গাড়িটা ধুপছায়ার সামনে ব্রেক করতেই মায়ের গম্ভীর মুখের দিকে একবার তাকিয়েই অতনু নেমে গেল কোন কথা না বলেই। ডিগি থেকে ট্রাভেল ব্যাগ আর বইয়ের ব্যাগটা ড্রাইভার সলিম মামা বড় গেইট পার হয়ে দারোয়ান নিয়াজ মামার সামনে রাখলো। একটু ঝিমুনি এসেছিল বোধ হয় নিয়াজের টুলে বসে বসে। ব্যাগটা রাখতেই কারো উপস্থিতি টের পেয়ে তড়াক করে উঠে দাঁড়ায় নিয়াজ। অতনু পায়ে পায়ে এগোয় গেইট পেরিয়ে বাগান ডিঙিয়ে একেবারে লিফটের সামনে এসে এগারো নাম্বারে চাপ দেয়। আর কান দুটো খাড়া করে রাখে মার গাড়িটি হর্ন বাজিয়ে অতনুর ছোট্ট বুকটায় মোচড় দিয়ে চলে গেল কিনা। ততক্ষনে নিয়াজ মামাও লাগেজ ব্যাগেজ নিয়ে হাজির।
তরতর করে উঠে গিয়ে লিফটের দরজা খুললো একেবারে এগারোতলায়। নিয়াজ মামার সাথে সাথে অতনু গিয়ে দাঁড়ায় সামনের ঝকঝকে তকতকে রকমারি পাতাবাহারের তেল চুকচুকে রঙা সারিবাঁধা টবগুলির কাছে। প্রতিবারের মত কলিং বেলটা টিপতেই আজ দরজায় নেই বাবা।দরজাটা ভেতর থেকে খুলে কেউ একজন শুধু বললো,
নিয়াজ, ব্যাগগুলো ঘরে তুলে দিয়ে যেও।
অতনুর মনটাই খারাপ হয়ে গেল। নিশ্চয় বাবা কোন জরুরী কাজে বেরিয়ে গেছেন, ফোন করেইতো বের হলাম। নইলে প্রতিবারের মত এতক্ষনে হৈ হৈ করে বলতেন,
--আরে আরে আমাদের অতনু সাহেব যে।
তারপর হেসে বুকে বুক মিলাতেন একটুখানি ঝুঁকে। তারপর চোখ বড় করে বলতেন , এবারতো দেখি আরও মস্ত বড় হয়ে গেছে আমার বাবাটা।
অতনু বাসায় ঢ়ুকে ওর ঘরটার জানালায় গিয়ে উঁকি দেয়। নাহ্ নেই। সমুদ্র নীল গাড়িটা এত উঁচু থেকেও দূরের রাস্তার কোথাও দেখা যাচ্ছে না। মাকে নিয়ে গাড়িটা এখন ছায়ানিড়ের দিকে ছুটে চলেছে। হ্যাঁ মার বাড়ি এখন ওটাই। অথচ কবছর আগেও মা বাবা আর অতনু সবার একটাই ঠিকানা ছিল ধুপছায়া। সেই ধুপছায়া এখন বাবা আন্টি আর তুতুনের। অতনুর ঘরটা অবশ্য তেমনি আছে শুধু ছড়ানো ছিটানো খেলনার বদলে সিঙ্গেল বেডের পাশে পড়ার টেবিল চেয়ার ঢুকেছে। ঢুকবে নাইবা কেন। এখন যে অতনু স্কুলের ক্লাশ থ্রির ছাত্র। কত কত বই খাতা জ্যামিতি বক্স ক্যালকুলেটর ওর টেবিল জুড়ে থাকে এখন। তাতে কি। ক মাস পরপর পাততাড়ি গুটিয়ে ধুপছায়া থেকে ছায়ানীড় আবার ছায়ানীড় থেকে ধুপছায়া। প্রথমটায় ভেবেছিল ভালইতো। তখন অতনু আরও ছোট, সবে স্কুলে যাওয়া আসা শুরু করেছে । কদিন থেকে বাবা মাকে কেমন যেন অচেনা লাগে। কখন খায়,ঘুমায়, অফিস যায়। টিভি দেখা , পেপার পড়া কিছুই যেন হয় না আর বাড়িতে। জাহেরা বুয়াও বকবক করে না আগের মত। শুধু সময়মত ঘুম খাওয়া গসুল করিয়ে দেয় আর বলে, মায়ের ঘরে এখন যেও না, মাকে বিরক্ত করো না। গেলে মার ডিস্টার্ব হবে, মা রাগ করবে। অতনু লক্ষী ছেলের মত তাই করেছে। ভেবেছে আগের মত মায়ের অফিসের বড় সাহেব আসবেন বুঝি। তাই একগাদা ফাইল নিয়ে মা নিশ্চয় ঘরে বসে কাজ করছেন। ফুরোলেই মা বাইরে ঘুরতে নিয়ে যাবেন, খাওয়াবেন সবাইকে। বাবা অবশ্য অতনুকে ফাঁকে ফাঁকে এসে নতুন খেলনা, চকোলেটের বক্স হাতে ধরিয়ে দিয়ে কপালে চুমু খেয়ে বলেছেন,জাহেরা বুয়ার কাছে লক্ষী হয়ে থাকতে । অতনু মাথা কাত করে সায় দিয়ে নতুন পাওয়া খেলনা গাড়ির রিমোট কন্ট্রোল চাপা নিয়ে ব্যস্ত থেকেছে।
হঠাৎ করে সেদিন বাবা এবং মা দুজনেই অফিস ছুটির আগেই বাসায় ফিরলেন । বাবা প্রতিদিনের মত অতনুর কপালে চুমু দিয়ে বললেন না, আমার সোনা বাবাটা। নিরবে এবং নিঃশ্চুপে ঘরে গিয়ে ঢ়ুকলেন। মার পিছে পিছে ড্রাইভার সলিম মিয়াও এলো। ঢাউস সুটকেশ দুটো টেনে নিয়ে গেল গাড়ির ডিগিতে ওঠাতে নিশ্চয়। জাহেরা বুয়া আঁচলে চোখ মুছে অতনুর জামা কাপড়ের ব্যাগটা হাতে নিয়ে ডাকলো, চলেন অতনু ভাই আপনেরে গাড়িতে দিয়া আহি।
অতনু বুয়ার হাত ছেড়ে একছুটে মার চুপচাপ দাঁড়ানো হাত দুটিকে ঝাঁকিয়ে বললো---মা, নানু বাড়ি যাচ্ছি নাকি সেবারের মত নীলগিরি? আমরা কি এবার অনেক দিন ঘুরবো মা?
মা জবাব না দিয়ে ছোট্ট হাতটা চেপে ধরলেন সজোরেই।
তারপর থেকে জীবনের পট বদলে যেতে লাগলো দ্রæত। মার ফ্লাট ছায়ানীড়ে বাবাহীন দিন যখন ছোট্ট দুহাতে ঠেলে পার করছিল অতনু ,তখনই জানতে পারলো খুব শিগগীরই সে বাবাকে পাবে তবে এখানে নয়, ধুপছায়া ফ্লাটে এবং মা ছাড়া। প্রথমটায় খাপছাড়া নিয়মগুলো চেঁচামেচি আর হাজারো প্রশ্ন মনে এলেও একসময় তা জীবনের অংশ হয়ে গেল অতনুর।
প্রথমবার যখন মা ধুপছায়ায় নামিয়ে দিয়ে গেলেন , বাবা র্কোট চুিক্ত অনুযায়ী বড় গেইটে অপেক্ষমান ছিলেন। অবশ্য মা বের হবার আগে নাম্বারটা কল করে অতনুর কানে ধরিয়ে দিয়েছিলেন। অতনু ওর ব্যাগ ব্যাগেজসহ নেমে যেতেই মার গাড়িটা অদৃশ্য হয়ে গেল রাস্তার ধুলো উড়িয়ে। বাবা একছুটে কাছে এসে কোলে তুলে নিয়ে আদরে আদরে ছোট্ট কচি মুখটা ভরিয়ে ফেললেন।
খোলা চত্বর, করিডোর আর লিফট পেরিয়ে বাবার কোল থেকে যখন নামলো অতনু,রাজ্যের বিস্ময় ওর দুচোখে। সেই ঘর সেই দোর অথচ কেমন যেন পাল্টে যাওয়া, অচেনা। শুধু জাহেরা বুয়া সেরকমই আছে। কোমরে আঁচল পেঁচিয়ে নিচ পাটির একটি শুন্য দাঁতের ফোকলা হাসিতে উচ্ছসিত হয়ে অতনুকে দেখে ছুটে এলো। ঠিক তখুনি মার ঘর থেকে কে একজন বেরিয়ে এলো মেরুন রঙা শাড়ি পরনে, কপালেও মেরুন টিপ, এলো চুলে কে ও?
মুখে হাসির আভা ছড়িয়ে বললো,
---অতনু নিশ্চয়।
জাহেরা বুয়া কলকল করে বলে চলে, হ আম্মা, আমগো অতনু ভাই। আর অতনু ভাই, এই হইলো তোমার নুতন মা।
বাবা বিরক্ত হলেন । বললেন, জাহেরা কি শুরু করলে আসতে না আসতে? বাবুকে ওর ঘরে নিয়ে নতুন খেলনাগুলো দেখাও।
অতনুর ছোট্ট মনটা একসময় সবটুকু বুঝে যায়। মাস গড়ায়, বছরও। ধীরে ধীরে চারপাশ থেকে নিজেকে সবার চেয়ে আলাদা মনে হতে লাগলো। গুটিয়ে নিল একটু একটু করে। সারাটাক্ষন কে কি কেন জানতে চাওয়া মনটা বুকের অনেক গহীনে চাপা পড়ে গেল যেন এক জগদ্দল পাথরের তলায়। নির্বাক স্থির চাহনিটা অন্তরে ততটাই এলোমেলো হলো আর হলো অস্থির চঞ্চল।
বাহিরের নির্বাক নয়ন দেখে চলে ঘটনার ঘনঘটা। ক্যালেন্ডারের দিন ক্ষন হিসেবে ধুপছায়া থেকে ছায়ানীড়ে আসে অতনু বাবার সাদা রঙ গাড়ি থেকে আবার ছায়ানীড় থেকে ধুপছায়া আসে মায়ের সমুদ্র নীল গাড়ি চড়ে। কিন্তু অন্তরের হাহাকার দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হয় দুই গাড়ির গতির চেয়ে অনেক অনেক গুন বেশি।
অতনু যখন তার আজন্ম চেনা বাড়িটায় মায়ের পরশ ছোয়া খাট আলমীরা ড্রেসিং টেবিল কিচেন ডাইনিং ঝুল বারান্দার এক ফালি বাগান , ঘরের সামনের লম্বা করিডোরের সারিবাঁধা গাছগুলোর পাশে নতুন আন্টিকে দেখে ভাল লাগে না, কিছুতেই ভাল লাগে না। বুকের ভিতর কষ্টের এক রাগী পাখি ভীষন ভীষন জোরে ডানা ঝাপটায়। আবার ছায়ানীড়ে মায়ের শুন্য বাড়িটার হাতছানিতে পরেরবার যখন ছুটে যায় দেখলো সেখানেও অচেনা দৃশ্য। সেবার দেখা হয়ে যায় ছায়া নামের বদমেজাজি মেয়েটির সাথে। ছায়ার বাবা মেয়ের নামেই বহুতল ভবনটির নামকরন করেছেন। ছায়ার মা মারা যান ছায়ার যখন ছয় বছর বয়স। কোলে পিঠে এতকাল মানুষ করার পর অফিস কলিগের অশান্তিময় কাহিনী শুনতে শুনতে নিজের একাকিত্বের অসহায়ত্ব অনুভব করে মন দেয়া নেয়ার এক পর্যায়ে নিরাশ্রয় অতনুর মাকে বিয়ে করে নিজ বাড়িতে আশ্রয়ের পাকাপোক্ত ব্যবস্থা করেন। ছায়াকে মানসিকভাবে তৈরি করতে দেশ বিদেশ ঘুরে ফিরেছেন সম্প্রতি। কিন্তু
কলেজ পড়ুয়া ছায়া নিজ বাড়িতে বাবার দ্বিতীয় স্ত্রীকে মেনে নিতে বাধ্য হলেও উটকো অতনুকে মানতে নারাজ। ছোট্ট অতনু ছায়ার তাচ্ছিল্য আর অকারন দুর্ব্যবহারে অতিষ্ট হয় পদে পদে। নতুন আংকেল সমঝোতা করে বলেন,
------অতনু, এত রাগ করলেতো চলবে না। মিলেমিশে থাকতে হবে দু ভাইবোনে। ছায়ার মা নেই, মা পেয়েছে। তোমারও বাবা -----
----আমার বাবা আছে, নিজের অগোচরে যেন চেঁচিয়ে ওঠে অতনু।
মা ছুটে আসেন। একতরফাভাবে অতনুকেই দায়ী করে বেয়াদবির দায়ে।
ধুপছায়ার ছোট্ট ঘরটির জন্য তখন ছটফট করে অন্তর অতনুর। মান অভিমানের মাথা খেয়ে সেখানে যাওয়ার কথা বলতেই মা অসন্তোষ প্রকাশ করে বললেন, মায়ের জন্য একটুও মায়া নেই অতনুর। শুধু বাবা আর বাবা ।
অবশেষে চুক্তির সময় ঘনালো। অতনু পৌঁছুলো ধুপছায়ায়। ছোট্ট ঘরের ছোট্ট টেবিলটায় ব্যাগের বইগুলো রাখতে গিয়ে অবাক হলো। এসব কার? এখানে কেন?
এমনি সময় নতুন আন্টি এসে এতগুলো বেবী লোশন ক্রিম এবং তুলতুলে পুতুল কয়টা টেবিলে রাখতে রাখতে বলেন, এই গ্যান্জামের মধ্যে আবার বই বের করছো কেন অতনু?
অতনুর হাত দুটো থেমে যায়। বুকের মাঝখানটায় কিসের যেন ধাক্কা লাগে। বইগুলো ওভাবে ফেলেই বেরিয়ে যায় । পেটটা কেমন খালি খালি লাগছে। ক্ষিদে পেয়েছে খুব। জাহেরা বুয়া কই? আসাবধি দেখা হয়নি তো এতক্ষন। কিচেনের কাছে আসতেই জাহেরা বুয়া চেঁচিয়ে ওঠে, অতনু ভাই রান্নাঘরে আইয়েন না। তুতুন বাবুর ফিডার জাল দিতাসি, গরম পানি ছিটা পড়বো।
অতনু দাঁড়িয়ে পড়ে, বিস্ময় মাখা কন্ঠে জিজ্ঞেস করে, তুতুন কে?
জাহেরা বুয়া ব্যস্ত হাতেই চোখ না তুলেই আনন্দে গদগদ হয়ে বলে, এখনতক দেখেন নাই বুঝি? যান শিগগীর ঘরে যান, আপনের ভাইরে দেহেন গিয়া।
অতনু মা চলে যাবার পর নতুন আন্টির ঘরে কখনো যায়নি। নিজ ঘরের দিকে পা বাড়াতে গিয়ে বাবার কন্ঠ কানে আসে ওঘর থেকে। ছোট্ট ছোট্ট পায়ে বাবার ঘরের দরজায় গিয়ে ডেকে ওঠে সেই পিচ্চিকালের মত করে, বাবা ওবাবা।
বাবা খুব ধীর পায়ে এগিয়ে আসেন ঘরের মাঝখানটায়। কোলে তোয়ালে মুড়ানো তুতুন। ওকে ঘুম পাড়াতে গিয়ে গলদঘর্ম বাবা ঠোঁটে তর্জনি চেপে ফিশফিশ করে বলেন, শশশশ্ আস্তে কথা বলো। তুতুনকে ঘুম দিচ্ছি। তুমি বরং তোমার ঘরেই যাও, ওখানে খেলা করো।
অতনু চটজলদি ঘুরে দাঁড়ালো। ওর চোখযে ভরতে শুরু করেছে লোনা পানিতে। তার একার বাবাটা এখন তুতুনের? তাও আবার তারই চোখের সামনে বাবার পুরো বুক জুড়ে পরম মমতায় আগলে রেখেছেন বাবা স্বয়ং। ওর দুচোখ ভরা পানি উছলে পড়লে মুছিয়ে দেবার কেউ নেই এখন। এত বেশি টুইটুম্বুর পানি যে ছোট্ট এতটুকুন বুকটা ভিজে গেলে অতনু পুরোটাই ডুবে যাবে ।ছোট্ট ছোট্ট পদক্ষেপে এগোয় অতনু। কোথায়,কার কাছে. কোন দিকে যেতে হবে, জানে না অবুঝ আর কঠিন নিয়তির কবলে পতিত অতনু ।
******
Comments & Reviews (0)
No comments yet :(