সীমার সাথে শুভর পরিচয় খুব ছোটবেলা থেকে । শুভর বয়স যখন সাত কি আট । পৃথিবীর প্রতিটি শব্দ যখন কানকে আলোড়িত করত, প্রতিটি বর্ণকে টেনে রাখত চোখ এবং প্রতিটি গন্ধ করত বিস্মিত তখন থেকে । পাশাপাশি বাড়ি । খুব সহজেই দেখা হত ওদের । সীমা আসত শুভদের বাড়ি, শুভ সীমাদের বাড়ি । সীমাদের বলতে ওর নানার বাড়ি । সীমার মা শুভর দূর সম্পর্কের ফুফু আছিয়া ঝড় বৃষ্টি মাথায় একদিন এসে হঠাৎ জানালেন “সীমা এখানেই থাকবে । আমাদের ওখানে থাকলে ওর পড়াশোনা হবে না” । সেই হতে সীমা শুভর চলার, পড়ার, খেলার এবং ঝগড়ার একমাত্র সাথী । সীমার প্রতি যে শুভর অন্য সবার থেকে বিশেষ কিছু দাবী ছিল একথা সে প্রতি মুহূর্তে সীমাকে বুঝিয়ে দিয়েছে । আর সেই অধিকার বলেই তার উপর যে শাসন এবং উপদ্রব চলতনা তা নয় । সীমাও নিরবে শুভর সকল ফরমাশ খাটত ।
স্কুলে যাবার আগে মাথায় তেল দিয়, সুন্দর করে সিঁথি কেটে, পায়ে আলতা দিয়ে, ¯েøট বই বুকে চেপে সীমা সোজা শুভদের বাড়ি চলে আসত । সেই ছোটবেলা হতেই শুভর বই, চক-¯েøট রেডি করা, ঘর হতে শার্ট এনে দেওয়া ইত্যাদি ওর নিয়মিত কাজ হয়ে পড়ে । আর এসব কাজে একটু ত্রুটি হলেই পিঠে ধমাধম কিল পড়ত । এর পর যা হবার তাই হত । মায়ের বকুনি, রাগ করে দু’বেলা না খেয়ে থাকা এবং অবশেষে সীমা হাতে পায়ে ধরে মাফ চেয়ে শুভকে ভাত খায়ানো । স্কুলে বেশীরভাগ দিনই পড়া হতনা শুভর । বাবুদের বাগান থেকে পেয়ার চুরি করা, শাপলা তোলা, গাছের গর্ত হতে শালিক পাখির বাচ্চা ধরা, নদীর ঘাটে সড়াৎ খাওয়া ইত্যাদি গুরুত্বপূর্ণ কাজেই সময় খরচ হয়ে যেত । বই পড়ার সময় কই ? স্যার পড়া জিজ্ঞেস করলেই সীমা পেছন থেকে ফিসফিস করে বলে দিত । ফলে পড়া হওয়া সত্তে¡ও অধিকাংশ দিনই সীমাকেও বেতের বাড়ি খেতে হত । শুভ জিজ্ঞেস করে “ তুই আমার জন্য মার খাস কেন রে ?”
- বা-রে মার খেতে তোর বুঝি কষ্ট হয় না?
- তাতে তোর কী?
- তুই পড়িস না কেন?
- আমার ইচ্ছে ।
- মার খাওয়াটাও আমার ইচ্ছে ।
ইতোমধ্যে সীমাও বহাল তবিয়াতে শুভকে জ্বালাতন করতে শুরু করেছে । পড়তে বসলে পেছন থেকে আচমকা ভয় দেখানো, মায়ের কাছে মিথ্যে নালিশ করে বকুনি খাওয়ানো ইত্যাদি অভিনব দুষ্টমিতে নিয়মিত নাজেহাল করতে শুরু করেছে । ওরা যখন ক্লাস নাইনে পড়ে তখন একদিন হঠাৎ শুভর চাকুরে ছোট মামা এসে তাকে শহরে নিয়ে যান ভালো স্কুলে পড়ার জন্য । স্কুল হতে ফেরার পথে শুভ কথাটা বলে ওর সবচেয়ে কাছের সহপাঠিনীকে ।
- জানিস সীমা আমি আর পড়ব না এই স্কুলে ।
- কেন, তুই কি লেখা পড়া ছেড়ে দিবি নাকি?
- না । লেখাপড়া করব, তবে এখানে নয় ।
- কোথায়?
- শহরে ।
- ছোট মামা খুব ভালো স্কুলে ভর্তি করিয়ে দেবেন ।
- না, যেতে হবে না কোথাও ।
- কেন?
- কেন জানিনা । তুই যাবিনা এখানেই থাকবি । আর আমার কথাই শুনবি ।
- বা-রে তোর কথা শুনবো কেন? আমায় বাঁধা দেওয়ার তুই কে ?
মুহূর্তের মধ্যে এক ঘন কালো মেঘ ঢেকে দিল সীমার সহাস্য মুখ । বহু চেষ্টা করেও কয়েক দিন ওর দেখা পায়নি শুভ । ও কেন এমন করল শুভ তার কিছুই টের পেলনা । অবশেষে শহরে যাবার দিন ওবাড়ির চাচা চাচীর কাছে বিদায় নিতে যেয়ে দেখে সীমা ঘরে শুয়ে আছে । ওর ঘরে ঢুকে অভ্যেস মত সীমার পিঠে শুভ বসায় এক কিল । কিন্তু সীমা একটুও নড়া চড়া না করে ভীষণ রকম শান্ত ভাবে বলল “ শুভ তুই সত্যিই চলে যাচ্ছিস ?”
- হ্যাঁ যাচ্ছি তো । কিন্তু তোর কী হয়েছে, শরীর খারাপ?
- না । আচ্ছা না গেলে হয় না?
- পাগলী কোথাকার, না গেলে হয়? এই গ্রামে পড়ে থাকলে জীবনে কিচ্ছু হবেনা ।
সীমা মনে মনে বলে ‘ তোর কিচ্ছু হবার দরকার নেই, তুই শুধু আমার কাছে থাক, শুধু আমার হয়ে ।’ শহরে নতুন স্কুলে যাবার আনন্দে শুভ আত্মহারা । সীমার কথার মাথা মুÐু বোঝার মত সময় বা মন কোনটাই তখন শুভর নেই । শুভ বলল “ আসিরে সীমা, ভালো থাকিস ।”
বলে ঘর থেকে বেরোবে এমন সময় সীমার আবার করুণ মিনতী। ‘শুভ!’
ততক্ষণে ঘন কালো মেঘ বৃষ্টি হয়ে ঝরতে শুরু করেছে। হঠাৎ থমকে যায় শুভ- সীমার চোখে পানি ? আস্তে করে বলে শুভ-
-কী সীমা ?
-সেই অশ্রু স্নাত চোখ দুটো তুলে ধরে ঠোট দুটো মৃদু কাপিয়ে বলল ‘আর আসবি না?’ চোখ মুছে দিয়ে শুভ বলে পাগলি কোথাকার, আসবো না কেন , প্রতি সপ্তাহে আসবো। আসলে তা আর হয়ে ওঠেনি। শহরের যান্ত্রিক জীবন, পড়ার চাপ, নতুন বন্ধু-বান্ধবী সব কিছু অতি অল্প সময়ের মধ্যেই ভুলিয়ে দিয়েছে গ্রাম্য সহজ সরল সেই সহপাঠিনীকে।
এদিকে গ্রাম্য বালিকার দিন যায়, রাত আসে সময়ের স্রোতে ভেসে ভেসে রচনা করে কল্পনার রাজ প্রাসাদ। ডুবে যায় এক অজানা সপ্নিল সাগরে। আর একটু একটু করে প্রতিটি মুহুর্ত অপেক্ষা করে শুভর জন্য। প্রিয় মানুষটার জন্য তুলে রাখে প্রিয় আমের আচার, যতœ করে রুমালে ফুল আঁকে ভুলনা আমায় । কোন পূর্ণিমা রাতে খুব করে সেঁজে খোপায় ফুল এটে লাল পেড়ে শাড়ীর আঁচলে ঘোমটা এটে বসে থাকে আয়নার সামনে। বিড়বিড় করে নিজেই নিজের সাথে কথা বলে, আবার লজ্জায় হাত দিয়ে মুখ ঢাকে । সীমার কল্প রাজ্যের উদ্দাম সাগরের এক বিন্দু জল সম্পর্কে ও কিচ্ছু জানতে পারে না শুভ। এর পর সীমা চলে গিয়েছিল তার নিজের বাড়ী। ফলে দু’জনার দেখা হয়নি আর।
শুভর বি.এ পরীক্ষা সামনে। হোস্টেলৈ থাকে। হঠাৎ পিওন একটা চিঠি দিয়ে গেল। লেখা খুবই অল্প।
শূভ,
কেমন আছিস? আমি ভিষণ সমস্যায় পড়েছি। তোকে খুবই দরকার। তাড়াতাড়ি চলে আয়।
ইতি
‘সীমা’।
চিঠি পেয়ে শুভর ইচ্ছে হচ্ছে আজই ছুটে যায় সীমার কাছে। কী সমস্যা হতে পারে ওর ? কিন্তু পরীক্ষা খুব কাছেই। পড়ার চাপে অল্প সময়েই দুমড়ে মুচড়ে অদৃশ্য হয়ে যায় ইচ্ছাটা। পুরো তিন মাস কঠিন পড়াশোনার পর পরীক্ষা শেষ করে বাড়ী ফিরলো শুভ। মায়ের সাথে অনেক গল্পের সাথে একটা মজার সংবাদ ও দিলো শুভর মা। বলল, তুই এসেছিস ভালো হয়েছে, সীমার বিয়েতে যেতে পারবি।
-সীমার বিয়ে ? কবে , কোথায়?
- হ্যা, আগামী শুক্রবার । ছেলে ভাল, খুলনা শহরে বাড়ী, গাড়ী ইত্যাদী ...... ইত্যাদী।
খুব দামী একটা শাড়ী নিয়ে ঠিক বিয়ের দিন বিকালে শুভ হাজির হয় সীমাদের বাড়ী। আত্মীয় স্বজনে ঠাসা বাড়ীটা গমগম করছে। চারদিকে ঝলমলে আলো, রং বেরং এর আলো সব মিলিয়ে বাড়ীটা আজ অপূর্ব সাজে সেজেছে। তার চেয়ে শত গুন যতেœ, নিখুত, নিপুন করে শিল্পীর তুলিতে আঁকার মতো করে সাজানো হচ্ছে এক অষ্টাদশী পরীকে । অন্দরমহল সেই রূপের বিচ্ছুরণে হেসে কুটিকুটি হচ্ছে। কিছুক্ষণ পরেই বরযাত্রী আসবে। অন্য সবার মতো শুভ ও মহাব্যাস্ত। হঠাৎ একটা মেয়ে এসে শুভকে বলল, আপনি কি শুভ?
-হ্যা, কী ব্যাপার?
-না মানে আপনাকে ভেতরে ডাকছে।
- ভেতরে? কে?
- আসুন না দেখবেন।
-আচ্ছা।
ভিড় ঠেলে ভিতরে ঢুকতেই শুভ বুঝলো এটা সীমার ঘর। কী সুন্দর করে সেজেছে ও। শুভ আশ্চার্য হয়ে গেল। মেয়েটা এতো সুন্দরী হলো কবে? বলল-
-সীমা কেমন আছিস?
- সুন্দর চোখ দুটো তুলে তাকালো একবার সীমা।
- তোকে না আজ হেব্বি লাগছে। আচ্ছা তোর সাথে তো আমার কথা বলাই উচিত না। তোর বিয়ে, আর তোর পক্ষ থেকে আমায় দাওয়াত না করে পারলি কী করে? কি ব্যাপার কথা বলছিস না কেন?
রূপার পুতুল এবার ঠোট খুলল।
-শুভ, তুমি আমাকে হত্যা করো না, তুমি বাঁচাও আমাকে ।
- কী আবোল তাবোল বকিছস? তোর মাথা ঠিক আছে তো?
-না মাথা ঠিক নেই। আমি পাগোল হয়ে গেছি, অনেক দিন থেকে। আমি বাঁচবো না শুভ, আমাকে বাঁচাও।
বলেই দু পা জড়িয়ে ধরল সীমা। শুভ কিছুই বুঝতে পাছে না কী হচ্ছে এখানে। আ¯েত করে বলল- সীমা তোর কী সমস্যা সব খুলে বল আমায়।
-শুভ, তোমাকে ছাড়া আমি বাঁচবো না।
চমকে উঠলো শুভ।
-কী বলিস তুই?
- হ্যা, শিশুকাল থেকেই প্রতিটি মেয়েই মনের অতি গহীনে অতি যতেœ একটা স্বপ্ন লালন করে। সারা জীবনের একটা সঙ্গী, একটা মনের মতো পুরুষ মানুষ, একটা সুন্দর সংসার। সেই পুতুল খেলার বয়স থেকেই আমি মাত্র একটা পুরুষ মানুষকে চিনি, জানি। যার এক মুহুর্তের হাসি আমার অনন্ত কালের স্বর্গবাস। যার শাসন, আদর, ঘৃণা, ভালোবাসা, অবহেলা সবই আমার হাজার বছরের চাওয়া। যার প্রতিটি রক্ত মাংশ কণা তিল তিল করে মিশে আছে আমার অনুভুতিতে। যার জন্য এতটি বছর প্রতিটি মুহুর্ত অপেক্ষা করেছি। যাকে নিয়ে স্বপ্নের বাসর সাজিয়ে কেটেছে আমার প্রতিটি ক্ষণ। বিশ্বাস কর শুভ সব কথা তোকে বলবার জন্য বারবার চেষ্টা করেছি কিন্তু পারিনি।
শুভ হতবাক হয়ে মুর্তীর মত এক দৃষ্টে তাকিয়ে থাকে সীমার দিকে। যেন লক্ষ লক্ষ টন ওজন তাকে নিচের দিকে টানছে, যেন মাটির নিচে ডেবে যাচ্ছে গহীন থেকে গহীনে। বিশ্বাসই হচ্ছে না এ সেই সীমা। বুকের ভেতরটা দুমড়ে মুচড়ে যাচ্ছে। কলিজাটা কেউ যেন বিষাক্ত ছুরি দিয়ে ফালি ফালি করে কাটছে, মাথাটা ঘুরপাক খাচ্ছে। হঠাৎ সীমা শুভর পায়ের উপর মাথাটা রেখে বলতে লাগল ‘ শুভ, তোমার পায়ে একটু ঠাই দাও আমায়, আমাকে বাঁচাও শুভ, আমাকে বাঁচাও।
শুভর মুখ থেকে কোন কথা বেরচ্ছেনা। অতি কষ্টে বলল, এতদিন একটি বার কেন বললি না পাগলি, কেন বললি না? এখনতো সব শেষ সব .............।
-আমি কিচ্ছু জানি না, কিচ্ছু বুঝতে চাইনা, তুমি এখই আমাকে নিয়ে পালিয়ে যাও। প্লিজ শুভ প্লিজ..........।
হঠাৎ চারদিকে কোলাহল, বাচ্চাদের চেচামেচি, আতশবাজীর শব্দ আর এক শব্দ “ বর এসেছে, বর এসেছে।”
সমস্ত বাড়ী আনন্দে লুটোপুটি খাচ্ছে, খুশির জোয়ার সবখানে, শুধু এই ছোট্ট ঘরটাতে টুপটাপ করে বৃষ্টি গড়িয়ে পড়ছে । চেচামেচির শব্দে সম্বিৎ ফিরে আসে দুই নিষ্পাপ অপরাধীর । শুভ মাথা তুলে একটা বিবর্ণ দীর্ঘ শ্বাস ছাড়ে। যেন হাজার বছরের জমানো কষ্টের ধোঁয়া বেরিয়ে আসে সেই দীর্ঘশ্বাসে। আস্তে করে সীমার মুখটা তুলে নিজের মুখের কাছে এনে বলে, “ সীমা আমি প্রাণ খুলে দোয়া করছি, তুই সুখী হবি ।”
------------------------
(রচনাকালঃ ০৯ নভেম্বর ২০০৪ ইং)
Comments & Reviews (0)
No comments yet :(