
উত্তর কলকাতার দক্ষিনখোলা একটি ফ্ল্যাট। হুহু করে হাওয়া বইছে আর এক মায়ের বুকফাটা চীৎকারে আকাশ বাতাস বিদীর্ণ হয়ে যাচ্ছে। সে আঁকড়ে ধরে রয়েছে তার ছোট্ট এক বছরের মেয়ের থেঁতলানো রক্তমাখা নিথর দেহটা। পাশে পাথরের মত স্থাণুবৎ আর এক মা- কোলে তার ভয়ে থরথর করে কাঁপতে থাকা বছর সাতেকের একটি মেয়ে। মেয়েটি নিজের মনে বিড়বিড় করে চলেছে, "আমি কিছু করিনি, আমি বারণ করেছিলাম, কিন্তু মেঘা, পালা কিছু শুনলই না। ওরা পিউকে মেরে ফেলল। "
বছর আস্টেক আগে উত্তর কোলকাতার একটি ফ্লাটে সমীরণ ও মিতালি তাদের সুখের নীড় গড়ে তোলে। দুজনেই কর্পোরেটে জব করে। কোল আলো করে আসে তাদের একমাত্র মেয়ে সুমী। অনেক আদর যত্নে বড় হতে থাকা সুমী এখন ক্লাস 2-এ পড়ে। বন্ধুবান্ধব নিয়ে সারাদিন স্কুলে হইচই করে থাকতেই ভালোবাসে। বাবা মা দুজনেই সারাদিন ঘরে না থাকার জন্য সুমী কে দেখাশোনা করার একটি আয়া থাকত- নাম মালতি। স্কুলের বাইরে এই মালতিই ছিল তার সর্বক্ষণের সাথী।
হঠাৎ কোত্থেকে এক মারণ রোগ covid-19 ছড়িয়ে পড়ল। সবাই ভয়ে সন্ত্রস্ত। শুরু হয়ে গেল lockdown। সুমীর স্কুল তো বন্ধই হয়ে গেছে। সমীরণ ও মিতালি-রও অফিস বন্ধ, work from home- অনির্দিষ্টকালের জন্য। তাই মালতিকেও ছুটি দিতে হল। সারাদিন মা বাবা ঘরে- এটা ভেবেই সুমী প্রথমটা খুব খুশী হল। ভাবল, সারাদিন খুব খেলা হবে, স্কুলে যেতে হবে না রোজ, মাম্মা, পাপা আর সুমী সারাদিন খাওয়া আর খেলা- রোজ holiday । কিন্তু সুমীর এই ভাবনা যে কতটা অলীক, তা অচিরেই প্রমানিত হল। যারা করেছেন, তাঁরাই বুঝবেন, অফিসের থেকে work from home -এ workload অনেকটাই বেশী, sunday ও কোনো ছুটি নেই, কাজ করার time-এরও কোনো limitation নেই।
সমীরণ ও মিতালি দুজনেই খুব ব্যস্ত, তার উপর কাজের লোকও আসছে না, তাই বাড়ির কাজ, রান্নাবান্নাও মিতালিকে একা হাতে সামলাতে হচ্ছে। সুমী যখনই মাম্মা পাপার কাছে এসে একটু খেলতে বলছে, তখনই শুনছে, "এখন না বেটা, একটু পর, কাজটা করে নিই, তুমি একা একা খেলা কর।" সত্যিই তারা খুব ব্যস্ত, কিন্তু সুমীর শিশুমন তো পুরোটা বুঝতে পারছে না। সে এবার বুঝল, সে কি ফাঁদে পড়েছে। না আছে স্কুল যাওয়া, না বন্ধুবান্ধবের সাথে খেলা, না টিচারের বকুনি, না বাইরের পার্কের খোলা হাওয়া, এমনকি মালতি মাসিও নেই। সারাদিন একা একা সুমী খুব বোর হত, মিস করত সেই স্বাভাবিক দিনগুলো। মাম্মা পাপা অফিস থেকে বাড়ি ফিরে যেটুকু খেলা করত, এখন তো সেটাও করে না। আগে মাম্মাকে জড়িয়ে ধরে রাতে ঘুমাত, এখন তো নিজের টেডিটাকেই জড়িয়ে শুতে হয়। মাম্মা যে কখন পাশে এসে শোয়, তা সে জানতেও পারে না। সবসময় মুখ ভার করে বসে থাকত সুমী, না খেত, না ভাল করে কথা বলত। সমীরণ ও মিতালিও সুমীকে নিয়ে চিন্তিত, কিন্তু কি করবে ভেবে পাচ্ছিল না।
এভাবেই কাটল কিছুদিন। কিন্তু সময় যে কাটতেই চাইছে না। সুমী একা একা কিভাবে কাটাবে সারাদিন, ভেবেই পেত না। এক একটা মিনিট তার কাছে এক একটা ঘন্টার সমান হতে লাগল। সে frustrated হয়েই খানিক তার প্রিয় টেডি-টাকেই তার বন্ধু বানিয়ে নিল। তার সাথেই সারাদিন খেলত, তার সাথে কথা বলত, পড়ত, তার সাথে খেত, ঘুমাত, সব। তার নাম দিল সফটি। সুমীকে একটু স্বাভাবিক দেখে সমীরণ ও মিতালিও খুশি হল, যাক মেয়েটা একটা বন্ধু পেয়েছে, হলই বা টেডি। আস্তে আস্তে শুধু টেডিকে নিয়েও সুমী বোর হয়ে গেল, তখন সে তার বন্ধুসংখ্যা বাড়াতে লাগল। এবার সে virtual দিকে গেল, তার স্কুলের দুই প্রিয় বন্ধুকে সে তৈরি করল, তার কল্পনার জগতে। সুমী ঢুকে পরল তারই তৈরি virtual world-এ । সেখানে সে আছে, তার প্রিয় টেডি আছে, আর আছে মেঘা, পালা (পল্লবী)। এবার সুমী খুব খুশি, সময় খুব দ্রুত এগিয়ে যেতে লাগল। সবাইকে আলাদা আলাদা স্নান করানো, খেতে দেওয়া, বিছানা করে ঘুম পাড়ানো- সব করত। এ সবে মিতালি মাঝে মাঝে রেগে যেত। সমীরণ মিতালিকে বোঝাত, "দেখ, এই পরিস্থিতিতে আমাদের সত্যিই কিছু করার নেই। কাজের চাপ এতটা বেশি, যে আমরাও সুমীকে সময় দিতে পারি না। থাক না মেয়েটা নিজের মত, ও তো এতে খুব আনন্দে আছে, তাই না? কোন বায়না নেই, চীৎকার নেই, শুধু বন্ধুদের নিয়েই তো একটু খেলছে। ওকে ওর মত থাকতে দাও না"।
ভুল ভাঙল, যেদিন মিতালি সুমীর ঘরে এসেছিল, তার সাথে গল্প করবে বলে। সুমী তখন খেলছিল তার বন্ধুদের নিয়ে। খুব স্বাভাবিক ভাবেই সে বিছানার উপর বসতে গিয়ে টেডিটা ভুলবশতঃ মাটিতে পড়ে যায়, সাথে সাথে সে সেটা তুলেও দেয়। কিন্তু কোত্থেকে যে কি হয়ে গেল, সুমী আচমকা মাকে এক ধাক্কা দিয়ে বিছানা থেকে ঠেলে ফেলে দেয়, মিতালি আঘাত পেয়ে জোরে চীৎকার করে ওঠে। সমীরণ ছুটে আসে, সুমীকে বকে, "কি করছ কি সুমী? মাম্মাকে কেউ এভাবে ঠেলে ফেলে?" রাগে সুমীর মুখটা লাল হয়ে যায়, বলে,"আর মাম্মা যে আমার সফটি কে ঠেলে ফেলে দিল, ওর লাগেনি?" এই প্রথম সমীরণ ও মিতালি বুঝল, তাদের প্রশ্রয় সুমীকে কোন অন্ধকূপের মধ্যে ঠেলে দিয়েছে। তার পর থেকে আস্তে আস্তে সুমী ওর বন্ধুদের ব্যাপারে খুব aggressive হয়ে উঠল। সবাইকে আলাদা আলাদা খাবার খেতে দিত, আর সবশেষে নিজে সবগুলো একসাথে খেয়ে নিত। এত ছোট একটা মেয়ে কিভাবে একা এত খাবার খেতে পারে সে ভেবে মিতালি অস্থির হয়ে উঠল, কিন্তু সুমীর কোন হেলদোল নেই। সমীরণ মিতালিকে আশ্বস্ত করে বলল, "দেখ বাড়িতে থেকে থেকে সুমী এরকম হয়ে গেছে, আবার স্কুল খুললে বন্ধুদের পেলে সব ঠিক হয়ে যাবে, চিন্তা কোরো না। " মিতালিও তাতে সায় দিল।
কিন্তু কেটে গেল অনেকদিন, lockdown উঠল, কিন্তু স্কুল খুলল না। এবার উপায় না পেয়ে মালতিকে পুনরায় কাজে নিয়োগ করা হল। মালতিও খুব খুশি, কিন্তু সুমী তাকে দেখে খুশি হল না। সে তার মত নিজের জগতেই ঢুকে থাকল। মালতি তার চেনা সুমীকে ঠিক মেলাতে পারল না, সারাদিন তাকে দেখত, নিজের মনে কারো সাথে বকতে থাকে, হাহা করে হাসে, অথচ উল্টোদিকে কাউকেই দেখতে পেত না। সে মিতালিকে জিজ্ঞাসা করল, "দিদি, সুমি মায়ের কি কিছু হয়েছে? নিজের মনে কি বিড়বিড় করে সবসময়? কই আগের মত মালতি মাসি বলে ছুটে আসে না তো?" মিতালি তাকে পুরো সত্যি না বলে সংক্ষেপে শুধু এটুকু বলে, "মালতি, ওসব কিছু না, আসলে এতদিন একা একা আছে, কোথাও খেলতে যেতে পারেনি, তুমিও আসোনি, সবমিলিয়ে তোমার উপর রাগ হয়েছে। এখন তো তুমি এসে গেছ, এবার সুমীর সব দায়িত্ব কিন্তু তোমার। ওকে না একটু পার্কে খেলতে নিয়ে যেও তো বিকালের দিকে, বেচারা খেলার সাথী পায় না, আর আমরাও ওকে সময় দিতে পারিনা। " মালতি কি বুঝল কে জানে, সেদিন সুমীকে খানিক জোর করেই পার্কে নিয়ে গেল। পার্কে গিয়ে সুমী খুশি তো হল, তবে সেখানে আর কারো সাথে মিশল না, নিজের মত নিজেই থাকল। মালতি ভাবল, এভাবেই সুমী আস্তে আস্তে স্বাভাবিক হয়ে যাবে। সে সারাক্ষণ সুমীর আশেপাশে ঘুরঘুর করত, তার সাথে খেলতে চাইত, তাকে পার্কে নিয়ে যেত। কিন্তু সুমীর কোনো পরিবর্তন এল না। মালতি পড়ল মহাচিন্তায়, যতই হোক সে তাকে ছোটো থেকে কোলেপিঠে করে মানুষ করেছে। মালতির সাধারণ বুদ্ধি সুমীর গোটা virtual world - এর হদিশ পেল না, শুধু দেখল তার টেডিটাকে। সে ভাবল, ওই টেডিটাকে যদি সুমীর কাছ থেকে আলাদা করা যায়, তাহলে হয়ত সুমী একটু স্বাভাবিক হবে। সুমী সেদিন ঘুম থেকে তখনও ওঠেনি, মালতি আস্তে আস্তে তার পাশ থেকে টেডিটাকে সরিয়ে নিল। ঘুম থেকে উঠেই খোঁজ পড়ল, মালতি বলল,"সুমী মা, ওই টেডিটা খুব নোংরা হয়েছিল, তাই কেচে দিয়েছি, বিকালেই শুকিয়ে যাবে, তুমি বাকি খেলনা নিয়ে খেল না।" সুমীর মুখটা থম্থমে হয়ে গেল, কিন্তু মুখে কিছু বলল না। মালতি ভাবল, যাক ওষুধে কাজ দিয়েছে। সেদিন বিকালে পার্ক থেকে খেলে বড় পুকুরটার পাশ দিয়ে আসার সময় আচমকাই সুমী মালতিকে দিল এক জোরে ধাক্কা। মালতি পড়ে গেল পুকুরে, সে কি বিকট হাসি সুমীর, চিৎকার করে বলতে লাগল, "আমার সফটিকে আর জলে চোবাবি? দেখ কেমন লাগে?"
এই ঘটনার পর আর চুপচাপ হাত গুটিয়ে বসে থাকা যায় না। সমীরণ ও মিতালি একজন psychologist-এর কাছে সুমীকে নিয়ে গেলেন। তিনি সব দেখে বললেন, "আপনারা বড়রা যদি একটু বাচ্চদের মনের মত করে ভেবে দেখতেন তাহলে কিন্তু সমস্যা হত না। covid-19 সবার জীবনেই অভিশাপ, আপনাদেরও, তবে সবথেকে বেশী suffer করছে কিন্তু বাচ্চারা। এটা one type of Delusional disorder, বা paranoid disorder ও বলতে পারেন। নিজেদের তৈরি জগতেই ওরা থাকে, ওরা নিজেরাও বোঝে না কোনটা real, আর কোনটা imagined। সুমী কিন্তু ওর virtual world এর ব্যাপারে খুবই aggressive, ও এখন high risk zone -এ আছে। এ সময়টা ওকে খুব carefully handle করতে হবে আপনাদের। পুরো স্বাভাবিক হতে সময় লাগবে। ওকে বাইরের জগতে involve করুন, পার্কে নিয়ে যান, কোথাও বেড়াতে নিয়ে যান, ওর বয়সী বাচ্চার সাথে খেলতে দিন। কিন্তু কখনো ভুল করেও ওকে একা ছাড়বেন না, সবসময় সতর্ক থাকবেন, যে কাউকে hurt করতে পারে। কিছু medicine দিচ্ছি, নিয়ম করে খাওয়াবেন, কোনো ওষুধ যেন skip না করে। এটা বাড়তে থাকলে কিন্তু ও split personality-র দিকে এগিয়ে যাবে, তখন কিন্তু হাতের নাগালের বাইরে চলে যাবে। এসব ব্যাপারে বাবা মাকে ধৈর্য ধরতে হবে, শক্ত থাকতেই হবে, চিন্তা করবেন না, আশা করছি ঠিক হয়ে যাবে।"
সমীরণ, মিতালি কিছুদিনের ছুটি নিল। বাইরে ঘুরতে গেল, সবাই খুব মজা করল। ওষুধ নিয়ম করেই চলছিল। ধীরে ধীরে যেন সুমী সুস্থ হয়ে উঠতে থাকল। এখন আর সে নিজের কল্পনার জগতে ডুবে থাকে না। সবার সাথে অল্প অল্প কথা বলতে থাকে। এখন সুমীকে দেখে সবাই একটু স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলছে। পাশের ফ্লাটে একটি ছোট্ট ফুটফুটে বাচ্চা এসেছে- পিউ, তাকে দেখে সুমী খুব খুশি। ওর সাথেই কিছুদিন ধরে খেলা করছে। মিতালিও সুমীকে দেখে নিশ্চিন্ত, যেন কত বড় বোঝা নেমে গেছে কাঁধ থেকে। সেদিনটাতেও সুমীকে নিয়ে মিতালি পিউ-দের বাড়ি গিয়ে দেখে ঘরে পিউ তার মায়ের সাথে একা বসে খেলা করছে, পিউ এর বাবা যথারীতি অফিস বেড়িয়ে গেছে। সুমী পিউ-এর সাথে খেলতে থাকে। মিতালি ভাবল, হাতে কিছু সময় আছে, সুমীর ঘরটা একটু গুছাই, কতদিন গোছানো হয় না। । চারদিক এলোমেলো, গুছাতে গুছাতে হাতে পড়ল একটা doll,সেটা রাখতে গিয়ে দেখে কি একটা ছুনছুন আওয়াজ হচ্ছে যেন, দেখা যাচ্ছে না বাইরে থেকে। এই doll টা তো এমন ছিল না, খুলে দেখে ভিতরে একমুঠো ওষুধ, ঠিক যেমনটা ডাক্তার ওকে রোজ খেতে দিয়েছিলেন। ওষুধগুলো হাতে নিয়ে হতভম্বের মত দাঁড়িয়ে আছে মিতালি। বুকের ভিতর হাজার দামামা বাজছে। পিছন থেকে পিউ-এর মা ডাকছে, "মিতালিদি, আজ রাতে সুমীর নিমন্ত্রণ, আজ তো পিউ-এর জন্মদিন তাই।" মিতালি ফ্যাকাসে মুখে ঘুরে তাকিয়ে বলল, "সুমী কোথায়?" পিউ-এর মা বলল, "সুমী তো পিউ এর সাথে খেলছে। " সাথে সাথে পিউ-এর গগনভেদী আর্তচীৎকারে দুই মা-ই স্তম্ভিত হয়ে গেল। মিতালির হাত থেকে ওষুধগুলো ঝরঝর করে গোটা মেঝেতে ছড়িয়ে পড়ল।
Comments & Reviews (0)
No comments yet :(