দুলালের মনটা যে খুব খারাপ, শুরুতেই সেটা লক্ষ করেছেন রহিমা। যদিও শীতের শেষ, বাইরে তখন দুপুরের রোদ জ্বলজ্বল করছে। রহিমা বেগম এক গ্লাস পানি এগিয়ে দিলেন ছেলের দিকে। দুলাল এক ঢোঁকে পুরো পানি পান করে নিলো। যেন সে খুবই তৃষ্ণার্ত। রহিমা জিজ্ঞাসা করলেন আরও এক গ্লাস পানি দিবেন কিনা। দুলাল মাথা দুলিয়ে মানা করে দিলো। রহিমা ছেলের দিকে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলে সে একটু দম নিয়ে বললো, "দেশের অবস্থা ভালো নয়, বুঝলে? সরকার ১৪৪ ধারা জারি করেছে। সকল মিটিং মিছিল বন্ধ করে দিয়েছে। মাতৃভাষা নিয়ে পূর্ববাংলায় যে চাঞ্চল্যের সৃষ্টি হয়েছে তাকে ধামাচাপা দিতে চাইছে। কিন্তু ওরা জানে না যে বাঙালিরা তাদের শরীরের শেষ রক্তকনা অবশিষ্ট থাকা পর্যন্ত ভাষার জন্য লড়াই করে যাবে।"
(বলতে বলতে দুলালের পুরো শরীর উত্তেজনায় কেঁপে উঠলো।)
"এখন তাহলে কি হবে?"
"কি আবার হবে? আগামিকাল আমরা মিছিল বের করবো। ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করবো।"
ছেলের মুখপানে চেয়ে তিনি অকল্যাণের কথা বললেন না। কিন্তু তার মনে হটাৎই একটা চাঁপা আতঙ্ক জেঁকে বসলো।
রাতে শুয়ে শুয়ে রহিমা ছেলেকে বললেন, "তুই মিছিলে যাবি,তো যা। কিন্তু পাকিস্তানি সরকার কি আর তোদের ছেড়ে দেবে? যদি খারাপ কিছু হয়?"
- "হলে হবে। তবু বাঙালি মাথা নত করবে না। বাংলা ভাষা বাঙালীর রন্ধ্রে রন্ধ্রে মিশে আছে। একে বাঙালীর থেকে কেড়ে নেয় এ সাধ্য কারো নেই। তুমি চিন্তা করোনা। দেখো একদিন এর শেষ হবে। বাংলাই হবে আমাদের রাষ্ট্রভাষা।"
মাঝরাতেই দুলাল বেড়িয়ে পরে ঢাকার উদ্দেশ্যে। যাবার আগে ছোট বোন মিলির কপালে এঁকে দেয় ভালেবাসার চিহ্ন। সাধারণত মিলি এতো রাতে জাগে না। কিন্তু সেদিন জেগে উঠলো। বললো, "কোথায় যাচ্ছ ভাইয়া?"
দুলাল বলল, "মাতৃভাষার মান রক্ষা করতে যাই বোন।"
তারপর ধীরে ধীরে সে অন্ধকারে হারিয়ে যায়।
পরের ঘটনাগুলো খুব দ্রুতই ঘটে। অনেকেই ফিরে আসে, কিন্তু দুলাল ফেরে না। জানা যায়, দুলাল মিছিলে সবার সামনে সামনে যাচ্ছিলো। পুলিশ প্রথমে কাঁদানো গ্যাস নিক্ষেপ করে। কিন্তু অপ্রতিরুদ্ধ দুলালদের যখন থামানো যায় না তখন পুলিশ গুলিবর্ষণ শুরু করে।
গুলি এসে দুলালের শরীর ঝাঁঝরা করে দেয়। কিন্তু তখনো দুলালের মুখে ছিলো অকৃত্রিম হাসি। বুকে জড়িয়ে রেখেছিলো “বাংলা আমার মায়ের ভাষা।” লেখা ব্যানারটি।
রহিমা বেগমের শেষ সম্বল দুলালকে ওরা কেড়ে নিয়েছে। শুধু রহিমা নয় আরও অনেক মায়ের বুক সেদিন খালি করেছে তারা। কিন্তু তবু বাঙালি থেমে যায় নি। জীবন দিয়েছে ভাষার জন্য। দেশের জন্য।
(সমাপ্ত)
Comments & Reviews (0)
No comments yet :(