। একদম মুখোমুখি বাড়ি, রাস্তার এপাড় আর ওপাড়। রামবাবুর মেয়ে পিহু আর যদুবাবুর ছেলে রাজ একে অপরের সমবয়সী, তারা যেমন একই ক্লাসের বন্ধু তেমন দুজনের নিজেদের ভাইবোন না থাকায় ভাইফোঁটার রীতিও চালু ছিল যথারীতি। দুই বাড়ির মধ্যে এত মিল, ভাব, ভালোবাসা সত্যিই লক্ষ্য করার মত ছিল। তখন তারা কত ছোট, একজনরা বাড়ি না থাকলে আর একজনদের উপর অনায়াসে বাড়ির সব দায়িত্ব দিয়ে যেত। মিলেমিশে খুব ভালোই চলছিল।
সেবছর কাঠফাটা গরমে গোটা শিবাইচন্ডী গ্রামের ফুটিফাটা অবস্থা, চাষের জমি শুকিয়ে গেছে, ফসলও ভালো ফলে নি এবার। সব বাড়িতেই হাহাকার, কারো পেটের ভাত জুটছে না, কারো চাকরি জুটছে না, কারো ব্যবসা মন্দা যাচ্ছে। এমন সময় গ্রামের শেষপ্রান্তে অশ্বত্থগাছের তলায় আবির্ভূত হলেন এক তান্ত্রিক বাবা, নাম কঁচুকীরাজ। তিনি নাকি সুদূর গুয়াহাটি থেকে এসেছেন। অসাধ্য সাধন করতে তিনি সিদ্ধহস্ত, মানুষের মনের কথা পড়া থেকে, তাকে বশ করাতেও তিনি পারদর্শি । তিনি আসার পর তো তাঁকে দেখতে রীতিমত রোজ সন্ধ্যেবেলা ভীড় জমে যেত অশ্বত্থগাছের তলায়। ধূপ ধূনোর সমাহারে অশ্বত্থগাছকেই মন্দির বলে ঠাওর হত। কত লোকের আনাগোনা শুরু হল, কেউ আসে দীর্ঘদিনের রোগ সারানোর জন্য, কেউ বা চাকরির জন্য, সংসারের সুখ- সমৃদ্ধির জন্য, কেউ সন্তানলাভের জন্য। তান্ত্রিকবাবার ভবিষ্যৎবাণী অক্ষরে অক্ষরে ফলতে লাগল, কারো চাকরি হল, কারো ব্যবসায় উন্নতি হল, কারো দীর্ঘদিনের চলা মামলার নিষ্পত্তি হল। সবাই কঁচুকীরাজ-এর নামে জয়জয়কার করতে লাগলেন।
যদুবাবুর স্ত্রী তার পছন্দের আংটিটি কোথায় হারিয়ে ফেললেন, খুব মন খারাপ। গেলেন কঁচুকীরাজের কাছে। তিনি একটি পিতলের বাটিতে একটু জল আর একটি ফুল দিয়ে মনে মনে কি যেন মন্ত্র পড়ে দিয়ে বললেন, "যা বাটিটা ঘরে রাখ, এই তোর আংটি খুঁজে দেবে।" বাড়ি গিয়ে মেঝেতে বাটিটি রাখার সাথে সাথেই সেটি আপনা থেকেই চলতে শুরু করল, আর থামল ঘরের কোনায় আলমারির কাছে। কি আশ্চর্য, সেই আলমারির তলা থেকেই উদ্ধার হল আংটিটি।
যদুবাবু এসব একদম পছন্দ করতেন না, সবই তাঁর কাছে ছিল ভাঁওতাবাজি। তবে গুরুদেবের গুণ ছিল বলতে হবে, যদুবাবুর স্ত্রীকে এমন বশ করলেন যে তিনি নিজে গুরুদেবকে নিমন্ত্রন করে নিজের বাড়িতে কিছুদিন থাকার জন্য ডেকে নিয়ে আসলেন, নিজের নানা সমস্যার ব্যাপারে পরামর্শও চাইলেন। যদুবাবুও স্ত্রীর মুখের উপর কথা বলতে পারেননি। রোজ সন্ধ্যে হলেই রাজেদের বাড়িতেই আসর বসত।
এমন সময় একদিন এই কঁচুকীরাজের দ্বারস্থ হলেন পিহু আর রাজের ইংলিশ টিচার সুবিনয়বাবু। তাঁর বড়ছেলে মাঝে মাঝেই ফেরার হয়ে যায়, সংসারের দিকে মন নেই, বাবা মা কে গ্রাহ্য পর্যন্ত করে না। তাকে ঘরে ফেরাতেই ওনার আসা। কঁচুকীরাজ সব শুনে বললেন,
-এ তো যে সে ব্যাপার নয়। তোদের বাড়ির পিছনে একটি বেল গাছ আছে না?
-হ্যাঁ, তা তো অনেকদিন ধরেই আছে, কিন্তু আপনি জানলেন কি করে?
-কোনোকিছুই আমার অজানা নয় রে। সেই বেলগাছে এক ব্রহ্মদত্যি বাসা বেঁধেছে, তাঁর অশুভ শক্তির প্রভাব তোর ছেলের উপর পড়েছে। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব এটা কাটাতে হবে, এক বিরাট যজ্ঞের আয়োজন করতে হবে।
সুবিনয়বাবুর হয়ত গুরুদেবের কথা ঠিক বিশ্বাসযোগ্য মনে হয়নি, তাই কোন ইতিবাচক কোন কথা না বলেই সেদিন ওখান থেকে বিদায় নিয়েছিলেন। এরপর এমন এক কান্ড ঘটল যা সুবিনয়বাবুর বিশ্বাসের ভিতকে নাড়িয়ে দিল।
সেদিনটা পিহু বা রাজ কোনদিন ভুলবে না। সন্ধ্যে ৮টা বাজবে, সুবিনয়বাবুর বাড়ি টিউশন পড়তে গেছে পিহু, রাজ দুজনেই। পড়া শেষ, বাড়ি আসার তোড়জোড় চলছে। এমন সময় নীচের গেট খোলার আওয়াজ হল, সাথে সাথে কলিং বেলের শব্দ। সবাই শুনেছে। সুবিনয়বাবু রাজকে বললেন,"দেখ তো কে এসেছে?" রাজ গেল, আর একটু পরেই তার আর্তচিৎকার শোনা গেল, সাথে সাথে ধুপ করে কিছু পড়ার শব্দ। সবাই পড়িমরি করে ছুটে গিয়ে দেখে রাজ অজ্ঞান হয়ে মেঝেতে পড়ে, দরজা হাট করে খোলা, নীচের গেটও। কিন্তু কেউ কোত্থাও নেই। রাজের জ্ঞান ফিরতেই, সে যা বলল, তাতে সবাই ভয়ে দিশেহারা হয়ে গেল। কি এক কিম্ভূতকিমাকার ভাল্লুকের ন্যায় কোন জীব নাকি এসেছিল, তাঁকে দেখেই রাজ ভয়ে অজ্ঞান হয়ে যায়। কিন্তু আর কেউ তো কিছু দেখতে পেল না। সাথে সাথে রাজের বাড়ি ফোন করা হল, কিছু বলার আগেই গুরুদেব ফোন ধরে বললেন,"কি রে ভয় পেলি নাকি? সে এসেছিল তো। ভয় পাওয়ার কিছু নেই, আমি যা করার এখান থেকেই করে দিচ্ছি, তোরা শুধু একটু ধূপধূনো দে। তবে মনে রাখিস যজ্ঞ না করলে এর হাত থেকে রেহাই নেই কারো। " ফোন রেখে সুবিনয়বাবু হতভম্ভ হয়ে বসে রইলেন, তাইত, তিনি তো কিছু বলেননি, অবে অতদূরে ঘরে বসেই তিনি এত কিছু কিভাবে জানলেন? সেদিন রাতেই তিনি আবার এলেন কঁচুকীরাজের কাছে, পায়ে ধয়ে ক্ষমা চাইলেন আগে তাঁকে অবিশ্বাস করার জন্য আর আয়োজন করতে বললেন মহাযজ্ঞের।
এমন সময় একদিন রাজের ছোটোমাসি এলো তাদের বাড়িতে, খুব রুগ্ন, তাঁর নাকি কি এক মারণরোগ হয়েছে। কঁচুকীরাজের কাছে দয়া ভীক্ষা করলেন। কঁচুকীরাজ বললেন, "সম্ভব, তবে তোকে খুব ভালোবাসে এমন একজন, কিন্তু রক্তের সম্পর্কের নয়, তাঁর কাপড় না জানিয়ে নিতে হবে মানে চুরি করতে হবে। সেই কাপড় তোকে মন্ত্রপূত লেবু আর সিঁদুর মাখিয়ে চৌমাথার মোড়ে রেখে দিয়ে আসতে হবে"। রাজের মাসি দোনামনা করছে দেখে হেসে বললেন,"ভয় পাস না, যার শাড়ি নিবি, তাঁর কোন ক্ষতি হবে না, সে রাজরানী হবে।" একথা শুনে রাজের মাসি রাজি তো হলেন। কিন্তু রক্তের সম্পর্কের নয়, এমন কে তাঁকে ভালোবাসে একথা ভাবতেই তার পিহুর মায়ের কথা মনে হল। তাঁর কাপড় চুরি করা কোনো ব্যাপারই না। চুরি তো হল। কিন্তু এত ভালো সম্পর্ক, তায় প্রতিবেশী, তাই সব জেনে আর চুপ করে থাকতে পারল না রাজের মা। বিবেক দংশনে পিহুর মায়ের কাছে কথাটা বলে ফেলে। ব্যাস, কঁচুকীরাজের টোটকা আর কাজ করে না। কঁচুকীরাজ রেগে গেলেন, আর বিধান দিলেন, রাজের মাসিকে প্রায়শ্চিত্ত করতে হবে।
সবার ক্ষেত্রে বিধান আলাদা হলেও একটা ব্যাপার কমন ছিল। বড় বড় কাজ যেমন সন্তানলাভ, প্রায়শ্চিত্ত করা, মারণরোগ সারানো,যজ্ঞ- এইসব কাজগুলি তিনি এখানে করেন না। সবাইকে গুয়াহাটিতে তাঁর নিজের আশ্রমে যেতে হবে, সেখানে মহাশক্তির কাছে পূজা দিলে তবেই হাতেনাতে ফল পাওয়া যাবে। সেই কথামত, সুবিনয়বাবু, তাঁর ছেলে, রাজের মাসি, মেসো, আরো যারা দৃঢ়প্রতিজ্ঞ সমস্যার সমাধানের জন্য এমন জনাদশেক কঁচুকীরাজের সাথে তাঁর আশ্রমে যেতে রাজি হলেন। পিহু আর রাজ সায়েন্স-এর স্টুডেন্ট, বড় হয়েছে, তারা এত সহজে সব মেনে নিতে নারাজ । তারাও জেদ ধরল তাদের সাথেই যাবে, নতুন জায়গা ঘোরাও হবে। পিহুর মা আপত্তি তুলেছিলেন, শুধু পিহুর জেদের কাছে হেরে গিয়ে রাজের ভরসায় যেতে দিতে রাজি হলেন।
তারা গুয়াহাটি তো পৌঁছলেন। গুরুদেবের চ্যালারা বোধহয় আশেপাশেই গাড়ি নিয়ে অপেক্ষা করছিল। কঁচুকীরাজের জন্য আলাদা গাড়ি আর বাকিদের জন্য অন্য গাড়ির ব্যবস্থা আছে। গাড়ি চলতে শুরু করল। কোথায় নিয়ে যাচ্ছে কেউ জানে না। রাস্তার ধার দিয়ে ব্রহ্মপুত্র নদ কুলকুল করে বয়ে চলেছে, তারই পাড়ে একটা ছোট্টো গ্রামের মধ্যে গাড়িটি প্রবেশ করল, ঢোকার মুখে সাইনবোর্ডে নাম লেখা "Mayong"। একটু দূরে গিয়ে জঙ্গল শুরু হল, তাদের গাড়ি থেকে নামিয়ে দেওয়া হল, প্রথমেই সবার মোবাইল নিয়ে নেওয়া হল, ওখানে নাকি এসব নিয়ে ঢোকা যাবে না, কঁচুকীরাজের আদেশ। তারপর সবাই চ্যালাটির পিছন পিছন চলেছে। জঙ্গলের এ কি রূপ, রূক্ষ, সব গাছপালা মরে কাঠ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে, কোনো পাখির আওয়াজ নেই, সবাই যেন মৃত্যু উপত্যকায় দাঁড়িয়ে মৃত্যুর প্রহর গুনছে। এমন সময় কোত্থেকে এক পাগল ছুটে এসে পিহুর হাত ধরল। পিহু তো ভয়ে চিৎকার করে উঠল। একটি চ্যালা পাগলটিকে সরাতে গেল, তখন পাগলটি চিৎকার করে বলল, "কেন এখানে এসেছিস তোরা, পালা, পালা, মরবি সব মরবি"। তারপর চ্যালারা তাদের নিয়ে গিয়ে একটি অন্ধকার ঘরে বন্দী করে ফেলল, সেটিকে কালকুঠুরী বললেও ভুল কিছু বলা হবে না। তারা অবাক হয়ে চারদিকে তাকিয়ে দেখল, আরো অনেক লোক সেখানে আগে থেকেই উপস্থিত। তাদের জিজ্ঞাসা করে জানতে পারে, তারাও তাদের সমস্যার সমাধানের আশায় এখানে এসেছে। কেউ এক সপ্তাহ, কেউ বা এক মাস ধরে এখানে বন্দী।
সবাই অন্ধকারের মধ্যে অপেক্ষা করতে লাগল। খানিক পরে ঘরের দরজা খুলে যিনি ঢুকলেন, এখন তাঁকে চেনা ভার। চেনা হাসিমুখের খোলস ছেড়ে তিনি রক্তবস্ত্র পরিহিত, কপালে সিঁদুরের টিকা। যেন স্বয়ং যমরাজের দূত। গুরুগম্ভীর গলায় যেন হুঙ্কার দিয়ে বললেন, "কাল অমাবস্যা, কালই পূজা। তোরা তৈরি হ।" তারপর রাজ আর পিহুর দিকে তাকিয়ে বললেন, "খুব টিকটিকিগিরি ফলানো না? এত অল্প বয়সে তোদের এত কৌতুহল কিসের?এর ফল কিন্তু তোদের ভুগতে হবে"। তারপর চ্যালাদের আদেশ করলেন, "নিয়ে আয় এদের সবকটাকে"। সবাই যেন মোহের বশে এগিয়ে চলেছে। চ্যালারা তাদের লাইন করে নিয়ে যেতে ব্যস্ত, কে আগে যাবে, মানে কার সমস্যার আগে সমাধান হবে, তাই নিয়ে গোল চলছে। একে একে তাদের সবাইকে নিয়ে গেল আর এক অন্ধকূপে। কি নিকষ কালো অন্ধকার জমাট বেঁধে আছে সেখানে। তার থেকেও ভয়ঙ্কর সেখানের পরিবেশ। হোমের আগুন জ্বলছে, চারদিকে নরকঙ্কাল আর মাথার খুলি ছড়িয়ে আছে। তার সামনেই একটি শবের উপর কঁচুকীরাজ ধ্যানে বসেছেন। পাশে রাখা একটি বলিকাঠ। একটি চ্যালা খাঁড়ায় শান দিচ্ছে।
পিহু আর রাজ কিছুই তো বুঝতে পারল না, শুধু এটুকু বুঝল, খুব খারাপ কিছু ঘটতে চলেছে, এখন ভয় পাওয়ার সময় নয়। তাদের এখান থেকে পালাতেই হবে, বাঁচতেই হবে। চ্যালারা বাকিদের গোল থামাতে ব্যস্ত, এই সুযোগ। পিহু আর রাজ একে অপরের দিকে তাকাল, চোখে চোখে কথা হল, আর দিল ছুট। চ্যালারা লক্ষ্য করে চেঁচাল,"ধর ধর, পালাচ্ছে।" পিহু আর রাজ প্রাণপণে ছুটছে, আর দুটি লোক তলোয়ার হাতে তাদের পিছন পিছন। তারা তখনও জানে না কোথায় যাচ্ছে, কুঠি থেকে বেরিয়ে শুধু জঙ্গল, কোথাও কোন রাস্তা নেই, প্রাণপণে শুধু দৌড়াচ্ছে।
হঠাৎ জঙ্গলে উঠল এক বিশাল ঝড়, চারদিক ধূলোয় ভরে গেল, কিচ্ছু দেখা যাচ্ছে না। দুজনে ছিটকে একটু দূরে গিয়ে পড়ল। ঝড় যেমন আচমকা এসেছিল, তেমন আচমকাই চলে গেল। শুধু আশপাশটা বদলে গেছে, ফুলে ফুলে ভরে আছে গাছপালা, প্রজাপতি উড়ছে, পাখি ডাকছে। পিহু আর রাজ অবাক হয়ে দেখছে, পিছন থেকে কারো গলার স্বর শুনে চমকে তাকালো। এক সৌম্যদর্শন সাধুবাবা- বললেন,
"তোরা আমার তৈরি জাদু-নগরীতে আছিস, বাইরের লোকের কাছে এ নগরী অদৃশ্য। ভয় পাস না, আমিই তোদের এখানে নিয়ে এসেছি ওই কঁচুকীরাজের হাত থেকে তোদের বাঁচাতে। কিন্তুএবার বল তো তোরা এখানে এলি কেন?"
এতক্ষণে যেন তারা একটু স্বস্তি পেল। তাঁকে দেখেই যেন মনে ভক্তি ভাব এলো। পিহু আর রাজ তাঁকে প্রথম থেকে শুরু করে এখানে এসে কি কি হয়েছে সব কথা খুলে বলল। পিহু জিজ্ঞাসা করল,
"আচ্ছা বাবা,গ্রামে আমরা চোখের সামনে অলৌকিক যা যা দেখেছি সবই কি ভুল? "
তিনি হেসে বললেন,"ও সব ভাঁওতাবাজি। সবই এদের পোষা ভূতের কারুকাজ। "
-পোষা ভূত? তবে কঁচুকীরাজ কে? আর এত মানুষকে এখানে নিয়ে এসেছে কেন?
- এ হল মায়ানগরী। কালোজাদুর শয়নকক্ষ। সেই মহাভারতের যুগ থেকে চলে আসছে। চারদিকে মৃত্যুর হিমশীতলতা বয়ে চলেছে। কত তান্ত্রিক, শয়তান যে এ জঙ্গলে ঘাপটি মেরে রয়েছে, তার ইয়ত্তা নেই। রাতের অন্ধকারে এ জঙ্গলের বাতাস এদের পৈশাচিক মন্ত্রোচ্চারনে বিষাক্ত হয়ে ওঠে। জেগে ওঠে পিশাচ, ওদের পোষা গোলাম হয়ে ওদের হয়ে কার্যসিদ্ধি করে। এখানে সবকিছুই সম্ভব । মানুষ জন্তুতে পরিণত হতে পারে, নিমেষে উধাও হয়েও যেতে পারে, আবার হিংস্র জন্তুও ল্যাজ নাড়তে নাড়তে এদের পোষ মানতে পারে। এরা শয়তানের পূজারি, নরবলি দিতে এদের হাত কাঁপে না। খুব সাবধান।
-কিন্তু আপনি এখানে এই জঙ্গলে এলেন কি করে?
-আমিও একজন তন্ত্রসাধক। লোকে আমায় ধূর্জটি-মহারাজ বলেই চেনে। নিজের গুরুর কাছে শুনেছিলাম এই মায়াঙ্ক সভ্যতার কথা। নিজের সাধনাকে আরো উচ্চমার্গে নিয়ে যাওয়ার জন্য আমার এখানে আসা। এসে একজন গুরুর তো দরকার, অবস্থাক্রমে এই কঁচুকীরাজের শরণাপন্ন হলাম। যেমন তাঁর নাম, তেমন তাঁর ক্রিয়াকলাপ। অনেক কিছুই শিখেছিলাম তাঁর কাছে যেমন কালভৈরব তন্ত্র, কুমারী তন্ত্র, কুণ্ডলিনী তন্ত্র, বিশুধি তন্ত্র, শৈব তন্ত্র, শাক্ত তন্ত্র, সূর্য তন্ত্র, কামধেনু তন্ত্র, নির্বান তন্ত্র, কামখা তন্ত্র, তারা তন্ত্র, কুল তন্ত্র, অভয় তন্ত্র, যোগিনী তন্ত্র ইত্যাদি। তন্ত্র মানেই কখনো বিশাল ভয়ংকর মন্ত্র পাঠ বা পৈশাচিক ক্রিয়াকলাপ নয়, তন্ত্র প্রধানত নিজের শরীর ও মনের উপর চরম নিয়ন্ত্রণ এবং অনুশাসন স্থাপন পদ্ধতি, যার উপর ভিত্তি করে সম্পুর্ন প্রক্রিয়া। তন্ত্র ক্ষমতা ব্যবহারের দ্বারা যোগী ও সিদ্ধ পুরুষেরা দেবতার মূর্তির মধ্যে প্রাণ প্রতিষ্ঠা থেকে শুরু করে শক্তির আবদ্ধিকরণ করেন বিভিন্ন ক্ষমতার সিদ্ধি লাভের জন্য। আর কঁচুকীরাজের মত তান্ত্রিকরা শয়তানের মূর্তির মধ্যে প্রাণ প্রতিষ্ঠা করে ডাকিনী, জিন, পিশাচকে আহ্বান করে। তন্ত্রের নামে মানুষের ভয় কে কাজে লাগিয়ে ও অসহায়তার সুযোগ নিয়ে প্রতি দিন মানুষ কে বিভিন্ন আশা দেখিয়ে নানা ভাবে ঠকিয়ে চলেছে শুধু মাত্র অর্থের লোভে।
-তবে আপনি কঁচুকীরাজের আসল স্বরূপ কি আগে জানতে পারেননি? আর এখন যখন পেরেছেন তখন এখনো পড়ে আছেন কেন?
-হয়ত আজকের দিনটার জন্যই। কি জানিস বড় হতে গেলে অনেক সময় কঁচুকীরাজের মত খারাপ সঙ্গের সাথেও থাকতে হয়। মানুষ ঠিক কতটা হতে খারাপ হতে পারে, কতটা ঘৃন্য কাজ করতে পারে তার আঁচ না পেলে তাঁকে প্রতিহত করাটা যে সম্ভব নয়। নিজের চোখের সামনে কত মানুষের বলি দেখেছি, কত নিরীহ মানুষের সর্বনাশ হতে দেখেছি। সেদিন কিচ্ছু করতে পারিনি, কারন তা প্রতিহত করার শক্তি আমার ছিল না। আজ আছে, সেদিন মুখ বুজে থাকতে পেরেছিলাম বলেই কঁচুকীরাজের থেকে সব গুপ্ত বিদ্যা শিখতে আমি সক্ষম হয়েছি। লুকিয়ে নিজের জন্য এই গুপ্ত মায়া-রাজ্য তৈরি করতে পেরেছি, যা ওই কঁচুকীরাজের আয়ত্তের বাইরে। তারপর থেকে চেষ্টা করে গেছি ওই নিরীহ মানুষগুলোকে বাঁচানোর। কিন্তু অসুবিধা হল যারা আসে তারা কঁচুকীরাজের বশে এতটা গদ্গদ হয়ে থাকে যে ওই মন্ত্রপূত ঘেরাটোপ কাল্কুঠুরী থেকে বেরোতেই ভুলে যায়। তোরা খুব সাহসী, ওই ঘেরাটোপ থেকে আজ পালাতে পেরেছিলিস বলেই কিন্তু তোদের বাঁচাতে পেরেছি।
-আপনি না থাকলে যে কি হত আমাদের? কিন্তু আমাদের সাথে তো আরো অনেকে আছেন, তাদের কি হবে?
-বিপদ এখন শেষ হয়নি। কাল কৌশিকী অমাবস্যা। কাল কঁচুকীরাজ মহাশক্তির পূজা করবেন, আর তাতে ওই ১০৮ জন নিরীহ মানুষের বলি চড়াবেন। অমর তন্ত্র বিদ্যার শেষ ধাপ এটা। কাল যদি কোনোভাবে কঁচুকীরাজ সফল হয়ে যায়, তাঁকে রোখা অসম্ভব হয়ে যাবে। আমি চেষ্টা করব, তবে সবই ভৈরবের ইচ্ছা, ওই নিরীহ মানুষগুলোকে বাঁচাতে পারব কিনা যানি না, তবে আমি এই দিনটার জন্যই এত সাধনা করে এখানে এখনও পড়ে আছি। আমার সমস্ত শক্তি আর বিদ্যা দিয়ে কঁচুকীরাজকে আটকাব আমি।
-আমরাও আপনার সাথে আছি, শুধু বলুন আমাদের কি করতে হবে।
-যা করার কাল রাত ১২ বাজার আগেই করতে হবে। তার আগে কালভৈরবের পূজা করতে হবে, তাঁকে জাগ্রত করতে হবে। আর তোদেরও এক বিরাট বড় কাজ করতে হবে। তোদের ফেরৎ যেতে হবে ওই স্থানেই। গিয়ে কঁচুকীরাজের ব্যবহার্য যে কোন জিনিস, বস্ত্র, চুল, নখ, যা পাবি নিয়ে আসতে হবে। সে এতদিন অন্যের উপর কালোজাদু করেছে, আজ তাঁর নিজের উপর সেটা প্রয়োগ করব আমি। এ ছাড়া কঁচুকীরাজকে প্রতিহত করা সম্ভব নয়।
-কিন্তু বাবা আমরা ফেরৎ গেলে কি উনি আমাদের আর আস্ত রাখবেন?
-মোটেই না। তোদের আমি কিছু শক্তি দান করব, অদৃশ্য হবার শক্তি। মনে রাখিস এই মায়ানগরীতে মায়া ছাড়া বেঁচে বেরনো অসম্ভব। তবে খুব সাবধান, কঁচুকীরাজ যেন কোনোপ্রকার সন্দেহ না করে। তাহলে কিন্তু ওই ১০৮ জন লোকের সাথে তোরাও বলির শিকার হবি। মনে সাহস রাখতে হবে কিন্তু। ভয় পেলে চলবে না। কি পারবি তো?
- পারব বাবা, আমাদের পারতেই হবে।
ধূর্জটি-মহারাজ পিহু আর রাজ কে নিয়ে গেলেন এক রম্য স্থানে, সেখানে এক বিরাট কালভৈরবের মূর্তি তাঁর নিজের হাতে তৈরি। তাদের দুজনের হাতেই মন্ত্রপূত সুতো বেঁধে দিলেন, আর শেখালেন অদৃশ্য হবার মন্ত্র। সকাল হতেই এদিকে তিনি পূজোর জোগাড়ে লেগে গেলেন, আর পিহু, রাজ চলল সেই কালকুঠুরির দিকে। গিয়ে দেখে সেখানের অবস্থা আরো কত সঙ্গীন হয়ে গেছে। কঁচুকীরাজ ইতিমধ্যে মহাশক্তির পূজায় বসে গেছেন। চারদিকে খুব ব্যস্ত ভাব। আটক লোকগুলির অবস্থা আরো গুরুতর। তাদের খুঁজে না পেয়ে বাকিদের উপর অকথ্য অত্যাচার করা হয়েছে, সকলেই কমবেশি অসুস্থ হয়ে পড়েছেন। পিহু তাই দেখে ছুটে যেতে গেলে, রাজ তার হাতটা ধরে আটকাল, চোখের জল মুছে বলল, যাস না, গেলে সব জানাজানি হয়ে যাবে, আর এই মানুষগুলোকে বাঁচানোর শেষ আশাটুকু চলে যাবে। আমাদের ধরা পড়লে চলবে না। তাড়াতাড়ি কর, আমাদের হাতে বেশি সময় নেই। দুজনে ছুটে কঁচুকীরাজের শোবার ঘরে ঢুকল। সেখান থেকে একটি লাল বস্ত্র নিল আর বাইরে বেড়িয়েই দিল প্রানপণে দৌড়। এদিকে ধূর্জটি-মহারাজও কালভৈরবের পূজার সব আয়োজন করে ফেলেছে। তারা এসে দেখল, সেখানে একটি বড় বৃত্তের মাঝে পঞ্চভূজ আঁকা হয়েছে, ঠিক যেমনটি কঁচুকীরাজের কালকুঠুরিতে দেখেছিল। সাথে একটি পুতুলও বানানো হয়েছে।
ধূর্জটি-মহারাজ জিজ্ঞাসা করলেন ওখানকার হাল হকিকত। সব শুনে বললেন, এত তাড়াতাড়ি পূজা শুরু হয়ে গেছে? অবস্থা ভালো ঠেকছে না। মনে হচ্ছে আরো বড় কোন ঝড় অপেক্ষা করছে। তাদের হাতে লাল বস্ত্র দেখে ঈশারায় তাড়াতাড়ি তাঁকে সেটি দিতে বললেন। তারপর পুতুলটিকে ওই বস্ত্র পড়ানো হল। মন্ত্র পড়ে পুতুলটিতে কঁচুকীরাজের প্রান প্রতিষ্ঠা করে ওই পঞ্চভূজের ঠিক কেন্দ্রে রাখা হল। যজ্ঞের আগুন জ্বলল। একটি ঘটে জল নিয়ে তাতে মন্ত্র পড়ে সবকটি মানুষের মঙ্গলকামনায় মঙ্গলঘট স্থাপন করে কালভৈরবের পায়ের কাছে রাখা হল। তারপর শুরু হল সেই যজ্ঞ, কত দুর্বোধ্য গুরুগম্ভীর মন্ত্র উচ্চারিত হতে লাগল। পিহু আর রাজ খিদে তেষ্টা ভুলে দুরুদুরু বুকে একমনে সেই যজ্ঞ দেখতে লাগলো। সারাদিন চলল সেই যজ্ঞ। আস্তে আস্তে সন্ধ্যে হল, রাত বাড়তে লাগল। রাত তখন ১১ টা হবে, আস্তে আস্তে যজ্ঞের আগুন থেকে একটা কালো অন্ধকারের পাহাড় উঠে এলো, --- পিশাচ। কি নিকষ কালো অন্ধকার। কঁচুকীরাজের পুতুলটি তুলে তার গায়ে ফোঁটানো হল পাঁচটি সূঁচ, তার পঞ্চইন্দ্রিয়কে বশে রাখার জন্য। তারপর সেই পিশাচকে পাঠানো হল কঁচুকীরাজকে হত্যা করার জন্য। সেই কালো অন্ধকার ধীরে ধীরে কঁচুকীরাজের আস্তানার দিকে এগিয়ে গেল। আর ধূর্জটি-মহারাজ, পিহু আর রাজ কায়মনে কালভৈরবের কাছে প্রার্থনা করতে লাগলেন। কতক্ষণ কেটেছে হিসেব নেই, হঠাৎ পুতুলটিতে আগুন ধরে গেল আর বোমা ফাটার ন্যায় আওয়াজ করে মঙ্গলঘটটি ফেটে চৌচির হয়ে গেল। সবাই চমকে তাকালো। ধূর্জটি-মহারাজকে এই প্রথম এতটা অস্থির লাগলো। রাজ জিজ্ঞাসা করল- কি হয়েছে বাবা? ঘট ফেটে গেল কিভাবে? আর আপনাকেই বা এত অস্থির লাগছে কেন?
ধূর্জটি-মহারাজ বললেন, সর্বনাশ হয়ে গেছে, তোদেরকে খুঁজে না পেয়েই হয়ত কঁচুকীরাজ কিছু আঁচ করেছিল, তাই আমার পিশাচ যাওয়ার আগেই সে নরবলী শুরু করে দিয়েছে, তাই তার শক্তি এখন অপ্রতিরোধ্য হয়ে উঠেছে পিশাচের জন্য। এবার আমাকেই কিছু করতে হবে।
-কি করবেন বাবা?
-তোরা ভয় পাস না। আজ আমি কঁচুকীরাজের বিনাশ করেই ছাড়ব। এমনিতেই আমার পিশাচ ব্যর্থ, তাই ফিরে এসে আমাকেই হত্যা করার কথা, কিন্তু তার আগেই আমি এই যজ্ঞের আগুনে নিজেকে আহুতি দিয়ে ওই পিশাচের মধ্যে নিজেকে নিয়োজিত করব আর ওই কঁচুকীরাজকে হত্যা করব, তার এই অবিচার আমি কিছুতেই সহ্য করব না।
নতুন করে মঙ্গলঘট প্রতিষ্ঠা করলেন, তারপর পিহু আর রাজকে বললেন, এই ঘট তোরা রক্ষা করিস। তারা আর কিছু বলার আগেই ধূর্জটি-মহারাজ নিজেই যজ্ঞের আগুনে ঝাঁপ দিলেন, তারা হতভম্বের ন্যায় বসে থাকল, চোখ থেকে দুফোঁটা জল গড়িয়ে এলো। আবার ঝড় উঠল, কি সে বিষম ঝড়, মনে হচ্ছে গোটা পৃথিবী ধ্বংস হয়ে যাবে। ততক্ষনে পিশাচ ফেরত এসেছিল, কিন্তু কিছু করার আগেই হোমের আগুন থেকে একটি আলোকশিখা গিয়ে তাঁর সাথে মিলিত হয়ে আগুনের ন্যায় প্রজ্জ্বলিত হয়ে উঠল, আর হুংকার ছেড়ে দ্রুত ফেরত গেল যেদিক থেকে এসেছিল। রাজ আর পিহু কাঁদতে কাঁদতে কালভৈরবের কাছে কায়মনে প্রার্থনা করতে লাগল। আবার সময়ের কোন হিসেব নেই। কি হল জানা নেই, তবে ধীরে ধীরে সেই ঝড় থেমে গেল, মৃদুমন্দ বাতাস বইতে লাগল, মন বলল সব ঠিক হয়ে গেছে। যজ্ঞের আগুন নিভে গেছে। ভোরের আলো ফুটল। রাজ আর পিহু মঙ্গলঘট নিয়ে ধীরে ধীরে এগিয়ে যেতে লাগল সেই কালকুঠুরির দিকে।
গিয়ে দেখল, আর এক বীভৎস ধ্বংসস্তুপ। প্রায় অর্ধেক লোকের বলি হয়ে গেছে, চারদিকে ছড়িয়ে আছে চাপ চাপ রক্ত, বাকি যারা বেঁচেছে, তাদের ভয়ে পাগল পাগল অবস্থা, কেউই আর সুস্থ মস্তিস্কে নেই। যজ্ঞের আগুনের উপর কঁচুকীরাজের মৃতদেহটা বিকৃত অবস্থায় পড়ে আছে। কে যেন তার ঘাড় মটকে রেখে গেছে, বহুদিনের ঘৃণা উগড়ে দিয়েছে একেবারে। তারা মঙ্গলঘট থেকে জল নিয়ে ওই বেঁচে যাওয়া মানুষগুলোর উপর ছড়িয়ে দিতেই তারা ক্রমশ স্বাভাবিক অবস্থায় ফেরৎ এলো। কিন্তু কেউ শান্ত নেই, কেউ বাবা হারিয়েছে, কেউ ছেলে হারিয়েছে। তাদের মধ্যে সুবিনয়বাবুকে খুঁজে পেল তারা, তবে তাঁর বড় ছেলে আর বেঁচে নেই। রাজের মাসি, মেসো কেউই আর বেঁচে নেই। সুবিনয়বাবু এখনও খুব অসুস্থ, শুধু তাদের হাতদুতো ধরে বললেন,"আমি কোন মুখে বাড়ি ফিরব? ছেলেটা সংসারমুখো না হলেও বেঁচে তো ছিল, মাঝে মাঝে দেখতে তো পেতাম, আজ আমার ভুলের মাশুল তাঁকে গুনতে হল।" কিছু বলেই স্বান্তনা দেওয়ার নেই। কিন্তু বাড়ি তো এবার ফিরতেই হবে, সেই গাড়িটি পাওয়া গেল। ধূর্জটি-মহারাজ ও কালভৈরবকে দূর থেকে নমষ্কার করে তারা রওনা হল বাড়ির উদ্দেশ্যে। ঘরে ফেরা মানুষগুলো ঘুমের মধ্যে আজও ওই মায়াঙ্ক সভ্যতার কথা ভেবে কেঁপে কেঁপে ওঠে।
Comments & Reviews (0)
No comments yet :(