Story

দড়ি

2 years ago

0


                           "দড়ি"


২০ জুলাই, ২০০৫

বাসার দিকে আসছিলাম। আবারও মেয়েটার জন্য কিছু কিনে নিতে পারলাম না। সারাদিন না খাওয়া আজ। ২টা ইন্টারভিউ দিয়েও সফল হইনি। যদিও ইন্টারভিউর কোনোটাই আমি ভালোমতো দিতে পারি নাই। মাথায় শুধু না পাওয়ার আর হারানোর ঘটনাগুলো ঘুরপাক খাচ্ছিল। কি হবে যদি আবার চাকরিটা না হয়? বাসার ভাড়া বাকি ২ মাসের। তাও ভাগ্য ভালো বাড়িওয়ালা ভালো লোক। ঘেমে নেয়ে একাকার হয়ে আছি। আকাশে যে মেঘ করেছে, মনে হচ্ছিল যেন আজ ভিজেই বাসায় ফিরতে হবে। তাও ভালো হত। গায়ে পড়ে থাকা ৩ দিনের না ধোঁয়া শার্টটা ধুয়ে যেত প্রকৃতির আশির্বাদে। বাসায় পৌঁছাতে পৌঁছাতে রাত হয়ে গেল। বাসায় এসে মিথিকে পেলাম না। হয়তো আমি আসছি না বলে পাশের বিল্ডিং -এ ওর মাসির কাছে গেছে৷ মিথি, মা মরা মেয়ে আমার৷ মেয়েটার বয়স ৭ বছর। স্কুলে ওর ভালো শিক্ষার্থী হিসাবে সুনাম আছে। এই অল্প বয়সেই মিথি যেন সব বুঝে। ওর জন্মের সময় মা মরে যাওয়ায় মেয়েটা মায়ের আদর ছাড়াই বড় হয়েছে৷ ৭ বছরের এই ছোট্ট জীবনে ও যে কতোকিছু দেখেছে, তার জন্য নিজেকে ক্ষমা করতে পারি না। প্রতিদিনই আমি ইন্টারভিউ দিয়ে বেরাই, বাসায় আসতে আসতে এমনই রাত হয়ে যায়, মেয়েটা আমার স্কুল থেকে ফিরে বাসায় আমায় না পেয়ে ওর মাসির বাসায় চলে যায়। হতাশাগ্রস্ত নিশ্বাস ছেড়ে বাসার দরজা লাগিয়ে দিলাম। খাটের উপর বসে কাঁধ থেকে ব্যাগ নামিয়ে রাখলাম৷ গোসলের জন্য বাথরুম এ যেতেই আয়নায় নিজেকে দেখে ঘৃণা ধরতে লাগল৷ চোখ দিয়ে ২-৩ ফোঁটা জল অজান্তেই গড়িয়ে পড়ল৷ কণক আমার জীবনে যেমন সৌভাগ্যের ঝুরি নিয়ে এসেছিল, সেভাবেই সৌভাগ্য সাথে করেই নিয়ে গেছে। নিজের দিকে তাকালেই এখন হাসি পায়। হতাশায় রাতে ঘুম পায় না। শরীরের অবস্থা দেখলে মনে হবে যেন কখনো পেট ভরে খেতে পাইনি। আসলেই তাই। 


বাসায় খাবারের কিছুই না পেয়ে শুয়ে পরলাম৷ মনে মনে আগামীকালের ইন্টারভিউর সময়গুলো আবার মনে করে ঘুমানোর চেষ্টা করলাম। ঘুম আসল না। জীবনকে এখন অনেক তুচ্ছ মনে হয়। এ জীবনে আমার ভাগ্যে আর কিছুই নেই। ভাগ্যদেবতা যেন প্রতিদিন আমার সাথে ছেলেখেলা করে। এসব ভাবতে ভাবতেই হঠাৎ ঘুমিয়ে পরলাম। 



কীভাবে যেন ঘুম ভাঙল হঠাৎ। উঠে বুঝলাম পেটের ভিতর খিদেয় চু চু করছে। রান্নাঘরে কিছুই পেলাম না খাওয়ার মতো। এমনকি বাসায় পানিও নাই। হাইরে কপাল। আমি আবার ঘুমাতে গেলাম। তবে এবার আর ঘুম হলো না। শুধু মাথায় আসতে থাকল বাজে খেয়াল। আমি জানি আমি মরে গেলে আমার মেয়েটা খারাপ তো নয় বইকি ভালো থাকবে ওর মাসির কাছে। আর আমি বাঁচলে ওর-ই হবে যত জ্বালা। সারারাত আর ঘুম হলো না।


২১জুলাই, ২০০৫

 সকাল হতেই শার্ট গায়ে দিয়ে চললাম চাকরির খোঁজে। আজকের ইন্টারভিউটার পর এই সপ্তাহে আর কোনো ইন্টারভিউ নেই। 

ইন্টারভিউ দিতে দিতে বিকেল হয়ে এলো। অনেক লোক এসেছিল এই চাকরির জন্য। আমার এই চাকরি হওয়ার সম্ভাবণা নেই বললেই হয়। পকেটে হাত দিয়ে ১০০ টাকা পেলাম। ভাবলাম কিছু খাই এ দিয়ে। কিন্তু ততক্ষণে হতাশা আমাকে আরো জেঁকে বসেছে। রাস্তার পাশের চায়ের দোকানে বসে বসে ভাবছিলাম কি করা যায়। আমার লাইফ ইনসিউরেন্স করা আছে। আমি মরলে আমার সন্তান সেখান থেকে ৫ লাখ টাকা পাবে। আগে যখন 'মিশন' কোম্পানিতে চাকরি করতাম তখনই করে ছিলাম। শেষকালে মায়ের চিকিৎসায় ব্যাংকের সব টাকা চলে যায় আমার। শুধু আমার কাছে ছিল কণক। কোম্পানিটা হঠাৎ একদিন লোকের টাকা চুরির অভিযোগে বন্ধ হয়ে যায়। আর আমি আমার ছোট্ট চাকরিটাও হারাই। আহ্ জীবন!! 

মিথির ভবিষ্যৎ কি হবে জানি না। চায়ের দোকান থেকে উঠে বাসার দিকে রওনা হলাম। সামনেই হার্ডওয়্যারের একটা দোকান পরল। দোকানে ঝুলে আছে অনেক শক্ত শক্ত দড়ির গোছা। আমি কিছু না ভেবেই পকেটের ১০০ টাকা দিয়ে ২ গোছা দড়ি কিনে নিলাম। বাসায় ঢুকার সময় মনে হলো, এটাই বোধহয় আমার জীবনের শেষ ঘন্টা। মরে গেলে লাইফ ইনসুরেন্সের টাকায় সন্তানহীন মাসির কাছে মিথি ঠিকই বেড়ে উঠবে। হয়তবা এর জন্য প্রথম প্রথম আমার উপর রেগে গেলেও পরে ঠিকই মনে মনে ওর ভবিষ্যৎ ঠিক করে দেওয়ায় আমায় ধন্যবাদ দিবে। বাসার ভিতরে ঢুকে দরজা লাগিয়ে দিলাম। আজ জীবনের শেষ এই দড়িতেই লিখে রাখব আমি। আজও বাসায় মিথি নেই। প্রতিদিনের মতোই মাসির বাসায় আছে হয়তো। সিলিং ফ্যানের সাথে দড়িটা ভালোভাবে লাগালাম। একটা চেয়ার আনতে গেলাম পাশের রুম থেকে। তখনই দরজায় কড়া পড়ল। আমি মিথি এসেছে ভেবে খুলতে গেলাম। কিন্তু পরক্ষণেই আমি যে মরে যাওয়ার জন্য তৈরি হচ্ছি সেটা মনে পড়ল। দরজায় কড়া আরও বেড়ে গেল। বাহির থেকে একটা চেনা কণ্ঠস্বর। রহমত সাহেব ডাকছেন- "করিম ভাই!!  ঘরে আছেন? তারাতারি আসেন। অনেক বড় ঘটনা ঘটে গেছে। " আমি জীবনের শেষ সময়টায় কারো সাহয্য করার জন্য এগোলাম। দরজা খুলতেই লোকটা আমার হাত ধরে নিচতলায় নিয়ে এলো। এসে দেখি আমার বাসার নিচে যে ছেলেটা থাকত তার লাশ ঝুলছে সিলিখ ফ্যান থেকে৷ তার মধ্যে যেন আমি নিজেকে খুজে পেলাম। নিজের ৩৩ বছরের জীবনে আমি এত বিভৎস লাশ কখনও দেখিনি৷ গলার দড়িটা যেন ছিড়ে চলে আসতে চাইছে। গলার ভিতর  থেকে  জিভটা যেন একহাত বের হয়ে এসেছে। চোখের মণি খোলা। হয়তো শেষের মিনিটে কাউকে দেখার জন্য চোখটা চেয়ে ছিল ওভাবে। হয়তোবা আর ৫ মিনিট পরে রহমত সাহেব ডাকতে আসলে আমারও একই দশা হতো। আমার চেহারাটাও হয়তো ওমন ফ্যাকাশে হয়ে যেত। লাশটা পা জড়িয়ে অঝোরে কেদে চলেছে তার বিধবা মা। গা থেকে তার শাড়ি নেমে যাচ্ছে। সেই কান্নাভেজা মুখে তিনি চিৎকার করে শুধু বারবার বলছেন -" ও মানিক! মানিকরে!  কেন করলি এমন??মানিক!!"

রহমত সাহেব বললেন - "আহারে, মায়ের মুখটাও দেখে যতে পারল না ছেলেটা। কি এমন হয়েছিল যে আত্মহত্যার পথ বেছে নিল? বুঝলেন ভাই, হতাশা জিনিসটা এমনই। ভওতরে ভিতরে কুড়ে কুড়ে খাবে৷ আর একদিন আপনি দেখবেন যে আপনার আর কিছুই বাকি নেই এ জীবনে। তখন জীবনটাকে একেবারে তুচ্ছ মনে হবে। মনে হবে আমি শেষ মানে সমস্যাও শেষ। হায়রে খোদা। "

রহমত সাহেবের কথাগুলো আমার মনে আঘাত হানল। আমি ডাগর ডাগর চোখে রহমত সাহেবের মুখের দিকে তাকিয়ে রইলাম। "আমি যাচ্ছি।" বলে রুমে চলে আসলাম। খাটে বসতেই সামনে থাকা মিথি আর কণকের ছবি দুটো পাশাপাশি দেখলাম। কণকের মরার সময় সে একটাই কথা বলেছিল -"আমাদের মেয়েটাকে ছেড়ে কখনো কোথাও যেও না। ওকে আগলে রেখো। বুঝতে দিও না যে আমি নেই। "

সিলিং থেকে ঝুলে থাকা দড়িটা আমার শরীরে বারবার ছোট ছোট ধাক্কা দিচ্ছে। বোধহয় ও আমার মৃতদেহটাকে ঝুলাতে চায়। 

আমি  পরক্ষনেই কিছু না চিন্তা করে পাশে রাখা স্টিলের ময়লার দানিটা সামনে নিয়ে এলাম। খাটে উঠে দড়িটা খুলে রাখলাম ওটার ভিতরে। আর রান্নাঘর থেকে দিয়াশলাইটা নিয়ে এসে স্টিলের দনিটার ভিতরে থাকা দড়িটায় আগুন লাগিয়ে দিলাম। ধীরে ধীরে আগুনটা ছেয়ে যেতে লাগল পুরো দনিটাতে। পাশে থাকা ফোনে ঘন্টা বেজে উঠল আমার। দেখি আননোউন একটা নাম্বার। আমি ধরতেই ওপাশ থেকে একজন বলল-"কঙ্গরাচুলেশন। আপনি আজকের ইন্টারভিউতে সিলেক্ট হয়েছেন। আজ অনেক লোক হওয়ায় আমরা ঠিক করি রেজাল্ট পরে জানাবো। তবে অন্যদের ইন্টারভিউয়ের তুলনায় আপনারটা আমাদের সকলের কাছে ভালো লেগেছে। আপনি চাকরিটা পেয়ে গেছেন অনেকটা ভাগ্যের জোড়েই। অন্যান্যদের মধ্যে কেউই ভালো মতো কিছু বলতে পারেনি। তাই আমরা আপনায় জবটা দেওয়ার জন্য ডিসিশন নেই। কাল সকালে চলে আসবেন সময়মতো ঠিকাছে? হ্যালো? হ্যালো?"

আমি হতবাক হয়ে যাই মুখ দিয়ে আমার আর কোনো শব্দ বের হয় না। পাশে আগুনে জ্বলন্ত দড়িটার দিকে শুধু তাকিয়ে থাকি। 




ডাইরিটা শেষ করে উঠে বসলেন মি. করিম চৌধুরী। আজ তিনি "মাইলস স্টোন" নামের দেশের শীর্ষ এক কোম্পানির মেনেজিং ডিরেক্টর। সামনে বসে থাকা লোকগুলো তার গল্প শুনে অবাক হয়ে আছে। কারো খুখ দিয়েই কোনো শব্দ বরুল না। শুধু ১,২,৩ করতে করতে পুরো অডিটোরিয়ামের লোকগুলো দাঁড়িয়ে করতালি দিতে থাকল। করিম চৌধুরী তার জীবনে শুধু দুটো পৃষ্ঠা ডাইরি লিখেছেন৷ কারণ তার পরের জীবনটা ছিল আনন্দের। যা কিনা ডাইরির পাতায় কলমের কালি দিয়ে তুলে ধরা যাবে না। তাই এই দুই পাতার ডাইরিটা করিম সাহেবের জীবনের এক কালো অধ্যায়ের সমাপ্তির চিঠির চিহ্ন ছাড়া কিছুই না। আজ দীর্ঘ  ১৬ বছর পরে এই ডাইরির দুটো পৃষ্ঠা তিনি আবারও দেখলেন। তবে এবারের চাহনিতে ছিল না কোনো হতাশা, ছিল না কোনো কষ্ট, ছিল না কোনো দুঃখ-বেদনা। ছিল শুধুই উজ্জ্বল দুটি চোখের শান্ত আর সফলতার গর্বে গর্বিত চাহনি। 

 | Kathamala - read, write and publish story, poem for free in hindi, english, bengali

  • Pen Name -
  • 2 years ago
Comments

To comment on content, please Login!

Comments & Reviews (0)

No comments yet :(