দ্যা ব্লু
ট্রেনের
রহস্য
আগাথা ক্রিস্টি
অনুবাদ : অভিজিৎ নাথ
চ্যাপ্টার ১
সাদা চুলের লোকটা
প্রায় মাঝরাতে একটি লোক প্লেস দে লা কংকার্ডে পেরিয়ে
যাচ্ছিলো। তার রোগা পাতলা চেহারার ওপর একটা দুর্দান্ত চামড়ার কোট চাপিয়ে রাখলেও, কোথাও যেন তার মধ্যে থেকে একটা দুর্বলতা বা হীনমন্যতার আভাস
পাওয়া যাচ্ছিলো।
সে একজন ছোট খাটো চেহেরার
মানুষ, লোকটার মুখটা অনেকটা ইঁদুরের মতো। তাকে দেখলে কারোরই মনে হবে না যে এ লোক কোনদিনও
কোনো গুরুত্ব পূর্ণ কাজ করেছে, বা কোনো গুরুত্ব পূর্ণ পদ
সামলেছে। কিন্তু লোকে ভাবতেও পারবে না যে, ওনাকে দেখে যা মনে তা
একদমই ভুল ও বিভ্রান্তিকর। কারণ দেখে ওনাকে তুচ্ছ বা সাধারণ মনে হলেও এই পৃথিবীর
ভবিষ্যতের জন্য কিন্তু উনি একটি উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করেছেন। যে রাজত্বে
ইঁদুরেরা রাজত্ব করে উনি সেই রাজত্বে রাজা ছিলেন।
এই মুহূর্তে একটি দূতাবাস
উনি কখন ফিরবেন তার অপেক্ষায় আছে। কিন্তু ওনাকে আগে ওনার কাজটা সারতে হবে - যে কাজের ব্যাপারে দূতাবাস সরকারি
ভাবে কিছুই জানে না। চাঁদের আলোয় ওনার মুখটা বেশ চকচক করছিলো ও ধারালো লাগছিলো।
পাতলা নাকে সামান্য বেঁকা ভাব আছে। ওনার বাবা ছিলেন একজন পোলিশ ইহুদি, শোনা যায় তিঁনি একটা দর্জির দোকানে দিনপ্রতি পারিশ্রমিকে কাজ করতেন। এই পেশা, যা তার বাবার সপ্ন ছিল,
তাকে আজ এই বিদেশের মাটিতে নিয়ে এসেছে।
তিঁনি সেইন এর পারে এলেন, নদী পেরোলেন,
এবং প্যারিসের একটি পাড়ায় ঢুকলেন যেটা খুব একটা নামকরা নয়।
তিঁনি একটি উঁচু,
ভাঙাচোরা, পুরোনো বাড়ির সামনে এসে
দাঁড়ালেন,
তারপর পাঁচ তলায় একটা এপার্টমেন্টের সামনে পৌঁছলেন। দরজায়
টোকা দিতে যাবেন এমন সময় একজন মহিলা দরজাটা খুলে দাঁড়ালো যেন তাঁর জন্যই এতক্ষন
অপেক্ষা করছিলো। মহিলা তাঁকে কোনো সম্ভাষণ না জানিয়ে তাঁর ওভারকোটটা খুলতে সাহায্য
করলো এবং ওনাকে একটি বসার ঘরে নিয়ে এলো। বসার ঘরটি সব সস্তার আসবাব দিয়ে সাজানো।
ইলেকট্রিক আলোটা এক
ফেকাসে নোংরা লাল রং এর ফেস্টুন দিয়ে ঘেরা ছিল, কিন্তু সেই অনুজ্জ্বল
আলোটাও মেয়েটির মুখে একটা কাঁচা রঙের মুখোশ থাকা সত্ত্বেও মুখটা লোকাতে পারছিলো না। তার মঙ্গোলিয়ান ধাঁচের মুখাকৃতিও লোকানো যাচ্ছিলো না।
ওলগা দেমিরফ এর পেশা, বা তার নাগরিকত্ত নিয়ে কোনো সন্দেহই ছিল না।
"সব ভালো তো?"
"সব ভালো, বরিস ইভানোভিচ।"
তিঁনি বিড়বিড় করে মাথা
নাড়তে নাড়তে বললেন "মনে হয় না আমাকে কেউ ফলো করেছে বলে।"
কিন্তু গলার স্বরে একটা
উৎকণ্ঠা ছিলই। তিঁনি জানলার কাছে গিয়ে পর্দাটা অল্প সরিয়ে একটু উঁকি দিয়ে দেখতে
গেলেন। জানলা দিয়ে তাকিয়েই তিঁনি ছিটকে সরে এলেন।
"দুটো লোক - উল্টো
দিকের ফুটপাথে,
আমার মনে হয় -"
তিঁনি দাঁত দিয়ে নখ কাটতে
লাগলেন - উত্তেজিত হলে এটাই তাঁর অভ্যেস।
রাশিয়ান মেয়েটি তাঁকে
আশ্বস্ত করার জন্য ধীরে ধীরে মাথা নাড়তে লাগলো।
"আপনি আসার আগে
থেকেই ওরা ওখানে ছিল।"
"সে যাই হোক, আমার মনে হচ্ছে ওরা এই বাড়ির দিকে নজর রাখছে।"
"হতে পারে "
মেয়েটি ঠান্ডা গলায় বললো।
"তাহলে -"
"তাহলে কি? ওরা যদি জেনেও থাকে - ওরা এখান থেকে অন্তত আর আপনাকে ফলো করবে না।" তার
মুখে একটা মৃদু নিষ্ঠুর হাসি খেলে গেলো।
"না, এটা ঠিক।" তিঁনি স্বীকার করে নিলেন।
তিঁনি এক দু মিনিট একটু
ভেবে নিলেন আর তারপর বললেন।
এই সাংঘাতিক আমেরিকানটি -
তিঁনি নিজের এবং অন্যেরও সুরক্ষার দায়িত্ব নিতে পারেন।"
"আমারও তাই মনে হয়।"
"কঠিন মক্কেল, ভয় হয় পুলিশের সাথেও বোধয় সাঁঠ আছে। তা ভালো,
উত্তর আমেরিকান গুন্ডা ভাইদের জন্য শুভ শিকারের কামনা করি।"
তিঁনি চাপা গলায় হাসতে হাসতে বললেন।
ওলগা দেমিরফ তাঁর মাথাটা
নাড়লেন।
"এই আমেরিকানটি যদি
সত্যিই সেই রকমের লোক হয়,
যা ওনার সম্পর্কে শোনা যায়, তাহলে ওনাকে কাবু করতে দুই এর বেশি এই ধরণের কাপুরুষ উত্তর আমেরিকান গুন্ডা
লাগবে।"
মেয়েটি কিছুক্ষন চুপ করে
থেকে বললো "আমি ভাবছি -"
"কি?"
"না কিছু না, আজ বিকেলে একটা লোক দু দুবার এই রাস্তা দিয়ে গেছে - একটা সাদা রঙের চুলের
লোক"
"তাতে কি?"
"ঘটনা হলো যে, লোকটা যখন এই দু জনের সামনে দিয়ে যাচ্ছিলো তখন তাঁর গ্লাভসটা পরে যায়। একজন
সেটা তুলে ওনাকে ফেরত দেয়। অতি সাধারণ একটা গ্লাভস।"
"তুমি কি বলতে চাও -
ওই সাদা চুলের লোক টা এদের নিয়োগকর্তা।"
"ওই রকম কিছু একটা।"
রাশিয়ান লোকটি কে
উত্তেজিত ও আতংকিত লাগছিলো।
"তুমি নিশ্চিত তো -
পার্সেল টা ঠিক আছে?
এটা নিয়ে কোনো ঘাঁটা ঘাঁটি হয় নি? এটা নিয়ে কিন্তু প্রচুর কথা শোনা যাচ্ছে - নানারকম কথাবার্তা।"
তিঁনি আবার দাঁত দিয়ে নখ
কাটতে লাগলেন।
"আপনি নিজেই একবার
দেখে নিন না।"
সে কয়েকটা কোচকানো খবরের
কাগজ এর বল এর তলা থেকে নোংরা খবরের কাগজ দিয়ে মোরা আয়াতকার একটা বাক্স লোকটার
হাতে তুলে দিলো।
"সত্যি জবাব নেই," তিঁনি প্রশংসা করে বললেন।
"এই এপার্টমেন্টটা
দু বার সার্চ হয়েছে। বিছানার গদিটা চিরে ফালা ফালা করেছে।
"একথা তো আমি আগেই
বলেছিলাম,"
তিঁনি বললেন "এটা নিয়ে অনেক রকম কথা শোনা যাচ্ছে। এই
দাম নিয়ে দর কষা কষি - এটা উচিত ছিল না।"
সে খবরের কাগজ টা খুললো, ভেতরে একটা ছোটো ব্রাউন পেপার এর বাক্স। সেটাও খুললো ভিতরে যা আছে তা ঠিকঠাক
আছে কিনা একবার দেখে নিলো,
তারপর আবার আগের মতো কাগজ দিয়ে মুড়ে দিল। এসবের মধ্যেই, জোরে,
একটা ইলেকট্রিক বেল বেজে উঠলো।
ঘড়ির দিকে আড়চোখে তাকিয়ে
ওলগা বললো "আমেরিকানটি একদম ঠিক সময়ে এসেছে।"
সে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলো।
কিন্তু এক মিনিট এর মধ্যে একজন অপরিচিত ভদ্রলোক কে নিয়ে ফিরে এলো। লোকটির বড়ো সড়ো
চেহারা ও চওড়া কাঁধ দেখলেই তাকে ট্রান্সআটলান্টিক বলে মনে হয়।
তার ক্ষুরধার দৃষ্টি
ছুঁয়ে গেলো সবাই কে।
তিঁনি খুব ভদ্র ভাবে
জিজ্ঞেস করলেন। "আপনিই কি মিস্টার ক্রাসনিনে?"
"হ্যাঁ আমিই," বরিস বললেন। "আমি খুবই দুঃখিত দেখা করার জন্য এইরকম একটা অদ্ভুত
জায়গা ঠিক করার জন্য। কিন্তু গোপনীয়তাটা খুবই জরুরি। আমি মানে - আমি এ ধরণের কাজের
সঙ্গে নিজেকে একদমই জড়াতে চাই না।"
"তাই নাকি?" আমেরিকানটি খুব বিনীত ভাবে বললেন।
"আপনি আমাকে কথা
দিয়েছিলেন এই লেন দেন বিষয়ে কোনো কথাই জনসমক্ষে আসবে না। ঠিক কিনা? বিক্রির জন্য এটা অন্যতম শর্ত ছিল।"
"এ ব্যাপারে তো আমি
আগেই আমার সম্মতি জানিয়েছি।" তিঁনি উদাস ভাবে বললেন "এবার জিনিসটা দিন।"
"আপনি টাকাটা এনেছেন, সব নোটেই তো?"
"হ্যাঁ" অন্যজন
জানালো।
তিঁনি কিন্তু টাকা বার
করার কোনো চেষ্টা করলেন না। একটু ইতস্তত করে ক্রাসনিনে টেবিলের ওপর ছোট বাক্সটার
দিকে দেখালেন।
আমেরিকানটি বাক্সটা নিলেন
ও যে সব কাগজ দিয়ে সেটা মোরা ছিল সেগুলো খুলে ফেললেন। বাক্সের ভেতরে যা ছিল সেগুলো নিয়ে তিঁনি ইলেকট্রিক আলোটার
কাছে গেলেন এবং খুব মন দিয়ে সেগুলো পরীক্ষা করতে লাগলেন। খুশি হয়ে, তিঁনি নিজের পকেট থেকে
একটা চামড়ার মোটা ওয়ালেট বার করলেন এবং তার থেকে এক তারা নোট বের করে রাশিয়ানটির
হাতে দিলেন,
রাশিয়ানটি সেগুলো নিয়ে সাবধানে গুনতে শুরু করলেন।
"সব ঠিক আছে?"
"আপনাকে ধন্যবাদ
মঁসিয়ে, একদম ঠিক আছে।"
"আঃ" বলে তিঁনি
ব্রাউন পেপার এর বাক্স টা অবহেলায় নিজের পকেট এ ঢুকিয়ে নিলেন। তিঁনি ওলগা কে একটা
বাও করে বললো "শুভ সন্ধ্যা মাদমোয়েজেল। শুভ সন্ধ্যা মিস্টার ক্রাসনিনে।"
তিঁনি বেরিয়ে গেলেন, যাবার আগে দরজাটা ভেজিয়ে দিয়ে গেলেন। ঘরের ভিতর দুজনে দুজনের চোখের দিকে তাকালেন। ভদ্রলোক নিজের জিবটা একবার শুকনো ঠোঁট এর ওপর বুলিয়ে নিলেন।
"আশঙ্কায় আছি, উনি কি আর নিজের হোটেলে ফিরতে পারবেন?" তিঁনি নিজের মনেই বললেন।
তাঁরা দুজনেই একসাথে
জানলার কাছে গিয়ে দাঁড়ালেন। ঠিক সেই সময় আমেরিকানটি বাড়ির ভিতর থেকে নিচের রাস্তায় বেরিয়ে এলো। সে একবারও
মাথা না ঘুরিয়ে বাঁ দিকে ঘুরে হাটতে থাকলো। দুটি ছায়া দরজার পাশ থেকে সরে গেলো এবং তাঁকে নিঃশব্দে ফলো করতে থাকলো।
অনুসরণকারী এবং অনুসরণ এর বস্তু দুপক্ষই রাতের অন্ধকারে মিলিয়ে গেলো।
"উনি নিরাপদেই ফিরবেন।"
মহিলাটি বললো "আপনাকে এ নিয়ে ভয় - বা চিন্তা কিছুই করতে হবে না।"
"তোমার কেন মনে
হচ্ছে উনি নিরাপদ?"
ক্রাসনিনে অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলেন।
" ওনার মতো লোক, যিনি নাকি, এতো টাকা রোজগার করতে পারেন, তিঁনি আর যাই হোক বোকা নন।" ওলগা বললো "আর টাকার কথাই যখন উঠলো -"
সে ক্রাসনিনের দিকে ভুরু কুঁচকে তাকালো।
"হ্যাঁ, বলো"
"আমার শেয়ারটা, বরিস ইভানোভিচ।"
কিছুটা অনিচ্ছুক ভাবেই
ক্রাসনিনে তাকে দুটো নোট এগিয়ে দিলো। সে অভিব্যক্তিহীন ভাবে মাথা ঝুকিয়ে ধন্যবাদ
জানালো ও নোট দুটো তার লম্বা মোজার ভাঁজে ঢুকিয়ে রাখলো।
"আমি খুশি " সে
সন্তুষ্টির সাথে মন্তব্য করলো।
ক্রাসনিনে মেয়েটির দিকে
অবাক চোখে তাকালো।
"তোমার কোনো দুঃখ
নেই, ওলগা ভাসিলভিনা?"
"দুঃখ, কিসের?"
"যে জিনিস তোমার
কাছে রাখা ছিল। মহিলারা - বেশিরভাগ মহিলাই আমার মনে হয় ওই জিনিসটার জন্য পাগল।"
সে মাথা নেড়ে জানালো যে এ
ব্যাপারে সেও একমত।
"হাঁ, আপনি ঠিক কথাই বলেছেন। অনেক মহিলার মধ্যেই এরকম পাগলামি আছে। আমার নেই। আমি এখন ভাবছি -" সে
হঠাৎ থেমে গেলো।
"ওগুলো এখন
আমেরিকানটির কাছে নিরাপদ - হাঁ, এ ব্যাপারে আমি নিশ্চিত।
কিন্তু পরে -"
"মানে? তুমি কি ভাবছো?"
"উনি ওগুলো অবশ্যই
কোনো মহিলাকেই দেবেন।" ওলগা একটু চিন্তিত ভাবেই বললো। "আমি ভাবছি তখন কি
হবে -"
সে অধৈর্য ভাবে পায়চারি
করতে করতে জানলার সামনে গিয়ে দাঁড়ালো। হঠাৎ সে অত্যন্ত অবাক হয়ে একটা চিৎকার করে সঙ্গী
ভদ্রলোককে ডাকলো।
"দেখুন দেখুন, উনি কোথাও যাচ্ছেন - মানে ওই লোকটা।"
তাঁরা দুজনেই নিচের দিকে তাকালেন। রাস্তা ধরে একটা রোগা মার্জিত চেহারার লোক ধীরে ধীরে হাটতে
হাটতে এগিয়ে যাচ্ছে। তার মাথায় একটা অপেরা হ্যাট ও গায়ে একটা চাদর। সে যখন রাস্তার
একটি আলোকস্তম্ভর তলা দিয়ে যাচ্ছিলো তখন সেই আলোয় তার মাথার গোছা গোছা ঘন সাদা চুল
উজ্জল হয়ে উঠেছিল।
চ্যাপ্টার ২
মঁসিয়ে লে মারকুইস
সাদা চুলের লোকটা তার
গন্তব্যের দিকে ধীরে সুস্থেই এগিয়ে যেতে লাগলো, আশপাশে কি হচ্ছে সেব্যাপারে
তার বিন্দুমাত্র ভ্রুক্ষেপ নেই। সে একবার বাঁ দিকের রাস্তায় ঢুকলো তারপর আবার ডান
দিকের রাস্তায় ঢুকলো। সে নিজের মনেই একটা সুর ভাঁজতে ভাঁজতে এগিয়ে চললো।
হঠাৎই সে থেমে গেলো আর
কান খাড়া করে শুনতে লাগলো। সে একটা নির্দিষ্ট শব্দ শুনতে পেয়েছে। এটা একটা টায়ার
ফাটার শব্দ হতে পারে অথবা - একটি গুলি চালানোর শব্দও হতে পারে। একটা অদ্ভুত হাসি তার ঠোঁটে খেলে গেলো। তারপর আবার সে আগের
মতো ধীরে সুস্থে হাটতে লাগলো।
একটা মোর ঘুরতেই সে একটা
দৃশ্যের সম্মুখীন হলো,
সেখানে কিছু ঘটনা ঘটেছে। একজন আইন-রক্ষক একটা পকেট-বুক এ
কিছু নোট নিচ্ছেন,
আর দু একজন পথ চলতি লোক যারা এতো রাতেও বেরিয়েছিল, ঘটনাস্থলের আসে পাশে দাঁড়িয়ে আছে। এই রকমই একজন লোকের কাছে সাদা চুল ওয়ালা
লোকটা খুব বিনীত ভাবে কি ঘটেছে জানতে চাইলো।
"এখানে কিছু একটা
হয়েছে, তাই না?"
"হ্যাঁ, মঁসিয়ে। দু জন উত্তর আমেরিকান গুন্ডা একজন বয়স্ক আমেরিকান ভদ্রলোক কে আক্রমণ
করেছিল।"
"উনি কি আহত?"
"না,না।" লোকটি হেসে উঠল "আমেরিকান ভদ্রলোকটির পকেটে একটি রিভলভার ছিল, লোক দুটি ওনাকে আক্রমণ করা আগেই উনি সেটা বার করে গুলি ছোড়েন, লোক দুটি ভয় পেয়ে পালিয়ে যায়। পুলিশ যথারীতি দেরিতে পৌচেছে।"
প্রশ্নকর্তা বললেন, "ওঃ,
তাই নাকি!"
তার মুখে কোনোরকম কোনো অনুভূতির
ছায়া পড়লো না। সে শান্ত,
উদ্বেগহীন ভাবে আবার তার নৈশ যাত্রা শুরু করলো। সে সেইন পার
হয়ে শহরের একটি উচ্চবিত্ত এলাকায় প্রবেশ করলো। আরো প্রায় মিনিট কুড়ি পরে, সে এক অভিজাত এলাকায়,
একটি বাড়ির সামনে এসে দাঁড়ালো।
দোকানটার নাম, হ্যা ওটা একটা সাদামাটা দোকানই ছিল। ডি. পাপপুলাউস, এন্টিকের ব্যাবসায়ী,
এতটাই বিখ্যাত যে তাঁর বিজ্ঞাপন দেবার কোনো দরকারই পরে না, আর অবশ্যই তাঁর বেশিরভাগ ব্যবসাই সামনাসামনি হয় না।
মঁসিয়ে পাপপুলাউস এর
নিজের একটা খুব সুন্দর বাড়ি আছে ঠিক চ্যাম্পস এলিসিস এর সামনেই, এই সময়ে ওনার ব্যাবসার জায়গার তুলনায়, ওনাকে সেখানে পাওয়ার
সম্ভাবনাই বেশি,
কিন্তু সাদা চুলের মানুষটি ওনাকে এখানে পাওয়ার ব্যাপারে
এতটাই আত্মবিশ্বাসী যে,
একবার চট করে নির্জন রাস্তার দু দিকে দেখে নিয়ে, একটা বেল,
এমন জায়গায় লাগানো যা চট করে চোখে পরে না, সেটা টিপে দিলেন।
তাঁর আত্মবিশ্বাস মিথ্যে
নয়। দরজাটা একটু খানি খুলে একজন মুখ বাড়ালো। তাঁর কানে একটা সোনার দুল কিন্তু মুখ
দেখে মনে হয় কর্মচারী স্থানীয়।
"শুভ সন্ধ্যা," আগন্তুক বললো "তোমার মালিক কি ভিতরে আছেন?"
কর্মচারীটি বেশ গম্ভীর
গলায় বললো "মালিক আছেন, কিন্তু রাতে এইসময় উনি যেকারুর
সাথে দেখা করেন না।"
"আমার মনে হয়, উনি আমার সাথে দেখা করবেন। ওনাকে গিয়ে বলো ওনার বন্ধু মঁসিয়ে লে মারকুইস
এসেছেন।"
লোকটি দরজাটা আরো একটু
খুলে দাঁড়ালো এবং আগন্তুক ভিতরে প্রবেশ করলেন।
মঁসিয়ে লে মারকুইস বলে
পরিচয় দেওয়া লোকটি সর্বক্ষন হাত দিয়ে নিজের মুখটা ঢেকে কথা বলছিলেন। যতক্ষনে
কর্মচারীটি এই বার্তা নিয়ে ফিরে এলো যে মঁসিয়ে পাপপুলাউস আগন্তুক এর সঙ্গে দেখা
করতে আগ্রহী ততক্ষনে কিন্তু আগন্তুক এর চেহারার মধ্যে একটা পরিবর্তন হয়েছে।
কর্মচারীটি হয়তো আগে খেয়াল করে নি বা তার প্রশিক্ষণ এরকমই যে সে এব্যাপারে কোনো
কৌতূহল প্রকাশ না করলেও,
আগন্তুক এর মুখ এখন একটা কালো সাটিন এর মুখোশে ঢাকা।
তাঁকে পথ দেখিয়ে নিয়ে
গিয়ে সে হল এর ওপর প্রান্তে একটি দরজার সামনে দাঁড়ালো, দরজাটা খুলে খুলে অতি সম্মানের সাথে ঘোষণা করলো "মঁসিয়ে লে মারকুইস।"
খুবই আকর্ষণীয় চেহারার
একজন ব্যাক্তিত্ব উঠে দাঁড়ালেন অতিথি কে অভ্যার্থনার জন্য। মঁসিয়ে পাপপুলাউস এর
চেহারায় এমন কিছু আছে যে তাঁকে দেখলেই একটা সম্মান ও শ্রদ্ধা জাগে। তাঁর কপাল চওড়া ও মুখে বেশ আকর্ষণীয় একটা দাড়ি আছে। তাঁর ব্যবহার অনেকটা একজন যাজকের মতো ও বিনীত।
" আসুন, আসুন হে আমার পরম বন্ধু," বললেন মঁসিয়ে পাপপুলাউস। গাঢ় গলায় একটা আবেগ মাখিয়ে, উনি ফরাসিতে বললেন ।
"আমি ক্ষমা চাইছি," অতিথি বললো "এতো রাতে বিরক্ত করার জন্য।"
"একেবারেই না, একেবারেই না,"
বললেন মঁসিয়ে পাপপুলাউস- "এটা তো রাতের একটা আকর্ষণীয়
সময়। মনে হয় আপনি একটা উত্তেজনা পূর্ণ সন্ধ্যাও কাটিয়েছো আজকে।"
"না, ব্যাক্তিগতভাবে নয় ।"
"ব্যাক্তিগতভাবে নয়," বললেন মঁসিয়ে পাপপুলাউস "ঠিকই তো, ঠিকই তো, তাহলে কোনো খবর আছে,
তাই তো?"
"কোনো খবর নেই।
আমাদের চেষ্টা বিফলে গেছে। যদিও আমি অন্যরকম কিছু আশা করি নি।"
"তা তো বটেই," বললেন মঁসিয়ে পাপপুলাউস "অন্য কোনো তাজা টাটকা খবর -"
তিঁনি তাঁর হাতটা এমন
ভাবে নাড়ালো যাতে বোঝা গেলো টাটকা জিনিসের প্রতি তাঁর একটা বিতৃষ্ণা আছে। মঁসিয়ে পাপপুলাউসের
মধ্যে কোনো টাটকা ব্যাপারই নেই, তাঁর ব্যবসাতেও কোনো
টাটকা জিনিস নেই। তিঁনি ইউরোপ এর বিভিন্ন রাজ্ দরবারে সুপরিচিত, এবং রাজারা তাঁকে বন্ধুত্বপূর্ণ ভাবে ডেমেট্রিয়াস বলে ডাকেন। বিচক্ষণ এবং
ব্যাক্তিত্বপূর্ণ বলে তাঁর একটা সুনাম আছে। এর সঙ্গে তাঁর অভিজাত দৃষ্টিভঙ্গি
তাঁকে অনেকগুলি খুবই সন্দেহজনক লেনদেনের দৃষ্টি এড়িয়ে যেতে সাহায্য করেছে।
"সরাসরি
আক্রমণ-" বললেন মঁসিয়ে পাপপুলাউস। মাথাটা একটু নাড়িয়ে "মাঝে মাঝে কাজে
দেয় - কিন্তু কদাচিৎ।"
"এটা সময় সাশ্রয়
করে।" সে বললো,
"আর ফেল করলেও কোনো লোকসান নেই - অথবা নেই বললেই হয়। অন্য পরিকল্পনাটা
- ব্যার্থ হবে না।"
"আঃ," বললেন মঁসিয়ে পাপপুলাউস। তার দিকে এক দৃষ্টে তাকিয়ে থেকে।
অপরজন একটু মাথাটা
নাড়ালো।
"আপনার সুনামের ওপর
আমার - ওই কি বলে -পূর্ণ আস্থা আছে," এন্টিক ব্যাবসায়ী বললেন।
"আমি অবশ্যই বলবো," সে বললো "যে আপনার এই আস্থা ব্যার্থ হবে না।"
"আপনার কাছে একটা
সুবর্ণ সুযোগ আছে।" অপর জন বললো, তার গলায় যেন একটা ঈর্ষার
সুর।
"আমি সুযোগ তৈরি করি," বললেন মঁসিয়ে লে মারকুইস।
তিঁনি উঠে দাঁড়ালেন ও
চেয়ার এর পেছন থেকে গায়ের চাদরটা তুলে নিলেন।
"আমি আপনাকে আমাদের
প্রচলিত উপায়ে খবর পাঠাতে থাকবো, আপনার দিক থেকে ব্যাবস্থায়
যেন কোনো ত্রুটি না থাকে।"
মঁসিয়ে পাপপুলাউস একটু
ব্যাথিত হলেন।
উনি অনুযোগের গলায় বললেন
"আমার ব্যাবস্থায় কখনো কোনো ত্রুটি হয় নি।"
অপরজন একটু হাসলেন, এবং কোনো রকম বিদায় সম্ভাষণ ছাড়াই দরজাটা পেছনে বন্ধ করে বেরিয়ে গেলেন।
মঁসিয়ে পাপপুলাউস তাঁর
সাদা যাজকের মতো দাড়িতে হাত বোলাতে বোলাতে কিছুক্ষন ভাবলেন, তারপর ঘরের দ্বিতীয় দরজাটির দিকে এগোতে লাগলেন, এই দরজাটা ভেতরের দিকে খোলে। দরজার হাতলটা ঘোরাতেই একটি অল্প বয়সী মেয়ে, যে নাকি দরজার কিহোলে কান লাগিয়ে ভেতরের কথা শোনার চেষ্টা করছিলো হুড়মুড় করে
ঘরের ভেতরে এসে পড়লো। এটা দেখে মঁসিয়ে পাপপুলাউস আশ্চর্যও হলেন না বা উদ্বিগ্নও
হলেন না। এটা যেন তাঁর কাছে এক অতি সাধারণ ঘটনা।
"তাহলে জিয়া ?" উনি জিজ্ঞেস করলেন।
"ওনার চলে যাওয়াটা
আমি শুনতে পাই নি,"
জিয়া ব্যাখ্যা করে বললো ।
যুবতী মেয়েটি বেশ সুন্দরী, তার শারীরিক গঠন একজন অভিজাত মহিলার মতো, তার উজ্জ্বল কালো চোখ
প্রমান করে মঁসিয়ে পাপপুলাউসের সঙ্গে তার চেহারার সাদৃশ্য, যে কোনো লোক দেখলেই বুঝতে পারবে যে তারা বাবা ও মেয়ে।
একরাশ বিরক্তি মাখিয়ে সে
বললো "কোনো মানে হয় না, একটা কিহোল দিয়ে কখনোই একসাথে
দেখতে ও শুনতে পাওয়া যায় না।"
"হ্যা আমিও মাঝে
মাঝে আশ্চর্য হয়ে যাই।" মঁসিয়ে পাপপুলাউস খুব সাধারন ভাবে জানালেন।
"তাহলে ইনিই হলেন
মঁসিয়ে লে মারকুইস,"
জিয়া আস্তে আস্তে বললো। "আচ্ছা বাবা, উনি কি সবসময় মুখে মুখোশ পরে থাকেন?"
"সবসময়।"
সে কিছুক্ষন চুপ করে
থাকলো।
"আমি ভাবছি, এটা কি রুবিগুলো নিয়ে?"
জিয়া জিজ্ঞেস করলো।
"আমার মনে হয়," জিয়া আস্তে আস্তে বললো,
"একজন অভিজাত ইংরেজ পুরুষের মুখে এতো ভালো ফরাসি খুবই
বিরল।"
"আঃ!" বললেন
মঁসিয়ে পাপপুলাউস "তাহলে তুমি এই বুঝলে।"
তাঁর মুখে কোনো ভাবান্তর
দেখা না গেলেও জিয়ার প্রতি তাঁর স্নেহ ফুটে উঠলো।
"এটাও মনে হলো," জিয়া বললো,
"যে ওনার মাথাটা যেন একটু অদ্ভুত ধাঁচের।"
"বিশাল," তার বাবা বলতে থাকলো - "অস্বাভাবিক রকমের বিশাল। তবে এই ধরণটা দেখা যায়
মাথায় কেউ পরচুলা পরে থাকলে।
তাঁরা দুজন দুজনের দিকে
তাকিয়ে হাসতে লাগলেন।
চ্যাপ্টার ৩
হার্ট অফ ফায়ার
রুফুস ভ্যান আলদীন, স্যাভয় এর রিভলভিং দরজাটা পেরিয়ে রিসেপশন ডেস্ক এর সামনে এসে দাঁড়ালেন।
ডেস্কের কর্মচারীটি তাঁকে হেসে স্বাগত জানালো।
"আপনাকে আবার দেখতে
পেয়ে খুবই খুশি হলাম,
মিস্টার ভ্যান আলদীন," সে জানালো।
আমেরিকান ধনকুবেরটি একটু
মাথা নাড়িয়ে সেই স্বাগতর প্রত্যুত্তর জানালেন।
"সব ঠিক আছে তো?" তিঁনি জিজ্ঞেসা করলেন।
"হ্যাঁ স্যার। মেজর নাইটোন
উপরে সুইটেই আছেন এখন।"
ভ্যান আলদীন আর একবার
মাথা নাড়লেন।
"কোনো চিঠি পত্র?" উনি জানতে চাইলেন।
"সেগুলো সবই উপরে
পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে মিস্টার ভ্যান আলদীন। ওঃ! এক মিনিট দাঁড়ান তো।"
সে পায়রার খোপের উপর ঝুকে
পড়লো, আর একটা চিঠি হাতে ঘুরে দাঁড়ালো।
"এই কিছুক্ষন আগেই
এটা এলো,"
সে জানালো।
রুফুস ভ্যান আলদীন তার
থেকে চিঠিটা নিলেন,
তিঁনি হাতের লেখাটা দেখলেন, মেয়েলি ছাঁদের টানা লেখা, এটা দেখেই তাঁর মুখে একটা
অদ্ভুত পরিবর্তন এলো। কঠিন চেহারাটা যেন নরম হয়ে গেলো, মুখের ঋজু রেখাগুলো মোলায়েম হয়ে এলো। তাঁকে একদমই অন্যরকম লাগছিলো। তিঁনি যখন
চিঠিটা হাতে নিয়ে লিফটের দিকে এগিয়ে যাচ্ছিলেন, ঠোঁটের কোনায় তখনো একটা
আলগা হাসি লেগেছিলো।
তাঁর সুইটের বসার ঘরে, একজন যুবক একটা ডেস্কে বসে চিঠি পত্র সাজাচ্ছিলো, তাকে দেখলে বোঝা যায় এব্যাপারে তার বেশ দক্ষতা আছে। ভ্যান আলদীন ঢুকতেই সে
তড়াক করে উঠে দাঁড়ালো।
"কি খবর, নাইটোন!"
"আপনি ফিরে এসেছেন
দেখে খুবই খুশি হয়েছি,
স্যার, সময় ভালো কেটেছে তো?"
"মোটামুটি!"
অনুভূতিহীন ভাবে ধনকুবেরটি জানালো। "প্যারিস তো আজকাল এক ঘোড়ার শহর। তবে -
আমি যেটার জন্য গিয়েছিলাম সেটা পেয়েছি।"
তিঁনি নিজের মনেই মৃদু
মৃদু হাসতে থাকলেন।
"আমি জানতাম, আপনি কখনো ব্যার্থ হন না।" সেক্রেটারিটি হাসতে হাসতে বললো।
তিঁনি খুব সাধারণ ভঙ্গিতে
কথা বলছিলেন,
কেউ যেন একটা অতি পরিচিত কোন তথ্যের বর্ণনা দিচ্ছে। তাঁর ভারী ওভারকোটটা ছুড়ে দিয়ে তিঁনি ডেস্কের কাছে এগিয়ে
গেলেন।
"কোনো জরুরি চিঠি
আছে?"
"আমার মনে হয় না, স্যার। সবই রোজকার চিঠি পত্র। তবে সব এখনো আমার গুছিয়ে ওঠা হয় নি।"
ভ্যান আলদীন মৃদু ভাবে
মাথাটা একবার ঝাঁকালেন। উনি এমন একজন মানুষ যে নাকি কোনো অভিযোগ বা প্রশংসা
কোনোটাই মুখে প্রকাশ করেন না। যাদের তিঁনি নিয়োগ করেন তাদের ব্যাপারে ওনার একটা
খুব সাধারণ পদ্ধতি আছে;
তিঁনি তাদের সবাইকে একটা যোগ্য সুযোগ দেন, অদক্ষদের তিঁনি সঙ্গে সঙ্গে বাদ দিয়ে দেন। তাঁর মানুষ নির্বাচন করার পদ্ধতিটি
একটু অন্যরকম।
নাইটোন এর কথাই ধরা যাক, নাইটোনের সঙ্গে ওনার এক সুইস রিসোর্টে আলাপ হয়েছিল মাস দুই আগে। ছেলেটাকে ভালো
লেগেছিলো,
তার যুদ্ধের রেকর্ডটা দেখে তার খুঁড়িয়ে হাঁটার কারণটাও
বুঝতে পেরেছিলো। নাইটোন তার কাছে কোনো কিছুই লুকোয় নি, সে যে একটা কাজের খোঁজে এ আছে একথাও জানিয়েছিল, এবং ধনকুবেরের কাছে নির্দ্বিধায় জানতে চেয়েছিলো যে তাঁর কাছে কোনো কাজের খোঁজ
আছে কিনা। তাকে এই মহান মানুষটির সেক্রেটারির পদেতে যোগ দেওয়ার কথা বলা হয়েছে একথা
জানার পর তার পুরোপুরি অবাক হয়ে ওঠা মুখটার কথা মনে পড়লেই, ভ্যান আলদীন এর মনটা একটা চাপা আনন্দে ভরে ওঠে।
"কিন্তু - আমার
ব্যাবসার ব্যাপারে কোনো অভিজ্ঞতা নেই।" সে তোতলাতে তোতলাতে বলেছিলো।
"এটা কোনো ব্যাপারই
না,"
ভ্যান আলদীন জানিয়েছিলেন। "এসব দেখার জন্য আমার আরো
তিন জন সেক্রেটারি আছে। কিন্তু আমাকে সম্ভবত আগামী ছয় মাস ইংল্যান্ডেই থাকতে হবে, আমি একজন ইংরেজ পুরুষ কে চাইছিলাম যার নাকি এখানকার আদব কায়দা সম্পর্কে
পরিচিতি আছে,
যে নাকি এখানে আমার সামাজিক দিকটাও সামলাতে পারবে।"
এখনো পর্যন্ত, ভ্যান আলদীন এর পছন্দ সঠিক বলেই প্রমাণিত হয়েছে। নাইটোন চটপটে, বুদ্ধিমান,
এবং করিৎকর্মা, এছাড়াও সবসময় তার মুখে
একটা হাসি যেন লেগেই আছে।
সেক্রেটারিটি ডেস্কের উপর
সাজানো তিন,
চারটে চিঠির দিকে নির্দেশ করে দেখালো।
"খুবই ভালো হয়, স্যার,
আপনি যদি এগুলোর ওপর একবার চোখ বুলিয়ে নেন।" সে
জানালো।"একদম উপরেরটা কোল্টন এগ্রিমেন্টের এর ব্যাপারে -"
কিন্তু, রুফুস ভ্যান আলদীন হাত তুলে মানা করলেন।
"আজ রাতে আমি কোনো
আজেবাজে জিনিস দেখতে পারবো না।" তিঁনি জানালেন। "কাল সকালেই সব দেখবো, শুধু এইটা ছাড়া,"
এটা বলে, নিজের হাতের চিঠিটির দিকে
তাকালেন। আর আবার সেই অদ্ভুত হাসিটি তার মুখে ছড়িয়ে গেলো।
রিচার্ড নাইটোন একটা
সহানুভূতির হাসি হাসলো ।
"মিসেস কেটারিং?" সে বিড়বিড় করে বললো। "উনি গতকাল এবং আজকেও ফোন করেছিলেন। আপনার সাথে এই মুহূর্তে দেখা করার জন্য উনি উদগ্রীব হয়ে
আছেন, স্যার।"
"তাই নাকি!
এখন।"
ধনকুবেরের মুখ থেকে
হাসিটা মিলিয়ে গেলো। উনি তাড়াতাড়ি হাতের খামটা ছিঁড়ে ভেতর থেকে কাগজটা বার করে
আনলেন। সেটা পড়তে শুরু করা মাত্র ওনার মুখ অন্ধকারে ঢেকে গেলো, এই গম্ভীর মুখটার রেখা গুলো ওয়াল স্ট্রিট খুব ভালো চেনে, আর ভুরুগুলো এক অশুভ সংকেতে বেঁকে গেলো। নাইটোন ওখান থেকে কায়দা করে সরে এসে, আবার চিঠি খুলতে ও সাজাতে লেগে পড়লো। একটা চাপা হুঙ্কার ধনকুবেরের মুখ থেকে
বেরিয়ে এলো,
হাতের মুঠিটি পাকিয়ে টেবিল এর ওপর সজোরে একটা ঘুসি মারলেন।
"এ সব আমি সহ্য করবো
না,"
তিঁনি নিজের মনেই বলতে থাকলেন, "ছোট্ট,
অসহায় মেয়েটা, একটাই ভালো যে ওর বুড়ো
বাবা এখনো ওর পাশে আছে।"
উনি ঘরের মধ্যে কিছুক্ষন
পায়চারি করতে থাকলেন,
ওনার ভুরু দুটি কুঁচকে একসাথে মিশে গেছে। নাইটোন তখনও ডেস্ক
এর উপর ঝুকে পরে একমনে কাজ করে যাচ্ছিলো। হঠাৎই ভ্যান আলদীন দাঁড়িয়ে পড়লেন। চেয়ার
থেকে নিজের ওভারকোটটা তুলে নিলেন, যেখানে ওটা আগে ছুড়ে
ফেলেছিলেন।
"স্যার,আপনি কি আবার বেরোচ্ছেন?"
"হ্যাঁ, আমি আমার মেয়ের সাথে দেখা করতে যাচ্ছি।"
"যদি কোল্টন থেকে
ফোন করে -"
"তাদের বোলো জাহান্নামে
যেতে।" ভ্যান আলদীন বললেন।
"ঠিক আছে।"
সেক্রেটারিটি নিচু স্বরে বললো।
ভ্যান আলদীন ততক্ষনে তাঁর
ওভারকোটটি পরে নিয়েছেন। মাথায় টুপিটি চাপিয়ে তিঁনি দরজার দিকে এগোতে লাগলেন। দরজার
কাছে পৌঁছে,
তার হ্যান্ডেল এর ওপর হাতটা রেখে তিঁনি একটু থামলেন।
"তুমি একজন ভালো লোক, নাইটোন,"
উনি বললেন। "আমি উত্তেজিত হয়ে উঠলে উদ্বিগ্ন হয়ো না।"
নাইটোন অল্প হাসলেও কোনো কথা বললো না।
"রুথ আমার একমাত্র
সন্তান,
" তিঁনি বললেন, " ও যে আমার কাছে কি সেটা এই পৃথিবীতে আর কেউ বুঝবে না।"
একটা চাপা হাসি তাঁর মুখে
খেলে গেলো। তিঁনি তাঁর পকেটে হাতটা ঢুকিয়ে দিলেন।
"একটা জিনিস দেখবে
নাইটোন?"
উনি আবার সেক্রেটারিটির
কাছে ফিরে এলেন।
উনি পকেট থেকে একটা বাক্স
বার করে আনলেন যেটা কোনোরকমে একটা ব্রাউন পেপার দিয়ে মোরা ছিল। উনি মোড়কটা ছুড়ে
ফেলে একটা বিচ্ছিরি দেখতে বড়ো, ভেলভেটের বাক্স বের করে
আনলেন। যার মদ্ধিখানে একটা মুকুটের মতো জায়গায় কিছু ভাঙাচোরা আদ্যাক্ষর। উনি
বাক্সটা খুললেন,
আর সেক্রেটারিটি একটি গভীর স্বাস নিলো। ভিতরের ছোট সাদা
জায়গাটার মধ্যে পাথরগুলো রক্তের মতো জ্বলছিল।
"হে, ভগবান! স্যার,"
বললো নাইটোন, "এগুলো - এগুলো কি আসল?"
ভ্যান আলদীন মুচকি মুচকি
হাসতে থাকলেন।
"তুমি একথা জিজ্ঞেস
করলে বলে আমি মোটেই অবাক হয় নি। এই রুবিগুলোর মধ্যে তিনটি রুবি হচ্ছে পৃথিবীর
বৃহত্তম। রাশিয়ার ক্যাথেরিন এগুলো ব্যবহার করতেন, নাইটোন। মদ্ধিখানে যেটা আছে, সেটার নাম হচ্ছে হার্ট অফ
ফায়ার। এটা পুরো নিখুঁত - এতে কোনো দোষ খুঁজে পাবে না।"
"কিন্তু," সেক্রেটারিটি বললো,
"এগুলোর নিশ্চই অনেক দাম।"
"চার, পাঁচ হাজার ডলার তো হবেই," ভ্যান আলদীন একটু গলা
খাঁকরে বললেন,
"আর সেটা, এদের ঐতিহাসিক মূল্য বাদ
দিয়ে।"
"আর আপনি এগুলো
এভাবে নিয়ে ঘুরছেন - খোলা ভাবে পকেটে নিয়ে?"
ভ্যান আলদীন তার কথা শুনে
আমোদে হাসতে লাগলেন।
"হ্যাঁ তাই, দেখো,
এগুলো রুথ এর জন্য আমার ছোট্ট উপহার।"
সেক্রেটারিটি এবার
উদ্দেশ্যপ্রনদিত ভাবে হাসলো।
"এবার আমি বুঝতে
পারলাম টেলিফোন এ মিসেস ক্যাটারিং এর উদ্বেগ এর কারণ," সে বিড়বিড় করে বললো। কিন্তু ভ্যান আলদীন মাথা নাড়াতে থাকলেন। তাঁর মুখে আবার
সেই কঠিন ভাব ফিরে এলো।
"এ ব্যাপারে তুমি
ভুল করছো,"
তিঁনি বললেন, "রুথ এগুলোর ব্যাপারে জানে না; এগুলো ওর জন্য আমার তরফ
থেকে একটা ছোট্টো চমক।"
উনি বাক্সটা বন্ধ করলেন
এবং আবার সেটা আস্তে আস্তে কাগজ দিয়ে মুড়তে লাগলেন।
"এটা খুব কঠিন
ব্যাপার,
নাইটোন," তিঁনি বললেন,"আমরা আমাদের প্রিয়জনদের জন্য মোটেই খুব একটা কিছু করতে পারি না। আমি রুথ এর
জন্য পৃথিবীর অনেককিছুই কিনে দিতে পারি, যদি সেগুলো তার কোনো কাজে
লাগে, কিন্তু না তা লাগবে না। আমি এগুলো তার গলায় পরিয়ে দিতে পারি ক্ষনিকের সুখের জন্য, হয়তো বা,
কিন্তু -"
উনি নিজের মাথা নাড়াতে
থাকলেন।
"যদি কোনো মহিলা
নিজের ঘরে সুখ না পায় -"
উনি কথাটা শেষ করলেন না।
সেক্রেটারিটি সম্মতি সূচক মাথা নাড়লো।
সে, অন্য সবার থেকে ভালোভাবে জানে, মাননীয় ডেরেক কেটারিংয়ের
সুখ্যাতি বা কুখ্যাতির কথা। ভ্যান আলদীন একটি দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। বাক্সটা কোটের
পকেটে পুরে,
নাইটোনের দিকে একবার মাথাটা ঝুকিয়ে তিঁনি ঘর থেকে বেরিয়ে
গেলেন।
চ্যাপ্টার ৪
কার্জণ স্ট্রিটে
সম্মানিয়া মিসেস ডেরেক
কেটারিং কার্জণ স্ট্রিটে থাকেন। বাটলারটি দরজা খুলে পরিচিত মিস্টার রুফুস ভ্যান
আলদীনকে দেখেই চিনতে পারলো এবং সে হাসি মুখে তাঁকে অভিবাদন জানালো। সে তাঁকে উপরে
দোতলায় এক বিশাল,
দ্বিগুন সাইজের একটা বসার ঘরে নিয়ে গেলো।
জানলার ধরে একজন মহিলা
বসেছিলেন যিনি ওনাকে দেখেই একটা চিৎকার করে উঠলেন।
"বাবা, কেন,
মাঝে মাঝে কিছু কিছু জিনিস এতটাই ভালো হয় যে তা বিশ্বাস করা
শক্ত হয়ে পরে! আমি তোমার সাথে কথা বলার জন্য মেজর নাইটোনকে সারাদিন ধরে ফোন করে
যাচ্ছি, কিন্তু উনি নিশ্চিত করে বলতে পারলেন না তুমি কখন ফিরবে।"
রুথ কেটারিং এর বয়স আঠাশ
বছর। তিনি তথাকথিত অসাধারণ সুন্দরী বা চমৎকার দেখতে না হলেও তাঁর চুলের রং খুবই
আকর্ষণীয়। ভ্যান আলদীনকে যৌবনে লোকে
ক্যারোট এবং জিঞ্জার বলতো ওনার লাল চুলের জন্য, কিন্তু রুথ এর চুল পুরো
কালচে লাল রঙের। এর সঙ্গে ওঁর ঘন কালো চোখ এবং চোখের পাতা - যেন কোনো শিল্পীর আঁকা
প্রতিকৃতি। তিনি লম্বা ও শীর্ণকায় এবং তাঁর হাঁটা চলার মধ্যে একটা আভিজাত্য আছে।
হঠাৎ করে তাঁর মুখের দিকে তাকালে মনে হয় যেন শিল্পী রাফায়েল এর আঁকা ম্যাডোনা।
কিন্তু কেউ ভালো করে লক্ষ্য করলে বুঝতে পারবে তাঁর চোয়াল এবং থুতনির গঠন অনেকটাই ভ্যান
আলদীনের মতো,
ওনার মতোই কঠিন এবং দৃঢ়চেতা। এই গঠন ছেলেদের যতটা মানায়
মেয়েদের ততটা মানায় না। ছোটবেলা থেকেই রুথ ভ্যান আলদীন নিজের মতো চলতে অভ্যস্ত, আর কেউ যদি তাঁর বিরুদ্ধে দাঁড়ানর সাহস করে সে দ্রুত বুঝে যায় রুফুস ভ্যান
আলদীনের মেয়ে ছাড়বার পাত্রী নয়।
ভ্যান আলদীন বললেন
"নাইটোন আমাকে জানিয়েছে যে তুমি তাকে ফোন করেছিলে, আমি প্যারিস থেকে মাত্র আধ ঘন্টা আগেই ফিরেছি। ডেরেকের ব্যাপারে কি হয়েছে?"
রুথ কেটারিং রাগে লাল হয়ে
উঠলো।
"সে কথা বলা যায় না।
এবার ও সমস্ত কিছু ছাড়িয়ে গেছে।" সে কাঁদতে লাগলো, "সে - সে আমার কোনো কথায়
কান দেয় না।"
তাঁর গলায় রাগ ও বিহ্বলতা
দুই ছিল।
"সে আমার কথা শুনবে," ধনকুবের বেশ দৃঢ়তার সাথে বললেন।
রুথ বলতে থাকলো।
"গত মাসে আমি কদাচিৎ
তার দেখা পেয়েছি। সে সব জায়গায় ওই মহিলাকে নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে।"
"কোন মহিলা?"
"মিরেলে। পার্থেননে
নাচ করে,
তুমি জানো।"
ভ্যান আলদীন মাথা নাড়লেন।
"গত সপ্তাহে আমি
লেকোনবুরি গেছিলাম। আমি - আমি লর্ড লেকোনবুরির সাথে কথা বলেছি। উনি আমার সাথে খুব
মিষ্টি ব্যবহার করেছেন ও সহমর্মিতাও জানিয়েছেন। উনি বলেছেন যে উনি ডেরেক কে যথেষ্ট
তিরস্কার করবেন।"
ভ্যান আলদীন বললেন
"আঃ!"
""আঃ!"
মানে কি বাবা?"
"মানে তুমি যা বোঝো, রুথ। বেচারা বৃদ্ধ লেকোনবুরি, পুরোপুরি ব্যার্থ। উনি
অবশ্যই তোমার সহমর্মী,
উনি তোমাকে শান্ত করার সবরকম চেষ্টা করেছেন। নিজের ছেলে এবং
উত্তরাধিকারীর সাথে স্টেটসের সবথেকে ধনী লোকের মেয়ের বিয়ে দিয়েছেন, এখন স্বাভাবিক ভাবেই উনি পুরো জিনিসটা ঘেটে দিতে চাইবেন না। কবরের দিকে এক পা
বাড়িয়েই বসে আছেন,
সবাই তা জানে, উনি ডেরেক কে যা বলবেন
তাতে কি কাজের কাজ হবে খুব সন্দেহ আছে।"
"তুমি কি কিছু করতে
পারো না,
বাবা?" রুথ জিজ্ঞেস করলো, এক দু মিনিট পরে।
"হয়তো বা, আমি পারি,"
বললেন ধনকুবের। তিনি এক সেকেন্ড চিন্তা করে বলতে থাকলেন।
"আমি অনেক কিছুই
করতে পারি,
কিন্তু একটাই মাত্র উপায় আছে যাতে ঠিকঠাক কাজ হতে পারে।
তোমার মনের জোর কতখানি,
রুখে?"
সে তাঁর দিকে অবাক হয়ে
তাকিয়ে থাকলো। তিঁনি তার দিকে তাকিয়ে মাথাটা নাড়লেন।
"আমি বোঝাতে চাইছি, তোমার কি এটা স্বীকার করার মতো সাহস আছে যে তুমি ভুল করেছিলে? এই ঝামেলার থেকে বেরোনোর একটাই মাত্র রাস্তা আছে রুখে। সব ক্ষতি ভুলে নতুন করে
শুরু করতে হবে।"
"তুমি বলতে চাইছো
-"
"ডিভোর্স।"
"ডিভোর্স!"
ভ্যান আলদীন একটা শুকনো
হাসি হাসলেন।
"তুমি কথাটা এমন
ভাবে বললে,
রুথ,
যেন তুমি এটা কোনোদিনই শোনো নি। এদিকে চারপাশে তোমার
বন্ধুরা বলতে গেলে হামেশাই এটা করছে।"
"ওহ! আমি এসব জানি।
কিন্তু -"
সে কিছুক্ষন থেমে, নিচের ঠোঠটা কামড়ে ধরলো। তার বাবা ব্যাপারটা বুঝে মাথা নাড়লেন।
"আমি জানি রুথ। তুমি
অনেকটা আমার মতো,
তুমি কোনো জিনিস ছাড়তে পারো না। কিন্তু আমি শিখেছি, এবং তোমাকেও শিখতে হবে,
অনেক সময় এটা ছাড়া আর কোনো পথ খোলা থাকে না। আমি ডেরেককে
তোমার কাছে ফিরিয়ে আনার উপায় বার করতে পারি, কিন্তু শেষে সেই একই
ব্যাপার হবে। ও মোটেই ভালো না, রুথ; উপর থেকে নিচে পর্যন্ত খারাপ। এবং জানো কি, তোমার ও ডেরেকের বিয়েতে
সম্মতি দেওয়ার জন্য আমি নিজেকেই দায়ী করি। কিন্তু তুমি ওকে পাওয়ার জন্য খেপে
উঠেছিলে,
আর ও ও যেন একটা নতুন খেলায় মেতে উঠেছিল, আমি তোমায় একবার সাবধান করতেও চেয়েছিলাম, সোনা... "
উনি তার দিকে না তাকিয়েই
শেষ কথাগুলি বলছিলেন। তাকালে হয়তো দেখতে পেতেন তার মুখে কিভাবে রং পরিবর্তন হচ্ছে।
"তুমি বলেছিলে," সে কঠিন স্বরে বললো।
"আমি দ্বিতীয়বার একই
কাজ করার ব্যাপারে দ্বিধাবিভক্ত ছিলাম। যদিও, আমি তোমাকে বলতে পারবো না
আমি কতটা চেয়েছিলাম এ কাজে তোমায় বাধা দিতে। গত কয়েকটা বছরে তোমাকে একটা নিম্ন
মানের জীবন কাটাতে হয়েছে,
রুথ।"
"এই জীবন - মেনে
নেওয়া যায় না,"
মিসেস কেটারিং স্বীকার করলেন।
"সেই জন্যই এ জিনিস
থামানো দরকার।" তিঁনি হাত দিয়ে টেবলে সজোরে একটা ঘুসি মারলেন। "ওর প্রতি
তোমার এখনো দুর্বলতা রয়ে গেছে হয়তো। ঝেড়ে ফেলো সবকিছু। বাস্তবের মুখোমুখি হও।
ডেরেক কেটারিং শুধুমাত্র তোমার টাকার জন্য তোমাকে বিয়ে করেছে । এখানে টাকাটাই
সবকিছু। ওর থেকে মুক্ত হও,
রুথ।"
রুথ কেটারিং কিছুক্ষন
মেঝের দিকে তাকিয়ে থেকে,
মাথাটা না তুলেই বললো :
"ও যদি সম্মতি দিতে
রাজি না হয়?"
ভ্যান আলদীন অবাক হয়ে তার
দিকে তাকালেন।
"এ ব্যাপারে ওর কোনো
মতামত থাকবে না।"
সে লজ্জা পেলো ও ঠোঁটটা
কামড়ে ধরলো।
"না - না - অবশ্যই
থাকবে না। আমি খালি বলছি -"
সে থামলো। তার বাবা গভীর
ভাবে তার দিকে তাকিয়েছিলো।
"তুমি কি বলতে চাও?"
"আমি বলতে চাই
-" সে একটু থামলো,নিজের কথাগুলি গুছিয়ে নিলো "ও বিনা প্রতিবাদে এ জিনিস মেনে নাও নিতে
পারে।"
ধনকুবেরের চিবুকটা কঠিন
হয়ে উঠলো।
"তোমার মনে হয় ও
কেসটা লড়বে?
লড়তে দাও! কিন্তু কথাটা হলো, এটা তোমার ভুল ধারণা । ও লড়বে না। যে আইনজীবীর কাছেই ও যাক না কেন, সেই জানাবে এই ব্যাপারে ওর দাঁড়ানোর কোনো জায়গায় নেই।"
"তোমার মনে হয় না
-" সে একটু ইতস্তত করে বললো, "মানে - শুধু মাত্র আমার
প্রতি বিদ্বেষ থেকে - ও কোনো গন্ডগোল পাকাবে?"
তার বাবা তার দিকে
আশ্চর্য হয়ে তাকিয়ে থাকলো।
"কেসটা ও লড়বে, তুমি মনে করো?"
উনি নিজের মাথা নাড়লেন।
"একেবারেই সম্ভব নয়।
ওর বেঁচে থাকার জন্য তো কিছু দরকার।"
মিসেস কেটারিং কোনো উত্তর
দিলেন না। ভ্যান আলদীন খুব তীক্ষ্ণভাবে তার দিকে তাকিয়ে থাকলেন।
"ঠিক আছে রুথ, বলে ফেলো এবার। কোনো একটা কারণে তুমি বেশ বিক্ষিপ্ত - সেটা কি?"
"কিছু না। একেবারেই
কিছু না।"
কিন্তু তার গলার স্বরটা
কৃত্রিম শোনালো।
"তুমি খবরটা
প্রচারের ভয় পাচ্ছ,
ওঃ?
এটাই তো? এসব আমার উপরে ছেড়ে দাও।
আমি সমস্ত কিছু এমন মসৃন ভাবে সামলে নেবো যে কোনও ঝামেলাই হবে না।"
"ঠিক আছে, বাবা,
তুমি যদি মনে করো এটাই করতে হবে তবে তাই সই।"
"ওর প্রতি কোনো
দুর্বলতা অনুভব করছো,
রুথ?
তাই কি?"
"না।"
তার কথায় কোনো দ্বিধা ছিল
না। ভ্যান আলদীন খুশি হলো। তিঁনি তাঁর মেয়ের কাঁধ চাপড়ে দিলেন।
"সব ঠিক হয়ে যাবে, মামনি। কোনো চিন্তা করো না। চলো এবার এসব কথা থাক। আমি প্যারিস থেকে তোমার
জন্য একটা উপহার এনেছি।"
"আমার জন্য? খুব দারুন কিছু নিশ্চই?"
"আশা করি, তোমার পছন্দ হবে,"
ভ্যান আলদীন হেসে বললেন।
তিঁনি নিজের কোটের পকেট
থেকে বাক্স টা বার করে তার হাতে দিলেন। সে খুব আগ্রহের সাথে মোড়কটা সরিয়ে বাক্স টা
খুলে ফেললো। একটা দীর্ঘ "ওহ!" বেরিয়ে এলো তার মুখ থেকে। গয়না, রুথ কেটারিং এর খুব পছন্দের জিনিস - চিরকালই পছন্দের।
"বাবা, কি - কি সুন্দর!"
"নিজের ক্ষেত্রে এরা
অতুলনীয়,
ঠিক কিনা?" ধনকুবের বেশ খুশির সাথে
বললেন,
"তোমার পছন্দ হয়েছে তো?"
"পছন্দ? বাবা,
এগুলো অসাধারণ। তুমি এগুলো পেলে কিভাবে?”
ভ্যান আলদীন হাসলেন।
"আঃ! এটা আমার গোপন
ব্যাপার। অবশ্যই,
এগুলো খুব গোপনীয়তার সাথে কিনতে হয়। এগুলোর যথেষ্ট খ্যাতি
আছে। মদ্ধিখানের বড় পাথরটা দেখছো? তুমি হয়তো এটার ব্যাপারে
শুনে থাকবে,
এটাই হচ্ছে সেই ঐতিহাসিক 'হার্ট অফ ফায়ার'”।
"হার্ট অফ ফায়ার!"
মিসেস কেটারিং আরেকবার বললেন।
সে বাক্স থেকে পাথরগুলো
বুকের কাছে তুলে ধরলো।
ধনকুবের তার দিকে
দেখছিলেন। তিঁনি ভাবছিলেন সেই সব মহিলাদের কথা, যারা এই পাথরগুলো গয়নায়
বসিয়ে পড়েছিলেন। ভগ্ন হৃদয়,
অসহায়তা, ঈর্ষান্বিতা। 'হার্ট অফ ফায়ার'
অন্য সব বিখ্যাত পাথরের মতোই হিংশ্র এবং বিয়োগান্ত সব পদচিহ্ন
রেখে এসেছে। আশা করা যায়, রুথ কেটারিংয়ের বিশ্স্বস্ত হাতে পরে, এটি তার অশুভ ক্ষমতা হারিয়ে ফেলবে। তার শান্ত,
ঠান্ডা চরিত্রের বলে, এই পাশ্চাত্য মহিলা যেন
এর সমস্ত বিয়োগান্ত ক্ষমতা ও ভগ্ন হৃদয়তা মুছে দেবে। রুথ পাথরগুলো আবার বাক্সের মধ্যে রেখে, এক লাফে গিয়ে তার বাবার গলা জড়িয়ে ধরলো।
"ধন্যবাদ, ধন্যবাদ,
ধন্যবাদ, বাবা! এগুলো সত্যিই
অসাধারণ! তুমি সব সময় আমাকে বিস্ময়কর সব উপহার দাও।"
"ঠিক আছে, ঠিক আছে,"
তার কাঁধে ধীরে ধীরে হাত বোলাতে বোলাতে, ভ্যান আলদীন বললেন।" তুমি তো জানো, তুমিই আমার সবকিছু, রুথিই।"
"তুমি ডিনার অব্দি
থাকবে তো বাবা?"
"আমার মনে হয় না।
তুমি তো বেরোচ্ছিলে,
ঠিক কিনা?"
"হ্যাঁ, কিন্তু না বেরোলেও ক্ষতি নেই। খুব জরুরি কিছু নয়।"
"না," বললেন ভ্যান আলদীন। "তোমার যেখানে যাওয়ার ছিল, যাও। আমার একটা জরুরি কাজ আছে। কাল আবার দেখা হবে, সোনা। পারলে আমি তোমাকে ফোন করে নেবো, আমরা গালব্রাইথের ওখানে
দেখা করতে পারি।"
মেসার্স্ গালব্রাইথ, গালব্রাইথ,
কাথবার্টসন ও গালব্রাইথ হলো ভ্যান আলদীনের লন্ডনের আইনজীবী।
"ঠিক আছে, বাবা।" সে একটু ইতস্তত করে বললো। "আমার মনে হয় না - এতে - আমার
রিভিয়েরা যাওয়া আটকাবে বলে?"
"তুমি কবে যাচ্ছ?"
"চোদ্দ
তারিখে।"
"আচ্ছা, সে ঠিকই আছে। এসব কাজে অনেক সময় লাগে। যা হোক, তোমার জায়গায় হলে আমি এই রুবিগুলো বিদেশে নিয়ে যেতাম না। এগুলো ব্যাঙ্ক এ রেখে
যেও।"
মিসেস কেটারিং মাথা
নাড়লেন।
ধনকুবের একটু মজা করে
বললেন,
"'হার্ট অফ ফায়ার' এর জন্য তোমাকে আমরা লুন্ঠিত
অথবা নিহত হতে দিতে পারি না।"
"তা সত্ত্বেও তুমি
এগুলো খোলাখুলি নিজের পকেট নিয়ে এসেছো," তাঁর মেয়ে একটু রাগান্নিত ভাবে বললো।
"হ্যাঁ -"
কোথাও যেন একটা, কিছু একটা দ্বিধা আছে বলে,
তার মনে হল।
"কি ব্যাপার, বাবা?"
"কিছু না।"
তিঁনি হাসলেন,
"প্যারিসে আমার একটা ছোট এডভেঞ্চার এর কথা মনে পরে
গেলো।"
"এডভেঞ্চার?"
"হ্যাঁ, যে রাতে আমি এগুলো কিনি।"
উনি বাক্সটার দিকে
নির্দেশ করলেন।
"তাই, আমাকেও বলো।"
"বলার মতো কিছু নয়, রুথিই। কয়েকজন উত্তর আমেরিকান গুন্ডা একটু চালাকি করার চেষ্টা করেছিল, আমি তাদের দিকে গুলি চালিয়ে দি, ওরা পালিয়ে যায়। এই
টুকুই।"
সে তাঁর দিকে বেশ গর্বিত
ভাবে তাকিয়ে থাকে।
"তুমি খুব কঠিন ঠাইঁ, বাবা।"
"ঠিক তাই, রুথিই ।"
তিঁনি তাকে একটা স্নেহ
মাখা চুমু দিলেন ও বেরিয়ে পড়লেন। স্যাভয় তে ফিরে তিঁনি নাইটোনকে কিছু সংক্ষিপ্ত
কিন্তু সুদৃঢ় আদেশ দিলেন।
"গোবি বলে একটা লোক
কে খুঁজে বার করতে হবে। তার ঠিকানা তুমি আমার ব্যাক্তিগত বইয়ে পাবে। সে যেন এখানে
কাল সকালে সাড়ে নয়টায় উপস্থিত হয়।"
"হ্যাঁ, স্যার।"
"আমি মিস্টার
কেটারিং এর সাথেও দেখা করতে চাই। তাকে পৃথিবীর যেকোনো প্রান্ত থেকে হোক খুঁজে বের
করো। ওর ক্লাবে চেষ্টা করো - যে কোনো ভাবে, যে কোনো উপায়ে তাকে খুঁজে
বার কর, এবং কাল সকালে যাতে তার সাথে আমার দেখা হয় সেই চেষ্টা করো। একটু বেলায় হলে
ভালো হয়,
বারোটা নাগাদ। ওর মতো লোকেরা সকাল সকাল ঘুম থেকে ওঠে
না।"
সেক্রেটারিটি যে নির্দেশগুলো
বুঝেছেন তা জানিয়ে মাথা নাড়লো। ভ্যান আলদীন এবার নিজেকে তাঁর ব্যাক্তিগত কাজের
লোকের হাতে ছেড়ে দিলেন। তাঁর চানের জন্য সব কিছু প্রস্তুত করা ছিল। তিঁনি যখন গরম জলে গা ডুবিয়ে বসে
ছিলেন, তখন কিন্তু মনে মনে তিঁনি তাঁর মেয়ের সাথে হওয়া
কথাবার্তায় ফিরে গেছিলেন। সব মিলিয়ে তিঁনি বেশ প্রসন্নই ছিলেন। তাঁর যুক্তিবাদী মন
অনেকদিন আগেই এই সত্য স্বীকার করে নিয়েছিল যে ডিভোর্সই হচ্ছে একমাত্র পথ। রুথ তাঁর
কথা,
তিঁনি যতটা আশা করেছিলেন তার থেকে তাড়াতাড়িই মেনে নিয়েছে।
কিন্তু তার সম্মতি সত্ত্বেও যেন কোথায় যেন একটা কাঁটা খচ খচ করছে। তার আচরণ, তাঁর মনে হচ্ছে,
যেন একটু খাপ ছাড়া। তিঁনি নিজেই যেন ব্যাপারটা ঠিক মেনে
নিতে পারছেন না।
"হয়তো সবই আমার
কল্পনা,
" তিঁনি নিজের মনেই বিড়বিড় করে বললেন, "তা সত্ত্বেও - আমি বাজি ধরতে রাজি আছি , যে ও সব কথা আমায় জানালো
না।"
চ্যাপ্টার ৫
একজন করিৎকর্মা
ভদ্রলোক
রুফুস ভ্যান আলদীন কফি ও
শুকনো টোস্ট দিয়ে তাঁর সংক্ষিপ্ত প্রাতরাশ সবে মাত্র শেষ করেছেন, তাঁর খাওয়া অতি সামান্য, এমন সময়ে নাইটোন ঘরে
ঢুকলো।
"মিস্টার গোবি আপনার
সঙ্গে দেখা করার জন্য নিচে অপেক্ষা করছেন, স্যার।"
ধনকুবের একবার ঘড়ির দিকে
তাকালেন। দেখলেন ঠিক সাড়ে নটা বেজেছে।
"ঠিক আছে।"
তিঁনি সংক্ষিপ্ত ভাবে বললেন, "ওকে ওপরে আস্তে
বলো।"
দু, এক মিনিট পরেই,
মিস্টার গোবি ঘরে ঢুকলেন। উনি একজন ছোটোখাটো, বয়স্ক লোক,
জামাকাপড় বেশ অগোছালো, যাঁর সাথে তার দরকার তাঁর
দিকে না তাকিয়ে তার নজর ঘরের চার দিকে ঘুরছিলো।
"সুপ্রভাত, গোবি।" ধনকুবের বললেন, "একটা চেয়ারে বস।"
"ধন্যবাদ, মিস্টার ভ্যান আলদীন।"
গোবি হাঁটুর ওপর হাত দুটো
রেখে বসলো ও উদগ্রীব হয়ে সেই তেজস্বী পুরুষের দিকে তাকিয়ে থাকলো।
"তোমার জন্য একটা
কাজ আছে।"
"বলুন,মিস্টার ভ্যান আলদীন?"
"তুমি হয়তো জানো, আমার মেয়ের বিয়ে হয়েছে মাননীয় ডেরেক কেটারিং এর সঙ্গে।"
মিস্টার গোবি তার চোখটা
তেজস্বী পুরুষটির উপর থেকে সরিয়ে ডেস্কের বাম দিকের ড্রয়ারটির দিকে একবার ফেলতেই, তার মুখে একটা অপ্রস্তুতকর হাসি দেখা গেলো। মিস্টার গোবি অনেক কিছুই জানেন, কিন্তু উনি সবকিছু সবসময় স্বীকার করতে চান না।
"আমার পরামর্শ মতো
সে একটা ডিভোর্সের আবেদন ফাইল করতে চলেছে। যদিও, এটা,
একজন আইনজীবীর কাজ। কিন্তু, একটা ব্যাক্তিগত কারণে,
আমার সমস্ত তথ্য সম্পূর্ণ ও সঠিক ভাবে চাই।"
মিস্টার গোবি কার্নিশের
দিকে তাকিয়ে বিড়বিড় করে বললেন:
"মিস্টার কেটারিং এর
সম্পর্কে?"
"মিস্টার কেটারিং এর
সম্পর্কে।"
"খুব ভালো, স্যার।"
মিস্টার গোবি উঠে
দাঁড়ালেন।
"এটা আমাকে কখন দিতে
পারবে?"
"খুব তাড়াতাড়ি আছে, স্যার?"
"আমি সবসময়
তাড়াতাড়ির মধ্যেই থাকি।"
মিস্টার গোবি দেয়াল এর
দিকে তাকিয়ে সমঝদার এর মতো হাসলেন। "আজকে দুপুর দুটোয়, স্যার?"
"চমৎকার।"
অপরজন খুশি হলেন। "সুপ্রভাত, গোবি।"
"সুপ্রভাত, মিস্টার ভ্যান আলদীন।"
"একজন খুবই
করিৎকর্মা লোক,"
ধনকুবেরটি বললেন, মিস্টার গোবি বেরিয়ে
যেতেই তাঁর সেক্রেটারিটি ঢুকলো। "ওনার কাজের ক্ষেত্রে উনি একজন বিশেষজ্ঞ।"
"ওনার কাজের
ক্ষেত্রটা কি?"
"তথ্য। ওকে চব্বিশ
ঘন্টা সময় দাও,
ও ক্যান্টারবুরির আর্চবিশপের ব্যাক্তিগত জীবনের সমস্ত তথ্য
তোমার সামনে রেখে দেবে।"
"একজন খুবই কাজের
লোক।" মিস্টার নাইটোন মুচকি হেসে বললেন।
" দু এক বার ও আমার
জন্য খুবই ভালো কাজ করেছে,"
ভ্যান আলদীন বললেন। তাহলে, নাইটোন,
এখন আমি কাজের জন্য প্রস্তুত।
পরবর্তী কয়েক ঘন্টায় বেশ
কয়েকটা কাজ খুব তাড়াতাড়ি সম্পন্ন হলো। ঠিক সাড়ে বারোটায় টেলিফোনটা বেজে উঠলো, এবং ভ্যান আলদীনকে জানানো হলো যে মিস্টার কেটারিং এসেছেন। নাইটোন, ভ্যান আলদীনের দিকে তাকালেন, এবং তাঁর সম্মতিসূচক মাথা
নাড়ানো দেখে সে সঙ্গে সঙ্গে বুঝে নিলো।
"দয়া করে, মিস্টার কেটারিং কে উপরে আস্তে বলুন।"
সেক্রেটারিটি সমস্ত কাগজ
গুছিয়ে নিয়ে বেরিয়ে গেলো। তার সাথে দর্শনার্থীর দরজার কাছে দেখা হয়ে গেলো, এবং ডেরেক কেটারিং একপাশে সরে ওনাকে বেরোনোর রাস্তা করে দিলো। তারপর সে ঘরে ঢুকে দরজাটা বন্ধ করে দিলো।
"সুপ্রভাত, স্যার। আমি শুনলাম,
আমার সাথে দেখা করার জন্য আপনি খুবই উদগ্রীব হয়ে
আছেন।" তার অলস গলায় কিছুটা বিদ্রুপাত্মক সুর ভ্যান আলদীনের স্মৃতিকে জাগিয়ে
তুললো।
তার মধ্যে একটা আকর্ষণীয়
ব্যাপার ছিল - চিরকালই তার মধ্যে আকর্ষণীয় ব্যাপার ছিল। তিঁনি তীক্ষ্ণভাবে তাঁর
জামাই এর দিকে তাকিয়ে ছিলেন। ডেরেক কেটারিং এর বয়স চৌত্রিশ বছর, রোগা একহারা চেহারা,
কালো, সরু মুখ, যেটার মধ্যে এখনো সামান্য কিছু ছেলেমানুষি ভাব রয়ে গেছে।
"ভিতরে এস," ভ্যান আলদীন সক্ষিপ্ত ভাবে বললেন। "বসো।"
কেটারিং হালকা ভাবে একটা
হাতলওয়ালা চেয়ারে বসলো। সে তার শশুরমশাই এর দিকে এমন ভাবে তাকিয়েছিলো যেন তিঁনি একটা বিনোদনের বস্তু।
"আপনার সাথে অনেক
দিন দেখা হয় নি,
স্যার," সে মজার ছলে বললো, "প্রায় বছর দুয়েক হবে,
মনে হয়। রুথের সাথে দেখা হয়েছে?"
"কাল রাতে তার সাথে দেখা
হয়েছে।" ভ্যান আলদীন বললেন।
"ওকে খুব ফিট লাগছে, তাই না?"
অপরজন হালকা ভাবে বললো।
"আমি জানি না এসব বোঝার
মতো যথেষ্ট সময় ও সুযোগ তোমার হাতে আছে কিনা।" ভ্যান আলদীন শুকনো ভাবে বললেন।
ডেরেক কেটারিংয়ের ভুরু
গুলো উপরে উঠে গেলো।
"আরে, আপনি জানেন,
আমাদের তো মাঝে মাঝে একই নাইট ক্লাবে দেখা হয়ে যায়।"
সে উরু উরু ভাবে বললো।
"আমি কোনো অবান্তর
কথা বলতে চাই না,"
ভ্যান আলদীন ছোট করে বললো। "আমি রুথকে ডিভোর্সএর আবেদন
ফাইল করতে বলেছি।"
ডেরেক কেটারিং খুব শান্ত
ভাবে বসে থাকলো।
"কি সাংঘাতিক!"
সে বিড়বিড় করে বললো,
"একটু ধূমপান করলে কি কিছু মনে করবেন, স্যার?"
সে একটা সিগারেট ধরিয়ে এক
গাল ধোয়া ছেড়ে বেশ নির্বিকার ভাবে জিজ্ঞেসা করলো:
"তা, রুথ কি বললো?"
"রুথ আমার পরামর্শ
মেনে নিয়েছে।" তার বাবা বললেন।
"সত্যি, তাই নাকি?"
"তোমার কি এটাই
প্রশ্ন?"
ভ্যান আলদীন তীক্ষ্ণ ভাবে জিজ্ঞেসা করলেন।
কেটারিং ঝাঁজরিতে তাঁর
ছাই ঝাড়লো।
"আশা করি, আপনি জানেন,"
সে বেশ উদাসীন ভাবে বললো, "যে সে খুব বড়ো একটা ভুল করতে চলেছে।"
"তোমার দিক থেকে
দেখলে, সেটা অবশ্য ঠিক,"
ভ্যান আলদীন ক্ষুন্ন ভাবে বললেন।
"ওঃ, ছেড়ে দিন,"
অপরজন বললো, "ব্যাক্তিগত বিষয় নিয়ে আলোচনা করতে চাই না। আমি এখন নিজের জন্য মোটেই চিন্তা
করছি না। আমি রুথের কথা ভাবছি। আপনি তো জানেন আমার বাবা বৃদ্ধ গভর্নর আর বেশিদিন
নেই, সব ডাক্তারই জবাব দিয়ে দিয়েছে। ভালো হয়, রুথ যদি আরো দু বছর সময়
দেয়, তাহলে আমি লর্ড লেকোনবুরি হবো আর সে লেকোনবুরির বধূ হতে পারবে, সেই জন্যই তো সে আমাকে বিয়ে করেছে।"
"আমি তোমার এই ঘৃণ্য
ঔদ্ধত মেনে নেবো না।" গর্জে উঠলেন ভ্যান আলদীন।
ডেরেক কেটারিং শান্ত ভাবে
তাঁর দিকে তাকিয়ে হাসতে লাগলো।
"আমি আপনার সাথে
একমত। এসব সেকেলে চিন্তাধারা।" সে বললো, "আজকাল এইসব উপাধিতে কিছু নেই। তবু লেকোনবুরি একটা মনোরম পুরোনো জায়গা, আর তাছাড়া,
আমরা ইংল্যান্ডের সবচেয়ে পুরোনো পরিবারগুলোর মধ্যে একটা।
এটা রুথের জন্য খুবই উদ্বেগজনক হবে যদি সে আমাকে ডিভোর্স করে এবং দেখে যে আমি আবার
বিয়ে করেছি এবং অন্য আরেকজন মহিলা তার জায়গায় লেকোনবুরির রানী হয়েছে।"
"ওহে ছোকরা, আমি কিন্তু সিরিয়াস।"ভ্যান আলদীন বললেন।
"ওঃ, আমিও,"
বললো কেটারিং। "টাকা পয়সার দিক থেকে আমি একটু হাত
টানের মধ্যে রয়েছি,
রুথ যদি আমাকে ডিভোর্স করে তাহলে আরো গাড্ডায় পরে যাবো, আর তাছাড়া,
সে যখন দশটা বছর সহ্য করেইছে, তখন আর কিছুটা সময় কেন নয়? আমি আপনাকে আমার কথা দিতে
পারি যে বৃদ্ধ ভদ্রলোকটি আর হয়তো আঠারো মাসও বাঁচবেন না, এবং,
এটা খুবই দুঃখের হবে যদি, যে কারণে রুথ আমাকে বিয়ে করলো সেটাই যদি সে না পায়।"
"তোমার মনে হয় রুথ
তোমাকে তোমার উপাধি আর পদের জন্য বিয়ে করেছে?"
ডেরেক কেটারিং মুখে একটা
হাসি ফুটে উঠলো,
কিন্তু সেটা মোটেই সুখের হাসি নয়।
"আপনি নিশ্চই মনে
করেন না যে এই বিয়ের মধ্যে কোনো ভালোবাসা ছিল?"
"আমি জানি," ভ্যান আলদীন ধীরে ধীরে বললেন, "কিন্তু দশ বছর আগে
প্যারিসে তুমি অন্যরকম কথা বলেছিলে।"
"তাই নাকি? হয়তো বলেছিলাম। রুথ খুবই সুন্দরী ছিল - একটা পরীর মতো নিষ্পাপ, অথবা এমনকিছু যা নাকি চার্চের অন্তর চিরে বেরিয়ে এসেছে। আমার মনে আছে, আমার ধারণা হয়েছিল,
যে আমি এক নতুন জীবন শুরু করতে চলেছি, একটা ইংলিশ পারিবারিক জীবন, একজন সুন্দরী স্ত্রীর
সাথে, যে নাকি আমায় ভালোবাসে।"
সে আরেকবার অর্থহীন একটা
হাসি হেসে উঠলো।
"কিন্তু আপনি এসব
বিশ্বাস করেন না। তাই তো?"
সে বললো।
"আমার এব্যাপারে
কোনো সন্দেহই নেই যে তুমি রুথকে শুধু মাত্র পয়সার জন্য বিয়ে করেছো।" ভ্যান
আলদীন আবেগহীন ভাবে বললেন।
"আর সে আমাকে
ভালোবেসে বিয়ে করেছে?"
অপরজন বিদ্রুপাত্মক ভাবে প্রশ্ন করলো।
"নিশ্চই।" বললেন ভ্যান আলদীন।
ডেরেক কেটারিং তাঁর দিকে
দু এক মিনিট তাকিয়ে থাকলো,
তারপর সে দুপাশে মাথা নাড়তে থাকলো।
"আপনি একথা বিশ্বাস
করেন, তাই তো,"
সে বললো, "আমিও সেই সময় করতাম।
কিন্তু হে প্রিয় শশুরমশাই,
আমি নিশ্চিত ভাবে আপনাকে জানাতে চাই, যে খুব তাড়াতাড়ি আমার ভুল ভেঙে যায়।"
"তুমি কি বলছো, আমি বুঝতে পারছি না। " বললেন ভ্যান আলদীন, "আর বুঝতেও চাই না। তুমি রুথের সাথে খুবই খারাপ ব্যবহার করেছো।"
"হ্যাঁ, করেছি,"
কেটারিং ধীর গলায় স্বীকার করে নিলো, "কিন্তু সে কঠোর,
আপনি জানেন। সে আপনারই মেয়ে। গোলাপি, সাদা নম্রতার নিচে সে গ্রানাইট পাথরের মতোই কঠিন। আমি সব সময় শুনে এসেছি যে
আপনি একজন কঠিন মানুষ,
কিন্তু রুথ আপনার থেকেও কঠিন। আপনি নিজের থেকেও অন্য একজন
কে বেশি ভালোবেসে এসেছেন,
কিন্তু রুথ কোনোদিন কউকে ভালোবাসে নি আর বাসবেও না।"
"যথেষ্ট হয়েছে," ভ্যান আলদীন বললেন,
"আমি তোমাকে এখানে ডেকেছিলাম যাতে সোজাসুজি স্পষ্ট ভাবে
তোমাকে জানাতে পারি যে আমি কি করতে চলেছি। আমার মেয়েটার জীবনে সুখ চাই, আর মনে রেখো,
আমি তার পেছনে আছি।"
ডেরেক কেটারিং চেয়ার থেকে
উঠে ম্যান্টেলপিসের কাছে গিয়ে দাঁড়ালো। সে সিগারেট টা ছুঁড়ে ফেলে দিলো। সে যখন কথা
বলতে শুরু করলো তার গলা একেবারে শান্ত।
"আমি আন্দাজ করার
চেষ্টা করছি,
আপনি ঠিক কি বলতে চাইছেন বলুন তো?" সে বললো।
"আমি বলতে চাইছি," ভ্যান আলদীন বললেন,
"তুমি এই কেস লড়তে যেও না।"
"আচ্ছা," কেটারিং বললো,
"আপনি কি আমায় ভয় দেখছেন?"
"তুমি যা চাও, মনে করতে পারো,"
ভ্যান আলদীন বললেন।
কেটারিং টেবিলের কাছে
একটা চেয়ার টেনে নিলো। সে ধনকুবেরের মুখোমুখি বসলো।
"আর যদি," সে বেশ নরম ভাবে বললো,
"তর্কের খাতিরে ধরে নি যে, আমি কেসটা লড়লাম?"
ভ্যান আলদীন কাঁধটা একটু
ঝাঁকিয়ে নিলেন।
"তোমার দাঁড়ানোর
কোনো জায়গাই নেই,
ওহে বোকা ছোকরা। তোমার আইনজীবীদের জিজ্ঞেসা করো, তারা জানিয়ে দেবে। তোমার কুখ্যাত সব কেচ্ছা, যা সারা লন্ডন জানে।"
"আমার মনে হয়, রুথ বোধয় মিরেলে কে নিয়ে কোনো ঝামেলা পাকিয়েছে। কি বোকাবোকা। আমি কিন্তু ওর বন্ধুদের ব্যাপারে নাক গলাই না।"
"তুমি কি বলতে চাইছো?" ভ্যান আলদীন কঠিন ভাবে জিজ্ঞেসা করলেন।
ডেরেক কেটারিং হাসলো।
"আমি দেখছি, আপনি সবকিছু মোটেও জানেন না।" সে বললো, "আপনি স্বাভাবিক ভাবেই একটু পক্ষপাতদুষ্ট।"
সে নিজের টুপি ও লাঠি তুলে
নিয়ে দরজার দিকে হাঁটা লাগলো।
"পরামর্শ দেওয়াটা
ঠিক আমার কাজ নয়।" সে যাবার আগে শেষ ধাক্কাটা দিতে চাইলো, "কিন্তু এ ব্যাপারে,
আমি কঠোর ভাবে পরামর্শ দেব বাবা ও মেয়ের মধ্যে এক খোলামেলা
আলোচনার জন্য।"
সে ঘর থেকে বেরিয়ে গিয়ে
দরজাটা বন্ধ করে দেওয়ার সাথে সাথে ধনকুবেরটি লাফিয়ে উঠলেন।
"এখন, এসব ও কি বোঝাতে চাইলো ?" ভ্যান আলদীন বললেন এবং
আবার নিজের চেয়ার এ বসে পড়লেন।
তাঁর মনের মধ্যে অস্বস্তিগুলো
আবার জোরদারভাবে ফিরে এলো।
এর মধ্যে এমন কিছু একটা ছিল
যার গভীরে তিঁনি এখনো পৌঁছুতে পারেন নি। টেলিফোনটা তাঁর হাতের কাছেই ছিল; উনি সেটা তুলে,
তাঁর মেয়ের বাড়ির নম্বরটা চাইলেন।
হ্যালো! হ্যালো! এটা কি
মেফেয়ার ৮১৯০৭?
মিসেস কেটারিং আছেন? উনি কি বাড়ি নেই? আচ্ছা,
লাঞ্চে বেড়িয়েছেন। কখন ফিরবেন? জানেন না?
আচ্ছা ঠিক আছে; না কোনো মেসেজ নেই।"
তিঁনি রিসিভারটা সপাটে
নামিয়ে রাখলেন।
দুপুর দুটোর সময় তিঁনি
ঘরের মেঝেয় পায়চারি করছিলেন ও মিস্টার গোবির জন্য অপেক্ষা করছিলেন।
দুটো বেজে দশ মিনিটে
মিস্টার গোবি ঘরে ঢুকলেন।
"খবর কি?" ধনকুবেরটি তীক্ষ্ণ ভাবে চিৎকার করে উঠলেন।
কিন্তু ছোটোখাটো মিস্টার
গোবির কোনো তারা নেই।
তিনি টেবিল এ গিয়ে বসলেন
এবং একটা পুরোনো ছেঁড়া পকেটবুক বার করে একটা একঘেঁয়ে গলায় সেটা থেকে পড়তে শুরু
করলেন। ধনকুবেরটি মন দিয়ে তার কথা শুনতে থাকলেন এবং যতই শুনছিলেন ততই তাঁর মন
খুশিতে ভরে উঠছিলো। গোবি পড়াটা শেষ করে থামলেন, এবং নোংরা কাগজ ফেলার
ঝুড়ির দিকে তাকিয়ে থাকলেন ।
"উম্ম!" ভ্যান
আলদীন বললেন "সবকিছু তো ঠিকঠাকই লাগছে। কেসটা তো চোখের পলক পড়ার আগেই শেষ হয়ে
যাবে। হোটেলের প্রমাণগুলো সব ঠিক আছে আশা করি?"
"কাস্ট আইরন।"
মিস্টার গোবি বললেন,
এবং বেশ রাগী রাগী ভাবে একটা সোনালী হাতলওয়ালা চেয়ার এর
দিকে তাকিয়ে থাকলেন।
"এবং টাকা পয়সার দিক
থেকে ও এখন বেশ কষ্টে আছে। ও এখন একটা লোনের জন্য চেষ্টা করছে, তুমি বলছো?
ওর বাবার দিক থেকে যা পাওয়ার তা প্রায় পুরোটাই তুলে নিয়েছে।
একবার ডিভোর্স এর খবরটা ছড়িয়ে পড়লে, ও আর একটি পয়সাও ধার পাবে
না, আর শুধু তাই নয়,
অন্য দেনাগুলোও বেরিয়ে আসবে আর সেদিক থেকেও চাপ থাকবে। আমার
ওকে বাগে পেয়েছি,
গোবি; আমরা ওকে মুঠোর মধ্যে
পেয়েছি।
তিঁনি টেবিল এর ওপর সজোরে
একটি ঘুসি মারলেন। তাঁর মুখে কঠিন এক বিজয়ীর ছবি ফুটে উঠছিলো।
"তথ্যগুলো"
মিস্টার গোবি একটা সরু গলায় বললেন "মনে হচ্ছে সন্তোষজনক।"
"আমাকে একটু কার্জণ
স্ট্রিটের দিকে যেতে হবে।" ধানকুবেরটি বললেন। "আমি তোমার কাছে কৃতজ্ঞ, গোবি। তুমি খুবই ভালো কাজ করেছো।"
তৃপ্তির একটা হাসি খেলে
গেলো ছোটখাটো মানুষটির মুখে।
"ধন্যবাদ, মিস্টার ভ্যান আলদীন,"
সে বললো, "আমি আমার সেরাটা দেওয়ার
চেষ্টা করেছি।"
ভ্যান আলদীন সরাসরি
কার্জণ স্ট্রিট গেলেন না। তিঁনি প্রথমে শহরে গেলেন, সেখানে তিনি দুজনের সাথে দেখা করলেন, তাদের সঙ্গে কথা বার্তা
যথেষ্ট সন্তোষজনক ছিল। সেখান থেকে পাতাল রেলে করে তিনি ডাউন স্ট্রিট গেলেন। তিঁনি
যখন কার্জণ স্ট্রিট ধরে হাঁটছিলেন, ১৬০ নঃ থেকে একটি লোক বেরিয়ে এলো, সে একই রাস্তা ধরে তাঁর দিকে মুখ করে হাঁটছিলো, যাতে ফুটপাথ দিয়ে হাটতে হাটতে তাঁরা একে অপরকে পেরিয়ে যেতে পারেন। কিছুক্ষন এর
জন্য, ধানকুবেরটির মনে হলো যে লোকটি বোধয় ডেরেক কেটারিং; চেহারা এবং উচ্চতা প্রায় একইরকম। কিন্তু মুখোমুখি হওয়ার সময়, তিঁনি বুঝতে পারলেন যে লোকটি তাঁর অপরিচিত। নাহ - না, একেবারে অপরিচিত নয়; তাঁর মুখ ধনকুবেরের মনে যেন একটা পরিচয়ের স্মৃতি খুঁজে বের করেছে, এবং সেই স্মৃতি মোটেই সুখকর নয়।
তিঁনি মাথার ভেতর হাতড়াতে
লাগলেন, কিন্তু কিছুতেই মনে করতে পারলেন না। তিঁনি অস্বস্তিতে মাথা নাড়াতে লাগলেন। এভাবে
অপ্রস্তুত হতে তিঁনি মোটেই পছন্দ করেন না।
রুথ কেটারিং স্পষ্টতই
তাঁর জন্য অপেক্ষা করছিলো। তিঁনি ঢুকতেই সে তাঁর কাছে দৌড়ে গেলো ও চুম্বন করলো।
"তাহলে, বাবা,
সবকিছু কেমন চলছে?"
"খুব ভালো," ভ্যান আলদীন বললেন,
"কিন্তু তোমার সঙ্গে আমার দু একটা কথা আছে, রুথ।"
প্রায় সঙ্গে সঙ্গে তার
মধ্যে একটা পরিবর্তন চোখে পড়লো, তাঁকে দেখার যে আনন্দ
ফুটে উঠেছিল তা বদলে গিয়ে যেন একটা চালাকি ও সতর্কতার চিহ্ন ফুটে উঠলো। সে একটা বড়
হাতলওয়ালা চেয়ারে বসলো।
"বলো, বাবা,"
সে বললো, "কি বলতে চাও?"
"আমি আজ সকালে তোমার
স্বামীর সাথে দেখা করেছি,"
ভ্যান আলদীন বললেন।
"তুমি ডেরেকের সাথে
দেখা করেছো?"
"করেছি। সে অনেক
কথাই বলেছে,
কিন্তু তার বেশিরভাগ কথাই আবোলতাবোল। কিন্তু বেরিয়ে যাবার
সময়, সে একটা কথা বলেছে,
যেটা আমি ঠিক বুঝতে পারি নি। সে আমায় উপদেশ দিয়েছে যে বাবা
ও মেয়ের মধ্যে কথাবার্তায় পুরোপুরি স্পষ্টতা থাকা জরুরি। সে কি বোঝাতে চেয়েছে, রুথিই?"
মিসেস কেটারিং তাঁর
চেয়ারে একটু নড়েচড়ে বসলো।
"আমি - আমি জানি না, বাবা। আমি কি করে জানবো?"
"অবশ্যই তুমি
জানো।" ভ্যান আলদীন বললেন, "সে অন্যকিছুও বলেছে, সে তার বন্ধুদের ব্যাপার নিয়ে বলেছে এবং তোমার বন্ধুদের ব্যাপারে তার নাক না
গলানোর কথাও বলেছে। এই কথার মানে কি?"
"আমি জানি না," রুথ কেটারিং আবারো বললো।
ভ্যান আলদীন বসলেন। তাঁর
মুখের রেখাগুলো কঠিন হয়ে উঠেছে।
"দেখো, রুথ। আমি কিন্তু চোখ বন্ধ করে এসবের মধ্যে ঢুকবো না। আমি একেবারেই নিশ্চিত নই, যে তোমার ওই স্বামী কোনো গন্ডগোল পাকাতে চেষ্টা করবে না। যদিও সে পাকাতে পারবে
না, এ ব্যাপারে আমি নিশ্চিত। আমার হাতে উপায় আছে তাঁকে চুপ করানোর, আমি জানি কিভাবে তার মুখ বন্ধ রাখতে হবে, কিন্তু আমাকে জানতে হবে
যে সেইসব উপায় প্রয়োগ করার কি কোনো দরকার আছে। তোমারও নিজস্ব বন্ধু আছে বলে সে কি
বোঝাতে চায়?"
মিসেস কেটারিং তাঁর
কাঁধটা ঝাঁকালেন।
"আমার অনেক বন্ধু
আছে,"
সে একটু আমতা আমতা করে বললো, "আমি জানি না ও কি বলতে চেয়েছে, আমি সত্যি বলছি।"
"তুমি জানো।"
ভ্যান আলদীন বললেন।
তিঁনি এখন এমন ভাবে কথা
বলছিলেন যেন যেন তাঁর কোনো ব্যাবসায়িক প্রতিপক্ষের সাথে কোনো আলোচনা করছেন।
"আমি সোজাসুজি ভাবে
জানতে চাই। লোকটা কে?"
"কোন লোকটা?"
"সেই লোকটা। ডেরেক
যার দিকে ইঙ্গিত করতে চাইছে। সেই বিশেষ লোকটা, যে নাকি তোমার বন্ধু।
তোমার চিন্তা করার কারন নেই, সোনা, আমি জানি এর মধ্যে কিছুই নেই, কিন্তু আমাদের সব দিক
খতিয়ে দেখতে হবে যেহেতু এটাও কোর্টে উঠতে পারে। তুমি তো জানো ওরা এসব জিনিস ঘুরিয়ে
পেঁচিয়ে পেশ করবে। আমি জানতে চাই লোকটা কে, এবং তোমার সাথে তার
বন্ধুত্ব কতখানি।"
রুথ কোনো উত্তর দিলো না।
তার হাত দুটো ভয়ানক নারভাস ভাবে একে অপরকে কচ্লাচ্ছিলো।
"বলো, সোনা।" ভ্যান আলদীন বেশ মোলায়েম গলায় বললেন। " নিজের বুড়ো বাবাকে ভয়
পেও না। আমি কখনই খুব কঠোর ছিলাম
না, ছিলাম কি,
প্যারিসে, ওই সময়ে? - হে ভগবান!"
তিঁনি থামলেন, বজ্রাহতের মতো।
"তাহলে ওটা সে
ছিল।" তিঁনি নিজের মনে বিড়বিড় করে বললেন। "আমার মনে হয়েছিল আমি তার
মুখটা চিনি।"
"তুমি কি ব্যাপারে
কথা বলছো,
বাবা? আমি বুঝতে পারছি না।"
ধনকুবেরটি উঠে তার কাছে
গেলেন এবং তার কব্জি টা শক্তকরে চেপে ধরলেন।
"এদিকে দেখো, রুথ,
তুমি আবার তার সাথে দেখা সাক্ষাৎ শুরু করেছো?"
"কার সাথে?"
"তার সাথে, যাকে নিয়ে এতো ঝামেলা হলো এই কয়েক বছর আগে। তুমি ভালো করেই জানো আমি কার কথা
বলছি।"
"তুমি বলতে চাইছো
-" সে ইতস্তত করে বললো - "তুমি কি কমতে দে লা রোচের কথা বলতে চাইছো?"
"কমতে দে লা
রোচে!" ভ্যান আলদীন ঘোৎ ঘোৎ করে বললো। "আমি তোমায় সেই সময়েই বলেছিলাম যে
ও একজন প্রতারক। কিন্তু তুমি খুব গভীরভাবে ওর সাথে জড়িয়ে পড়েছিলে, যদিও আমি তোমাকে ওর খপ্পর থেকে ছাড়িয়ে এনেছিলাম।"
"হ্যাঁ, তুমি এনেছিলে।" রুথ তেতো ভাবে বললো। "এবং আমি ডেরেক কেটারিংকে বিয়ে
করেছিলাম।"
"তুমি চেয়েছিল," ধনকুবেরটি তীক্ষ্ণ গলায় বললো।
সে তার কাঁধ ঝাঁকালো।
"আজকাল," ভ্যান আলদীন আস্তে আস্তে বললেন, "তুমি আবার ওর সাথে মেলামেশা শুরু করেছো - তোমায় যে এতো কিছু বলেছিলাম, তাসত্ত্বেও। সে আজ এ বাড়িতে এসেছিলো। বাইরে তার সঙ্গে আমার দেখা হয়েছিল, আমি তখন তাকে ঠিক চিনতে পারি নি।"
রুথ কেটারিং এর মধ্যে
আবার তার সংযম ফিরে এলো।
"আমি তোমায় একটা কথা
বলতে চাই,
বাবা; আর্মন্ড - কমতে দে লা
রোচের প্রতি তোমার ধারণা একেবারে ভুল। অল্প বয়সে যদিও সে বেশ কয়েকটা খারাপ কাজে
জড়িয়ে পড়েছিল - আমাকে সে ওগুলোর ব্যাপারে জানিয়েছিল; কিন্তু সে সবসময় আমার খেয়াল রাখতো। প্যারিসে যখন তুমি আমাদের দূরে সরিয়ে দিলে, ওর মন ভেঙে গেছিলো,
আর এখন -"
তার বাবার রাগে গড়গড়ানি
একটা শব্দ তাকে মাঝপথে থামিয়ে দিলো।
"তাহলে তুমি ওর
সাথেই জড়িয়ে পড়েছো,
ঠিক কিনা? তুমি, আমার মেয়ে! হে ভগবান! "
তিঁনি নিজের হাত দুটো উপর
দিকে ছুঁড়ে দিলেন।
"নারীরা এত বোকা হতে
পারে!" তিঁনি বিড়বিড় করতে লাগলেন।
চ্যাপ্টার ৬
মিরেলে
ভ্যান আলদীনের ঘর থেকে
ডেরেক কেটারিং এমন ঝড়ের মতো বেরোলো যে আরেকটু হলে করিডোরে তার সঙ্গে আরেকজন মহিলার
ধাক্কা লেগে যেত। সে মার্জনা চাইলো, একটা আশ্বাসের হাসিতে তার
মার্জনা স্বীকার করে নিয়ে মহিলা এগিয়ে গেলেন, তার মনে লেগে থাকলো
মহিলার প্রশান্তময়ী ব্যাক্তিত্ব এবং তার সুন্দর ধূসর চোখের চাউনি।
সে যতই উদাসীন ভাব করে
থাকুক না কেন,
তার শশুরমশাইয়ের সাথে এই সাক্ষাৎকার, সে গোপন করতে চাইলেও তাকে নাড়িয়ে দিয়েছে। সে একা একাই দুপুরের খাওয়া সারলো, তারপরে,
নিজের ওপর একটু বিরক্ত হয়ে, বড়োসড়ো একটা ফ্ল্যাট এর সামনে এসে দাঁড়ালো যেখানে মিরেলে বলে একজন মহিলা থাকে।
একজন পাতলা ফরাসি মহিলা হাসি মুখে তাকে অভ্যার্থনা জানালো।
'ভিতরে আসুন, মঁসিয়ে। মাদাম এখন বিশ্রাম নিচ্ছেন।'
সে তাঁকে তার অতিপরিচিত
পুবমুখী লম্বা ঘরটাতে নিয়ে এলো। মিরেলে একটা ডিভানে শুয়েছিল, অনেকগুলো বালিশ নিয়ে,
বালিশগুলোর রং হলুদের বিভিন্ন শেড এ, এগুলো সবই তার গায়ের হলুদ রঙের সাথে মেলানোর জন্য। নৃত্যশিল্পীটি এক অসাধারণ
সুন্দরী মহিলা,
যদিও তার মুখখানি যেন হলুদ মুখোশের নিচে একটু ম্লান মতো, তবুও তার মধ্যে যেন অদ্ভুত মনোমুগ্ধকর আকর্ষণ আছে, তার কমলা ঠোঁট দুটোতে ডেরেক কেটারিংকে আমন্ত্রনের একটা হাসি ফুটে উঠলো।
সে তাকে চুমু খেয়ে একটা
চেয়ার এ বসলো।
"তুমি নিজেকে নিয়ে
কি করছো বলতো?
এখুনি সবে ঘুম থেকে উঠলে, নাকি?”
একটা লম্বা হাসিতে কমলা রঙের
ঠোঁট দুটো চওড়া হয়ে উঠলো।
"না," নিত্যশিল্পীটি বললো। " আমি কাজ করছিলাম।"
সে তার লম্বা, ফ্যাকাসে হাতটা পিয়ানোর দিকে ছড়িয়ে দিলো, যেটার উপরে ছড়িয়ে আছে
কিছু অগোছালো সুরের স্বরলিপি।
'আম্ব্রোসে এখানে এসেছিলো, ও আমাকে নতুন অপেরা বাজিয়ে শোনাচ্ছিল।'
কেটারিং খুব একটা গুরুত্ব
না দিয়েই মাথা নাড়লো। তার ক্লাউড আম্ব্রোসে বা তার ইসবেনের পিয়ার গ্যান্ট এর অপেরা
রূপান্তরের প্রতি কোনো উৎসাহ নেই। কিন্তু মিরেলে, এ ব্যাপারে,
মনে করে যে আনিত্রার ভূমিকায় অভিনয়ে নিজেকে প্রমান করার তার
একটা অতুলনীয় সুযোগ আছে।
'এটা একটা অসাধারণ নাচ' সে বিড়বিড় করে বললো,
'মরুভূমির পুরো আবেগটা আমি এর মধ্যে ফুটিয়ে তুলবো। বিভিন্ন
গয়নায় সেজে আমি নাচটা করবো - আর, হ্যাঁ, বন্ধু,
গতকাল বন্ড স্ট্রিটে আমি একটা মুক্ত দেখেছি - একটা কালো
মুক্তো।'
সে থামলো, তার দিকে আমন্ত্রনের চোখে তাকিয়ে থাকলো।
'ওগো প্রিয়া।' কেটারিং বললো,
'আমাকে কালো মুক্তোর কথা বলে কোনো লাভ নেই, আমার কথা যদি বলো,
তাহলে আমার সামনে এখন সমূহ বিপদ।'
সে তার স্বরটা শুনেই
দ্রুত সারা দিলো। সে উঠে বসলো, আর তার কালো বড় চোখ দুটো আরো বড় বড় করে তাকালো।
'কি বলছো, ডেরেক?
কি হয়েছে?'
"আমার পূজনীয় শশুরমশাই," কেটারিং বললো,"আমাকে এক মহা গাড্ডায় ফেলার চেষ্টা করছেন।"
"কি?"
"অন্যভাবে বলতে গেলে, উনি চাইছেন রুথ আমাকে ডিভোর্স করুক।"
"কি বোকা বোকা," মিরেলে বললো,
"সে তোমাকে ডিভোর্স করতে চাইবে কেন?"
ডেরেক কেটারিং মুচকি
হাসলো।
"প্রধানত তোমার জন্য, সোনা!" সে বললো।
মিরেলে তার কাঁধ ঝাঁকালো।
"এটা তো বোকামো," সে নিরস গলায় নিজের পর্যবেক্ষণ করে জানালো।
"সত্যিই বোকামো।
" ডেরেক একমত হলো।
"এ ব্যাপারে তুমি কি
করবে?"
মিরেলে জানতে চাইলো।
"ওগো প্রিয়ে, আমি কি বা করতে পারি?
একদিকে, এমন একজন লোক যার হাতে
অফুরন্ত পয়সা,
আর আরেক দিকে এমন একজন লোক যার অফুরন্ত দেনা। কে জিতবে সে
ব্যাপারে কোনো সন্দেহই নেই।"
"এরা অসাধারণ, এই আমেরিকানরা।" মিরেলে মন্তব্য করলো। "এটা তো এমন নয় যে তোমার
স্ত্রী তোমাকে পছন্দ করে।"
"তাহলে," ডেরেক বললো,
"এ ব্যাপারে আমরা কি করবো?"
মিরেলে তার দিকে জিজ্ঞাসু
দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিল। ডেরেক এগিয়ে এসে তার দুটি হাত নিজের হাতে নিলো।
"তুমি কি আমার সাথে
থাকবে?"
"কি বলছো? এর পরে -"
"হ্যাঁ," কেটারিং বললো,
"এর পরে, যখন পাওনাদারেরা নেকড়ের
মতো ঘিরে ধরবে। আমি তোমার প্রতি ভয়ানক ভাবে আকৃষ্ট, মিরেলে;
তুমি কি আমায় ফিরিয়ে দেবে?"
সে নিজের হাত ডেরেকের হাত
থেকে ছাড়িয়ে নিলো।
"তুমি জানো, আমি তোমাকে পছন্দ করি,
ডেরেক।"
সে মিরেলের গলায় এড়িয়ে
যাবার সুর শুনতে পেলো।
"তো, তাহলে এই?
ইঁদুরেরা ডুবন্ত জাহাজ ছেড়ে পালাবে।"
"আঃ, ডেরেক!"
"তুমি কি ভাবছ
খোলাখুলি বলো,"
সে হিংস্রতার সাথে বললো। "তুমি আমাকে ছুঁড়ে ফেলে দেবে; তাই না?"
মিরেলে নিজের কাঁধ ঝাঁকালো।
"আমি তোমায় পছন্দ
করি - সত্যিই পছন্দ করি। তুমি খুবই মনোমুগ্ধকর, সুন্দর পুরুষ কিন্তু
বাস্তবে এটা সম্ভব নয়।"
"তুমি কি বড়োলোকের
বিলাসিতা হয়ে থাকতে চাও,
হ্যাঁ? তাই না?"
"যদি তুমি ব্যাপারটা
এভাবে দেখো তবে তাই।"
মিরেলে বালিশে পিঠটা
এলিয়ে দিলো,
তার মাথাটা পেছনে ঝুলিয়ে দিলো।
"তা হলেও, আমি তোমাকে পছন্দ করি,
ডেরেক।"
ডেরেক উঠে জানলার কাছে
গেলো এবং বাইরের দিকে তাকিয়ে কিছুক্ষন দাঁড়িয়ে থাকলো, তার দিকে পেছন ফিরে। এতক্ষনে নৃত্যশিল্পীটি তার কনুইয়ে ভর দিয়ে নিজের শরীরটা
কিছুটা তুলে ধরেছে এবং তার দিকে কৌতূহলীর মতো তাকিয়ে আছে।
" তুমি কি ভাবছো, বন্ধু?"
ডেরেক কাঁধের উপর দিয়ে
তার দিকে তাকিয়ে মুচকি মুচকি হাসতে লাগলো। একটা অদ্ভুত হাসি যাতে সে আরো
অস্বস্তিতে পরে গেলো।
" কি বলবো, সোনা,
আমি একজন মহিলার কথা ভাবছিলাম।"
"একজন মহিলা, এ্যঁ?"
মিরেলে বোঝবার মতো
কোনোকিছু খুঁজে বেড়াচ্ছিল।
"তুমি এক অন্য
মহিলার কথা ভাবছিলে,
তাই তো?"
"ওহ, তোমার চিন্তা করার কিছু নেই, এটা একটা কাল্পনিক
প্রতিকৃতি। 'একটি ধূসর চোখের মহিলার প্রতিকৃতি'"
ডেরেক কেটারিং হাসতে
লাগলো, তার হাসিতে যেন ব্যাঙ্গ ও বিদ্রুপ মেশানো।
"স্যাভয় হোটেলের
করিডোরে আমার সঙ্গে এক মহিলার ধাক্কা লাগতে যাচ্ছিলো।"
"তো, সে তোমাকে কি বললো?"
"যতদূর আমার মনে পরে, আমি বললাম,
'আমি মার্জনা চাইছি,' এবং তিঁনি বললেন, 'ঠিক আছে কোনো ব্যাপার নয়' বা ঐরকম কিছু।"
"তারপর?" নৃত্যশিল্পীটি উৎসুক হয়ে জানতে চাইলো।
কেটারিং তার কাঁধ
ঝাঁকালো।
"তারপর - কিছু না।
ঘটনা এখানেই শেষ।"
"তুমি যা বললে, আমি তার একটা কথাও বুঝতে পারলাম না," নিত্যশিল্পীটি জানালো।
"ধূসর চোখের এক
মহিলার প্রতিকৃতি,"
ডেরেক নিজের মনেই বিড়বিড় করতে থাকলো।
"বলতে গেলে, আমার আর কখনো তার সাথে দেখা হওয়ার সম্ভবনা নেই ।"
"কেন?"
"উনি হয়তো আমার জন্য
মন্দ ভাগ্য নিয়ে আসবেন। মহিলারা আমার জন্য দুর্ভাগ্য নিয়ে আসে।"
মিরেলে তাড়াতাড়ি তার কোচ
থেকে উঠে,
ডেরেকের পাশে এসে দাঁড়ালো, তার সাপের মতো,
লম্বা একটা হাত দিয়ে ডেরেকের গলা জড়িয়ে ধরলো।
"তুমি একজন বোকা, ডেরেক,"
সে বিড়বিড় করে বললো। "তুমি ভয়ানক বোকা। তুমি একজন
সুদর্শন পুরুষ,
আর আমি তোমাকে পছন্দ করি, কিন্তু আমি কিছুতেই গরিব হয়ে বাঁচতে পারবো না - না, আমি গরিব হয়ে বাঁচতে পারবো না। এখন, আমার কথা শোনো; ব্যাপারটা খুবই সোজা। তোমার স্ত্রীর সাথে মিটমাট করে নাও।"
"আমি আশঙ্কা করছি
বাস্তবিক পরিস্থিতি ঠিক এইদিকে মোর নেবে না," ডেরেক শুকনো ভাবে বললো।
"তুমি কি করে এটা
বলছো? আমি বুঝতে পারছি না।"
"সোনা, ভ্যান আলাদীন আর কোনো কথাই মানবে না। সে এমন একজন পুরুষ যে নাকি কোনো কিছু
একবার ঠিক করে নিলে সেখান থেকে তাকে আর নড়ানো যায় না।"
"আমি ওনার কথা
শুনেছি,"
নৃত্যশিল্পীটি মাথা নাড়লো। "উনি খুব পয়সাওয়ালা লোক, তাই না?
বোধয় আমেরিকার সবচেয়ে ধনী লোক। কিছুদিন আগে, প্যারিসে,
উনি পৃথিবীর সবথেকে সুন্দর রুবি কিনেছেন - সেটার নাম 'হার্ট অফ ফায়ার'"
কেটারিং কোনো উত্তর দিলো
না।নৃত্যশিল্পীটি কিছু চিন্তা করতে করতে বলতে থাকলো:
"ওটা একটা অসাধারণ
পাথর - এমন একটা পাথর যা কিনা আমার মতো মহিলার কাছে থাকাই উচিত। আমি রত্ন ভালোবাসি, ডেরেক,
তারা আমার সাথে কথা বলে। আঃ! 'হার্ট অফ ফায়ার'
এর মতো একটা রুবি পড়তে পারলে।"
সে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললো, আর তারপর আবার স্বাবাভিক হয়ে গেলো।
"তুমি এসব বুঝবেনা, ডেরেক,
কারণ তুমি একজন পুরুষ। আমার মনে হয়, ভ্যান আলাদীন এই রুবিগুলো তাঁর মেয়েকে দেবেন। সে কি ওনার একমাত্র সন্তান?"
"হ্যাঁ।"
"তাহলে যখন উনি মারা
যাবেন, ওনার সমস্ত সম্পত্তি ওনার মেয়ে পাবে। সে একজন ধনী মহিলা হবে।"
"সে এখনই একজন ধনী
মহিলা,"
কেটারিং শুকনো ভাবে বললো। "বিয়ের সময়েই উনি ওকে কুড়ি লক্ষ
পাউন্ড উপহার দিয়েছিলেন।"
"কুড়ি লক্ষ! সে তো বিরাট
অঙ্ক। আর সে যদি হঠাৎ মারা যায়, তাহলে?
এই সব সম্পত্তি কি তোমার হবে?
"বর্তমানে ভাবলে যা
দাঁড়ায়,"
কেটারিং আস্তে আস্তে বললো "এটাই সত্যি। যতদূর আমি জানি
ও এখনো কোনো উইল করে নি।"
"ওঃ ভগবান! নৃত্যশিল্পীটি
বললো,
"সে যদি মারা যায়, তাহলেই তো সব সমস্যার
সমাধান হয়।"
কিছুক্ষনের জন্য একটা
নিস্তব্ধতা নেমে এলো,
তারপর ডেরেক কেটারিং হো হো করে হেসে উঠলো।
"আমি তোমার সরল, বাস্তবিক চিন্তাধারা পছন্দ করি, মিরেলে, কিন্তু তুমি যা চাইছো তা কখনোই ঘটবে না। আমার স্ত্রী একজন সুস্বাস্থের অধিকারিণী
মহিলা।"
"আচ্ছা!"
মিরেলে বললো,
"দুর্ঘটনা তো ঘটতে পারে।"
ডেরেক খুব তীক্ষ্ণ ভাবে
তার দিকে তাকিয়ে রইলো,
কিন্তু কোনো উত্তর দিলো না।
সে বলতে থাকলো।
"যাক গে, তুমিই ঠিক,
বন্ধু, এসব কথা নিয়ে আমাদের আর
কোনো আলোচনা করা উচিত নয়। তাহলে, আমার ডেরেক সোনা, এই ডিভোর্স এর ব্যাপারে আর কোনো কথাবার্তা হওয়া ঠিক নয়। তোমার স্ত্রীকে অবশ্যই
এই অভিপ্রায় ছাড়তে হবে।"
"আর, যদি সে না ছারে?"
নৃত্যশিল্পীটি চোখ দুটো
বড়ো বড়ো করে তাকিয়ে থাকলো।
"আমার মনে হয় ও
ছাড়বে। ও এমন একজন যে নাকি নিজেকে নিয়ে প্রচার পছন্দ করে না। ওর এমন কিছু গল্প আছে
যেগুলো ও কিছুতেই চাইবে না ওর বন্ধুরা খবরের কাগজের মাদ্ধমে জানুক।"
"তুমি কি বলতে চাইছো?" কেটারিং তীক্ষ্ণ ভাবে বললো।
মিরেলে হাসাতে হাসাতে
মাথাটা পেছনে হেলিয়ে দিলো।
"উদাহরণ হিসেবে, একজন ভদ্রলোকের কথা বলতে চাই যে নাকি নিজেকে কমতে দে লা রোচে বলে। আমি তার ব্যাপারে সব কিছু জানি। তুমি তো জানো আমি একজন
প্যারিসের নাগরিক। তোমাকে বিয়ে করার আগে সেই ছিল ওর প্রেমিক, ঠিক কিনা?"
কেটারিং কাঁধের ওপর দিয়ে
মাথাটা ঘুরিয়ে তার দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিল।
"এটা পুরোপুরি
মিথ্যা,"
সে বললো, "আর এটা মনে রেখো, তুমি আমার স্ত্রীর ব্যাপারে কথা বলছো।"
মিরেলে কিছুটা শান্ত হয়ে
গেলো।
"তোমরা ইংলিশরা, তোমরা তো অসাধারন,"
সে অনুযোগ করলো। "যাক গে, আমি মেনেও নিতে পারি,
যে তুমিই হয়তো ঠিক। আমেরিকানরা খুব ঠান্ডা প্রকৃতির, ঠিক কিনা?
কিন্তু, বন্ধু, এ কথা বলতে তুমি আমাকে নিশ্চই বাধা দেবে না যে, ও তোমাকে বিয়ে করার আগে তাকেই ভালোবাসতো, এবং ওর বাবার হস্তক্ষেপেই
কমতে নিজের কাজে মন দিতে বাধ্য হয়। এবং বেচারা মাদমোয়েজেল,
সে খুব কান্না কাটি করে! কিন্তু বাবার কথা মেনে নেয়। যাহোক, ডেরেক,
তুমিও নিশ্চই আমার মতো জানো যে, এখনকার গল্পটা আবার অন্যরকম। রুথ এখন প্রায় প্রতিদিনই তার সাথে দেখা করে, আর চোদ্দ তারিখে সে প্যারিস যাচ্ছে তার সাথে দেখা করার জন্য।"
"এসব তুমি কিভাবে
জানলে?"
কেটারিং জানতে চাইলো।
"আমি! প্যারিসে আমার
বন্ধুরা আছে,
প্রিয় ডেরেক, যারা কমতে কে খুব ভালো
করে চেনে। সবকিছু আগে থেকেই ঠিক করা আছে। সে সবাইকে বলছে যে, সে রিভিয়েরা যাচ্ছে,
কিন্তু আসলে কমতে তার সাথে প্যারিসে দেখা করবে আর - কে জানে
কি হয়! আর,
হ্যাঁ, তুমি আমার এ কথা মেনে
নিতে পারো যে এসবই পূর্বপরিকল্পিত।"
ডেরেক কেটারিং স্তব্ধ হয়ে
দাঁড়িয়ে থাকলো।
"দেখো," নৃত্যশিল্পীটি আস্তে আস্তে নাটকীয় ভাবে বললো, "তুমি যদি বুদ্ধি করে এগোতে পারো, তবে ও একেবারে তোমার
হাতের মুঠোয়। তুমি ওর সমস্ত কাজ ভেস্তে দিতে পারো।"
"ওঃ, ভগবানের দোহাই থামো।" কেটারিং চেঁচিয়ে উঠলো, "তোমার ওই অভিশপ্ত মুখটা বন্ধ করো।"
মিরেলে হাসতে হাসতে আবার
ডিভানে বসে পড়লো। কেটারিং তার টুপি এবং কোট টা তুলে নিয়ে বেরিয়ে গেলো, যাবার সময় সশব্দে দরজাটা বন্ধ করে দিয়ে গেলো। নৃত্যশিল্পীটি তখন ডিভান এর উপর
বসে হেসে যাচ্ছিলো। সে তার নিজের কাজে মোটেও অখুশি নয়।
চ্যাপ্টার ৭
চিঠি পত্র
"মিসেস স্যামুয়েল
হারফিল্ড মিস ক্যাথেরিন গ্রে র খুব প্রশংসা করলেন এবং জানালেন যে ঘটনাচক্রে মিস
গ্রে হয়তো জানেন না -"
মিসেস হারফিল্ড, এতক্ষন বেশ তরতর করে লিখে এসে, একেবারে থেমে গেলেন। তিনি
আটকে গেলেন এমন একটা জায়গায় এসে, যা নাকি অনেকের কাছেই
অনতিক্রম্য - ব্যাপারটা হলো, নিজেকে সরল ভাবে থার্ড
পার্সনে প্রকাশ করা।
দু এক মিনিট ইতস্তত করার
পরে, মিসেস হারফিল্ড খাতার কাগজটা ছিঁড়ে
ফেললেন, এবং আবার নতুন করে শুরু করলেন।
"প্রিয় মিস গ্রে,
আপনার অকুণ্ঠ প্রশংসা করি, আপনি যেভাবে আমার তুতো বোন
এম্মার (যার সাম্প্রতিক মৃত্যু আমাদের
সবার কাছেই এক মর্মান্তিক আঘাত) প্রতি নিজের কর্তব্য পালন করেছেন, আমি অনুভব করতে পারি -"
আবারো মিসেস হারফিল্ড কে
থামতে হলো। আর আবারো চিঠিটার স্থান হলো ময়লা ফেলার ঝুড়িতে।
চার বার একই পরিণতি হবার
পর মিসেস হারফিল্ড এমন একটা চিঠি দাঁড় করতে পারলেন, যেটা দেখে উনি সন্তুষ্ট হলেন। চিঠিটা খামে বন্দি করে, স্ট্যাম্প মেরে ঠিকানা লেখা হলো মিস
ক্যাথেরিন গ্রে,
লিটল ক্র্যাম্পটন, সেন্ট মেরি মিড, কেন্ট,
এবং তারপর সেটা রাখা থাকলো একটা কেতাদুরস্ত প্লেট এর পাসে
যতক্ষন না পরদিন সকালে প্রাতরাশ এর সময় আর একটা আরো জরুরি দেখতে লম্বা নীল খাম এর
সাথে জমা হয়।
ক্যাথেরিন গ্রে মিসেস
হারফিল্ডের চিঠিটাই প্রথমে খুললো। শেষ পর্যন্ত চিঠিটা যা দাঁড়িয়েছিল তা হলো :
প্রিয় মিস গ্রে,
যে ভাবে আপনি আমার অভাগা
তুতো বোন এম্মার প্রতি আপনার কর্তব্য পালন করেছেন, তার জন্য আমি এবং আমার স্বামী আপনাকে আমাদের ধন্যবাদ জানাই। তার মৃত্যু আমাদের
কাছে এক বিরাট আঘাত,
যদিও, আমরা বুঝতে পারছিলাম, সে তার মানসিক ভারসাম্য শেষ কিছুদিন যাবৎ হারিয়ে ফেলছিলো। আমি বুঝতে পারছি যে
স্বভাবতই তার শেষ ইচ্ছাপত্রটি একটু অদ্ভুত ধরণের, এবং কোনো আইনি আদালতেই এ জিনিস দাঁড়াবে না। আমার কোনো সন্দেহই নেই যে, আপনি আপনার স্বাভাবিক বুদ্ধিতে প্রকৃত ঘটনাটা আগেই বুঝতে পেরেছেন। আমার স্বামী বলেছেন, এসব জিনিস যদি ব্যাক্তিগত
স্তরেই মিটিয়ে নেওয়া যায় তাহলে সবথেকে ভালো হয়। আমরা আনন্দের সঙ্গে আপনার জন্য একই
ধরণের পদের জন্য উচ্চমানের সুপারিশ করতে পারি এবং আশা করি যে আমাদের একটা ছোট্ট
উপহারও আপনি স্বীকার করবেন। আমাকে বিশ্বাস করুন, প্রিয় মিস গ্রে,
আন্তরিকতার সাথে, আপনার, মেরি অ্যান হারফিল্ড।"
ক্যাথেরিন গ্রে চিঠিটা মন
দিয়ে পড়লো,
একটু পড়লো, এবং আবার দ্বিতীয়বার
পড়লো। দ্বিতীয়বার পড়ার পর সে যখন চিঠিটা নামিয়ে রাখলো তখন তার মুখে একটা কৌতুকের
হাসি। তারপর সে দ্বিতীয় চিঠিতে তুলে ধরলো। একবার তাড়াতাড়ি চোখ বুলিয়ে নিয়ে সে
চিঠিটা নামিয়ে রাখলো এবং সোজা সামনের দিকে তাকিয়ে থাকলো। এবার কিন্তু সে আর হাসলো
না। তার শান্ত,
চিন্তাশীল দৃষ্টির দিকে তাকিয়ে এ কথা আন্দাজ করা সত্যই কঠিন, যে তার মনে কোন আবেগ খেলা করছে।
ক্যাথেরিন গ্রে র বয়স
তেত্রিশ বছর। সে একটা ভালো পরিবার থেকে এসেছে, কিন্তু তার বাবা সমস্ত
টাকাই খুইয়ে ফেলেছিলো,
এবং কাথেরিনকে খুব অল্প বয়স থেকেই জীবিকার সন্ধানে নামতে
হয়েছিল। তার যখন মাত্র তেইশ বছর বয়স তখন সে বৃদ্ধ মিসেস হারফিল্ডের সহায়িকা হিসেবে
যোগ দেয়।
এ কথা সবাই জানতো যে
বৃদ্ধা মিসেস হারফিল্ড ছিলেন 'খিটখিটে'।
সহায়িকারা আসতো এবং যত
তাড়াতাড়ি আসতো ততো তাড়াতাড়ি চলেও যেত। তারা অনেক আশা নিয়ে আসতো আর কাঁদতে কাঁদতে
ফিরে যেত। কিন্তু যখন থেকে ক্যাথেরিন গ্রে লিটল ক্র্যাম্পটনে পা রেখেছিলো, প্রায় দশ বছর আগে,
তখন থেকে সেখানে এক অশেষ শান্তি বিরাজ করতো। কেউ জানে না কি
হয়েছিল। লোকে বলে,
সাপুড়েরা জন্মায়, তাদের তৈরি করা যায় না। ক্যাথেরিন
গ্রে জন্ম থেকেই বৃদ্ধা মহিলা, কুকুর এবং ছোট বাচ্ছাদের
সামলানোর ক্ষমতা নিয়ে জন্মেছিলো, এর জন্য তাকে কোনো অধিক
পরিশ্রম করতে হয় নি।
তেইশ বছর বয়েসে সে একজন
সুন্দর চোখের শান্ত মেয়ে ছিল। তেত্রিশ বছর বয়েসেও সে একজন শান্ত মহিলা, সেই ধূসর চোখের অধিকারিণী, যে উজ্জ্বল চোখ পৃথিবীতে এমন এক আনন্দের প্রশান্তি ছড়িয়ে দেয় যাকে কোনো কিছুই
হেলাতে পারে না।
এছাড়াও, সে রসিকতা করার একটা ক্ষমতা নিয়েও জন্মেছে, এবং সে ক্ষমতা এখনো আছে।
সে প্রাতরাশের টেবিলে বসে, সামনের দিকে দূরে তাকিয়েছিলো, এইসময় একবার বেল বাজলো, বেলের সাথে সাথে কেউ দরজার করাটাও খুব জোরে জোরে খট খট করে নাড়তে থাকলো। আর এক
মিনিটের মধ্যেই ছোট মতো পরিচারিকাটি দরজা খুলে হাঁপাতে হাঁপাতে জানালো:
"ডাক্তার হ্যারিসন।"
মদ্ধ-বয়সী, বড়সড়ো চেহারা ডাক্তার হ্যারিসন যেন একটা কর্মব্যস্ততার ঝড় সঙ্গে নিয়ে ঢুকলেন, যেটা তাঁর করা নাড়ার শব্দেই বোঝা যাচ্ছিলো।
"সুপ্রভাত, মিস গ্রে।"
"সুপ্রভাত, ডাক্তার হ্যারিসন।"
"আমি একটু সকাল
সকাল চলে এলাম।" ডাক্তারবাবু বলতে শুরু করলেন, "একজন হারফিল্ডের তুতো বোন তোমার সাথে যোগাযোগ করেছে হয়তো। মিসেস স্যামুয়েল -
নিজেকে একজন বিষাক্ত মানবী বলেই পরিচয় দেন।
কোনো কথা না বলে
ক্যাথেরিন টেবিলে থেকে মিসেস হারফিল্ডের চিঠি টা তুলে তাঁর দিকে এগিয়ে দিলো। তিঁনি যখন চিঠিটা পড়ছিলেন ক্যাথেরিন বেশ আমোদের সাথে তাঁকে
লক্ষ্য করছিলো,
তিঁনি কখনো রাগে ফোঁস ফোঁস কখনো গড় গড় করছিলেন। তিঁনি টেবিলে
এর উপর চিঠিটা ছুঁড়ে ফেললেন।
"পুরোপুরি ভয়ঙ্কর," তিঁনি ক্ষোভে ফুঁসতে ফুঁসতে বললেন। "তুমি ঘাবড়িও না, সোনা। এঁরা ভুল ভাল বকছেন। তুমি যাকেই জিজ্ঞেস করো না কেন এ কথা কেউ বলবে না
যে, মিসেস হারফিল্ড তোমার বা আমার থেকে বুদ্ধিমান। ওরা ভালো করেই জানে যে, ওদের দাঁড়ানোর কোনো জায়গা নেই। এটাকে আদালতে টেনে নিয়ে যাওয়ার কথাটা পুরোপুরি
মিথ্যে। এইজন্যই তোষামোদ করে তোমাকে ফাঁসানোর চেষ্টা। দেখো, সোনা,
ওদের মিষ্টি কথায় মোটেই ভুলো না। এ কথা মনে কখনোই স্থান দিও না যে টাকা পয়সা ওদের হাতে তুলে
দেয়াটা কর্তব্য,
অথবা কোনো বোকা বোকা বিবেকের দন্ধ নিয়ে ভেবো না।"
"এ কথা আমার কখনো
মনে হয় নি যে এব্যাপারে আমার কোনো দ্বিধা আছে।" ক্যাথেরিন বললো। "এঁরা সবাই মিসেস হারফিল্ডের স্বামীর অনেকে দূরের
আত্মীয়, তিঁনি বেঁচে থাকতে এঁরা কেউ কোনোদিন আসেন নি বা কোনো খোঁজখবর রাখেন নি।"
"তুমি যথেষ্ট
বুদ্ধিমতী মহিলা,"
ডাক্তারবাবু বললেন। "আমি আর কাউকে জানি না যে নাকি গত দশ বছর ধরে তোমার মতো এতো কঠিন জীবন
কাটিয়েছে। বৃদ্ধা মহিলার সম্পত্তিতে, ওদের মতো, তোমারও সম্পূর্ণ অধিকার আছে।"
ক্যাথেরিন একটু চিন্তিত
ভাবে হাসলো।
"ওঁদের মতো"
সে পুনরাবৃত্তি করে বললো,
"আপনারও বোধয় সম্পত্তির পরিমান এর ব্যাপারে কোনো ধারণা নেই, ডাক্তারবাবু?"
"সম্ভবত - বছরে
পাঁচশো টাকার মতো,
মনে হয়।"
ক্যাথেরিন মাথা নাড়লো।
"আমিও তাই
ভেবেছিলাম। " সে বললো,
"এটা পড়ুন।"
ক্যাথেরিন যে চিঠিটা নীল
রঙের লম্বা খাম থেকে বের করেছিল সেটা তাঁর হাতে তুলে দিলো। ডাক্তার বাবু সেটা পরে
বিস্ময়ে হতবাক হয়ে একটা চিৎকার করে উঠলেন।
"অসম্ভব," তিঁনি বিড়বিড় করে বললেন, "অসম্ভব।"
"তিঁনি মোড়টাওল্ডস
এর আদি শেয়ারহোল্ডার ছিলেন। চল্লিশ বছর আগে ওনার আয় ছিল বছরে আট থেকে দশ হাজার।
আমি নিশ্চিত,
উনি কখনোই বছরে চারশোর বেশি খরচ করেন নি। টাকা পয়সার
ব্যাপারে উনি অসম্ভব রকমের সাবধানী ছিলেন। আমি বিশ্বাস করি, উনি প্রতিটি পাই পয়সার হিসাব রাখতেন।"
"আর এই সময়ে ওনার
উপার্জন গুলো জমা হতো কম্পাউন্ড ইন্টারেস্টের সাথে। সোনা, তুমি একজন ধনী মহিলা হতে চলেছো।"
ক্যাথেরিন গ্রে মাথা
নাড়লো।
"হ্যাঁ।" সে
বললো,
"হতে চলেছি।"
সে একটু উদাসীন, ছাড়া ছাড়া ভাবে কথা বলছিলো, যেন দূর থেকে সে সমস্ত
ব্যাপারটা দেখছে।
"তাহলে," ডাক্তার বাবু,
যেতে যেতে বললেন, "তুমি আমার আন্তরিক অভিনন্দন গ্রহণ কোরো।" আর নিজের বুড়ো আঙ্গুল দিয়ে
মিসেস স্যামুয়েল হারফিল্ডের চিঠিটা একটু নাড়িয়ে দিয়ে বললেন। "এই মহিলার বা
ওনার এই ঘৃণ্য চিঠির ব্যাপারে কোনো চিন্তা কোরো না।"
"এটা কোনো ঘৃণ্য
চিঠি নয়,"
মিস গ্রে শান্ত ভাবে বললো। "পরিস্থিতির বিচার করে, আমার মনে হয় এটাই স্বাভাবিক।"
"মাঝে মাঝে তোমার
উপর আমার গভীর সন্দেহ হয়,"
ডাক্তার বাবু বললেন।
"কেন?"
"কারণ সমস্ত কিছু
তোমার কাছে একবারে স্বাভাবিক মনে হচ্ছে।"
ক্যাথেরিন গ্রে হাসলো।
ডাক্তার হ্যারিসন দুপুরে
খাওয়ার সময় সুসংবাদটি তাঁর স্ত্রীকে পরিবেশন করলেন। তিনিও এই খবরে উত্তেজিত হয়ে
উঠলেন।
"সৌখিন বৃদ্ধা
মিসেস হারফিল্ড - তাঁর এতো টাকা। আমি খুশি যে তিঁনি ওগুলো ক্যাথেরিন গ্রে কে দিয়ে
গেছেন। মেয়েটা একদম সন্ন্যাসিনীর মতো।"
ডাক্তার বাবু একটু রাগী
রাগী মুখ করলেন।
"আমি সব সময় মনে
করি সন্যাসিগুলো ভন্ড। ক্যাথেরিন গ্রে এতটাই মানবিক যে সে কখনো সন্ন্যাসিনী হতে
পারে না।"
"রসিকতা করে বললে
সে একজন সন্ন্যাসিনী।" ডাক্তার বাবুর স্ত্রী চোখ নাচিয়ে বললেন। "আর, আমার একদমই মনে হয় না যে তুমি কোনোদিন লক্ষ্য করে দেখেছো যে সে কতটা
সুন্দরী।"
"ক্যাথেরিন গ্রে," ডাক্তারবাবু সত্যিসত্যি অবাক হলেন।" তার চোখ দুটো খুব সুন্দর, আমি জানি।"
"ওঃ, তোমরা পুরুষরা,"
তাঁর স্ত্রী চিৎকার করে বললেন, "বাদুড়দের মতোই অন্ধ। সুন্দরী বলতে যা বোঝায়, তার সমস্ত কিছুই আছে ক্যাথেরিনের মধ্যে। যেটা দরকার সেটা হলো পোশাক।"
"পোশাক? তার পোশাক কি দোষ করলো?
তাকে তো সবসময়েই বেশ ভালো লাগে।"
মিসেস হ্যারিসন একটা বড়সড়
দীর্ঘশ্বাস ফেললেন,
আর ডাক্তার বাবু রুগী দেখতে যাবার জন্য উঠে দাঁড়ালেন।
"তুমি ওর সঙ্গে
একবার দেখা করতে পারো,
পলি,"
তিঁনি প্রস্তাব দিলেন।
"আমি দেখা
করবো।" মিসেস হ্যারিসন সাথে সাথে জানালেন।
মিসেস হ্যারিসন তার সাথে
বেলা তিনটের সময় দেখা করতে গেলেন।
"সোনাটা, আমি খুব খুশি হয়েছি,"
তিঁনি তার হাত দুটো ধরে, খুব উষ্ণতার সাথে বললেন।
"আর গ্রামের সবাই খুব খুশি হবে।"
"এটা আপনার মহানুভবতা
যে আপনি আমাকে একথা বলতে এসেছেন। ক্যাথেরিন বললো। "আমি আশা করছিলাম যে আপনি
আসবেন, কারন আমি জনির ব্যাপারে কিছু কথা জিজ্ঞেস করতে চাই।"
"ওঃ, জনি। আচ্ছা -"
জনি ছিল মিসেস হ্যারিসনের
ছোট ছেলে। পরের মিনিটেই তিঁনি ফিরে
গেলেন বিরাট পুরোনো ইতিহাসে যখন জনির এডেনোইডস আর টন্সিল বিশাল ফুলে উঠেছিল।
ক্যাথেরিন সমবেদনার সাথে তাঁর কথা শুনছিলো। অভ্যাস কখন মরে না। দশ বছর ধরে তার শুনে আসাই কাজ। "সোনা, আমার মনে পড়ছে না, তোমাকে কখনো পোর্টসমাউথে নৌবাহিনীর নাচের অনুষ্ঠানের কথা বলেছি কিনা? যখন লর্ড চার্লস আমার গাউনের খুব প্রশংসা করেছিলেন?" শান্ত ভাবে,
সহৃদয়তার সাথে ক্যাথেরিন জবাব দিতো: "আমার মনে হয় আপনি
বলেছিলেন,
মিসেস হারফিল্ড, কিন্তু আমি বোধয় ভুলে
গেছি, আপনি কি আরেকবার বলবেন?"
আর তারপর সেই বৃদ্ধা মহিলা পুরো দমে শুরু করতেন, প্রত্যেকটা খুঁটি নাটি বিস্তারিত ভাবে। ক্যাথেরিনের অর্ধেক মন তা শুনতো, যান্ত্রিক ভাবে উপযুক্ত কথাটা বলতো যখনি বৃদ্ধা থামাতেন....
এখন, সেই কৌতূহলের অদ্ভুত দ্বৈত অনুভূতি নিয়ে, যেটাতে সে অভ্যস্ত, সে মিসেস হ্যারিসনের কথা শুনতে লাগলো।
আধ ঘন্টা পরে, অপরজনের হটাৎ হুঁশ ফিরলো।
"আমি তো আমার কথাই
বলে যাচ্ছি এতক্ষন ধরে।" তিঁনি বিস্ময়ের সাথে বললেন, "আর আমি তো এখানে এসেছি তোমার কথা, তোমার পরিকল্পনা জানবো
বলে।"
"আমি জানি না, এখনো কোনো পরিকল্পনা নেই।"
"বাছা, তুমি নিশ্চই এখানেই পরে থাকবে না।"
অপরজনের গলায় ভয়ের স্বর
শুনে ক্যাথেরিন হাসলো।
"না, আমার বেড়ানোর ইচ্ছা আছে। জানেন, আমি পৃথিবীর প্রায় কিছুই
দেখি নি।"
"আমি চিন্তাও করতে
চাই না। কি ভয়ঙ্কর খাঁচাবন্দি একটা জীবন এতবছর ধরে তুমি এখানে কাটিয়েছো।"
"আমি জানি না," ক্যাথেরিন বললো,
"আমি এখানে অনেক স্বাধীনতা পেয়েছি।"
সে অপরজনকে ঢোক গিলতে
দেখলো, এবং একটু লাল হয়ে উঠলো।
"বলতে গেলে - এটা
বেশ বোকা বোকা শোনাচ্ছে। যদিও, শারীরিক স্বাধীনতা বলতে
যেটা বোঝায় সেটা খুব একটা ছিল না -"
"মনে হয় না," মিসেস হ্যারিসন একটা নিঃস্বাস নিয়ে বললেন, তাঁর মনে পরে গেলো
"ছুটি" বলে যে উপকারী জিনিসটা আছে তা ক্যাথেরিনের খুব কমই ছিল।
"কিন্তু, একরকম ভাবে বলতে পারি,
শারীরিক ভাবে আটকে গেলেও মানসিক ভাবে অনেক সুযোগ পাওয়া
যায়।"
মিসেস হ্যারিসন মাথা
নাড়লেন।
"আমি এসব বুঝি না।"
"ওঃ, আপনি বুঝতেন,
যদি আপনি আমার জায়গায় থাকতেন। কিন্তু, যা হোক,
আমি মনে করি, আমার একটা পরিবর্তন প্রয়োজন।
আমি চাই - কি বলবো,
আমি চাই কোনো একটা ঘটনা ঘটুক। ওঃ, আমার সাথে না - আমি একথা বলতে চাই নি। কিন্তু কোনো ঘটনার মধ্যমনি হিসেবে থাকা, উত্তেজক ঘটনা – যে ঘটনার আমিই একমাত্র দর্শক। জানেন তো, সেইন্ট মেরি মিড এ কোনো আকর্ষণীয়
ঘটনাই ঘটে না।"
"না, কিছুই ঘটে না।" মিসেস হ্যারিসন উৎসাহের সাথে বললেন।
"প্রথমে আমি লন্ডন
যাবো,
"ক্যাথেরিন বললো। "আমাকে আইনজীবীর সাথেও দেখা করতে হবে।
তারপর আমি বিদেশ যাবো,
আশা করি।"
"খুব ভালো।"
"কিন্তু, সবার আগে -"
"হ্যাঁ?"
"আমার কিছু পোশাক
দরকার।"
"এক্কেবারে ঠিক, এই কথাই আমি আর্থার কে আজ সকালে বলছিলাম।" ডাক্তারবাবুর স্ত্রী কেঁদে
ফেললেন। "তুমি জানো,
ক্যাথেরিন, তুমি যদি একটু চেষ্টা করো, তাহলে তোমাকে অসাধারণ সুন্দরী লাগবে।"
মিস গ্রে সরলভাবে হাসলো।
"ওঃ, আমার মনে হয় না আমাকে আপনি সুন্দরী বানাতে পারবেন।" সে আন্তরিকভাবে বললো।
"কিন্তু কিছু ভালো পোশাক পেলে, আমি সত্যি সেগুলো উপভোগ
করবো। আমি মনে হয় নিজের বিষয়ে বড্ডো বেশি কথা বলছি।"
মিসেস হ্যারিসন তার দিকে
চতুরভাবে তাকিয়েছিলেন।
"এটা তোমার জন্য
নিশ্চয় একটা অভিনব অভিজ্ঞতা," তিঁনি শুকনোভাবে বললেন।
ক্যাথেরিন গ্রাম ছেড়ে
যাবার আগে বৃদ্ধা মিস ভিনেরের সাথে দেখা
করে তাঁকে বিদায় জানালো। মিস ভিনের মিসেস হারফিল্ডের থেকে দু বছরের বড়, এবং তাঁর মনে একটাই প্রশান্তি যে তিঁনি তাঁর মৃত বন্ধুর থেকে বেশিদিন বেঁচে
আছেন।
"তুমি কোনোদিন
ভাবতে পারো নি যে আমি জেন হারফিল্ডের থেকে বেশিদিন বাঁচবো, ঠিক কিনা?"
তিঁনি বিজয়িনীর মতো ক্যাথেরিনের কাছে জানতে চাইলেন। " আমরা
দুজনে একসাথে স্কুলে পড়তাম,
সে এবং আমি। আর আজ, সে নেই, আমি রয়ে গেছি। একথা কে ভেবেছিলো?"
"আপনি সন্ধ্যাবেলার
খাওয়ার সময় সবসময় ব্রাউন ব্রেড খেতেন, তাই না?" ক্যাথেরিন যান্ত্রিকভাবে বিড়বিড় করে বললো।
"আশ্চর্য, বাছা,
তুমি একথা মনে রেখেছো। হ্যাঁ; জেন হারফিল্ড ও যদি এক খানা করে ব্রাউন ব্রেড খেত প্রত্যেক সন্ধ্যাবেলা আর
খাবারের সাথে শরীর চাঙ্গা রাখার মতো কিছু খেত তাহলে আজ হয়তো সে এখানেই
থাকতো।"
বৃদ্ধা থামলেন, বিজয়িনীর মতো মাথা নাড়তে থাকলেন, তারপর হঠাৎ তাঁর মনে
পড়লো:
"শুনলাম, তুমি নাকি অনেক টাকা পেয়েছো?" ভালো, ভালো। সাবধানে রেখো। আর তুমি নাকি লন্ডনে যাচ্ছ জীবনকে উপভোগ করার জন্য? কিন্তু বিয়ে করার কথা যেন চিন্তাও কোরো না, বাছা, কারন তুমি তা পারবে না। আর তুমি সেই ধরণের মেয়ে নও যারা সবসময় পুরুষদের আকর্ষণ
করার চেষ্টা করে। আর তোমার বয়সও হচ্ছে। এখন
তোমার বয়স যেন কত?"
"তেত্রিশ।"
ক্যাথেরিন তাঁকে বললো।
"আচ্ছা," মিস ভিনের একটু চিন্তিতভাবে মন্তব্য করলেন, "এটা তেমন খারাপ কিছু নয়। কিন্তু, অবশ্যই, তুমি তোমার যৌবনের অনেকটাই পার করে ফেলেছো।"
"আমারও সেটাই মনে
হয়।" ক্যাথেরিন পুলকতার সাথে বললো।
"কিন্তু, তুমি একজন খুব ভালো মেয়ে।" মিস ভিনের দয়ালুভাবে বললেন। "আর আমি
নিশ্চিত যে ওখানে অনেক পুরুষ আছে যারা তোমাকে স্ত্রী হিসেবে কামনা করার বদলে সেই
সব প্রাণীদের পেছনে ঘুরে বেড়াবে যারা স্রষ্টা যতটা না চান তার থেকেও বেশি পা
দেখিয়ে ঘুরে বেড়ায়। বিদায়,
বাছা, আশা করি তুমি তোমার জীবন
উপভোগ করবে,
কিন্তু জীবনে দূর থেকে যা দেখা যায়, বাস্তবিকে তা সম্পূর্ণ আলাদা।"
এইসব হৃদয়গ্রাহী
ভবিষ্যৎবাণী শুনে,
ক্যাথেরিন বেরিয়ে পড়লো। প্রায় অর্ধেক গ্রামের লোক এসেছিলো
স্টেশনে তাকে বিদায় জানাতে,
তার ছোট্ট পরিচারিকা, এলিস ও এসেছিলো, সে একটা ফুলের তোরাও এনেছিল এবং সবার সামনেই কাঁদছিলো।
"ওনার মতো আর কেউ
নেই,"
এলিস ফোঁপাতে ফোঁপাতে বলছিলো যখন ট্রেনটা ছেড়ে দিলো।
"আমি বলছি,
চার্লি যখন আমাকে ছেড়ে ওই ডেইরির মেয়েটার সাথে চলে গেছিলো, তখন মিস গ্রের মতো কেউ আমার পাশে এসে দাঁড়ায় নি, যদিও পিতলের জিনিস এবং ধুলোর ব্যাপারে একটু খুঁত খুঁতে ছিলেন, তবুও পরিষ্কার হলে পরে তাঁর নজর এরাতো না। ওনার জন্য আমি নিজেকে কুটিকুটি করে
কেটেও ফেলতে পারি,
যেকোনো দিন। ওনাকে আমি আদর্শ মহিলা হিসেবেই দেখি।"
এভাবেই ক্যাথেরিন সেইন্ট
মেরি মিড থেকে রওনা দেয়।
চ্যাপ্টার ৮
লেডি ট্যাম্পলিং
একটা চিঠি লিখলেন
"আচ্ছা," লেডি ট্যাম্পলিং বললেন,
"আচ্ছা।"
মহাদেশীয় ডেইলি মেইলটা
রেখে তিনি ভূমধ্যসাগরের নীল জলের দিকে তাকিয়ে থাকলেন। লজ্জাবতী লতার একটা সোনালী
ডাল ঠিক তাঁর মাথার উপর ঝুলছিলো, পুরো দৃশ্যটাই একটা
সুন্দর ছবির ফ্রেম এর মতো লাগছিলো। নীল চোখ, সোনালী চুলের এক মহিলা
ঘরোয়া পোশাকে বসে আছেন। একথা অস্বীকার করা যায় না, যে দেখে মনে হয় তাঁর সোনালী চুলটা যেন কোনো হাতে আঁকা ছবি থেকে নেওয়া, এবং তাঁর গোলাপি সাদা রঙের ত্বকও যেন সেই ছবিরই আরেকটা অঙ্গ, কিন্তু তাঁর চোখের নীল রংটা পুরোপুরি প্রকৃতির উপহার, আর এই চুয়াল্লিশ বছর বয়সেও লেডি ট্যাম্পলিংকে সুন্দরী বলা যায়।
যদিও তাঁকে মনোমুগ্ধকর
দেখতে লাগছিলো,
লেডি ট্যাম্পলিং কিন্তু, একবারের জন্যেও নিজের কথা
ভাবছিলেন না। বলতে গেলে,
নিজেকে কেমন দেখতে লাগছে, সে ব্যাপারে তিনি বিন্দুমাত্র চিন্তিত ছিলেন না। তিনি খুব মন দিয়ে খুব গুরুতর
একটা ব্যাপার নিয়ে ভাবছিলেন। রিভিয়েরাতে লেডি ট্যাম্পলিং একজন খুবই পরিচিত চরিত্র, আর ভিলা মার্গেরিতে তে ওনার পার্টিগুলো ব্যাপকভাবে প্রসিদ্ধ। তিনি একজন অপার
অভিজ্ঞতাসম্পন্ন মহিলা,
এবং তাঁর স্বামীর সংখ্যা, চার। প্রথমজন ছিলেন শুধুমাত্র
একটা হঠকারিতার ফল,
তাই মহিলা তাঁর কথা খুব কমই উল্লেখ করেন। তাঁর খুব তাড়াতাড়ি
শুভবুদ্ধির উদয় হয়,
এবং সাথে সাথে পরলোকে গমন করেন, এরপর তাঁর বিধবা একজন ধনী বোতাম কারখানার মালিক কে বিয়ে করেন। তিঁনিও
বিবাহিত জীবনের তিনটে বছর পার হতে না হতে
অন্যলোকে গমন করেন - শোনা যায় কিছু সমনস্ক সঙ্গীদের সাথে একটা সুন্দর সন্ধ্যা
কাটানোর পরেই অঘটনটা ঘটে। এরপর এলেন ভিসকাউন্ট ট্যাম্পলিং, উনিই রোসালিয়ে কে এমন এক উচ্চতায় প্রতিষ্ঠিত করেন যেখানে পৌঁছনোটাই তাঁর
লক্ষ্য ছিল। রোসালিয়ে চতুর্থ বিয়েটা করার
পরেও টাইটেল টা ছাড়েন নি। চতুর্থ উদ্যোগটা শুধুমাত্র বাসনা চরিতার্থের উদ্দেশ্যে।
মিস্টার চার্লস ইভান্স একজন সাতাশ বছর বয়সী অনিন্দ সুন্দর যুবক, আচার ব্যাবহারও অতীব মনোরম, খেলা ধুলায় উৎসাহী, এবং এই পৃথিবীতে যা কিছু সুন্দর সেই সব কিছুর তিঁনি গুণগ্রাহী, তাঁর নিজের কোনো টাকা পয়সা নেই। লেডি ট্যাম্পলিং সাধারণভাবে নিজের জীবন নিয়ে
বেশ খুশি এবং তৃপ্ত,
কিন্তু মাঝে মাঝে তাঁকে টাকা পয়সার ব্যাপারে একটু ব্যাস্ত
থাকতে হয়। বোতাম কারখানার মালিক তার বিধবার জন্য বেশ মোটা অংকের সম্পত্তি রেখে
গেছিলেন,
কিন্তু, লেডি ট্যাম্পলিং একটা
কথাই বার বার বলেন যে,
"এই মূল সমস্যা এবং আনুসাঙ্গিক সমস্যাটা যে কি -" (মূল
সমস্যা হলো যুদ্ধের কারণে স্টকের দাম কমে যাওয়া, এবং
আনুসাঙ্গিক সমস্যাটা হলো মৃত লর্ড ট্যাম্পলিং এর অপব্যয়।) যথেষ্ট সাচ্ছন্দেই তাঁর
জীবন কেটে যাচ্ছে। কিন্তু শুধুমাত্র সাচ্ছন্দে জীবন কাটানোটা রোসালিয়ে
ট্যাম্পলিংয়ের মেজাজের কাছে মোটেই সন্তোষজনক নয়।
জানুয়ারির সেই বিশেষ
সকালে, কোনো একটি বিশেষ সংবাদ পড়ার সাথে সাথে তিনি তার নীল চোখ দুটো বড় বড় করে একটাই
কথা বলে উঠলেন,
"আচ্ছা।"
ব্যালকনিতে অন্য আরেকজনও যে
ছিল, তাঁর মেয়ে। মাননীয়া লেনক্স ট্যাম্পলিং।
লেডি ট্যাম্পলিং এর কাছে লেনক্স হচ্ছে এক দুঃখের কাঁটা, এমন এক মেয়ে যে নাকি তেমন চালাক চতুর নয়, দেখতে তাঁর থেকেও যেন বয়স্ক
মনে হয়, আর তার ব্যাঙ্গাত্মক রসিকতাগুলোর সম্বন্ধে, কম করে বললেও, অস্বস্তিকর।
"সোনা," লেডি ট্যাম্পলিং বললেন,
"একবার ভাব।"
"কি বলছো?"
লেডি ট্যাম্পলিং ডেইলি
মেইল তা তুলে নিলেন,
এবং সেটি তাঁর মেয়ের দিকে এগিয়ে দিলেন, আর কাঁপা কাঁপা আঙুলে দরকারি অনুচ্ছেদটার দিকে নির্দেশ করলেন।
তার মা খবরটা যখন খবরটা
পড়ছিলেন তখন তাঁর মুখে যে রকম অভিব্যাক্তি ফুটে উঠছিলো সে রকম কোনো অভিব্যাক্তি
ছাড়াই লেনক্স সেটা পরে ফেললো। পড়া হয়ে গেলে সে কাগজটা ফেরত দিয়ে দিলো।
"এটার মধ্যে কি আছে?" সে জিজ্ঞেস করলো। "এরকম জিনিস তো হামেশাই ঘটছে। প্রায় গ্রামের দিকে কিপ্টে, বৃদ্ধা মহিলারা মারা যাবার সময় তাঁদের সম্পত্তি গরিব সহায়িকাদের দিয়ে যান।
"হ্যাঁ, বাছা,
আমি জানি," তার মা বললেন, "আর আমি একথাও জানি যে সম্পত্তিটা যতটা বড় বলা হয়েছে, ততটা বড়ও নয়;
খবরের কাগজগুলো এতো বাড়িয়ে বলে। কিন্তু তাও যদি তুমি এটার
অর্ধেকও ধরো -"
"আচ্ছা," লেনক্স বললো,
"এটা কিন্তু আমাদের কেউ দিয়ে যায় নি।"
"ঠিক তা নয়, বাছা,
" লেডি ট্যাম্পলিং বললেন, "কিন্তু এই মেয়েটা,
এই ক্যাথেরিন গ্রে, আসলে আমার এক তুতো বোন। ওরসেস্টারশায়ারের
গ্রে দেড় একজন,
এজওয়ার্থদের দিকের। আমার নিজের তুতো বোন! ভাব একবার!"
"আঃ - হাঃ।"
লেনক্স বললো।
"আর আমি ভাবছিলাম
-" তার মা বললো।
"এতে আমাদের জন্য
কি আছে,"
মুখে সেই অদ্ভুত হাসিটা নিয়ে লেনক্স কথাটা শেষ করলো,যা তার মা কোনো সময়েই বুঝতে পারেন না।
"ওঃ, সোনা,"
লেডি ট্যাম্পলিং মৃদু বকুনির সুরে বললেন।
সুরটা খুবই মৃদু ছিল, কারণ লেডি ট্যাম্পলিং তাঁর মেয়ের স্পষ্টভাষিতার সাথে পরিচিত, এবং তাঁর কথায় এটাই লেনক্স এর কোনো জিনিসকে অস্বস্তিকর ভাবে উপস্থাপনা করা।
"আমি ভাবছিলাম," লেডি ট্যাম্পলিং,
তাঁর ছবির মতো সরু ভুরু দুটোকে একসাথে করে বললেন, "যদি -,
ওঃ,
সুপ্রভাত, ছুব্বি সোনা, তুমি কি টেনিস খেলতে যাচ্ছ, কি ভালো!
ছুব্বি, যাকে কথাটা বলা হলো,
তাঁর দিকে তাকিয়ে হাসলেন, আর অযৌক্তিক একটা মন্তব্য করলেন, "এই পীচ রঙের জিনিসটাতে তোমাকে অসাধারণ লাগছে।"
"আমার খুবই পছন্দের
জিনিস,"
নিজের স্বামীর দিকে একটা প্রেমপূর্ণ চাউনি দিয়ে লেডি
ট্যাম্পলিং বললেন।
"তাহলে, আমি যেন কি বলছিলাম?
আঃ!" তিঁনি তাঁর মনটাকে আবার কাজের দিকে ফিরিয়ে আনলেন, "আমি ভাবছিলাম -"
"ওঃ, ঈশ্বরের দোহাই,
এবার আগে বারো। এই নিয়ে তিনবার তুমি একই কথা বললে।
"আচ্ছা, বাছা,"
লেডি ট্যাম্পলিং বললেন, "আমি ভাবছিলাম,
যদি আমি প্রিয় ক্যাথেরিন কে একটা চিঠি লিখি এবং তাকে এখানে
আসতে অনুরোধ করি। স্বাভাবিকভাবেই, সোসাইটির কারোর সাথেই তার
কোনো যোগাযোগ নেই। এটা তার পক্ষেই ভালোই হবে যদি তার কোনো আপনজন তাকে উপস্থাপনা
করে। এটা যেমন তারও সুবিধা আবার আমাদেরও সুবিধা।"
"তুমি তার থেকে কত
টাকা আদায় করতে পারবে বলে মনে করো?" লেনক্স জিজ্ঞেস করলো।
তার মা তার দিকে ভর্ৎসনার
চোখে তাকিয়ে বিড়বিড় করতে থাকলেন।
"আমাদের অবশ্যই, একটা আর্থিক চুক্তির মধ্যে আসতে হবে। এই মূল সমস্যা এবং আনুসাঙ্গিক সমস্যাটা
কি ভাবে সামলানো যাবে - যুদ্ধ - তোমার বেচারা বাবা -"
"আর এখন ছুব্বি," লেনক্স বললো,"
যদি চিন্তা করে দেখো ও একজন ব্যায়বহুল বিলাসিতা।"
"যতদূর মনে পরে ও
একজন ভালো মেয়ে ছিল। " নিজের মনেই চিন্তা করতে করতে লেডি ট্যাম্পলিং বিড়বিড়
করে বলতে থাকলেন - "শান্ত, নিজের মতামত চাপিয়ে দিতো
না, সুন্দরী নয়,
আর পুরুষ-শিকারী তো একদমই নয়।"
"তাহলে, ও ছুব্বির দিকে নজর দেবে না?" লেনক্স বললো।
"ছুব্বি কোনোদিনই
-" তিঁনি বললেন।
"না," লেনক্স বললো,
"আমার মনে হয় না সে করবে, সে ভালো করেই জানে রুটির
কোন দিকটা মাখন লাগানো।"
"সোনা," লেডি ট্যাম্পলিং বললেন,
"তুমি এতো কঠোরভাবে কথাগুলো বলো।"
"দুঃখিত," লেনক্স বললো।
লেডি ট্যাম্পলিং ডেইলি
মেইলটা, তাঁর ঘরে পড়ার পোশাক,
ভ্যানিটি ব্যাগ, আর অনেকগুলো টুকি টাকি
চিঠি পত্র গুছিয়ে নিলেন।
"আমি প্রিয়
কাথেরিনকে এখনই একটা চিঠি লিখবো," তিঁনি বললেন, "আর তাকে এজওয়ার্থের পুরোনো দিনের কথা মনে করিয়ে দেব।"
তিঁনি বাড়ির ভেতর গেলেন, তাঁর চোখে তাঁর উদ্দেশ্যের একটা আলো খেলা করছিলো।
ওনার ক্ষেত্রে ব্যাপারটা
মোটেই মিসেস স্যামুয়েল হারফিল্ডের মতো নয়, চিঠি পত্র লেখালেখি তে
তাঁর কলম খুব অনায়াসেই চলে। একবারও না থেমে বা অনায়াসেই তিঁনি চার পাতা লিখে
ফেললেন, তারপর তাতে আর একবার চোখ বুলিয়েও তিঁনি, একটাও শব্দ পরিবর্তনের
প্রয়োজন দেখলেন না।
ক্যাথেরিন যেদিন লন্ডনে
পৌছুলো, সেদিনই সকালে সে সেটা পেলো। চিঠিটার সত্যিকারের মানেটা বুঝলো কিনা সেটা অবশ্য অন্য ব্যাপার।
চিঠিটা সে হ্যান্ডব্যাগে
ঢুকিয়ে রেখে মিসেস হারফিল্ডের আইনজীবীর সাথে যে এপয়েন্টমেন্ট করেছিল, সেটা রাখতে বেরোলো।
ফার্মটি লিংকনের ইন
ফিল্ডসে বহু কাল আগে প্রতিষ্ঠিত, আর কিছুক্ষন অপেক্ষার পর
ক্যাথেরিনের একজন প্রবীণ অংশীদারের সঙ্গে আলোচনা হলো, দয়ালু,
বয়স্ক এবং নীল চোখের একজন ভদ্রলোক, ব্যবহারেও বেশ পিতৃসুলভ।
তারা কিছুক্ষন মিসেস
হারফিল্ডের ইচ্ছাপত্রের আইনি দিকগুলো নিয়ে আলোচনা করলো। তারপর ক্যাথেরিন মিসেস
স্যামুয়েলের চিঠিটি তাঁর হাতে তুলে দিলো।
"আমার মনে হয়, এটা আপনার দেখা দরকার,"
সে বললো, "যদিও, এটা অদ্ভুত রকমের হাস্যকর।"
তিঁনি মৃদু হাসি হাসি
মুখে চিঠিটি পড়লেন।
"একটা খুব অপরিণত
একটা প্রচেষ্টা,
মিস গ্রে। আমার বলার প্রয়োজনই নেই যে, এইসব লোকেদের সম্পত্তিতে বিন্দুমাত্র অধিকার নেই, যদি এঁরা এই ইচ্ছাপত্রকে চ্যালেঞ্জ করতে যান, তবে কোনো আদালতেই তা ধোপে টিকবে না।"
"আমিও তাই
ভেবেছিলাম।"
"মানুষের স্বভাব
সবসময় সৎ থাকে না। মিসেস স্যামুয়েল হারফিল্ডের জায়গায় থাকলে, আমি তোমার দানভিক্ষার জন্য প্রার্থনা করতাম।"
"এই ব্যাপারটা নিয়ে
আমি আপনার সাথে কথা বলতে চাইছিলাম। আমি চাই এঁরাও কিছু টাকা পান।"
"কোনো বাধ্যবাধকতা
নেই।"
"আমি জানি।"
"কিন্তু এঁরা এর
আসল মর্ম বুঝবে না। এঁরা ভাববে ভয় পেয়ে টাকা দিয়ে মুখ বন্ধ করানো হচ্ছে, যদিও কোনো অবস্থাতেই তাঁরা টাকা নিতে না বলবে না।"
"আমি বুঝতে পারছি, কিন্তু কি আর করা যাবে।"
"আমি আপনাকে
পরামর্শ দেব,
মিস গ্রে, এই চিন্তা আপনি আপনার
মাথা থেকে বার করে দিন।"
ক্যাথেরিন তাঁর মাথা
ঝাঁকালো,
"আমি জানি, আপনি একদমই ঠিক, কিন্তু তাও আমি এটা করতে চাই।"
"এঁরা টাকাটা হজম
করে নেবেন এবং আপনার বিরুদ্ধে এর পরে আরো অনেক কুকথা ছড়াবেন।"
"ঠিক আছে," ক্যাথেরিন বললো,
"ওঁদের যা ভালো লাগে করতে দিন, আমরা আমাদের মতো করে জীবনকে উপভোগ করবো। যতই হোক, ওনারা মিসেস হারফিল্ডের একমাত্র আত্মীয়, যদিও ওনারা ওনাকে আত্মীয়
হিসেবে ঘৃণা করতেন,
এবং তিঁনি যখন বেঁচে ছিলেন তখন ওনার কোনো খোজঁখবরই রাখতেন
না, তবুও আমার মনে হয় ওনাদের একেবারে কিছু না দেওয়াটা অন্যায্য হবে।"
ক্যাথেরিন তার যুক্তিটি
রাখলো, যদিও আইনজীবীটি তখনও এব্যাপারে অনিচ্ছুক, আর এখন অনায়াসেই সে
লন্ডনের রাস্তায় কোনো চিন্তা ভাবনা ছাড়াই কেনাকাটা করতে পারবে এবং নিজের ইচ্ছামতো ভবিষ্যতের
পরিকল্পনাও করতে পারবে। তার প্রথম কাজ হলো একজন বিখ্যাত পোশাক প্রস্তুতকারকের
দোকানে যাওয়া।
একজন পাতলা চেহারার, বয়স্ক ফরাসি মহিলা,
যিনি একটু স্বপ্নালু গম্ভীর প্রকৃতির তাকে অভ্যর্থনা জানালেন, এবং ক্যাথেরিন এমন ভাবে তাঁর সাথে কথা বলতে লাগলো, যে শুনলেই বোঝা যায় যে এব্যাপারে সে একেবারেই আনাড়ি।
"আমি, নিজেকে,
পুরোপুরি আপনার হাতেই ছেড়ে দিলাম। আমি সারাজীবনই খুব গরিব ছিলাম এবং পোশাক আসাকের ব্যাপারে
কিছুই জানি না। কিন্তু এখন আমি কিছু টাকা পয়সা পেয়েছি এবং এখন নিজেকে সুন্দর
পোশাকে সাজিয়ে তুলতে চাই।"
ফরাসি মহিলাটি তার
ব্যাবহারে মুগ্ধ হয়ে গেছিলো। তাঁর মধ্যে একটা শিল্পী সুলভ মনোভাব ছিল, যা নাকি আজ সকালে আর্জেন্টিনীয় মাংসের রানীর সঙ্গে দেখা হবার পর বেশ চটকে
গেছিলো, যে নাকি এমন সব পোশাক পছন্দ করছিলো, যেগুলো তার প্রসাধনী
সৌন্দর্যের সঙ্গে একদমই মানায় না। তিঁনি কাথেরিনকে তাঁর তীক্ষ্ণ, চতুর চোখ দিয়ে নিরীক্ষণ করতে লাগলেন। "ঠিক - ঠিক, এটা খুবই তৃপ্তিদায়ক হবে, মাদমোইজেলের গঠন খুবই
সুন্দর; ওনাকে সাধাসিধা ধরণের পোশাকই সব থেকে ভালো মানাবে। ওনাকে একজন ইংরেজ মহিলার মতোই দেখতে। অনেককে একথা বললে
অপমানিত বোধ করে,
কিন্তু মাদমোইজেলের ক্ষেত্রে, না। একজন সুন্দরী ইংরেজ মহিলার জন্য এর থেকে ভালো স্টাইল আর হতে পারে
না।"
স্বপ্নালু গম্ভীর প্রকৃতি
ঝট করে নিমেষে সরে গেলো। তিঁনি চিৎকার করে দোকানের বিভিন্ন প্রদর্শনকারিনীদের নির্দেশ দিতে থাকলেন।
"ক্লোথিল্ডে,
ভির্জিনিয়ে, জলদি, আমার ছোট পোশাকগুলো,
আমার ছোট হালকা ধূসর রঙের স্যুট এবং সান্ধ্য পোশাক শরতের
দীর্ঘশ্বাস। মার্সেলে,
সোনা আমার, ছোট মিমোসা স্যুটটা ক্রেপ
ডি চাইনের।
সেটা ছিল এক মনোমুগ্ধকর সকাল। মার্সেলে, ক্লোথিল্ডে, ভির্জিনিয়ে,
বিরক্ত আর অবজ্ঞার সাথে আসছিলো আর যাচ্ছিলো, যথাসম্ভব তাড়াতাড়ি,
চটপট করে অনেকটা সেই চিরকালীন পোশাকের দোকানের প্রদর্শনকারী
পুতুলগুলোর মতো। গম্ভীর মহিলাটি ক্যাথেরিনের পাশে দাঁড়িয়েছিলেন এবং একটা নোটবুকে
কি সব লিখছিলেন।
"অসম্ভব ভালো পছন্দ, মাদমোয়েজেল। মাদমোয়েজেলের পছন্দ
অসাধারণ। হ্যাঁ,
অবশ্যই। মাদমোয়েজেল, যদি এই শীতে, রিভিয়েরা যান,
তাহলে এই ছোট স্যুটগুলো তো অবশ্যই নিতে হবে।"
"আমাকে ওই সান্ধ্য
পোশাকটা আরেকবার দেখান না,
"ক্যাথেরিন বললো - "ওই পিঙ্কী মভ রঙের টা।"
ভির্জিনিয়ে এলো এবং ধীরে
ধীরে গোল করে ঘুরতে লাগলো।
"এটাই সবথেকে
সুন্দর,"
ক্যাথেরিন মভ, ছাই ছাই, নীল রঙের পোশাকটা দেখতে দেখতে বললো। "এটাকে কি বলে?"
"শরতের দীর্ঘশ্বাস; হ্যাঁ,
হ্যাঁ, এই পোশাকটা মাদমোয়েজেলের
জন্যই তৈরি।"
কথাগুলোর মধ্যে এমন কিছু
ছিল যা নাকি সে পোশাক প্রস্তুতকারীর দোকান থেকে বেরিয়ে আসার পরেও ক্যাথেরিনের কাছে
তা একটা মৃদু দুঃখের মতো ফিরে আসছিলো।
"শরতের দীর্ঘশ্বাস; এই পোশাকটা মাদমোয়েজেলের জন্যই তৈরি।"
শরৎ, হ্যাঁ,
এটা তার জন্য শরৎই। সে, যে কিনা বসন্ত বা
গ্রীষ্মের ব্যাপারে কোনোদিন জানতে পারে নি, বা এখনো তাদের বিষয়ে
জানতে চায় না। এমনকিছু সে হারিয়েছে যা আর কোনোদিন ফেরত পাওয়া সম্ভব নয়। এতো বছর
ধরে সেইন্ট মেরি মিডে শুধু কাজের ব্যাস্ততা - আর জীবন পেরিয়ে গেছে।
"আমি একজন বোকা," ক্যাথেরিন বললো,
"আমি একজন বোকা। আমি জানিনা, আমি কি চাই?
কেন মনে হচ্ছে, মাস খানেক আগেও আমি এখনকার
থেকে অনেক শান্তিতে ছিলাম।"
সে হ্যান্ডব্যাগ থেকে
ঐদিন সকালে লেডি ট্যাম্পলিংয়ের যে চিঠিটা পেয়েছিলো সেটা বার করলো। ক্যাথেরিন বোকা না।
সে অন্য অনেক লোকের মতো ভালোই বুঝতে পারছিলো যে লেডি ট্যাম্পলিংয়ের দীর্ঘ দিন আগে
ভুলে যাওয়া তুতো বোনের উপর হঠাৎ এতো ভালোবাসা দেখানোর কারণটা কি। এটা শুধু মাত্রই
নিজের মুনাফার জন্য এবং কখনোই তুতো বোনকে কাছে পাওয়ার জন্য না। ঠিক আছে, তাতে কি?
যেখানে দু পক্ষেরই লাভ।
"আমি যাবো," ক্যাথেরিন বললো।
সে পিকাডিলি দিয়ে হাটছিলো, যাওয়ার ব্যাপারটা তখনি ঠিক করার জন্য সে কুকে ঢুকলো। তাকে কয়েক মিনিট অপেক্ষা
করতে হলো। কর্মচারীটি যে ভদ্রলোকটির সঙ্গে কথা বলছিলো তিনিও রিভিয়েরা যাবেন। তার
মনে হলো,
সবাই যেন রিভিয়েরা যাচ্ছে। ভালোই, জীবনে প্রথমবার সে এমন এক কাজ করতে চলেছে যা 'সবাই করেছে'।
তার সামনের ভদ্রলোকটি
হটাৎ করে ঘুরে দাঁড়ালেন এবং সে তাঁর জায়গায় গিয়ে দাঁড়ালো। সে কর্মচারীটি কে তার কি
চাই জানালো,
কিন্তু একই সময় তার অর্ধেক মন জুড়ে এক অন্য চিন্তা কাজ
করছিলো। ওই লোকটার মুখটা - যেন খুব অস্পষ্ট ভাবে তার কাছে পরিচিত। সে তাকে আগে
কোথায় দেখেছে?
হঠাৎ ই তার মনে পরে গেলো, স্যাভয়ে সেদিন সকালেই তার ঘরের সামনে।
তার সাথে প্যাসেজ এ
ধাক্কা লাগতে যাচ্ছিলো।
এটা অদ্ভুত কাকতালীয় ঘটনা
যে একই লোকের সঙ্গে একই দিনে দ্বিতীয়বার দেখা হয়ে গেলো। সে ঘাড় ফিরিয়ে একবার
তাকালো, কোনো একটা কিছু যেন তার অস্বস্তিকর লাগছিলো, সে ঠিক বুঝতে পারছিলো না। একটা ঠান্ডা স্রোত ক্যাথেরিনের ওপর দিয়ে বয়ে গেলো; সে বিয়োগান্ত ঘটনার গন্ধ পায়, আসন্ন সর্বনাশের...
সে এসবের সমস্ত ছাপ সরিয়ে
আবার সুস্থ চেতনায় ফিরে এলো এবং তার সমস্ত মনোযোগ কর্মচারীটি যা বলছিলো সেইদিকে
দিলো।
চ্যাপ্টার ৯
একটা প্রস্তাবের
প্রত্যাখ্যান
ডেরেক কেটারিং রাগের বসে
কোনো কাজ করেছে,
এটা খুবই বিরল ঘটনা। এক আয়েশি উদাসীনতা তার চরিত্রের মূল
বৈশিষ্ট,
এবং এই বৈশিষ্টই তাকে বেশ কয়েকবার বিব্রতকর পরিস্থিতি থেকে
উদ্ধার করেছে। এখনো,
যখন সে মিরেলের ফ্ল্যাট থেকে বেরোলো, তখন সে একেবারে শান্ত। তার এখন মাথা ঠান্ডা রাখার বিশেষ প্রয়োজন। এখন সে যা
পরিস্থিতিতে পড়েছে,
এরকম জটিল পরিস্থিতিতে সে আগে কখনো পরে নি, অনেকগুলো অপ্রত্যাশিত বিষয় উঠে এসেছে, এই মুহূর্তে সেগুলো কি
করে সামলানো যাবে,
সে ব্যাপারে তার কোনো ধারণা নেই।
সে গভীর ভাবে চিন্তা করতে
করতে হাটছিলো। তার ভুরুগুলো কুঁচকে ছিল, এবং তার সহজ, স্ফূর্তিবাজ স্বভাবের,
যা নাকি তার পরিচিতি, তার কোনো চিহ্নই ছিল না।
অনেকরকম সম্ভবনা তার মনে খেলা করছিলো। ডেরেক কেটারিং সম্পর্কে এ কথা বলা যায় যে
তাকে যতটা বোকা দেখায় সে আসলে ততটা বোকা নয়। সামনে সে অনেকগুলো রাস্তা দেখতে
পাচ্ছিলো - তার মধ্যে একটার ব্যাপারে সে বেশ আগ্রহী। এটার থেকে সরার চিন্তা যদি
কখনো তার মাথায় আসে,
তবে তা এক মুহূর্তের জন্যই শুধু।
মর্মান্তিক অসুখের জন্য
মরিয়া সমাধান প্রয়োজন। সে তার শশুর মশাইকে সঠিক ভাবেই মূল্যায়ন করেছিল। রুফুস
ভ্যান আলদীন এবং ডেরেক কেটারিং এর মধ্যে যুদ্ধ হলে তার একটাই পরিনাম হবে। ডেরেক
টাকা এবং টাকার ক্ষমতাকে ভীষণভাবে ঘৃণা করে। সে সেইন্ট জেমস স্ট্রিট ধরে হাটতে
হাটতে, পিকাডিলি এসে পৌঁছলো,
সে একই রাস্তা ধরে পিকাডিলি সার্কাসের দিকে হাটতে থাকলো।
যখন মেসার্স থমাস কুক এন্ড সন্স এর অফিসের সামনে দিয়ে যাচ্ছিলো তার হাঁটা আপনা
আপনি শিথিল হয়ে এলো। সে হাঁটছিলো, যদিও, তার মনে ব্যাপারটা নিয়ে একটা উথাল পাথাল চলছিল। শেষে, সে একবার সামান্য মাথাটা নাড়িয়ে, আচমকা ঘুরে দাঁড়ালো -
এতটাই আচমকা,
যে তার সঙ্গে দুজন পথচারীর, যারা তার পেছনে ছিল,
তাদের সঙ্গে ধাক্কা লেগে গেলো, এবং যেদিক থেকে এসেছিলো সেইদিকে ফিরে চললো। এবার আর সে কুক কে পেরিয়ে না গিয়ে, ভেতরে ঢুকলো। অফিসটা প্রায় ফাঁকা ছিল, এবং প্রায় সাথে সাথেই একজন
তাকে সাহায্য করতে এগিয়ে এলো।
"পরের সপ্তাহে আমি
নাইস যেতে চাই। আপনারা কি এ বিষয়ে সমস্ত
বিবরণ আমাকে জানাতে পারেন?"
"কোন তারিখে, স্যার?"
"চোদ্দ তারিখে। কোন
ট্রেনে গেলে সবথেকে ভালো হয়?"
"সবথেকে ভালো ট্রেন, বলতে গেলে,
বলতে হয় 'দ্যা ব্লু ট্রেন' এর কথা। এতে ক্যালিস এ কাস্টমসের ক্লান্তিকর ঝামেলা পোয়াতে হয় না।"
ডেরেক মাথা নাড়লো, সে এসবকিছুই বেশ ভালোভাবে জানে।
"চোদ্দ তারিখ," কর্মচারীটি একটু বিড়বিড় করে বললো, "এতো তাড়াতাড়ি,
দ্যা ব্লু ট্রেন সবসময় প্রায় পুরো ভর্তি থাকে।"
ডেরেক বললো, "দেখুন না কোনো আসন খালি আছে কিনা। "
"যদি কোনো খালি না
থাকে -" সে বাক্যটা শেষ করলো না তার মুখে একটা কৌতূহলের হাসি।
কর্মচারীটি কিছুক্ষনের
জন্য উধাও হয়ে গেলো,
তারপর আবার ফিরে এলো। "ঠিক আছে, স্যার,
এখনো তিনটি আসন খালি আছে। আপনাকে আমি একটা আসন দিতে পারি। কি নাম হবে?"
"পাভেট," ডেরেক বললো। সে তার জেরমিন স্ট্রিটের বাড়ির ঠিকানা দিলো।
কর্মচারীটি মাথা নাড়লো, সে নাম,
ঠিকানা লিখে নিলো, খুব বিনম্র ভাবে ডেরেক কে
সুপ্রভাত জানালো,
তারপর পরবর্তী লোকের দিকে মনোযোগ দিলো।
"আমি নাইস যেতে চাই
- ১৪ তারিখে। দ্যা ব্লু ট্রেন বলে একটা ট্রেন আছে না?"
ডেরেক তাড়াতাড়ি ঘুরে
তাকালো।
কাকতালীয় - এক অদ্ভুত
কাকতালীয় ঘটনা। মিরেলেকে করা তার নিজের খাম খেয়ালি মন্তব্য মনে পরে গেলো, "ধূসর চোখের এক মহিলার প্রতিকৃতি। আমার মনে হয় না, তার সাথে আবার দেখা হতে পারে।" কিন্তু তার সাথে আবার দেখা হয়ে গেলো, আর, আবার কি,
সেও রিভিয়েরা যেতে চায়, তার মতো, একই দিনে।
তার মধ্যে একটা শিহরণ
খেলে গেলো;
কিছু কিছু ব্যাপারে সে একটু কুসংস্কারচ্ছন্ন। সে মুচকি
মুচকি হাসতে হাসতে বলেছিলো,
যে ওই মহিলা তার জন্য দুর্ভাগ্য নিয়ে আসবে। হয়তো - হয়তো
এটাই সত্যি হবে। দরজার কাছ থেকে সে তারদিকে ঘুরে তাকিয়েছিলো, কিন্তু মহিলাটি,
কর্মচারীটির সাথে কথা বলে যাচ্ছিলো। এই একবার তার স্মৃতি
তাকে ভুল প্রমান করলো না। একজন মহিলা - পৃথিবীর সমস্ত অর্থেই যিনি মহিলা। খুব অল্প
বয়সী নন,
আবার এককথায় সুন্দরীও নন। কিন্তু, মনে হয় যেন - ওই ধূসর চোখ দুটো দিয়ে যেন অনেক কিছু দেখতে পান। সে যখন দরজা
দিয়ে বেরিয়ে এলো,
সে জানতো, যে কোনো কারণেই হোক ওই
মহিলা তার পক্ষে ভয়ানক। তার মধ্যে একটা সর্বনাশের আতঙ্ক ছিল।
সে জেরমিন স্ট্রিটে তার
বাড়ি ফিরে গেলো এবং ঘরে ঢুকে তার কাজের লোকটিকে ডেকে পাঠালো।
"পাভেট, এই চেক টা নাও,
সকালে আগে এই চেকটা ক্যাশ করাবে, তারপর পিকাডেলিতে কুকে যাবে। সেখানে তোমার নাম একটা টিকেট বুক করা আছে, টাকা দিয়ে,
সেটা নিয়ে আসবে।"
"ঠিক আছে, স্যার।"
পাভেট চলে গেলো।
ডেরেক উঠে সাইড টেবিলের
কাছে গেলো ও বেশ কয়েকটা চিঠি তুলে নিয়ে দেখতে লাগলো। এদের ধাঁচটা সুপরিচিত। বিল, ছোট বিল,
বেশ বড় বিল, সবাই বিলের টাকা মেটানোর
জন্য চাপ দিচ্ছে।
তাদের চাহিদার স্বর এখনো
নম্র।
ডেরেক জানে তাদের এই নম্র
স্বর বদলে যাবে যদি - যদি কোনো নির্দিষ্ট একটি খবর জনগণের সামনে চলে আসে।
সে একটা বড়ো চামড়ায় মোরা
চেয়ার এ হাত পা ছড়িয়ে বসলো। একটা ভয়ানক গর্ত - সেখানেই সে পরে গেছে। হ্যাঁ, একটা ভয়ানক গর্তে!
এই ভয়ানক গর্ত থেকে
বেরোনোর রাস্তাও দেখা যাচ্ছে না।
পাভেট, একটা কাশি দিয়ে নিজের উপস্থিতি জানান দিলো।
"একজন ভদ্রলোক
আপনার সাথে দেখা করতে চাইছেন - স্যার - মেজর নাইটোন।"
"নাইটোন, এ্যঁ?"
ডেরেক সোজা হয়ে বসলো, ভুরু দুটো কুঁচকে গেলো,
এবং সাথে সাথে সতর্ক হয়ে গেলো। সে খুব নিচু গলায় প্রায়
নিজেকেই বললো।
"নাইটোন - অনুমান
করার চেষ্টা করছি হাওয়ায় নতুন কি খবর ভাসছে।"
"আমি কি - মানে -
ওনাকে নিয়ে আসবো,
স্যার?"
তার মালিক মাথা নাড়লো।
নাইটোন ঘরে ঢুকে দেখলো একজন নম্র এবং ভদ্র মানুষ তাকে আপ্যায়নের জন্য প্রস্তুত।
"খুবই ভালো করেছেন
আমার সাথে দেখা করতে এসে।" ডেরেক বললো।
নাইটোন একটু নারভাস ছিল।
অপরজনের সতর্ক চোখে
কিন্তু সেটা এড়ালো না।
সেক্রেটারিটি যে কাজ করতে
কে পাঠানো হয়েছে তা মোটেই তার পছন্দের নয়। ডেরেকের সাবলীল কথার পিঠে সে প্রায়
যান্ত্রিক ভাবে উত্তর দিয়ে যাচ্ছিলো। সে কোনো পানিও নিতেও চাইলো না, আর, এরপর তার আচরণ আরো কঠিনতর হয়ে উঠলো।
অবশেষে ডেরেকও এটা নজর
করলো।
"তারপর," ডেরেক বললো,
"আমার সম্মানীয় শশুরমশাই আমার থেকে কি চান? আপনি ওনার কাজেই তো এসেছেন, মনে হয়।"
উত্তরে নাইটোন কিন্তু
হাসলো না।
"হ্যাঁ, ঠিক তাই,"
সে খুব সাবধান ভাবে বললো, "আমি চাইছিলাম,
ভ্যান আলদীন এই কাজের জন্য অন্য কাউকে পাঠান।"
ডেরেক অবাক হবার ভান করলো
ও তার ভুরু দুটো উপরে উঠে গেলো।
"ব্যাপারটা কি
এতটাই খারাপ?
আমি কিন্তু খুব একটা পাতলা চামড়ার লোক নই, আমি আপনাকে আস্বস্ত করছি, নাইটোন।"
"না," নাইটোন বললো,
"কিন্তু এই -"
সে থামলো।
ডেরেক তাকে তীক্ষ্ণভাবে
নিরীক্ষণ করতে থাকলো।
"নিন, বলেই ফেলুন,"
সে সদয় ভাবে বললো, "আমি বুঝতে পারছি আমার শশুর মশাইয়ের আদেশ সব সময় খুব একটা সুখকর হয় না।"
নাইটোন গলাটা একটু
পরিষ্কার করে নিলো। সে নিজের অস্বস্তি ঢাকার জন্য একটা কেজো গলায় বলতে লাগলো।
"মিস্টার ভ্যান
আলদীন আমাকে আপনার কাছে একটা নির্দিষ্ট প্রস্তাব দিয়ে পাঠিয়েছেন।"
"একটা প্রস্তাব?" ডেরেক কিছুক্ষন অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকলো। নাইটোনের কথাগুলি সে পরিষ্কার ভাবেই
আশা করে নি। সে নাইটোনকে একটা সিগারেটে দিলো, এবং নিজেও একটা ধরালো, তারপর নিজের চেয়ারে গা হেলিয়ে দিলো, তিক্ত ভাবে কিছু বিড়বিড়
করতে থাকলো।
"একটা প্রস্তাব? বেশ ইন্টারেষ্টিং শোনাচ্ছে।"
"আমি কি বলবো?"
"অবশ্যই, আপনি আমার অবাক হওয়া ক্ষমা করবেন, কিন্তু আমার মনে হচ্ছে, আজ সকালে আমাদের কথাবার্তা হবার পর আমার প্রিয় শশুর মশাই যেন কিছুটা নরম
হয়েছেন। আর নরম হওয়া তো কঠিন লোকেদের চরিত্রের সাথে যায় না। উনি তো তো ফিন্যান্সের নেপোলিয়ান, ইত্যাদি। এটা প্রমান করে - আমার মনে হয় এটা প্রমান করে যে উনি বুঝতে পেরেছেন
যে ওঁর অবস্থান উনি যতটা ভেবেছিলেন তার থেকেও দুর্বল।
নাইটোন খুব শান্ত ভাবে
তার সাবলীল,
বিদ্রুপাত্মক কথাগুলি শুনছিলো ও তার অবিচল ভঙ্গিমাতে এর
কোনো প্রভাব পরে নি।
সে ডেরেকের কথা শেষ হওয়া
পর্যন্ত অপেক্ষা করলো,
তারপর শান্ত ভাবে বললো;
"আমি প্রস্তাবটা
যতটা সম্ভব কম কথায় জানাবো।"
নাইটোন অপরজনের দিকে
তাকাচ্ছিলো না। তার গলা তীখ্ন এবং বাস্তব সম্মত।
"কথাটা হলো এই যে।
আপনি তো জানেনই,
মিসেস কেটারিং, ডিভোর্সের জন্য আবেদন জমা
করতে যাচ্ছেন। যদি এর বিরুদ্ধে আদালতে কেউ চ্যালেঞ্জ না করে এবং ওনার সপক্ষে রায়
যায়, রায় দানের দিনে আপনি একশো হাজার পাবেন।"
ডেরেক, সিগারেটে টা ধরাতে যাচ্ছিলো, আচমকাই থেমে গেলো।
"একশো হাজার!"
সে তীক্ষ্ণ ভাবে জিজ্ঞেস করলো, "ডলার?"
"পাউন্ড।"
কম করেও দু মিনিটের জন্য
নিস্তব্ধ নীরবতা। কেটারিংয়ের ভুরু দুটি চিন্তায় জুড়ে গেছে। একশো হাজার পাউন্ড। এর
মানে মিরেলে,
এর মানে তার আনন্দময়, চিন্তা ভাবনা হীন জীবন
কাটিয়ে যাওয়া। এর মানে ভ্যান আলদীন কিছু একটা জানেন। ভ্যান আলদীন শুধু শুধু কাউকে
পয়সা দেন না। সে উঠে চিমনির কাছে গিয়ে দাঁড়ালো।
"আর, যদি আমি তাঁর এই উদার প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করি?" সে একটা ঠান্ডা,
শ্লেষ্মাত্মক গলায় বিনীত ভাবে জিজ্ঞেস করলো?
নাইটোন একটি বিরক্তির
ভঙ্গিমা করলো।
"মিস্টার কেটারিং, আমি আপনাকে আশ্বাস দিতে পারি," সে খুব আন্তরিক ভাবে বললো, "প্রচন্ড অনিচ্ছা সত্ত্বেও আমি এই বার্তা নিয়ে এখানে এসেছি।"
"ঠিক আছে," কেটারিং বললো,
"নিজের উপর চাপ নেবেন না, আপনার কোনো দোষ নেই। এখন বলুন
- আমি আপনাকে যে প্রশ্ন করেছি তাঁর উত্তর কি?"
নাইটোন ও উঠে দাঁড়ালো। সে
আগের থেকেও অনিচ্ছুক ভাবে বলতে থাকলো।
"আপনি যদি এই
প্রস্তাব ফিরিয়ে দেন,"
সে বললো, "মিস্টার ভ্যান আলদীন, শুধু এইটুকুই,
আমাকে সোজা ভাষায় বলতে বলছেন যে উনি আপনাকে ধংস করে দেবেন।"
কেটারিং তার ভুরু দুটি
তুললো, কিন্তু সে তার হালকা,
মজার ভাবটা বজায় রাখলো।
"আচ্ছা, আচ্ছা,"
সে বললো, "আমার মনে হয় উনি এটা
করতেই পারেন। আমেরিকার কোটিপতির বিরুদ্ধে আমি দাঁড়াতেই পারবো না। একশো হাজার! যদি
কাউকে ঘুষ দিতে চাও তো এর থেকে ভালোভাবে আর কিছু হয় না। যদি আমি বলি দুশো হাজার
দিলে উনি যা চাইছেন আমি তাই করবো, তাহলে?"
"আমি আপনার বার্তা
মিস্টার ভ্যান আলদীনের কাছে পৌঁছে দেব।" নাইটোন অনুভূতিহীন ভাবে বললো, "এটাই কি আপনার উত্তর?"
"না," ডেরেক বললো,"হাস্যকর হলেও এটা নয়। আপনি আমার শশুর মশাইকে গিয়ে বলবেন যে তিঁনি নিজেকে এবং
তাঁর এই ঘুষ নিয়ে জাহান্নামে যেতে পারেন। এটা পরিষ্কার তো?"
"নিশ্চয়ই।" সে
উঠে দাঁড়ালো,
একটু ইতস্তত করলো, তার চেহারা আর একটু লালচে
হয়ে উঠলো,
নাইটোন বললো। "আমি - যদি অনুমতি দেন তো বলি, মিস্টার কেটারিং,
আমি বলতে চাই আমি সত্যিই খুশি যে আপনি যথাযত উত্তর দিয়েছেন।"
ডেরেক কোনো উত্তর দিলো
না। অন্য জন যখন ঘর থেকে বেরিয়ে গেলো, তখন সে দু এক মিনিটের
জন্য গভীর চিন্তায় মগ্ন। একটা অদ্ভুত হাসি তার ঠোঁটে ফুটে উঠেছে।
"তাহলে এই ব্যাপার।"
সে লঘু ভাবে বললো।"
চ্যাপ্টার ১০
দ্যা ব্লু ট্রেনে
"বাবা!"
মিসেস কেটারিং আক্রমণাত্মকভাবে
বলে উঠলো। আজ সকাল থেকেই তার
স্নায়ুগুলো ঠিক নিজের বসে নেই। একটা লম্বা মিংক কোট এবং ছোট চাইনিজ বার্ণিশ লাল
রঙের হ্যাটে তার পোশাক একদম যথাযত, সে ভিক্টোরিয়ার জনবহুল
প্লাটফর্ম দিয়ে চিন্তামগ্ন হয়ে হেটে যাচ্ছিলো, হঠাৎ তার বাবার আবির্ভাব
এবং তাঁর আন্তরিক অভিবাদন তার ওপর এক অপ্রত্যাশিত প্রভাব তৈরি করলো।
"একি রুথ, তোমায় হঠাৎ এরকম দেখাচ্ছে কেন!"
"তোমায় আমি এখানে
দেখতে পাবো আশা করি নি,
বাবা। তুমি তো কালকে রাতেই আমাকে বিদায় জানালে আর বললে আজ
সকালে তোমার একটা কনফারেন্স আছে।
"হ্যাঁ
বলেছিলাম" ভ্যান আলদীন বললেন, "কিন্তু যেকোনো জঘন্য কনফারেন্সের থেকে তুমি আমার কাছে অনেক বেশি কিছু। আমি তোমায় শেষ একবারের জন্য দেখতে এলাম, যেহেতু অনেক দিন আর দেখা হবে না।
"তুমি খুবই মিষ্টি, বাবা,
আমি তো চাইছিলাম তুমিও আমার সাথে চলো।"
"আর, যদি সত্যিই যাই,
তাহলে কি বলবে?"
মন্তব্যটা মজা করার জন্যই
বলা হয়েছিল। কিন্তু তিঁনি অবাক হয়ে গেলেন রুথের গালের রঙে পরিবর্তন দেখে। কয়েক
মুহূর্তের জন্য ওনার মনে হলো উনি যেন রুথের চোখে একটা আতঙ্ক ফুটে উঠতে দেখলেন।
সে আত্মবিশ্বাসহীন এবং
নারভাস ভাবে হাসতে লাগলো।
"কয়েক মুহূর্তের
জন্য আমার মনে হয়েছিল তুমি সত্যি সত্যি যাবে," সে বললো।
"তুমি কি খুশি হতে?"
"অবশ্যই।" সে
খুব ফলাও করে জোরের সঙ্গে বললো।
"তাহলে," ভ্যান আলদীন বললেন,
"ভালো।"
"খুব একটা
বেশিদিনের ব্যাপার নয়,
বাবা," রুথ বলতে থাকলো, "তুমি তো জানোই,
তোমাকে পরের মাসেই বাইরে যেতে হবে।"
"আঃ!" ভ্যান
আলদীন আবেগহীনভাবে ভাবে বললেন, "মাঝে মাঝে আমার মনে হয়
আমি হারলে স্ট্রিটের কোনো একজন সবজান্তা লোকের কাছে চলে যাই এবং তাকে দিয়ে বলাই যে
আমার এখনই রৌদ্রোজ্জ্বল দিন এবং হওয়া বদলের প্রয়োজন।"
"এতটা নিরাশ হয়েও
না।" রুথ চেঁচিয়ে বললো, "পরের মাসটা এই মাসের থেকে
অনেক সুন্দর হবে। তোমার এখন অনেক কাজ পরে আছে। তুমি এখনই যেতে পারবে না।"
"হ্যাঁ, একেবারেই তাই,"
ভ্যান আলদীন একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন। "তুমি বরং তাড়াতাড়ি তোমার ট্রেনে উঠে পরো, রুথ। তোমার আসন কোনটা?"
রুথ কেটারিং অনিশ্চিতভাবে
ট্রেনের দিকে তাকালো। একটা পুলমান কারের দরজায় কালো পোশাক পড়া একজন লম্বা, রোগা মহিলা দাঁড়িয়ে ছিল - রুথ কেটারিংয়ের পরিচারিকা। তার মালকিন তার দিকে
এগিয়ে আসতেই সে একপাশে সরে দাঁড়ালো।
"আমি আপনার জামা কাপড়ের
বাক্স আপনার সিটের তলায় রেখে দিয়েছি, ম্যাডাম, যদি আপনার কোনো কারণে দরকার লাগে। কার্পেটগুলো কি আপনার লাগবে, নাকি আমি নিয়ে যাবো?"
"না না আমার লাগবে
না। এখন তাড়াতাড়ি যাও এবং নিজের সিট খুঁজে নাও, ম্যাসন।"
"হ্যাঁ, ম্যাডাম।"
পরিচারিকাটি চলে গেলো।
ভ্যান আলদীন রুথের সাথে
পুলমান কারে উঠলেন। সে তার সিট দেখতে পেলো, আর ভ্যান আলদীন বিভিন্ন
কাগজ এবং পত্রিকা তার সামনের টেবিলে জড়ো করে রাখলেন। তার উল্টোদিকের সিটে আগে
থেকেই একজন বসে ছিলেন এবং আমেরিকানটি তাঁর দিকে খুব মনোযোগ দিয়ে দেখছিলেন। তার
ধূসর চোখ এবং পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন ভ্রমণের পোশাক তাঁর মনে একটা ক্ষণস্থায়ী ছাপ
ফেলেছিলো। তিঁনি রুথের সাথে আরো কিছু অগোছালো কথা বার্তায় ব্যাস্ত হয়ে পড়লেন, যে ধরণের কথা বার্তা লোকে ট্রেনে বিদায় জানাতে এসে সাধারণত বলে থাকে।
ট্রেনের হুইসেল বাজতেই, তিঁনি তাঁর ঘড়ির দিকে তাকালেন।
"এইবার তবে আমি যাই, বিদায়। চিন্তা করো না,
চিন্তা করো না, আমি আমার সমস্ত কাজ ঠিকই
করবো।"
"ওঃ, বাবা!"
তিঁনি চকিতে ঘুরে
দাঁড়ালেন। রুথের গলার আওয়াজে যেন কিছু একটা ছিল, এমন কিছু যা সাধারণত তার স্বাভাবিক আচরণের সাথে যায় না, এটাই তাঁকে হতচকিত করে দিয়েছিলো। এটা যেন এক অসহায়ের আর্তনাদ। সে যেন এক আবেগে
তাঁর দিকে এগিয়ে গিয়েছিলো,
কিন্তু পরের মুহূর্তেই সে আবার তার নিজের ওপর নিয়ন্ত্রণ
ফিরে পেয়েছিলো।
"পরের মাস অবধি," সে প্রফুল্লভাবে বললো।
দু মিনিট পরেই ট্রেন ছেড়ে
দিলো। রুথ চুপ করে বসে,
নিজের নিচের ঠোঁট টা কামড়াচ্ছিল আর প্রানপন চেষ্টা করছিলো
অনভস্ত্য চোখের জলটা আটকাতে। হঠাৎই যেন এক একাকিত্বের অনুভূতি তাকে চেপে ধরলো। এক
বন্য আকাঙ্খায় তার যেন ইচ্ছা করছিলো ট্রেন থেকে লাফিয়ে পরে এবং বেশি দেরি হবার
আগেই আবার ফিরে যায়। সে,
এতো শান্ত, এতো আত্মবিশ্বাসী, হওয়া সত্ত্বেও,
জীবনে প্রথমবার তার মনে হলো সে যেন এমন একটা পাতা যাকে
হাওয়ায় উড়িয়ে নিয়ে যাচ্ছে। যদি তার বাবা জানতেন - তিঁনি কি বলতেন?
পাগলামো! হ্যাঁ, এটা সত্যিই,
পাগলামো! জীবনে প্রথমবার সে আবেগে ভেসে গেলো, ভেসে গেলো এমন এক বিন্দুতে যেখানে সে নিজেই জানে যে সে এমন এক কাজ করতে চলেছে
যা অবিশাস্য রকমের বোকামো এবং অপরিণামদর্শিতার পরিচয়। ভ্যান আলাদীনের মেয়ে হবার
কারণে সে নিজের বোকামোটা বুঝতে পারছে, এবং স্থির মস্তিষ্কের
অধিকারিণী বলে নিজেই নিজের কাজটাকে ধিক্কার দিতে পারছে। কিন্তু সে অন্য দিক থেকেও তাঁরই মেয়ে। তার মধ্যেও আছে সেই
লৌহ কঠিন সংকল্প যার ফলে সে যা চায় তাই পায় আর একবার মনস্থির করে ফেললে সে আর
পেছনে ফিরে তাকায় না। ছোটবেলা থেকেই সে জেদি;
তার আশপাশের পরিবেশই তাকে জেদি বানিয়েছে। এই জেদই এখন তাকে
অনুতপ্তহীনভাবে তাড়িয়ে নিয়ে বেড়ায়। এখন, রূপরেখা তৈরী হয়ে গেছে।
তাকে এখন এর মধ্যে দিয়েই চলতে হবে।
সে চোখ তুলে তাকালো, এবং তার চোখাচোখি হয়ে গেলো উল্টোদিকের সিটে বসা মহিলার সঙ্গে। তার একটা অদ্ভুত
অনুভূতি হলো যেন কোনভাবে ওই মহিলা তার মনের কথা পড়তে পারছেন। সে ওই ধূসর চোখ দুটির
মধ্যে সমমনস্কতা আর - হ্যাঁ - সহানুভূতি দেখতে পাচ্ছিলো।
এই অনুভূতি শুধু কয়েক
মুহূর্তের জন্য। দুই মহিলারই মুখ কঠিন হয়ে উঠলো তাদের অতি-চর্চিত নিরুৎসাহিতা ভাব
দেখানোয়। মিসেস কেটারিং একটি পত্রিকার তুলে নিলো এবং ক্যাথেরিন গ্রে জানলা দিয়ে
বাইরে তাকিয়ে থাকলো এবং অনন্ত লম্বা পথ ঘাট আর মফস্সলের বাড়ি ঘর দেখতে লাগলো।
রুথ কিছুতেই পত্রিকাতে
মনসংযোগ করতে পারছিলো না। তার মনের মধ্যে যেন হাজার আশংকা খেলা করছিলো। সে কি ভীষণ
বোকা হয়ে গেছে! সে কি ভীষণ বোকা ছিল! সমস্ত শান্ত এবং স্বনির্ভর মানুষদের মতো, সে যখন নিজের আত্ম নিয়ন্ত্রণ হারালো সে তা একেবারেই হারালো - তখন অনেক দেরি
হয়ে গিয়েছিল....সত্যিই কি অনেক দেরি হয়ে গিয়েছিলো? কেউ যদি তাকে বলার থাকতো, কেউ যদি তাকে পরামর্শ
দেবার মতো থাকতো। আগে কখনো তার এমন ইচ্ছা হয় নি; নিজের ছাড়া অন্য যে কারুর মতামতের ওপর ভরসা করার বদলে সে সেগুলো ছুড়ে ফেলে
দিতো, কিন্তু এখন - তার কি হয়েছে? আতঙ্ক। হ্যাঁ, এই কথাটাই যেন সঠিক ভাবে বর্ণনা করছে - আতঙ্ক। সে, রুথ কেটারিং সম্পূর্ণভাবে এবং পুরোপুরি ভাবে আতঙ্কিত।
সে উল্টো দিকের
চরিত্রটিকে একবার চোরা চাহনিতে দেখে নিলো।
তার সাথে যদি এরকম কারো
পরিচয় থাকতো,
কোনো সদাশয়, শান্ত, ঠান্ডা মাথার,
সহানুভূতিশীল মানুষ।
এই ধরণের মানুষের সাথেই
মনের কথা বলা যায়। কিন্তু,
অবশ্যই, তুমি কোনো অপরিচিত কে
বিশ্বাস করতে পারো না। কথাটা মনে হতে, রুথ নিজের মনেই একটু হেসে
নিলো। সে আবার পত্রিকাটা তুলে নিলো। সত্যি সত্যি তাকে নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতেই হবে।
যতই হোক,
এ সমস্ত কিছুই সে আগে থেকে ভেবে রেখেছে। সে তার নিজস্য
স্বাধীন চিন্তা ভাবনার ওপরেই বিশ্বাস রেখেছে। এতো দিন পর্যন্ত সে জীবনে কি সুখ
পেয়েছে? সে নিজেকে অনবরত বলতে থাকলো : "কেন আমি সুখী হবো না? কেউ কোনদিন জানতে পারবে না।"
মনে হলো যেন খুব তাড়াতাড়ি
ডোভার এসে গেলো। রুথ সমুদ্র যাত্রায় অভিজ্ঞ। সে ঠান্ডা পছন্দ করে না, টেলিগ্রাফ করে সে যা চেয়েছিলো সেই প্রাইভেট কেবিনটা তে পৌঁছে সে সত্যি খুশি
হলো। যদিও সে সত্যিটা প্রকাশ করলো না, এসব ব্যাপারে রুথ একটু
কুসংস্কারাচ্ছন্ন। সে সেই ধরণের মানুষ যারা কাকতালীয় ঘটনা পছন্দ করে। কালাইসে
জাহাজ থেকে নামার পর এবং দ্যা ব্লু ট্রেনে সে এবং তার পরিচারিকা তাদের ডাবল
কম্পার্টমেন্টে গুছিয়ে নেওয়ার পর, সে লাঞ্চের কামরার দিকে
চললো।
সে একটা ছোট বিস্ময়ের
ধাক্কা খেলো,
যখন দেখলো, সে যে ছোট টেবিলটা তে
বসেছে, তার উল্টোদিকে,
সেই একই মহিলা যে নাকি পুলমানে তার সাথে ছিল। একটা হালকা
হাসি দুই মহিলার ঠোঁটেই খেলে গেলো।
"এটা সত্যি একটা
কাকতালীয় ঘটনা,"
মিসেস কেটারিং বললো।
"আমি জানি," ক্যাথেরিন বললো,
"ঘটনাগুলো কখনো এমন ভাবে ঘটে যা সত্যি অদ্ভুত।"
একজন পরিচারিকা যে নাকি
ঘুরে ঘুরে পরিবেশন করছিলো,
এমন এক দ্রুত গতিতে তাদের সামনে উপস্থিত হলো যা
কোম্প্যাগনিয়ে ইন্টারন্যাশনাল দেশ ওয়াগনস্ - লিটস এর পরিচয় এবং দু কাপ সূপ তাদের
সামনে রাখলো। স্যুপের পরে ওমলেট আসতে আসতে তারা বন্ধুর মতোই কথা বার্তা বলতে শুরু
করে দিলো।
"রৌদ্রজ্জ্বল দিনে
ঘুরে বেড়ানো এক স্বর্গীয় ব্যাপার হবে," রুথ দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো।
"একদমই ওই অসাধারণ
অনুভূতির কোনো তুলনাই হবে না।"
"তুমি কি রিভিয়েরা
চেনো ভালো করে?"
"না; এটাই আমার প্রথমবার যাওয়া।"
"তাই নাকি।"
"আশা করি, তুমি প্রতি বছরই যাও?"
"প্রায় তাই।
জানুয়ারী এবং ফেব্রুয়ারী তে লন্ডনের পরিস্থিতি ভয়াবহ।"
"আমি সবসময়
কাউন্ট্রিতেই কাটিয়েছি। ওই মাসগুলোতে ওখানকার পরিস্থিতিও মোটেই সুবিধার হতো না।
বেশিরভাগই কাদা।"
"কি কারণে তুমি
হঠাৎ ভ্রমণের কথা ঠিক করলে?"
"টাকা," ক্যাথেরিন বললো। "দশ বছর ধরে আমি একজন সহায়িকার চাকরি করেছি এবং আমি যা
উপার্জন করতাম তা দিয়ে কেবল নিজের জন্য শক্ত পোক্ত কাউন্ট্রি জুতোই কিনতে পারতাম; এখন আমি এক সম্পত্তির উত্তরাধিকারী হয়েছি যা নাকি আমার কাছে সৌভাগ্যের মতো, যদিও আমার মনে হয় তোমার কাছে এটা কিছুই নয়।"
"আমি চমৎকৃত তুমি
হঠাৎ কেন বললে যে - যে আমার কাছে এটা কিছুই নয়।"
ক্যাথেরিন হেসে উঠলো।
"আমি সত্যিই জানি না। আমার মনে হয় লোকে চিন্তা না করেই অন্যের প্রতি একটা
ধারণা তৈরী করে নেয়। আমি তোমাকে আমার মনে মনে পৃথিবীর অন্যতম ধনী হিসেবে কল্পনা
করে নিয়েছি। এটা শুধুমাত্র একটা ধারণা। আমি স্বীকার করে নিচ্ছি এটা আমার ভুল ছিল
।"
"না," রুথ বললো,
"এটা তোমার ভুল নয়।"
সে হঠাৎই খুব গম্ভীর হয়ে
গেলো। "আমি চাই যে তুমি আমাকে বলো আমার আমার সম্পর্কে তুমি আর কি কি ধারণা
করেছো।"
"আমি -"
অপরজনের বিহ্বলতা
সত্ত্বেও রুথ থামলো না।
ওঃ, দয়া করে ভদ্রতা কোরো না। আমি জানতে চাই। আমরা যখন ভিক্টোরিয়া থেকে রওনা হলাম
আমি তোমাকে দেখছিলাম,
আর আমার মনে এক অনুভূতি হচ্ছিলো যা তুমি - আশা করি, বুঝতে পারবে আমার মনে কি হচ্ছিলো।"
"আমি তোমায় আস্বস্ত
করতে চাই যে আমি কারুর মনের কথা পড়তে পারি না।" ক্যাথেরিন হাসতে হাসতে বললো।
"না; কিন্তু তুমি আমাকে দয়া করে বলো, তোমার কি মনে
হয়েছিল।" রুথের আগ্রহ এতটাই জোরালো এবং আন্তরিক ছিল যে সে তার কথা মেনে নিলো।
"তুমি যদি চাও, আমি বলতে পারি,
কিন্তু তুমি আমাকে মোটেই বাচাল বলে ভেবো না। আমার মনে
হয়েছিল তুমি কোনো কারণে বেশ মানসিক অশান্তিতে আছো, আর তোমাকে দেখে আমার কষ্ট হয়েছিল।"
"তুমি ঠিক বলেছো।
তুমি একদমই ঠিক বলেছো। আমি এক সাংঘাতিক ঝামেলায় পড়েছি। তুমি অনুমতি দিলে, আমি - আমি তোমাকে এব্যাপারে কিছু বলতে চাই।
"হে ভগবান," ক্যাথেরিন নিজের মনেই ভাবতে থাকলো, "কি অদ্ভুত ভাবে পৃথিবীটা সব জায়গায় একই রকমের! লোকে আমায় সেইন্ট মেরি মিডে নিজেদের
কথা শোনাতো,
আর এখানেও একই ব্যাপার, আমি আসলে অন্যের সমস্যার
কথা শুনতে চাই না!"
সে বিনীতভাবে উত্তর দিলো:
"আচ্ছা বলো।"
তারা তাদের দুপুরের খাওয়া
প্রায় শেষ করে এনেছিল। রুথ তার কফি টা কোনো রকমে তাড়াতাড়ি গিলে নিয়ে নিজের আসন
থেকে উঠে দাঁড়ালো,
সে খেয়ালই করলো না যে ক্যাথেরিন এখনো তার কফিতে চুমুকেই দেয়
নি, বললো: "আমার সঙ্গে আমার কম্পার্টমেন্টে এসো।"
পাশাপাশি দুটো সিঙ্গেল
কম্পার্টমেন্টের মদ্ধিখানে একটা যাতায়াতের দরজা। দ্বিতীয় কম্পার্টমেন্টে একজন রোগা
মতন পরিচারিকা ছিল,
যাকে ক্যাথেরিন ভিক্টোরিয়াতে লক্ষ্য করেছিল, সে একটা টক টকে লাল রঙের মরক্কো বাক্স কোলে নিয়ে, সিটের উপর একদম সোজা ভাবে বসে ছিল, বাক্সর ওপরে আদ্যাক্ষর
আর.ভি.কে. লেখা ছিল। মিসেস কেটারিং যাতায়াতের দরজাটা টেনে বন্ধ করে সিটে বসলো।
ক্যাথেরিন তার পশে বসলো।
"আমি খুব ঝামেলায়
পড়েছি আর আমি জানি না এই ঝামেলা থেকে কি করে উদ্ধার পাবো। একজন লোক আছে যাকে আমি
পছন্দ করি - মানে খুবই পছন্দ করি। আমরা যখন অল্প বয়স্ক ছিলাম তখন আমরা একে অপরের
অনুরক্ত ছিলাম,
কিন্তু আমাদের দুজনকে একে অপরের থেকে খুব নৃশংস ভাবে এবং
অন্যায় ভাবে আলাদা করে দেওয়া হয়েছিল। এখন আবার আমরা কাছা কাছি এসেছি।
"তাই নাকি?"
"আমি - আমি তার
সঙ্গেই দেখা করতে যাচ্ছি। ওঃ! তুমি হয়তো ভাবছো এটা একদমই ঠিক কাজ নয়, কিন্তু তুমি আমার পারিপার্শিক অবস্থা জানো না। আমার স্বামী এক অসহ্যকর মানুষ।
সে আমার সাথে খুব অপমানকর ব্যবহার করে।"
"আচ্ছা," ক্যাথেরিন আবার বললো।
"এর মধ্যে আমার
সবথেকে খারাপ লাগে যেটা,
তা হলো আমি আমার বাবার সাথে প্রতারণা করছি - উনিই আজ আমাকে
ভিক্টোরিয়াতে তুলে দিতে এসেছিলেন। উনি চান আমি আমার স্বামীকে ডিভোর্স করি, আর, ওনার কোনো ধারণাই নেই যে - আমি এখন এই অপর লোকটির সাথে দেখা করতে চলেছি। উনি এটাকে এক ভয়ঙ্কর বোকামো বলেই ভাবতেন।"
"আচ্ছা, তোমার কি তা মনে হয় না?"
"আমারও তাই মনে
হয়।"
রুথ কেটারিং নিজের হাতের
দিকে তাকালো;
সেগুলো ভয়ানক ভাবে কাঁপছিলো।
"কিন্তু এখন আর আমি
ফিরে যেতে পারবো না।"
"কেন নয়?"
"আমি - সব আয়োজন
হয়ে গেছে। ফিরে গেলে ওর মন ভেঙে যাবে।"
"তোমার কি মনে হয়
না,"
ক্যাথেরিন দৃঢ়ভাবে বললো, "মন বেশ কঠিন জিনিস।"
"ও ভাববে আমার কোনো
সাহস নেই,
কোনো দৃঢ়তা নেই।"
"আমার মনে হয় তুমি
যা করতে চলেছো তা ভীষণরকম বোকামি, ক্যাথেরিন বললো, "আমার মনে হয় তুমি নিজেও তা বুঝতে পারছো।"
রুথ কেটারিং দুই হাতের
মধ্যে নিজের মুখটা চেপে ধরলো। "আমি জানি না - আমি জানি না। যখন থেকে আমরা
ভিক্টোরিয়া ছেড়েছি তখন থেকে আমার কোনো একটা কিছু সম্পর্কে একটা ভয়ঙ্কর আশঙ্কা
হচ্ছে - কোনো একটা কিছু যা খুব শীঘ্রই ঘটতে চলেছে - আর সেটা থেকে পালানোর আমার
কোনো উপায় নেই।"
সে খুব শক্ত করে
ক্যাথেরিনের হাত চেপে ধরলো।
"আমাকে এইসব কথা
বলতে শুনে তোমার নিশ্চই আমাকে পাগল বলে মনে হচ্ছে, কিন্তু আমি তোমাকে বলছি কিছু একটা সাংঘাতিক ঘটবেই।"
"এসব ভেবো না," ক্যাথেরিন বললো,
"নিজের আবেগগুলোকে নিয়ন্ত্রণে আনার চেষ্টা করো। যদি তোমার
মনে হয়, তুমি প্যারিস থেকে তোমার বাবাকে একটা তার করে দিতে পারো, তাহলেই উনি সঙ্গে সঙ্গে তোমার কাছে চলে আসবেন।"
"হ্যাঁ, সেটাতো আমি করতেই পারি। আমার আদরের বাবা। এটা খুব আশ্চর্যের - আমি এতদিন
পর্যন্ত বুঝতেই পারি নি যে আমি ওনাকে ঠিক কতটা ভালোবাসি।" সে উঠে বসলো এবং
একটা রুমালে চোখ মুছে নিলো। "আমি খুবই বোকামো করেছি, তোমাকে অশেষ ধন্যবাদ আমার কথা শোনার জন্য। আমি জানি না কি করে আমি এই আজব, ছিটগ্রস্ত অবস্থায় পৌছুলাম।"
সে উঠে দাঁড়ালো।
"এখন আমি ঠিক আছি। আমার মনে হয়, আমার এমন একজনকে দরকার
ছিল, যাকে সমস্ত কথা খুলে বলতে পারি। আমি এখনো ভাবতেই পারছি না যে কি করে আমি এমন
বোকামো করলাম।"
ক্যাথেরিনও উঠে দাঁড়ালো।
"তুমি এখন ভালো বোধ
করছো শুনে আমি খুব খুশি হয়েছি।" নিজের গলাটা যতটা সম্ভব পরিশীলিত রাখা যায়
ততটা চেষ্টা করে,
সে বললো। সে খুব ভালো করেই জানে যে আত্মবিশ্বাস ফিরে আসার
পরেই আসে বিব্রত হবার পালা। সে খুব কৌশলে যোগ করলো:
"আমাকে এবার নিজের
কম্পার্টমেন্টে ফিরতে হবে।"
সে যখন করিডোরে বেরিয়ে
এলো তখন পরিচারিকাটিও পাশের ঘর থেকে বেরিয়ে আসছিলো। অপরজন একবার ঘাড় ঘুরিয়ে
ক্যাথেরিনের দিকে তাকালো,
তার চোখে মুখে প্রচন্ড রকমের অবাক হবার ছাপ স্পষ্ট। ক্যাথেরিনও ঘুরে তাকালো, কিন্তু ততক্ষনে যে পুরুষ
বা মহিলা পরিচারিকাটির আগ্রহ তৈরি করেছিলেন তিঁনি নিজের কম্পার্টমেন্টে ঢুকে
গেছিলেন,
ক্যাথেরিন শূন্য করিডোর ছাড়া আর কিছুই দেখতে পেলো না।
ক্যাথেরিন করিডোর দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে, পরের কোচে নিজের জায়গায়
পৌঁছলো। সে যখন শেষ কম্পার্টমেন্টটা পেরোচ্ছিলো তখন একটি দরজা খুলে গেলো, একজন মহিলার মুখ বেরিয়ে এলো কয়েক মুহূর্তের জন্য এবং সঙ্গে সঙ্গে প্রচন্ড জোরে
আবার দরজাটা বন্ধ হয়ে গেলো।
এমন একটা মুখ যা সহজে
ভোলা যায় না,
ক্যাথেরিন পরে আবার সেটা দেখলেই চিনতে পারবে। খুব সুন্দর একখানি মুখ, ডিমের মতো এবং নিষ্প্রভ, ভারী অদ্ভুত ধাঁচের তৈরী। ক্যাথেরিনের মনে হলো সে আগে এটা কোথাও দেখেছে।
ক্যাথেরিন তার অভিযান শেষ
করে নিজের কম্পার্টমেন্টে ঢুকলো এবং সেখানে বসে একটু আগে তার ওপর যে আস্থা দেখানো
হলো সেটা নিয়েই ভাবছিলো। সে অলস ভাবে ভাবছিলো ওই মিঙ্ক কোট পড়া মহিলাটি কে নিয়ে, একথাও চিন্তা করার চেষ্টা করছিলো ওই মহিলার কাহিনীর শেষটা কেমন হবে।
"যদি আমি কাউকে
নিজের কাছেই নিজে বোকা প্রতিপন্ন হওয়ার থেকে রক্ষা করতে পারি, তাহলে আশা করি,
একটা বেশ ভালো কাজ করেছি।" সে নিজের মনেই ভাবতে থাকলো।
"কিন্তু,
কে না জানে? ওনার মতো জেদি এবং অহংকারী
মহিলারা যারা সারা জীবন এরকমই করে থাকেন, এবং ওনার পক্ষে ভালোই হবে
যদি উনি এবার অন্য রকম কিছু করেন। ওঃ, ভালোটা হলো - আমার মনে হয়
না, ওনার সঙ্গে আবার দেখা হবে। উনি নিশ্চিত আমার সঙ্গে আর দেখা করতে চাইবেন না।
এটাই মানুষের কাছে নিজের ব্যাক্তিগত কথা খুলে বলার খারাপ দিক। তারা কেউই আবার দেখা
করতে চায় না।
সে চাইছিলো রাতে খাবার
সময় যেন তাকে আবার একই টেবিলে বসতে না হয়। সে হাস্যকর ভাবে কল্পনা করার চেষ্টা
করছিলো যে সেই পরিস্হিতি তাদের দুজনের পক্ষেই কেমন অপ্রীতিকর হবে। সে হেলান দিয়ে
বসে মাথাটা একটা বালিশে এলিয়ে দিয়েছিলো তার নিজেকে খুব ক্লান্ত এবং বিষন্ন মতো
লাগছিলো। তারা প্যারিস পৌঁছে গেছিলো, এই ধীরে ধীরে ঘুরে ঘুরে
যাত্রা, তার সাথে অগুনতি স্টপ এবং অপেক্ষা বেশ ক্লান্তিকর ছিল।
তারা যখন গারে ডি লিওনে পৌঁছলো
একঘেঁয়েমি কাটাতে সে ট্রেন থেকে নেমে প্লাটফর্মে এদিক থেকে ওদিক পায়চারি করতে
থাকলো। এতক্ষন গরম বাস্পওয়ালা ট্রেনে কাটানোর পর টাটকা ঠান্ডা বাতাসে তার প্রাণ
জুড়িয়ে যাচ্ছিলো।
সে মুচকি হেসে লক্ষ্য
করলো যে তার মিঙ্ক কোট পড়া বন্ধু রাতে খাবারের সময়ের সম্ভাব্য অপ্রীতিকর পরিস্থিতি
এড়ানোর জন্য নিজের মতো একটা সমাধান বার করে নিয়েছে। একটা ডিনার বাস্কেট তুলে দেওয়া
হলো এবং পরিচারিকাটি জানলা দিয়ে হাত বাড়িয়ে সেটা নিলো।
ট্রেন যখন আবার চলতে শুরু
করলো, এবং খুব কর্কশ ভাবে বেল বাজিয়ে রাতের খাবারের ঘোষণা করা হলো, ক্যাথেরিন খুব হালকা মনে সেইদিকে চললো। আজ রাতে তার সামনে একদম অন্য ধরনের
একজন মানুষ - একজন বেঁটে খাটো দেখতে লোক, দেখলেই বোঝা যায় বিদেশী, একটা জোড়া মোম লাগানো কায়েদা করা গোঁফ, এক পাশে হেলানো একটা
ডিমের আকৃতির মাথা। ক্যাথেরিন ডিনারে সঙ্গে করে একটা বই নিয়ে গেছিলো। সে দেখলো
বেঁটে খাটো মানুষটা সেই বইটার দিকে তাকিয়ে মুচকি মুচকি হাসছেন।
"মাদাম, আপনার কাছে দেখছি একটা গোয়েন্দা উপন্যাস রয়েছে। আপনি কি এসব জিনিস পছন্দ করেন?"
"এগুলো আমাকে আনন্দ
দেয়,"
ক্যাথেরিন স্বীকার করলো।
বেঁটে খাটো লোকটা মাথা
নাড়িয়ে জানালো যে সে ব্যাপারটা পুরোপুরি বুঝতে পেরেছে।
"আমি শুনেছি, এগুলো বেশ ভালো বিক্রি হয়। কিন্তু কেন বলুন তো, ইয়ে,
মাদমোয়েজেল? আমি একজন মনুষ্য চরিত্রের
ছাত্র হিসেবে আপনার কাছে জানতে চাইছি - কেন এরকম হবে?"
ক্যাথেরিন তাঁর কথা শুনে
বেশ মজা পাচ্ছিলো।
"এগুলো হয়তো এক
রোমাঞ্চকর জীবনের স্বপ্ন দেখায়," সে একটা অনুমান রাখলো।
তিনি খুব গম্ভীর ভাবে
মাথা নাড়লেন।
"হাঁ, এরকমই কোনো ব্যাপার এগুলোর মধ্যে আছে।"
"যদিও, সবাই জানে,
এরকম কোনো ব্যাপার সত্যি সত্যি ঘটে না," ক্যাথেরিন আরো কিছু বলতে যাচ্ছিলো, কিন্তু তিঁনি তাকে আচমকা
থামিয়ে দিলেন।
"মাঝে মাঝে, মাদমোয়েজেল! মাঝে মাঝে! এই যে আমি আপনার সাথে কথা বলছি - আমার সাথে এরকম ঘটনা
ঘটেছে।"
তিঁনি তার দিকে একটা চকিত, কৌতূহলী চাহনি ছুড়ে দিলেন।
"হয়তো কোনো একদিন, কে জানে,
আপনার সাথেও এরকম ঘটনা ঘটতে পারে।" তিঁনি বলে চললেন, "এগুলো সবই ভাগ্যের ব্যাপার।"
"আমার মনে হয় না
এরকম কিছু হতে পারে,"
ক্যাথেরিন বললো, "এরকম কোনো কিছু আমার সাথে কোনোদিনও ঘটে নি।"
তিঁনি সামনের দিকে ঝুকে
এলেন।
"আপনি কি চান, কিছু ঘটুক?"
প্রশ্নটা তাকে অবাক করে
দিয়েছিলো,
আর সে জোরে একটা শ্বাস নিলো।
"এটা আমার একটা কল্পনা, হয়তো।" বেঁটে খাটো মানুষটা একটা কাঁটা চামচকে যত্ন করে মুছতে মুছতে বললেন, "কিন্তু আমার মনে হয় আপনার মনে একটা ইচ্ছা আছে কোনো রোমাঞ্চকর ঘটনায় জড়িয়ে
পড়ার। জানেন তো,
মাদমোয়েজেল, আমি সারা জীবন ধরে একটা
জিনিস দেখে এসেছি - 'কেউ যা কামনা করে সে তাই পায়!' কে জানে?" তার মুখটা হাস্যকর ভাবে কুঁচকে গেলো। "আপনি যা চাইছেন তার থেকে বেশিও
পেতে পারেন।"
"এটা কি কোনো
ভবিষ্যৎবাণী?"
ক্যাথেরিন হাসতে হাসতে টেবিল থেকে উঠে দাঁড়িয়ে জিজ্ঞেস
করলো।
বেঁটে খাটো মানুষটি মাথা
নাড়লেন।
"আমি কোনো
ভবিষ্যৎবাণী করি না।" তিনি খুব গর্বভরে বললেন, "একথা ঠিক যে স্বভাবতই আমি সব সময় সঠিক প্রমাণিত হই - কিন্তু এনিয়ে আমি খুব
একটা বড়াই করি না। শুভ রাত্রি, মাদমোয়েজেল, আশা করি আপনার ঘুম ভালো হবে।"
ক্যাথেরিন তার সহযাত্রী
বেঁটে খাটো মানুষটির কথায় আনন্দিত হয়ে বেশ প্রফুল্ল মনে ট্রেনের ভেতর দিয়ে ফিরে
চললো।
সে তার বন্ধুর
কম্পার্টমেন্টের খোলা দরজার সামনে দিয়ে পেরিয়ে যাবার সময় দেখতে পেলো যে কন্ডাক্টরটি
বিছানা করছে। মিংক কোট পড়া মহিলা দাঁড়িয়ে জানলা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে আছে। দ্বিতীয়
কম্পার্টমেন্টটাও সে যাতায়াতকারী দরজাটার ফাঁক দিয়ে সে দেখতে পেলো, খালি,
ব্যাগ আর কার্পেট গুলো মেঝেতে জড়ো করা আছে। পরিচারিকাটি
ওখানে ছিল না।
ক্যাথেরিন দেখলো তার
নিজের বিছানা করাই আছে আর যেহেতু সে খুব ক্লান্ত ছিল, সে বিছানায় উঠে পড়লো এবং প্রায় সাড়ে নটা নাগাদ আলো নিবিয়ে শুয়ে পড়লো।
হঠাৎ একটা ঝাকুনিতে তার
ঘুম ভেঙে গেলো;
কতক্ষন কেটে গেছে সে জানে না। ঘড়ির দিকে তাকাতে, সে বুঝলো ওটা বন্ধ হয়ে
গেছে।
একটা ভীষণ অস্বস্তিকর
পরিবেশ যেন তাকে ঘিরে ধরেছে, যত সময় যাচ্ছে ততই যেন
সেটা বাড়ছে। অবশেষে সে বিছানা ছেড়ে উঠে পড়লো, ড্রেসিং গাউনটা কাঁধের
ওপর দিয়ে জড়িয়ে নিয়ে সে করিডোরে এসে দাঁড়ালো। পুরো ট্রেনটা যেন ঝিমিয়ে আছে। ক্যাথেরিন জানলাটা নামিয়ে দিয়ে তার ধরে কিছুক্ষন বসলো, রাতের শীতল হওয়া অনুভব করতে করতে সে নিজের ভয়ের অনুভূতিটাকে কমানোর বার্থ
প্রচেষ্টা চালিয়ে যেতে লাগলো। সে ঠিক করলো যে সে এখন শেষের দিকে যাবে এবং
কন্ডাক্টরকে সঠিক সময় টা জিজ্ঞেস করবে, যাতে সে নিজের ঘড়িতে সঠিক
সময় টা সেট করতে পারে। কিন্তু, সে গিয়ে দেখলো যে তার ছোট
মতন চেয়ার টা খালি।
সে কিছুক্ষন ইতস্তত করে
পরের কোচের দিকে চললো। সে লম্বা করিডোরের ঢিমে আলোতে খুব অবাক হয়ে দেখলো, একজন লোক মিঙ্ক কোট পড়া মহিলার কম্পার্টমেন্টের দরজায় হাত রেখে দাঁড়িয়ে আছে।
সত্যি কথায়,
তার মনে হলো ওটাই সেই কম্পার্টমেন্ট। যদিও, হতে পারে,
তার ভুল হয়েছিল। লোকটি তার দিকে পেছন করে সেখানে কয়েক মিনিট
দাঁড়িয়েছিল,
তার আচরণ খুবই অস্থির এবং দ্বিধাগ্রস্ত লাগছিলো। তারপর সে
আস্তে আস্তে ঘুরে দাঁড়ালো,
আর একটা অস্বস্তিকর ভয়ঙ্কর আতঙ্কের সাথে ক্যাথেরিন তাকে
চিনতে পারলো,
ওটা একই লোক যাকে নাকি আগে সে দুবার দেখেছে একবার স্যাভয়ে
হোটেলের করিডোরে এবং আর একবার কুকের অফিসে। তারপর সে কম্পার্টমেন্টের দরজাটা খুলে
ভেতরে ঢুকে গেলো এবং দরজাটা বন্ধ করে দিলো।
একটা কথা হঠাৎ
ক্যাথেরিনের মাথায় খেলে গেলো। এটাই কি সেই লোক যার কথা ওই মহিলা বলেছিলো - যে
লোকের সাথে সে দেখা করার জন্য যাচ্ছে।
ক্যাথেরিন তারপর নিজেকে
বললো যে সে বোধয় একটু বেশিই ভাবছে। সে হয়তো কম্পার্টমেন্টটা চিনতেই ভুল করেছে।
সে তার নিজের কোচে ফিরে
গেলো, পাঁচ মিনিট বাদে টেনের গতি কমে গেলো।
ওয়েস্টিংহাউস ব্রেকের
একটা লম্বা হিস্স্ এর কয়েক মিনিট পরেই ট্রেনটা লিয়োন্সে থেমে গেলো।
চ্যাপ্টার ১১
খুন
পরদিন এক রৌদ্রজ্জ্বল
সকালে ক্যাথেরিনের ঘুম ভাঙলো। সে তাড়াতাড়ি প্রাতরাশ করতে গেলো, কিন্তু আগের দিনের কোনো সঙ্গী কে দেখতে পেলো না। সে যখন কম্পার্টমেন্টে ফিরে
এলো ততক্ষনে কন্ডাক্টরটি,
বিষন্ন মুখের ঝোলা গোঁফওয়ালা একজন কালো লোক, বিছানাটা তুলে সেটা দিনেরবেলা ব্যবহারের উপযোগী করে তুলেছে।
"মাদাম খুব
ভাগ্যবতী,"
সে বললো, "আজ সূর্য উঠেছে, সকালবেলা পৌঁছে যদি দেখেন মেঘলা আকাশ যাত্রীরা সাধারণত খুব হতাশ হয়ে
পড়েন।"
"আমিও নিশ্চিতভাবেই
খুব হতাশ হয়ে পড়তাম,"
ক্যাথেরিন বললো।
লোকটি এবার যাওয়ার জন্য
তৈরি হলো।
"আমরা অনেকটাই
দেরিতে চলছি,
মাদাম," সে বললো। "আমরা
নাইসে পৌঁছনোর কিছুক্ষন আগেই আপনাকে জানিয়ে দেব।"
ক্যাথেরিন মাথা নাড়লো। সে
জানলার ধারে বসলো;
বাইরের রৌদ্রজ্জ্বল প্রাকৃতিক দৃশ্য দেখে মুগ্ধ হয়ে গেলো।
প্যালিড গাছগুলো,
গভীর নীল সমুদ্র, উজ্জ্বল হলুদ রঙের
লজ্জাবতী লতা নতুন জগৎ দেখার আনন্দ হয়ে ধরা দিলো এমন এক মহিলার কাছে যে নাকি গত
চোদ্দ বছর ধরে কেবল মাত্র ইংল্যান্ডের নোংরা, কাদামাখা শীতকালই দেখেছে।
যখন তারা কাননেসে পৌঁছলো
ক্যাথেরিন বেরিয়ে এসে প্লাটফর্মে পায়চারি করতে লাগলো। মিঙ্ক কোট পড়া মহিলার বিষয়ে তার বেশ কৌতূহল ছিল, সে তার কম্পার্টমেন্টের জানলা দিয়ে ভেতরে দেখার চেষ্টা করলো। জানলাটাতে তখন
পর্দা ফেলা ছিল - সারা ট্রেনে ওটাই একমাত্র জানলা যেখানে তখনো পর্দা ফেলা।
ক্যাথেরিন একটু অবাক হলো,
সে যখন আবার ট্রেনে চড়লো এবং করিডোর দিয়ে যাচ্ছিলো লক্ষ্য
করলো যে ওই দুটো কম্পার্টমেন্টের দরজা তখন বন্ধ। মিঙ্ক কোট পড়া মহিলার সকালে ওঠা
অভ্যেস নেই।
কিছুক্ষনের মধ্যেই
কন্ডাক্টরটি তার কাছে এলো এবং জানালো যে আর কয়েক মিনিটের মধ্যেই ট্রেন নাইস পৌঁছে
যাবে। ক্যাথেরিন তাকে কিছু বকশিস দিলো; সে তাকে ধ্যন্যবাদ জানালো, কিন্তু তার পরও দাঁড়িয়ে থাকলো।
তার মধ্যেই একটা
অস্বাভাবিক কিছু ছিল। ক্যাথেরিন প্রথমে ভেবেছিলো, বকশিসটা বোধয় যথেষ্ট হয় নি, কিন্তু এখন বুঝতে পারলো
কিছু একটা বেশ বড়ো গন্ডগোল হয়েছে। তার মুখ একদম ফেকাসে, হাত পা কাঁপছে,
আর মনে হচ্ছে জীবনে এতো ভয় সে আগে কোনোদিন পায় নি। সে তার
দিকে খুব অদ্ভুত ভাবে তাকিয়েছিলো। কিছুক্ষন পরে সে হঠাৎ বললো, "ক্ষমা করবেন মাদাম,
নাইসে, ওনার সাথে কোনো বন্ধুর কি
দেখা করার কথা ছিল?"
"হতে পারে," ক্যাথেরিন বললো,
"কেন?"
কিন্তু লোকটা শুধু মাথা
নাড়লো আর বিড়বিড় করে কি সব বললো যা ক্যাথেরিন বুঝতে পারলো না তারপর ওখান থেকে চলে
গেলো, ট্রেনটা স্টেশনে একেবারে থেমে যাওয়ার আগে আর তার দেখা পাওয়া গেলো না, স্টেশনে পৌঁছনোর পর ক্যাথেরিন জানলা দিয়ে নিজের জিনিসপত্র গুলো তার হাতে
দিচ্ছিলো নামিয়ে দেওয়ার জন্য।
ক্যাথেরিন প্লাটফর্মে
নেমে দু এক মিনিট দাঁড়িয়ে থাকলো, সে বুঝতে পারছিলো না কি
করবে, একজন অল্প বয়স্ক সুন্দর দেখতে যুবক, যার মুখ দেখে বেশ চালাক
চতুর বলে মনে হয় তার দিকে এগিয়ে এলো এবং একটু ইতস্তত করে জিজ্ঞেস করলেন :
"আপনিই কি, মিস গ্রে?"
ক্যাথেরিন যখন তাকে
জানালো যে সে ঠিকই অনুমান করেছে তখন যুবকটি আনন্দে লাফিয়ে উঠে তার দিকে একটা
নিষ্পাপ হাসি দিয়ে বিড়বিড় করে বললেন:
"আমি ছুব্বি, নিশ্চই জানেন - লেডি ট্যাম্পলিংয়ের স্বামী। আশা করি উনি আমার কথা বলেছেন, আবার ভুলেও যেতে পারেন। আপনার কি লাগেজের টিকেট আছে? এবছর যখন ফিরছিলাম,
আমি না আমারটা হারিয়ে ফেলেছিলাম, আপনি চিন্তাও করতে পারবেন না এরা তখন কি যে হয়রানি করেছিল। যথারীতি ফ্রেঞ্চ
লাল ফিতে।
ক্যাথেরিন টিকেটটা বের
করলো, এবং তার সাথে যাবার জন্য যখন এগোতে গেলো, একটা খুব মোলায়েম এবং
নিচু স্বর তার কানে বিড়বিড় করে বললো:
"দয়া করে একটু
শুনবেন, ম্যাডাম।"
ক্যাথেরিন ঘুরে দাঁড়িয়ে
একজন ভদ্রলোককে দেখতে পেলো যার য়ুনিফর্ম এবং বিপুল পরিমানে সোনালী লেসের সংখ্যা
তার পদ মর্যাদার প্রমান দেয়।
ব্যাক্তিটি জানালো, "কয়েকটা ফর্মালিটিস আছে। মাদাম যদি দয়া করে একটু ওনার সঙ্গে আসেন। পুলিশের কিছু
নিয়ম কানুন -" সে তার হাত দুটো ছুড়ে দিয়ে বললো, "অযৌক্তিক,
নিঃসন্দেহে, কিন্তু এগুলো করতেই
হবে।"
মিস্টার ছুব্বি এভান্স
এতক্ষন শুনলেও ঠিক বুঝতে পারছিলেন না, কারণ তাঁর ফরাসি ভাষার
ওপর দখল খুবই সীমিত।
"একদম ফরাসিদের মতো," মিস্টার এভান্স বিড়বিড় করে বললেন। তিনি হচ্ছেন একজন ব্রিটেনের গোঁড়া দেশভক্ত
যিনি, বিদেশের মাটিতেও নিজেদের মতো একটা জায়গা বানিয়ে নিয়েছেন, এবং এখানকার আদি বাসিন্দাদের একেবারেই পছন্দ করেন না। "সবসময় সামান্য
কিছু না কিছু নিয়ে ঝামেলা করবেই, যদিও, এরা কখনো থানায় নিয়ে যায় না। এটা একটা নতুন ব্যাপার। আমার মনে হয় আপনাকে যেতে
হবে।"
ক্যাথেরিন তার পথ
নির্দেশকের সাথে চললো। সে কিছুটা অবাক হয়ে দেখলো যে পথ নির্দেশকটি তাকে একটা
সাইডিংয়ের দিকে নিয়ে চললো যেখানে ছেড়ে যাওয়া ট্রেনের একটা কোচ রাখা আছে। সে তাকে
উঠতে সাহায্য করলো,
এবং,
করিডোরে তার আগে আগে চললো, সে একটা কম্পার্টমেন্টের দরজা খুলে দাঁড়ালো
তার ভেতরে একজন জমকালো
চেহারার অফিসার ছিলেন,
এবং তাঁর সঙ্গে একজন সাদামাটা লোক ছিলেন যাকে কর্মচারী বলে
মনে হলো। জমকালো চেহারার লোকটি বিনীত ভাবে উঠে দাঁড়ালেন, কাথেরিনকে একটা বাও করলেন, এবং বললেন:
"আমাকে ক্ষমা করবেন, মাদাম,
কিন্তু কয়েকটা ফর্মালিটিস আছে যা মানতেই হবে। মাদাম, ফরাসি বলতে পারেন,
আসা করি?"
"যথেষ্টই, মনে করি,
মসিয়েঁ," ক্যাথেরিন সেই ভাষাতেই
উত্তর দিলো।
"খুব ভালো। দয়া করে
বসুন, মাদাম। আমি মসিয়েঁ কাউক্স, পুলিশ কমিশনার।
তিঁনি নিজের গুরুত্ব
বোঝাতে তাঁর বুকটা ফুলিয়ে দাঁড়ালেন, এতে যে সে যথেষ্ট প্রভাবিত হয়েছে ক্যাথেরিন সেটাই দেখাতে চেষ্টা করছিলো।
"আপনি কি আমার
পাসপোর্ট দেখতে চান?"
সে জিজ্ঞেস করলো, "এই যে এটা।"
কমিশনারটি তাকে তীক্ষ্ণ
ভাবে দেখতে থাকলেন এবং একটা ঘোৎ করে মৃদু শব্দ করলেন।
"ধ্যনবাদ, মাদাম,"
তার থেকে পাসপোর্টটা নিয়ে তিঁনি বললেন। তিঁনি গলাটা একবার পরিষ্কার করে নিলেন।
"আমি আসলে যা চাই
তা হলো কিছু তথ্য।"
"তথ্য?"
কমিশনার ধীরে ধীরে মাথা
নাড়ালেন।
"আপনার সহযাত্রী
একজন মহিলার বিষয়ে। গতকাল দুপুরে আপনারা একসাথে খেয়েছিলেন।"
"আমি দুঃখিত, আমি ওনার সম্পর্কে আপনাকে কিছুই বলতে পারবো না। আমরা খেতে খেতে কিছু কথা
বার্তা বলছিলাম,
কিন্তু উনি আমার একদম অপরিচিত একজন ব্যাক্তি। আমি ওনাকে আগে কোনোদিন দেখিনি।
"তা সত্ত্বেও," কমিশনারটি তীক্ষ্ণ স্বরে বললো, "দুপুরের খাওয়ার পর আপনি ওনার কম্পার্টমেন্টেও যান এবং বেশ কিছুক্ষন বসে কথা
বার্তা বলেন।"
"হ্যাঁ," ক্যাথেরিন বললো,
"একথা সত্যি।"
কমিশনারটি আশা করেছিলেন
ক্যাথেরিন আরো বেশি কিছু বলবে। তিঁনি খুব আগ্রহভরে তার দিকে তাকিয়েছিলেন।
"তারপর, মাদাম?"
"কি, মসিয়েঁ?"
ক্যাথেরিন বললো।
"আপনি হয়তো, আপনাদের মধ্যে কি নিয়ে কথা বার্তা হয়েছিল সে সম্পর্কে একটা ধারণা আমাকে দিতে
পারেন?"
"পারি," ক্যাথেরিন বললো,
"কিন্তু এই মুহূর্তে সেটার কোনো কারণ আমি দেখতে পাচ্ছি
না।"
সে ব্রিটিশ কায়দায় কিছুটা
উৎকন্ঠিত হয়ে উঠলো।
এই বিদেশি অফিসার গুলোকে
তার খুব দাম্ভিক লাগছিলো।
"কোনো কারণ দেখতে
পাচ্ছেন না?"
কমিশনারটি চেঁচিয়ে উঠলো, "ঠিক আছে,
মাদাম, আমি আপনাকে আস্বস্ত করছি
যে একটা কারণ আছে।"
"তাহলে কারণটা
আমাকে জানান।"
কমিশনারটি কোনো কথা না
বলে নিজের থুতনিটা দু এক মিনিট বেশ করে ঘষলো।
"মাদাম," শেষ পর্যন্ত তিঁনি বললেন, "কারণটা খুবই সহজ।
ভদ্রমহিলাকে আজ সকালে ওনার কম্পার্টমেন্টে মৃত অবস্থায় পাওয়া গেছে।"
"মৃত," ক্যাথেরিন দম বন্ধ করে বললো, "কি হয়েছিল - হার্ট ফেল?"
"না," কমিশনারটি প্রতিদ্ধনির মতো বললো। "না - ওনাকে খুন করা হয়েছে।"
"খুন!"
ক্যাথেরিন চেঁচিয়ে উঠলো।
"দেখতেই পাচ্ছেন, মাদাম,
কেন আমরা কোনো রকম কোনো তথ্যের জন্য এতো উদগ্রীব হয়ে খোঁজ
করছি।"
"কিন্তু, নিশ্চিত ওনার পরিচারিকাটি -"
"পরিচারিকাটির কোনো
খোঁজ পাওয়া যাচ্ছে না।"
"ওঃ!"
ক্যাথেরিন একটু থেমে নিজের চিন্তাগুলো গুছিয়ে নিচ্ছিলো।
"যেহেতু
কন্ডাক্টরটি আপনাকে ওনার সাথে ওনার কম্পার্টমেন্টে কথা বলতে দেখেছিলো, সে স্বাভাবিক ভাবেই এই কথাটা পুলিশকে জানিয়েছিল, এবং এই জন্যই আমরা আপনাকে আটকেছি, মাদাম, যদি কোনো তথ্য পাওয়া যায় এই আশায়।"
"আমি খুবই দুঃখিত," ক্যাথেরিন বললো,
"আমি ওনার নামটাও জানি না।"
"ওনার নাম কেটারিং।
এটা আমরা জানতে পেরেছি ওনার পাসপোর্ট থেকে এবং ওনার লাগেজের লেবেল দেখে। আমরা যদি
-"
এইসময় কম্পার্টমেন্টের
দরজায় কেউ একটা টোকা দিলো। মসিয়েঁ কাউক্সের ভুরুগুলো কুঁচকে গেলো। তিঁনি দরজাটা ছ
ইঞ্চি মতো খুললেন।
"কি ব্যাপার?" তিনি রুষ্ট ভাবে বললেন। "আমাকে এখন বিরক্ত করবেন না।"
ক্যাথেরিনের রাতের
খাবারের সঙ্গীর ডিমের মতো মাথাটা দরজার ফাঁক দিয়ে দেখা গেলো। তাঁর মুখে একটা
উজ্জ্বল হাঁসি।
"আমার নাম হলো," তিঁনি বললেন,
"এরকুল পোয়ারো"
"আপনি কি," কমিশনারটি তোতলাতে তোতলাতে বললেন, "আপনি কি সেই এরকুল পোয়ারো?"
"এক্কেবারেই।"
বললেন মিস্টার পোয়ারো,
"আমার মনে আছে যে আগে প্যারিসে, সুরেতে একবার আমাদের দেখা হয়েছিল, মসিয়েঁ কাউক্স, আপনি নিশ্চয় আমাকে ভুলে গেছেন।"
"একেবারেই না, মসিয়েঁ,
একেবারেই না।" কমিশনারটি নিজের হৃদয় থেকে জানালেন। "আমি আপনাকে ভেতরে আসার অনুরোধ করছি। আপনি ঘটনাটা
জানেন -"
"হ্যাঁ, আমি জানি,"
এরকুল পোয়ারো বললেন। "আমি এসেছিলাম এটাই জানতে আমি কি
কোনোরকম ভাবে কোনো সাহায্য করতে পারি?"
"আমরা
আপ্লুত।" কমিশনারটি সঙ্গে সঙ্গে উত্তর দিলেন। "মিস্টার পোয়ারো, আসুন আপনার সাথে আলাপ
করিয়ে দি -"তিঁনি পাসপোর্টটা, যেটা এতক্ষন হাতে ধরে
ছিলেন সেটা একবার দেখে নিয়ে বললেন - "মাদাম - মানে - মাদমোয়েজেল গ্রের
সাথে।"
পোয়ারো ক্যাথেরিনের দিকে
তাকিয়ে হাসলেন।
"কি অদ্ভুত, তাই না,"
তিঁনি বিড়বিড় করে বললেন, "আমার কথাগুলো এতো তাড়াতাড়ি সত্যি হয়ে গেলো?"
"হায়, মাদমোয়েজেল! আমাদের খুব অল্পই কিছু বলতে পারলেন।"
"আমি বোঝাতে চাইছি," ক্যাথেরিন বললো,
"ওই হতভাগ্য মহিলা আমার কাছে একেবারেই অপরিচিতা।"
পোয়ারো মাথা নাড়লেন।
"কিন্তু, উনি আপনার সাথে কথা বলেছিলেন, ঠিক কিনা?" উনি খুব ভদ্র ভাবে বললেন, "আপনি ওনার সম্পর্কে একটা
ধারণা তৈরী করেছিলেন,
তাই না?"
"হ্যাঁ," ক্যাথেরিন একটু চিন্তা করে বললো। "মনে হয়, আমি করেছিলাম। আর সেই ধারণাটা ছিল -"
"বলুন মাদমোয়েজেল
-" কমিশনারটি এক ঝাকুনিতে সামনে এগিয়ে এলেন - "আমাদের আপনার ধারণার কথা
জানান।"
ক্যাথেরিন পুরো জিনিসটা
একবার নিজের মনে চিন্তা করে নিলো। তার একবার মনে হলো যেন সে বিশ্বাসঘাতকতা করতে
যাচ্ছে, কিন্তু ওই বিচ্ছিরি কথাটা 'খুন' যেন তার কানে বাজছে,
সে কোনো কথাই আর লুকোতে চায় না। অনেক কিছুই এর ওপরে দাঁড়িয়ে
আছে। তাই,
যতটা সম্ভব, মৃত মহিলার সাথে কথা
বার্তা গুলো যেমন যেমন হয়েছিল তেমন ভাবেই সে প্রতিটা কথা জানালো।
"এ তো খুবই অদ্ভুত একটা
ব্যাপার।" কমিশনারটি বললেন, অপরজনের দিকে তাকিয়ে। "ইয়ে, মসিয়েঁ পোয়ারো, এ তো খুবই অদ্ভুত একটা ব্যাপার? কিন্তু এই অপরাধের সাথে
এর কোনো সম্পর্ক আছে কিনা -" উনি বাক্যটি আর শেষ করলেন না।
"আমি ভাবছিলাম এটা
কি সুইসাইড হতে পারে না,"
ক্যাথেরিন একটু অনিশ্চয়তার সাথে বললো।
"না," কমিশনারটি বললেন,
"এটা সুইসাইড হতে পারে না। ওনাকে একটা কালো লম্বা দড়ি দিয়ে
দম বন্ধ করে মারা হয়েছে।
"ওঃ!"
ক্যাথেরিন কেঁপে উঠলো। মসিয়েঁ কাউক্স ক্ষমা চাওয়ার ভঙ্গিতে তাঁর হাত দুটো ছড়িয়ে
দিলেন। "এটা মোটেই সুখকর নয় - আমাদের ট্রেন ডাকাতরা আপনাদের দেশের থেকে অনেক
বেশি নিষ্ঠুর।"
"এটা ভয়ঙ্কর।"
"হ্যাঁ, হ্যাঁ,"
তিনি সান্তনা দেওয়া এবং ক্ষমা প্রার্থনার মতো বললেন -
"কিন্তু আপনার অসম্ভব সাহস, মাদমোয়েজেল। যখন থেকে আমি
আপনাকে দেখেছি,
তখন থেকেই আমি বুঝেছি, "মাদমোয়েজেলের অসম্ভব সাহস। আর সেই জন্যই আমি আপনাকে আরো কয়েকটা কাজ করতে বলবো
- জানি খুবই কষ্টদায়ক,
কিন্তু আমি আপনাকে বলতে চাই যে এটা খুবই জরুরি।"
ক্যাথেরিন তাঁর দিকে ভীত
সন্ত্রস্তভাবে তাকিয়ে থাকলো।
তিঁনি ক্ষমা প্রার্থীর
মতো তাঁর হাত গুলো ছড়িয়ে দিলেন।
"আমি আপনাকে অনুরোধ
করবো যে,
যদি আপনি আমার সঙ্গে পরের কম্পার্টমেন্টে আসেন।"
"আমাকে যেতেই হবে?" ক্যাথেরিন একটু নিচু স্বরে জিজ্ঞেস করলো।
"কোনো একজনকে তো
ওনাকে সনাক্ত করতে হবে,
" কমিশনারটি বললো, "আর যেহেতু পরিচারিকাটিকেও পাওয়া যাচ্ছে না" - তিঁনি একটু খুক খুক করে
কাসলেন - " আপনাকেই ট্রেনে ওঠার পর থেকে ওনার সাথে সব থেকে বেশি সময় কাটাতে
দেখা গেছে"
"ঠিক আছে," ক্যাথেরিন শান্ত ভাবে বললো, "যদি এটা জরুরি হয় -"
সে উঠে দাঁড়ালো, পোয়ারো মাথা নাড়িয়ে তাকে সম্মতি জানালেন।
"মাদমোয়েজেল
বুদ্ধিমতী,"
তিনি বললেন, "আমি কি আপনার সাথে আস্তে পারি, মসিয়েঁ কাউক্স?"
"অবশ্যই, প্রিয় বন্ধু মসিয়েঁ পোয়ারো।"
তাঁরা করিডোরে বেরিয়ে
এলেন এবং মসিয়েঁ কাউক্স মৃতা মহিলার কম্পার্টমেন্টের দরজাটা খুললেন। উল্টো দিকের
পর্দা গুলো অর্ধেক তোলা আলো আসার জন্য। মৃতা মহিলা তাদের বাঁ দিকের বার্থে শুয়ে
ছিলেন, তিনি এমনভাবে স্বাভাবিক ভাবে শুয়ে ছিলেন যে দেখলে মনে হবে ঘুমোচ্ছেন। তাঁর
গায়ে বিছানার চাদর চাপা দেওয়া ছিল, আর মাথাটা দেয়ালের দিকে
ঘোরানো ছিল,
এমভাবে ছিল যে শুধু কালচে লাল রঙের কোঁকড়া চুল গুলো দেখা
যাচ্ছিলো। খুব ধীরে ধীরে মসিয়েঁ কাউক্স তার কাঁধটা ধরে তার দেহটা এমন ভাবে ঘুরিয়ে
দিলেন যাতে তার মুখটা দেখা যায়। ক্যাথেরিন একটু কেঁপে উঠলো এবং তার নখগুলো হাতের
তালুতে চেপে ধরলো। একটা ভয়ঙ্কর আঘাতে তার মুখটা এরকম ভাবে বিকৃত করে দেওয়া হয়েছে
যে চেনা অসম্ভব।
পোয়ারো বিস্ময়ে একটা
তীক্ষ্ণ চিৎকার করে উঠলেন।
"আমি ভাবছি, এটা কখন করা হলো?
তিনি জিজ্ঞেস করলেন, "মৃত্যুর আগে না পরে?"
"ডাক্তার বলেছেন
পরে।" মসিয়েঁ কাউক্স বললেন।
"আশ্চর্য," পোয়ারো তাঁর ভুরু গুলো একসাথে করে বললেন।
তিনি ক্যাথেরিনের দিকে
ঘুরে বললেন,
"মাদমোয়েজেল, সাহস সঞ্চয় করুন, ওনাকে ভালো করে দেখুন। আপনি কি নিশ্চিত গতকাল ট্রেনে এই মহিলার সাথেই আপনি কথা
বলেছিলেন?"
ক্যাথেরিনের নার্ভ যথেষ্ট
ভালো। সে নিজেকে শক্ত করে বেশ কিছুক্ষন ধরে শায়িত চেহারাটার দিকে দেখলো। তারপরে সে
ঝুকে মৃত মহিলার হাতটা দেখতে লাগলো।
"আমি একেবারে
নিশ্চিত।" সে কিছুক্ষন পরে বললো, "চেহারাটা এমন ভাবে বিকৃত করা হয়েছে চেনা সম্ভব নয়, কিন্তু শারীরিক গঠন ও উচ্চতা এবং চুল একইরকম, আর তাছাড়া আমি এটা লক্ষ করেছিলাম -" সে মৃত মহিলার কব্জিতে একটা তিলের
দিকে দেখালো - "যখন ওনার সাথে কথা বলছিলাম।"
"বাঃ," পোয়ারো প্রশংসার সাথে বললেন। "আপনি একজন চমৎকার সাক্ষী, মাদমোয়েজেল। "পরিচয়ের ব্যাপারে আর কোনো সন্দেহই নেই, কিন্তু তবুও,
এটা বেশ আশ্চর্যের।" তিনি ভুরু দুটো কুঁচকে মৃত মহিলার
দিকে অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকলেন।
মসিয়েঁ কাউক্স তার কাঁধ
দুটো ঝাঁকালেন।
"খুনটা কোনো রাগের
বসে করা হয়েছে,
এব্যাপারে সন্দেহ নেই।" তিঁনি জানালেন।
"যদি ওনাকে আঘাত
করে ফেলে দেওয়া হতো তাহলে ব্যাপারটা যুক্তিযুক্ত হতো।" পোয়ারো একটু চিন্তা
করে বললেন,
"কিন্তু যে ওনাকে দমবন্ধ করে মেরেছে সে চুপি চুপি পেছন থেকে
এসেছে এবং অপ্রস্তুত অবস্থায় ওনাকে আক্রমণ করেছে। একটা গলা চেপে ধরার অস্পষ্ট
আওয়াজ - একটা ঘড়ঘরে আওয়াজ - ছাড়া আর কোনো শব্দই শোনা যাবে না, আর তারপরে - এইভাবে মুখের ওপর প্রচন্ড আঘাত। কেন? সে কি আশা করেছিল যদি মুখটা বিকৃত হয়ে যায় তাহলে আর পরিচয় জানা যাবে না? অথবা সে কি ওনাকে এতটাই ঘৃণা করতো যে মৃত্যুর পরেও মুখের ওপর ওই প্রচন্ড আঘাতগুলো
করা থেকে নিজেকে সামলাতে পারে নি?
ক্যাথেরিন একটু কেঁপে
উঠলো, এবং তিঁনি সঙ্গে সঙ্গে তার দিকে পরম মমতার সঙ্গে ঘুরে দাঁড়ালেন।
"আমি আপনাকে কষ্ট
দিতে চাই নি,
মাদমোয়েজেল," তিঁনি বললেন। "আপনার কাছে এগুলো খুব সাংঘাতিক ব্যাপার, কিন্তু,
হায়,
আমার কাছে এগুলো সব পুরোনো কাহিনী। আমি আপনাদের দুজনের কাছ
থেকেই কিছুক্ষনের জন্য অনুমতি চাইছি।"
তারা দরজার কাছে দাঁড়িয়ে
তাঁকে দেখতে লাগলো এবং তিঁনি খুব তাড়াতাড়ি কম্পার্টমেন্টটা একবার ঘুরে নিলেন।
তিঁনি দেখলেন মৃত মহিলার পোশাক বার্থ এর শেষের দিকে খুব যত্ন করে ভাঁজ করে রাখা
আছে, পশমের বড়ো কোটটা একটা হুকে ঝোলানো আছে, আর ছোট লাল রঙের ল্যাকর্
হ্যাটটা তাকের ওপর ছুড়ে ফেলে রাখা আছে। তারপর তিঁনি পাশের কম্পার্টমেন্টায় ঢুকলেন, যেখানে ক্যাথেরিন পরিচারিকাটিকে বসে থাকতে দেখেছিলো। এই বার্থটায় বিছানা করা
নেই। তিন চারটে কার্পেট সিটের ওপর ছড়িয়ে ছিটিয়ে জড়ো করে রাখা আছে; ওখানে একটা হ্যাট বক্স এবং গোটা দুই সুটকেস রাখা ছিল। তিঁনি হঠাৎ ক্যাথেরিনের
দিকে ঘুরে বললেন।
"আপনি এখানে গতকাল
এসেছিলেন,"
তিঁনি বললেন, "কোনো পরিবর্তন বা কোনো কিছু নেই বলে কি মনে হচ্ছে?"
ক্যাথেরিন দুটো কম্পার্টমেন্টই
এক এক করে খুব ভালো করে দেখলো।
"হ্যাঁ," সে বললো,
"একটা জিনিস নেই বলে মনে হচ্ছে - একটা টক টকে লাল রঙের
মরক্কো বাক্স।বাক্সটার ওপরে আদ্যাক্ষর আর.ভি.কে. লেখা ছিল। ওটা একটা ছোট
ড্রেসিংয়ের বাক্স অথবা একটা বড়ো গয়নার বাক্স হতে পারে। যখন আমি দেখেছিলাম, পরিচারিকাটি ওটা কোলে নিয়ে বসে ছিল। "
"আঃ!" পোয়ারো
বললেন।
"কিন্তু, নিশ্চিতভাবেই,"
ক্যাথেরিন বললো, " যদিও আমি - আমি এসব ব্যাপারে কিছুই জানি না, তবুও মনে হচ্ছে খুব সহজ একটা ব্যাপার, যদি পরিচারিকাটি এবং
গয়নার বাক্সটা দুটোই উধাও হয়ে যায়?"
"আপনি বলতে চাইছেন পরিচারিকাটিই
চুরিটা করেছে?
না,
মাদমোয়েজেল; এর বিপক্ষে একটা খুব ভালো
কারণ আছে।,"
কমিশনারটি বললেন।
"কি?"
"পরিচারিকাটিকে
প্যারিসেই ছেড়ে আসা হয়েছে।"
তিঁনি পোয়ারোর দিকে
ঘুরলেন।
"আমি চাই আপনি
কন্ডাক্টরের জবানবন্দিটাও তার নিজের মুখ থেকেই শুনুন।" তিঁনি বেশ গোপনতার
সঙ্গে বিড়বিড় করে বললেন। "এটা বেশ ইঙ্গিতপূর্ণ।"
"মাদমোয়েজেলও
নিঃসন্দেহে এটা শুনতে চাইবেন।" পোয়ারো বললেন। "আপনার আপত্তি নেই তো
মসিয়েঁ লে কমিসাইরে?"
"না," কমিশনারটি বললেন,
যদিও তিঁনি পরিষ্কার ভাবেই আপত্তি করতে চাইছিলেন।
"না, অবশ্যই যদি আপনি চান,
মসিয়েঁ পোয়ারো। আপনার এখানকার কাজ কি মিটেছে?"
"আশা করি, একটা মিনিট শুধু।"
তিনি কার্পেট গুলো তুলে
তুলে দেখছিলেন,
আর এখন একটাকে নিয়ে জানলার কাছে গিয়ে দেখতে লাগলেন, আঙ্গুল দিয়ে সেটার থেকে কিছু একটা তুলে নিলেন।
"ওটা কি?" মসিয়েঁ কাউক্স খুব তীক্ষ্ণ ভাবে জানতে চাইলেন।
"চারটে লালচে
বাদামি রঙের চুল। "তিঁনি মৃতা মহিলার ওপর একটি ঝুকে দেখলেন। "হ্যাঁ, এগুলো মাদামের মাথা থেকেই এসেছে।"
"আর ওগুলো দিয়ে কি
বোঝাচ্ছে?
আপনি কি ওগুলোর ওপর গুরুত্ব দিচ্ছেন?"
পোয়ারো কার্পেটটি আবার
সিটের ওপর রেখে দিলেন।
"কোনটা
গুরুত্বপূর্ণ আর কোনটা নয়?
সেটা এখন বলা সম্ভবপর নয়। কিন্তু সমস্ত ছোট ছোট সূত্রও
গুরুত্বের সঙ্গে আমাদের মাথায় রাখতে হবে।"
তাঁরা আবার প্রথম
কম্পার্টমেন্টে ফিরে গেলেন,
এবং এক দু মিনিটের ভেতরে কন্ডাক্টরটি প্রশ্নোত্তরের জন্য
এসে উপস্থিত হোলো।
"আপনার নাম, পিয়ের মিচেল?"
কমিশনারটি বললেন।
"হ্যাঁ, মসিয়েঁ লে কমিসাইরে"
"আমি চাই আপনি
আরেকবার এই ভদ্রলোককে বলুন -" তিঁনি পোয়ারোর দিকে দেখালেন -"প্যারিসে কি
ঘটেছিলো,
সেই কথাগুলো, যা আপনি আমাকে
বলেছিলেন।"
"ঠিক আছে, মসিয়েঁ লে কমিসাইরে,
এটা ঘটেছিলো আমরা গারে ডি লিওন ছাড়ার পর। আমি বিছানা করতে
এলাম, এই ভেবে যে মাদাম বোধয় রাতের খাবার খেতে গেছেন, কিন্তু তাঁর কম্পার্টমেন্টে একটা ডিনার-বাস্কেট ছিল। তিঁনি জানালেন যে তাঁর
পরিচারিকাটিকে প্যারিসে ছেড়ে আসতে বাধ্য হয়েছেন, তাই আমাকে খালি একটা বিছানাই করতে হবে। তিঁনি তাঁর ডিনার-বাস্কেটটা নিয়ে পাশের
ঘরে গেলেন,
আর ওখানেই বসে ছিলেন যতক্ষণ আমি ওনার বিছানা করি; তারপর উনি আমাকে জানান যে ওনাকে যেন আমি সকাল সকাল তুলে না দি, উনি একটু বেলা পর্যন্ত ঘুমোতে চান। আমি তাঁকে জানাই, যে আমি ওনার কথা বুঝেছি এবং উনি আমাকে 'শুভ রাত্রি' জানান।"
"আপনি নিজে থেকে
কখনো পাশের কম্পার্টমেন্টে যান নি?"
"না, মসিয়েঁ।"
"তাহলে আপনি নিশ্চই
ওখানে লাগেজের মধ্যে একটা টক টকে লাল রঙের মরক্কো বাক্স দেখেন নি?"
"না, মসিয়েঁ,
আমি দেখিনি।"
"কোনো লোকের পক্ষে
কি পাশের কম্পার্টমেন্টে লুকিয়ে থাকা সম্ভব?"
কন্ডাক্টরটি একটু চিন্তা
করলেন।
"দরজাটা অর্ধেক
খোলা ছিল,"
তিঁনি বললেন, "কোনো লোক যদি দরজাটার পেছনে দাঁড়িয়ে থাকেন তাহলে তাঁকে আমার পক্ষে দেখা সম্ভব
নয়, কিন্তু,
মাদাম তাঁকে পরিষ্কার ভাবেই দেখতে পাবেন যখন তিঁনি ওই ঘরে
গেলেন।"
"ঠিক তাই," পোয়ারো বললেন,
"আপনার কি আমাদের আর কিছু বলার আছে?"
"আমার মনে হয়, এই টুকুই,
মসিয়েঁ, আর কিছু আমি মনে করতে
পারছি না।"
"আর আজ সকালে?" পোয়ারো অনুরোধ জানালেন।
"মাদাম যে রকম
বলেছিলেন,
আমি ওনাকে বিরক্ত করতে যাই নি। শেষে, ঠিক কাননেস আগে আমি ওনার দরজায় গিয়ে ঠক ঠক করি। কোনো সারা না পেয়ে, আমি দরজাটা খুলি। মহিলাটি বিছানায় ঘুমোচ্ছেন মনে হোলো। আমি তাঁর কাঁধ ধরে
তুলতে গেলাম,
আর তখনি -"
"আর তখনি আপনি কি
হয়েছে জানতে পারলেন,"
পোয়ারো নিজেই কথাগুলো বলে দিলেন। "খুব ভালো, আমার মনে হয় আমার যা জানার ছিল, সব জানা হয়েছে।"
"আসা করি, মসিয়েঁ লে কমিসাইরে,
আমি কোনো গাফিলতির জন্য দায়ী হবো না।" লোকটি করুন ভাবে
বললো। "দ্যা ব্লু ট্রেনে এরকম
একটা ঘটনা! এ তো ভয়ানক।"
"শান্ত হন," কমিশনারটি বললেন। "ঘটনাটা যতটা সম্ভব চেপে রাখার চেষ্টা করা হবে, যতটুকু বিচারের স্বার্থে জরুরি ততটা ছাড়া। আমার মনে হয় না আপনি কোনো গাফিলতির
জন্য দায়ী।"
"আর মসিয়েঁ লে
কমিসাইরে এই রিপোর্টটাই কোম্পানিকে জানাবেন তো?"
"অবশ্যই, অবশ্যই,"
মসিয়েঁ কাউক্স একটু অধৈর্য ভাবে বললেন, "আপাতত এতেই হবে।"
কন্ডাক্টরটি চলে গেলেন।
"মেডিকেল পরীক্ষা
অনুযায়ী,"
কমিশনারটি বললেন, "ভদ্রমহিলার মৃত্যু সম্ভবত ট্রেন লিয়োন্স পৌঁছনোর আগেই হয়েছে। তাহলে খুনি কে? মাদমোয়েজেলের কথা অনুযায়ী, এটা পরিষ্কার মনে হচ্ছে, যে এই যাত্রার মধ্যেই ওনার সাথে সেই ভদ্রলোকের, যার কথা উনি বলেছিলেন,
দেখা হবার কথা। ওনার পরিচারিকাটিকে ছেড়ে আসা এ ব্যাপারে
উল্লেখযোগ্য। ওই ভদ্রলোকটি কি প্যারিসে ট্রেনে উঠেছিলেন, আর উনি কি তাঁকে পাশের কম্পার্টমেন্টে লুকিয়ে রেখেছিলেন? যদি তাই হয়,
তাঁদের মধ্যে ঝগড়া হয়েছিল, আর রাগের মাথায় তিঁনি ওনাকে খুন করেছিলেন। এটা একটা সম্ভবনা। অন্যটা, আমার মনে যেটার সম্ভবনা সবথেকে বেশি, ওনার খুনি একজন ট্রেন
ডাকাত যে এই ট্রেনেই যাচ্ছিলো এবং কন্ডাক্টরটির চোখের আড়ালে সে করিডোরে লুকিয়ে ছিল, ওনাকে খুন করে,
এবং লাল মরক্কো বাক্সটা নিয়ে পালিয়ে যায় যেটাতে নিঃসন্দেহে
বেশ কিছু দামি গয়না ছিল। আর খুব সম্ভবত সে লিয়োন্সে ট্রেন থেকে নেমে যায়। ইতিমধ্যেই
আমরা ওই স্টেশনে টেলিগ্রাফ করে দিয়েছি যে ওই স্টেশনে যাদের ট্রেন থেকে নেমে যেতে
দেখা গেছে তাদের সম্পর্কে পূর্ণ বিবরণের জন্য।"
"অথবা, সে নাইস পর্যন্ত এসেছে।" পোয়ারো প্রস্তাব দিলেন।
"হতে পারে," কমিশনারটি একমত হলো,
"তাহলে সেটা একটা সাংঘাতিক সাহসিকতার কাজ হবে।"
পোয়ারো এক দু মিনিট চুপ
করে থাকলেন কিছু বলার আগে,
তারপর তিনি বললেন;
"পরবর্তী ক্ষেত্রে
আপনার মনে হয় লোকটি একজন সাধারণ ট্রেন ডাকাত?"
কমিশনারটি কাঁধ ঝাঁকালেন।
"এটা বিভিন্ন
বিষয়ের ওপর নির্ভর করে। আমাদের আগে পরিচারিকাটিকে পাওয়া দরকার। সম্ভবত লাল মরক্কো
বাক্সটা তার কাছেই আছে। যদি তাই হয়, তাহলে যে ভদ্রলোকের কথা
উনি মাদমোয়েজেলকে জানিয়েছিলেন তিনি এই ব্যাপারে জড়িত হতে পারেন, এবং এটা আবেগের বসে করা অপরাধ হতে পারে। আমার মনে হচ্ছে, ট্রেন ডাকাতের সম্ভবনাই সব থেকে বেশি। ট্রেন ডাকাতদের সাহস ইদানিং খুবই বেড়ে গেছে।"
পোয়ারো হঠাৎ ক্যাথেরিনের
দিকে তাকালেন।
"আর মাদমোয়েজেল, আপনি,"
তিনি বললেন, "আপনি রাত্রে কিছু দেখেন নি বা শোনেন নি?"
"না।"
পোয়ারো কমিশনারটির দিকে
ঘুরলেন।
"আমাদের আর
মাদমোয়েজেলকে আটকানোর দরকার নেই, আমার তাই মনে হয়," তিনি প্রস্তাব করলেন।
অপরজন মাথা নাড়লেন।
"উনি আমাদের কাছে
নিজের ঠিকানাটা দিয়ে যাবেন?"
তিনি বললেন।
ক্যাথেরিন তাঁকে লেডি
ট্যাম্পলিংয়ের ভিলার ঠিকানাটা দিলো। পোয়ারো তাকে একটা ছোট বাও করলেন।
"যদি অনুমতি দেন
তাহলে আমাদের আবার দেখা হতে পারে, মাদমোয়েজেল।" তিনি
বললেন,
"অথবা, আপনি কি বন্ধু বান্ধবদের
সাথে খুবই ব্যাস্ত থাকবেন?"
"একেবারেই উল্টো," ক্যাথেরিন বললো,
"আমার কাছে প্রচুর অবসর থাকবে। আর আপনার সাথে দেখা করতে
পারলে আমি খুবই খুশি হবো।"
"চমৎকার," পোয়ারো বললেন,
এবং তার দিকে বন্ধুত্বপূর্ণ মাথা নাড়ালেন। "এটা একটা
নতুন গোয়েন্দা উপন্যাস হবে। আমরা এই ঘটনাটা একসাথে অনুসন্ধান করবো।"
চ্যাপ্টার ১২
ভিলা মার্গেরিতে তে
"তাহলে তুমি সত্যি
সত্যি এই সমস্ত ঘটনার মধ্যমনি হিসেবে ছিলে," লেডি ট্যাম্পলিং ঈর্ষার সঙ্গে বললেন। "কি রোমাঞ্চকর! সোনা," তিনি একটা ছোট দীর্ঘশ্বাসের সঙ্গে তাঁর চীনা নীল চোখ দুটো বড়ো বড়ো করে খুলে
বললেন।
"একটা সত্যিকারের
খুন,"
মিস্টার এভান্স আনন্দে উত্তেজিত হয়ে বললেন।
"ছুব্বির অবশ্য এসব
ব্যাপারে কোনো ধারণাই ছিল না," লেডি ট্যাম্পলিং বলে
চললেন,
"ও বুঝতেই পারে নি পুলিশ তোমাকে কি জন্যে চাইছিলো। কি দারুন
একটা সুযোগ! সোনা,
আশাকরি, তুমি বুঝতে পারছো - আর, আমি নিশ্চিত এর থেকে কিছু একটা করা সম্ভব।
একটা হিসেবি দৃষ্টি নীল
চোখের সরলতাটাকে ভেঙে চুরমার করে দিলো।
ক্যাথেরিন কিছুটা
অস্বস্তি অনুভব করতে শুরু করলো। দুপুরের খাওয়া তাদের প্রায় শেষ হয়ে এসেছিলো, আর সে টেবিল উপস্থিত বাকি তিন জনের দিকেই একবার করে তাকিয়ে দেখলো। লেডি ট্যাম্পলিং, বিভিন্ন বাস্তবিক পরিকল্পনায় পূর্ণ; মিস্টার এভান্স, সবসময় অকৃত্রিম প্রশংসায় পঞ্চমুখ, এবং
লেনক্স,
তার অন্ধকার ময় মুখে অদ্ভুত কুটিল হাসি।
"দুর্দান্ত কপাল," ছুব্বি বিড়বিড় করে বললেন। "আহা, আমি যদি আপনার সাথে যেতে
পারতাম - আর সমস্ত তথ্য প্রমাণগুলো নিজের চোখে দেখতে পারতাম।"
তাঁর গলাটা বিষন্ন এবং
বাচ্ছাদের মতো।
ক্যাথেরিন কিছু বললো না।
পুলিশ তার ওপরে কোনো গোপনীয়তা রক্ষা করার নির্দেশ দেয় নি, আর সে যাদের অতিথি হয়ে আছে তাদের কাছ থেকে সত্যিটা লুকোনো তো তার পক্ষে
একেবারেই অসম্ভব।
কিন্তু সে এই অসম্ভব
ব্যাপারটা যাতে সম্ভব হয় তারই প্রার্থনা করছিলো।
"হ্যাঁ," লেডি ট্যাম্পলিং হঠাৎ তাঁর চিন্তা থেকে জেগে উঠে, বললেন,
"আমার মনে হয়, কিছু একটা করা যেতেই পারে। একটা ছোট বিবরণী, খুব বুদ্ধি মত্তার সাথে
লেখা। একজন প্রত্যক্ষদর্শীর, একটা নারীসুলভ
দৃষ্টিভঙ্গি: 'কিভাবে আমি মৃতা মহিলাটির সাথে কথা বলেছিলাম। ছোট্ট আলোচনা -' এই ধরণের জিনিস,
বুঝতে পারছো।"
"একেবারে জঘন্য!"
লেনক্স বললো।
"এব্যাপারে তোমার
কোনো ধারণাই নেই,"
লেডি ট্যাম্পলিং একটা নরম বিষন্ন গলায় বললেন, "যে খবরের কাগজগুলো ছোট খাটো চাঞ্চল্যকর খবরের জন্য কত টাকা দিতে পারে! অবশ্যই, এমন একজনকে লিখতে হবে,
যার নাকি একটা উঁচু সামাজিক অবস্থান আছে। তুমি নিশ্চই নিজেই
এটা করতে চাইবে না। তাই আমি বলি কি, তুমি শুধু কাঠামোটা
বানিয়ে আমাকে দাও,
তোমার হয়ে আমিই সবকিছু সামলে নেবো। মিস্টার ডি হ্যাভিল্যান্ড আমার এক বিশেষ বন্ধু। আমাদের
মধ্যে একটা বোঝাপড়া আছে। চমৎকার একজন ভদ্রলোক - একদমই সাংবাদিকসুলভ নন। বুদ্ধিটা
কেমন লাগলো ক্যাথেরিন?"
"আমি এরকম কিছুই
করতে চাইছি না,"
ক্যাথেরিন স্পষ্টভাবে জানালো।
এই আপোষহীন প্রত্যাখ্যানে
লেডি ট্যাম্পলিং বেশ বিচলিত হয়ে পড়লেন। তিনি একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন, এবং এটা নিয়ে আরো বিস্তারিত আলোচনার দিকে যেতে চাইলেন।
"তুমি বললে, একজন অসাধারণ সুন্দরী ভদ্রমহিলা? আমি ভাবছি উনি কে হতে
পারেন। তুমি নামটা শোনো নি।
"নামটা শুনেছিলাম," ক্যাথেরিন স্বীকার করলো, "কিন্তু, আমি মনে করতে পারছি না। বুঝতেই পারছেন, আমি একটু বিচলিত হয়ে
পড়েছিলাম।"
"আমারও তাই মনে
হচ্ছে,"
মিস্টার এভান্স বললেন, "এটা নিঃসন্দেহে একটা ভয়াবহ আঘাত।"
এ ক্ষেত্রে সন্দেহ করা
যেতে পারে যে নামটা যদি সত্যি ক্যাথেরিনের মনে থাকতো, সে আদৌ সেটা স্বীকার করতো কিনা। লেডি ট্যাম্পলিংয়ের নির্মম জেরা তাকে অস্থির
করে তুলছিলো। লেনক্স,
এতক্ষন নিজের মতো করে সবকিছু লক্ষ্য করছিলো, সে ব্যাপারটা বুঝতে পারলো, আর কাথেরিনকে ওপরের তলায়
তার নিজের ঘরটা দেখাবার প্রস্তাব দিলো। সে তাকে সেখানে পৌঁছে দিয়ে চলে গেলো, যাবার আগে সে সহৃদয়তার সাথে মন্তব্য করলো, "আপনি মায়ের কথায় কিছু মনে করবেন না; উনি পারলে ওনার মৃত্যু
পথযাত্রী ঠাকুমার থেকেও কয়েক পয়সা লাভ কামিয়ে নেন।"
লেনক্স আবার নিচে ফিরে
গিয়ে দেখলো তার মা এবং সৎ বাবা নতুন অতিথিকে নিয়ে আলোচনায় ব্যাস্ত।
"উপস্থাপনযোগ্য," লেডি ট্যাম্পলিং বললেন,
"বেশ ভালোভাবেই উপস্থাপনযোগ্য। ওর পোশাক আশাক ঠিকই আছে। ওই
ধূসর জিনিসটা হচ্ছে যা গ্লাডিস কুপার পাম ট্রিসে পড়েছিলেন ইজিপ্টে তার অবিকল
প্রতিরূপ।"
"তুমি কি ওর চোখ
দুটো লক্ষ্য করেছো - অদ্ভুত?" মিস্টার এভান্স মদ্ধিখানে
বললেন।
"ওর চোখ নিয়ে ভেবো
না, ছুব্বি,"
লেডি ট্যাম্পলিং কর্কশ ভাবে বললেন, "আমরা এমন কিছু জিনিস নিয়ে আলোচনা করছি যা সত্যি দরকারি।"
"ওঃ! ঠিক তাই," মিস্টার এভান্স বললেন,
এবং নিজের খোলের মধ্যে গুটিয়ে গেলেন।
"ওকে আমার খুব একটা
নরম সরম বলে মনে হয় নি,"
লেডি ট্যাম্পলিং, সঠিক শব্দটা খোঁজার জন্য
একটু ইতস্তত করে বললেন।
"একজন মহিলার সমস্ত
সহজাত প্রবৃত্তি,
যা বইতে লেখা আছে তা ওনার মধ্যে আছে," লেনক্স একটু মুচকি হেসে বললো।
"সংকীর্ণমনা"
লেডি ট্যাম্পলিং বিড়বিড় করে বললেন, "মনে হচ্ছে,
পরিস্হিতির চাপেই এটা অনিবার্য ভাবে ঘটেছে।"
"আশাকরি ওনাকে উদার
মনস্কতে পরিণত করার জন্য তুমি নিশ্চই সবরকমের চেষ্টা করবে।" লেনক্স একটা
মুচকি হাসির সাথে বললো। "কিন্তু এই মুহূর্তে তোমার কাজ ভীষণ কঠিন। একটু আগে
তুমি নিশ্চই লক্ষ্য করলে যে উনি আপাতত এক পাও এগোতে নারাজ উনি যথেষ্ট অসন্তুষ্ট
এবং কোনো কিছুই মানতে রাজি নন।"
"যাইহোক," লেডি ট্যাম্পলিং আশাপ্রদ হয়ে বললেন, "ওকে আমার ইতর বলে মনে হয় নি। কিছু লোক আছে, যারা টাকা পয়সা পেলেই, সেগুলোকে ভয়ানক গুরুত্ব দিতে থাকে।"
"তুমি খুব সহজেই
ওনাকে যেভাবে চাও সেভাবেই নিয়ন্ত্রণ করতে পারবে।" লেনক্স বললো, "আর, সমস্ত কিছুর থেকে,
এটাই একমাত্র গুরুত্বপূর্ণ বিষয়, তাই না?
আর সেই জন্যই তো উনি এখানে এসেছেন।"
"ও আমার তুতো বোন,"লেডি ট্যাম্পলিং সসম্মানে বললেন।
"তুতো বোন, তাই নাকি,"
মিস্টার এভান্স, আবার জেগে উঠে বললেন।
"আমি তো বোধয় ওনাকে ক্যাথেরিন বলে ডাকছিলাম, তাই না?"
"তুমি ওকে কি বলে
ডাকবে সেটা খুব একটা গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার নয় ছুব্বি," লেডি ট্যাম্পলিং বললেন।
"ঠিক আছে," মিস্টার এভান্স বললেন,
"আমি তাহলে তাই করবো। তুমি কি জানো উনি টেনিস খেলেন কিনা?" তিনি আশাপ্রদ হয়ে প্রশ্ন করলেন।
"অবস্যই না," লেডি ট্যাম্পলিং বললেন। "ও একজন সহায়িকা ছিল, আমি তোমায় বলেছি। সহায়িকারা টেনিস - বা গল্ফ খেলে না। ও হয়তো গল্ফ-ক্রোকেট
খেললেও খেলতে পারে,
কিন্তু আমার মনে হয় সহায়িকারা দিনের বেশিরভাগ সময় উল গোটাতে
এবং কুকুরকে পরিষ্কার করতেই ব্যাস্ত থাকে।"
"হে ভগবান," মিস্টার এভান্স বললেন,
"সত্যি তাই নাকি?"
লেনক্স আবার উপরের তলায়
ক্যাথেরিনের ঘরে ফিরে গেলো। "আমি কি তোমায় সাহায্য করতে পারি?" সে অনেকটা অযৌক্তিক ভাবেই প্রশ্ন করলো।
ক্যাথেরিন কিছু না বলাতে, সে বিছানার ধারে বসলো এবং বেশ চিন্তামগ্ন হয়ে অতিথির দিকে তাকিয়ে থাকলো।
"আপনার আসার কারণটা
কি?"
সে অবশেষে বললো, "মানে,
আমাদের কাছে। আমরা তো ঠিক আপনার ধরণের নই।"
"ওঃ! আমি সোসাইটিতে
ঢুকতে আগ্রহী।"
"গাধার মতো কথা
বলবেন না।" লেনক্স অবিলম্বে একটা হাসির ঝিলিক লক্ষ্য করে বললো। "আমি কি
বলতে চাইছি আপনি ভালো করেই তা বুঝতে পারছেন, আপনি মোটেও তেমনটা নন যেমনটা
আমি ভেবেছিলাম,
যদিও আপনার পোশাক আশাক বেশ ভালো।"
সে দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো, "পোশাক আসাকে আমার তেমন আগ্রহ নেই। আমি জন্ম থেকেই একটু খাপছাড়া মতন। এটাই দুঃখের বিষয়, যে আমি যে ওঁদের
ভালোবাসি"
"আমিও ওঁদের
ভালোবাসি।" ক্যাথেরিন বললো, "কিন্তু, আমি ওঁদের ভালোবাসলেও,
সেটা এখনো পর্যন্ত ওঁদের কোনো কাজে আসে নি। তোমার কি এটাকে
ভালো বলে মনে হয়?"
সে এবং লেনক্স বিভিন্ন
মূর্তির বৈশিষ্ট বিষয়ে শৈল্পিক উৎসাহ নিয়ে আলোচনা করলো।
"আপনাকে আমার ভালো
লেগেছে,"
লেনক্স হঠাৎ বললো, "আমি আপনাকে মায়ের কথা মেনে চলার ব্যাপারে নিষেধ করতে এসেছিলাম, কিন্তু আমার মনে হয় এখন আর তার কোনো প্রয়োজন নেই। আপনি প্রচন্ড আন্তরিক এবং
জেদিও আর ঐসব অদ্ভুত জিনিসগুলোও, কিন্তু আপনি বোকা নন।
ধুত্তোর! এখন আবার কি হলো?"
হল থেকে লেডি ট্যাম্পলিং
একটু অভিযোগের সুরে তাকে ডাকছিলেন:
"লেনক্স, ডেরেক একটু আগে ফোন করেছিল। সে আজ রাতের খাবারের সময় আসতে চায়। কি বলবো? মানে,
আমাদের কাছে অপ্রস্তুত হবার মতো কিছু নেই তো, মানে কোয়েলের মতো,
আছে কি??"
লেনক্স তাঁকে শান্ত করে
ক্যাথেরিনের ঘরে ফিরে এলো। তার মুখটা বেশ উজ্জ্বল এবং কম বিষন্ন লাগছিলো।
" ডেরেক আসছে, আমি খুব খুশি," সে বললো,
"আপনার ওনাকে ভালো লাগবে।"
"ডেরেক কে?"
"উনি লর্ড
লেকোনবুরির ছেলে,
একজন খুব বড়লোক আমেরিকান মহিলার সাথে বিয়ে হয়েছে। মহিলারা
ওনার ব্যাপারে পাগল।"
"কেন?"
"ওই যা হয় - খুবই
সুন্দর দেখতে এবং তারসাথে স্বাভাবিক খারাপ গুণগুলোও আছে। তাঁর কথায় সবারই মাথা
খারাপ হয়ে যায়।"
"তোমারও?"
"মাঝে মাঝে আমারও," লেনক্স বললো,
"মাঝে মাঝে আমার ইচ্ছে হয় কোনো সহকারী যাজককে বিয়ে করে
কাউন্ট্রিতে তে থাকবো চাষাবাদ করবো।" সে মিনিট খানেক চুপ করে থাকলো, তারপর আবার বললো,
"একজন আইরিশ সহকারী যাজক হলে সবথেকে ভালো হয়, তাহলে আমি শিকার করার সুযোগ পাবো।"
দু এক মিনিট পরেই সে আবার
পুরোনো বিষয়ে ফিরে গেলো,
"ডেরেকের মধ্যে কিছু অদ্ভুত ব্যাপার আছে। তুমি জানো, পুরো পরিবারটারই যেন মাথায় গন্ডগোল - সাংঘাতিক জুয়াড়ি সবাই। আগেকার দিনে ওরা
বৌদের, জমিদারি নিয়েও জুয়া খেলতো আরো অনেক আজব কান্ড কারখানা করেছে শুধুমাত্র জুয়ার
প্রতি ভালোবাসার জন্য। ডেরেক যদি একজন ঘোড়ায় চড়া ডাকাত হতো ভালো মানাতো - সুদর্শন
সদা হাস্যময়,
একদম যেন সঠিক চরিত্র।" সে দরজার দিকে এগিয়ে গেলো।
"ভালো কথা,
যখনি ইচ্ছে হবে নিচে চলে এসো।"
একা একা, ক্যাথেরিন নিজের মধ্যে চিন্তায় ডুবে গেলো। বর্তমান সময়ে সে তার আসে পাশের পরিবেশে
খুবই অস্বস্তি বোধ করছে।
ট্রেনে ওই ঘটনাটা
আবিষ্কারের ধাক্কা এবং সেই সংবাদটা তার নতুন বন্ধুরা যেভাবে নিয়েছে সেটা তার সংবেদনশীলতাকে আহত করেছে। সে অনেক্ষন ধরে
খুব মন দিয়ে মৃতা মহিলার কথা চিন্তা করছিলো। সে রুথের জন্য দুঃখিত, কিন্তু সে তাকে পছন্দ করতো একথা বলা যাবে না। সে তার মধ্যে ভয়ঙ্কর ইগোটাকে
অনুভব করতে পেরেছিলো এবং এটাই তাকে তার দিক থেকে দূরে সরিয়ে দিয়েছিলো।
সে কিছুটা আনন্দিত এবং
কিছুটা আহতও হয়েছিল তার কাজ ফুরিয়ে যেতেই অন্যদের তার দিক থেকে মুখ ঘুরিয়ে নিতে
দেখে। ক্যাথেরিন নিশ্চিত যে, সে কোনো একটা সিদ্ধান্তে
পৌঁছেছিল,
কিন্তু, সিদ্ধান্তটা কি ছিল, সেটাই চিন্তার । সিদ্ধান্তটা যাই হোক না কেন মৃত্যু এসে তাকে অর্থহীন করে
দিয়েছে।
এটা বিস্ময়ের যে
ঘটনাগুলোকে এই ভাবে ঘটলো,
এবং ওই দুৰ্ভাগ্যপূর্ণ যাত্রার শেষে একটা নৃশংস অপরাধ।
কিন্তু হঠাৎই ক্যাথেরিনের একটা ছোট ঘটনা মনে পরে গেলো যেটা তার সম্ভবত পুলিশকে বলা
উচিত ছিল - একটা ঘটনা যা তার মাথা থেকে বেরিয়ে গেছিলো। সেটা কি সত্যিই
গুরুত্বপূর্ণ ছিল? তার মনে হয় সে কি সত্যি একটা লোক কে ওই নির্দিষ্ট
কম্পার্টমেন্টে ঢুকতে দেখেছিলো? কিন্তু আবার তার মনে হলো
এটা তার ভুলও হতে পারে। সেটা হয়তো পাশের কম্পার্টমেন্টের দরজা ছিল আর লোকটি কোনো
মতেই ট্রেন ডাকাত ছিল না। সে তাকে খুব ভালো ভাবেই চিনতে পেরেছিলো যেহেতু সে আগে দু
বার তাকে দেখেছিলো - একবার স্যাভয়ে এবং আর এক বার কুকের অফিসে। না, নিঃসন্দেহে সে ভুল করছে। সে মৃত মহিলার কম্পার্টমেন্টে যায় নি, এবং মনে হয় এব্যাপারে পুলিশকে কিছু না জানিয়ে ভালোই হয়েছে। একথা জানালে সে হয়তো ভয়ানক কোনো ক্ষতি করে ফেলতো।
সবাই বাইরে বারান্দায় ছিল
সে নিচে নেমে তাদের সাথে যোগ দিলো। লজ্জাবতী লতার ফাঁক দিয়ে সে নীল ভূমধ্য সাগরের
দিকে তাকিয়ে ছিল,
এবং,
এর মধ্যে এক কান দিয়ে লেডি ট্যাম্পলিংয়ের বকর বকর ও শুনছিলো, এখানে আসার জন্য সে সত্যি খুশি। সেন্ট মেরি মিডের থেকে এ জায়গাটা অনেক সুন্দর।
সেই সন্ধ্যায় সে মভ এবং
পিঙ্ক রঙের পোশাকটা যার নাম 'শরতের দীর্ঘশ্বাস' সেই পোশাকটা পড়লো,
আয়নায় নিজের প্রতিচ্ছবির দিকে তাকিয়ে একবার হেসে নিয়ে, সে নিচের দিকে চললো,
জীবনে প্রথমবার একটু হালকা লজ্জার অনুভূতির সঙ্গে।
লেডি ট্যাম্পলিংয়ের সব
অতিথিরাই প্রায় এসে গেছেন,
আওয়াজ যেহেতু লেডি ট্যাম্পলিংয়ের পার্টিতে অপরিহার্য, একটা বিকট,
কর্কশ শব্দ কান ফাটিয়ে দিছিলো। ছুব্বি তাড়াতাড়ি ক্যাথেরিনের কাছে গেলো, এবং তাকে একটা ককটেল ধরিয়ে দিলো, সেই তাকে সবার সাথে পরিচয়
করিয়ে দিতে লাগলো।
ঘরের দরজাটা খুলে যেই শেষ
অতিথিটি ঢুকলেন,
লেডি ট্যাম্পলিং চিৎকার করে উঠলেন, "আরে,
এই তো ডেরেক। এইবার অবশেষে আমরা কিছু খাওয়া দাওয়া শুরু করতে
পারবো, আমার তো ভীষণ খিদে পেয়েছে।"
ক্যাথেরিন ঘরের ওপর
প্রান্তে তাকিয়ে দেখলো। সে চমকে উঠলো। তাহলে - এই ডেরেক, সে বুঝতে পারলো যে সে কিন্তু অবাক হয় নি। সে সবসময় জানতো একদিন ওই লোকটার সাথে
আবার দেখা হবে যার সাথে কাকতালীয়ভাবে ঘটনাক্রমে আগেও তিন বার দেখা হয়েছিল। তার মনে হলো, উনিও তাকে চিনতে পেরেছেন।
উনি লেডি ট্যাম্পলিংয়ের সাথে কথা বলতে বলতে হঠাৎই থেমে গেলেন, এবং কিছুটা প্রচেষ্টার পরে যেন আবার শুরু করলেন। তারা সবাই রাতের খাবার খেতে
বসলো, আর ক্যাথেরিন দেখলো যে সে তাঁর পাশেই বসার জায়গা পেয়েছে। তিঁনি সঙ্গে সঙ্গে
তার দিকে তাকিয়ে একটি প্রাণবন্ত হাসি উপহার দিলেন।
"আমি জানতাম আপনার
সাথে খুব তাড়াতাড়ি দেখা হতে চলেছে।" তিঁনি মন্ত্যব্য করলেন, "কিন্তু আমি স্বপ্নেও ভাবিনি যে সেটা এখানেই হবে। এই দেখা হওয়াটা হতেই হবে, আপনার নিশ্চই মনে আছে। একবার স্যাভয়ে আর একবার কুকের ওখানে - তিন বার ছাড়া দু
বার হতেই পারে না। আবার বলবেন না যেন যে আমাকে লক্ষ্য করেন নি বা মনে করতে পারছেন
না। আমি জবরদস্তি ধরেই নিচ্ছি, আপনি আমাকে লক্ষ্য করেছেন।"
"হ্যাঁ, আমি করেছি,"
ক্যাথেরিন বললো, "কিন্তু এটা তৃতীয় বার নয়। চতুর্থ বার। আমি আপনাকে দ্যা ব্লু ট্রেনে
দেখেছি।"
"দ্যা ব্লু
ট্রেনে!" তার আচরনে হঠাৎ একটা অদ্ভুত পরিবর্তন এলো; সে বলতে পারবে না সেটা ঠিক কি। তিনি যেন হঠাৎই কোনো একটা প্রতিবন্ধকতার সামনে
পড়েছেন, যেন একটি বাধা। তারপর যেন চিন্তা ভাবনা না করে বললেন।
"আজ সকালে এতো হৈ
চৈ কি নিয়ে ছিল?
কেউ একজন মারা গেছেন, তাই না?"
"হ্যাঁ," কাহেরিনে ধীরে ধীরে বললো, "কেউ একজন মারা
গেছেন।"
"ট্রেনে মারা যাওয়া
উচিত হয় নি।" ডেরেক অলস ভাবে বললো। "আমার মনে হয় এতে সবরকমের আইনি
জটিলতা এবং আন্তর্জাতিক সমস্যা তৈরি হবে, আর এতে ট্রেন আরো দেরিতে
চলার একটা ছুতো পেয়ে যাবে।
"মিস্টার কেটারিং?" উল্টো দিকে বসা একজন শক্তপোক্ত আমেরিকান মহিলা সামনে ঝুকে এলেন এবং তাঁদের
জাতীয় উচ্চারণের সাথে কথা বলতে লাগলেন। "মিস্টার কেটারিং, আপনি মনে হয় আমাকে ভুলে গেছে, কিন্তু আমি আপনাকে সত্যি
একজন প্রকৃত সুন্দর মানুষ বলে মনে করি।"
ডেরেক সামনে ঝুকে ওনাকে
উত্তর দিতে গেলো,
আর ক্যাথেরিন যেন একটা ঘোরের মধ্যে বসে থাকলো।
কেটারিং! এই নামটাই তো
ছিল, একদমই! - তার এখন মনে পরে গেছে - কিন্তু, কি অদ্ভুত, উপহাসকর অবস্থা! এখানে সেই মানুষটা বসে আছেন যাকে সে কাল রাতে তাঁর স্ত্রীর
কম্পার্টমেন্টে ঢুকতে দেখেছে, সে যখন বেরিয়ে এসেছে তখনো
সে সুস্থ এবং নিরাপদ ছিল,
তিনি জানেনই না তাঁর স্ত্রীর ভাগ্যে কি দুর্ঘটনা ঘটেছে।
এব্যাপারে কোনো সন্দেহই নেই। তিনি জানেনই না।
একজন চাকর এসে ডেরেকের
দিকে ঝুকে,
তাঁকে একটা চিরকুট দিলো এবং তার কানে বিড়বিড় করে কিছু বললো।
তিনি লেডি ট্যাম্পলিংয়ের
থেকে অনুমতি নিয়ে,
সেটা খুললেন, এবং সেটা পড়তে পড়তে তার মুখে
একটা চরম বিস্ময়কর অনুভূতির ছবি ফুটে উঠলো; তারপর সে গৃহকর্ত্রীর
দিকে তাকালো।
"এটা চূড়ান্ত
অস্বাভাবিক। রোসালিয়ে,
আমি বলতে বাধ্য হচ্ছি, আমায় এখুনি একবার যেতে
হবে। পুলিশ প্রধান এখুনি আমাকে ডেকে পাঠিয়েছেন। আমি বুঝতে পারছি না কেন।"
"এটা নিশ্চই আপনার
কোনো পাপের ফল,"
লেনক্স মন্তব্য করলো।
'নিশ্চই," ডেরেক বললো,
"হয়তো কোনো বোকা বোকা কারণ, কিন্তু আমাকে এখনই তাঁদের অফিসে দৌড়োতে হবে। কোন সাহসে উনি আমাকে রাতের
খাবারের থেকে উঠিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন? মারাত্মক গুরুতর কোনো
কারণ ছাড়া একটা কখনোই যুক্তিযুক্ত হতে পারে না। তিনি হাসতে হাসতে চেয়ার টা সরিয়ে
উঠে দাঁড়ালেন ঘর থেকে বেরোবার জন্য।
চ্যাপ্টার ১৩
ভ্যান আলদীন একটা
টেলিগ্রাম পেলেন
১৫ই ফেব্রুয়ারী দুপুরবেলা
একটা ঘন হলুদ কুয়াশা লন্ডনের ওপর ছেয়ে ছিল।
রুফুস ভ্যান আলদীন
স্যাভয়ে নিজের সুইটে বসে প্রায় দ্বিগুন কাজ করে আবহাওয়ার ফায়দা তোলার চেষ্টা
করছিলেন। নাইটোন খুবই খুশি ছিল। সে কিছুদিন ধরেই তার নিয়োগকর্তা হাতে যে কাজগুলো
আছে সেগুলোর প্রতি যেন মনোযোগ দেন সেজন্য খুব চেষ্টা করছিলো। যখনি সে কোনো বিষয়
নিয়ে আলোচনা করতে গেছে,
ভ্যান আলদীন তাকে সংক্ষিপ্ত দু এক কথায় চুপ করিয়ে দিয়েছেন।
কিন্তু এখন যেন ভ্যান আলদীন দ্বিগুন উৎসাহে কাজে ঝাঁপিয়ে পড়েছেন, আর সেক্রেটারিটি সেই সুযোগেরই সদব্যাবহার করছে। বেশ ভালো কৌশলী হবার কারণে। সে
সন্তর্পনে তাঁর উদ্দীপনাকে কাজে লাগিয়ে এমন ভাবে সব কাজ করিয়ে নিচ্ছে যে ভ্যান
আলদীন কোনো সন্দেহই করতে পারছেন না।
তবুও, ব্যবসা সংক্রান্ত কাজে ডুবে থাকলেও, একটা ছোট্ট জিনিস যেন
ভ্যান আলাদীনের মনের গভীরে খচখচ করছিলো। নাইটোনের একটা আলগা মন্তব্য, সেক্রেটারিটি যা অজান্তেই করে ফেলেছে, এবং সেই জিনিসটার জন্ম
দিয়েছে। সেই জিনিসটা অন্তরালে বড়ো হচ্ছে, ধীরে ধীরে সেটা ভ্যান
আলাদীনের চেতনাকে প্রায় ছুঁয়ে ফেলছে, অবশেষে, তাঁকে সেটার শক্তির কাছে মাথা নত করতে হলো।
তিনি যেমন মনযোগ দিয়ে
শোনেন সেইভাবে নাইটোনের কথা শুনছিলেন, কিন্তু বাস্তবে একটা কথাও
তাঁর মনের গভীরে ঢুকতে পারছিলো না। তিনি স্বয়ংক্রিয় ভাবেই মাথা নাড়ছিলেন, তারপরে,
সেক্রেটারটি আবার কিছু অন্য কাগজ পত্র নিয়ে আলোচনা শুরু
করতে গেলো।
সে যখন কাগজগুলো গুছিয়ে
নিচ্ছিলো,
তখন তার নিয়োগকর্তা কথাটা বললেন:
"তুমি কি আরেকবার
আমাকে ঐটার ব্যাপারে বলতে পারবে, নাইটোন?"
কয়েক মুহূর্তের জন্য
নাইটোন হতচকিত হয়ে গেলো।
"মানে, আপনি কি এইটার কথা বলছেন, স্যার? সে একটা বিস্তারিত কোম্পানি রিপোর্ট তুলে ধরলো।
"না, না,"
ভ্যান আলদীন বললেন, "কাল রাতে প্যারিসে রুথের পরিচারিকার সঙ্গে দেখা হবার ব্যাপারটা, যেটা তুমি আমাকে বলেছিলে। আমি ঠিক ধরতে পারছি না। নিশ্চই তোমার কোথাও ভুল
হয়েছিল।"
"আমার কোনো ভুল হতে
পারে না,
স্যার, আমি সত্যি সত্যি তার সাথে
কথা বলেছিলাম।"
"ঠিক আছে, আমাকে আরেকবার পুরো ঘটনাটা বলো।"
নাইটোন উত্তরে বলতে শুরু
করলো।
"আমি বার্থেরমেরসের
চুক্তিটা নিশ্চিত করলাম,"
সে ব্যাখ্যা করতে লাগলো, "তারপর রিট্জে ফিরে গেলাম আমার রাতের খাবারের জোগাড় যন্ত্র করতে ও নর্ড স্টেশন
থেকে রাত নটার ট্রেনটা ধরার প্রস্তুতি নিতে। রিসেপশন ডেস্কে একজন মহিলাকে দেখলাম
যে, আমি নিশ্চিত মিসেস কেটারিংয়ের পরিচারিকা। আমি তার কাছে গিয়ে জিজ্ঞেস করলাম মিসেস
কেটারিং ওখানেই আছেন কিনা।"
"হ্যাঁ, হ্যাঁ,"
ভ্যান আলদীন বললেন, "অবশ্যই। খুব স্বাভাবিক। আর সে তোমাকে বললো রুথ রিভিয়েরা চলে গেছে এবং তাকে রিট্জে
পাঠিয়ে দিয়েছে এবং সেখানেই তাকে নতুন নির্দেশের জন্য অপেক্ষা করতে বলেছে।"
"ঠিক এটাই, স্যার।"
"ভারী অদ্ভুত," ভ্যান আলদীন বললেন,
"সত্যি ভারী অদ্ভুত, যদি না ওই মহিলা
শিষ্টাচারহীন বা ওই ধরণের কিছু হন।"
"সে ক্ষেত্রে," নাইটোন প্রতিবাদ করে বললো, "মিসেস কেটারিং ওকে কিছু
টাকা দিয়ে ইংল্যান্ডে ফিরে যেতে বলতেন। উনি কিছুতেই ওকে রিট্জে পাঠাতেন না।"
"না," ধনকুবেরটি বিড়বিড় করে বললেন, "সেটা ঠিক।"
তিঁনি আরো কিছু বলতে
যাচ্ছিলেন,
কিন্তু নিজেকে সামলে নিলেন। তিঁনি নাইটোনকে পছন্দ করেন ভালোবাসেন
এবং বিশ্বাস করেন,
কিন্তু তাঁর মেয়ের ব্যাক্তিগত বিষয় নিয়ে তিঁনি তাঁর
সেক্রেটারির সাথে আলোচনা করতে পারেন না। তিঁনি আগে থেকেই রুথের স্পষ্টভাবে কথা না
বলা নিয়ে যথেষ্ট আঘাত পেয়েছেন, তার ওপর এই আকস্মিক
ঘটনাক্রম তার সন্দেহ দূর করতে কোনো সাহায্যই করলো না।
রুথ কেন তার পরিচারিকাকে
প্যারিসে ছেড়ে গেলো?
এই কাজ করার কি উদ্দেশ্য বা কারণ থাকতে পারে?
তিঁনি কিছুক্ষন ধরে
অদ্ভুত সব বিভিন্ন কারণ এবং তাদের মিলিয়ে মিশিয়ে চিন্তা ভাবনা করতে থাকলেন। রুথ কি
করে জানবে,
সবচেয়ে অদ্ভুত কাকতালীয় ভাবে, প্যারিসে প্রথম যে লোকটার সাথে তার পরিচারিকার দেখা হবে সে তার বাবার
সেক্রেটারি?
আঃ,
কিন্তু এভাবেই ঘটনাগুলো ঘটে। এই ভাবেই গোপন জিনিস সামনে
আসে।
শেষ বাক্যটাতে তিঁনি যেন
কুঁচকে গেলেন,
খুব স্বাভাবিক ভাবেই এই কথাটা তাঁর মনে হলো। তাহলে কি সত্যি
কোনো 'গোপন জিনিস সামনে আসার'
মতো আছে? তিঁনি এই প্রশ্নটা নিজেকে
করতে চান না;
উত্তর সম্পর্কে তাঁর কোনো সন্দেহই নেই। উত্তরটা হলো - তিঁনি
নিশ্চিত - আর্মন্ড ডে লা রোচে।
এটা ভ্যান আলাদীনের কাছে
একটা তিক্ত ব্যাপার যে ওনার মেয়ে এরকম একজন লোকের প্রতি আকৃষ্ট, তবুও তিঁনি স্বীকার করতে বাধ্য হয়েছিলেন যে সে ভালো সংসর্গেই আছে - অন্যান্য
সু-শিক্ষিত এবং বুদ্ধিমতী মহিলারা এতো সহজেই কাউন্টের আকর্ষণের কাছে আত্মসমর্পণ
করতো। পুরুষেরা তার আসল রূপটা ধরতে পারে, মহিলারা পারে না।
তিঁনি তাঁর সেক্রেটারিটির
মনে কোনো সন্দেহ জেগে থাকলে সেটাকে চাপা দেওয়ার জন্য কোনো কথা খুঁজছিলেন।
"রুথ ক্ষনে ক্ষণেই নিজের
মনোভাব পাল্টায়,"
তিঁনি মন্তব্য করলেন; তারপর যেন একটা অগোছালো
স্বরে যোগ করলেন,
"পরিচারিকাটি কোনো - মানে - এই পরিকল্পনা বদল হওয়ার কোনো
কারণ জানায় নি না?
নাইটোন খুব সাবধানে তাঁর
স্বর যতটা সম্ভব স্বাভাবিক করে উত্তর দিলো:
"সে বলেছিলো, স্যার,
যে মিসেস কেটারিংয়ের এক বন্ধুর সাথে হঠাৎই দেখা হয়ে
গেছিলো।"
"তাই নাকি?"
হালকা চলে বলা কথাটার
পেছনে যে একটা কষ্টের ছাপ আছে তা সেক্রেটারির অভিজ্ঞ কান এড়ালো না।
"আচ্ছা, তাই নাকি,
পুরুষ না মহিলা?"
"আমার মনে হয়, সে একজন পুরুষের কথা বলেছিলো, স্যার।"
ভ্যান আলদীন মাথা নাড়লেন।
তাঁর ভয়টা সত্যে পরিণত হয়েছে। তিঁনি চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়ালেন, ঘরের মধ্যে এদিক ওদিক পায়চারি করতে লাগলেন, বিচলিত হয়ে পড়লে এটাই
ওনার স্বভাব।
"একটা জিনিস কোনো
পুরুষ মানুষই পারে না,
মহিলাদের যুক্তি দিয়ে কোনো কারণ শোনাতে। কোনো ভাবে যেন এব্যাপারে তাদের কোনো বুদ্ধিই নেই। মহিলাদের
সহজাত প্রবৃত্তির কথা যদি বলা যায় - কেন, এতো সারা পৃথিবী জানে যে
একজন নারী হলো বদমাস প্রতারকদের নিশ্চিত লক্ষ্য। দশ জনের মধ্যে একজনও একটা বদমাশকে
দেখে চিনতে পারে না;
সুন্দর চেহারা এবং মিষ্টি কথায় তারা সহজেই বশ হয়ে যায়। যদি
আমি নিজের ইচ্ছা মতো চলতে পারতাম -"
তাঁর চিন্তায় একটা ছেদ
পড়লো। হোটেলের এক কর্মচারী একটি টেলিগ্রাম নিয়ে ঢুকলো। ভ্যান আলাদিন ওটা ছিড়ে
পড়লেন, এবং তাঁর মুখটা হঠাৎই চকের মতো সাদা হয়ে গেলো। তিনি চেয়ারের পেছনদিকটা ধরে
কোনোক্রমে নিজেকে সামলালেন এবং কর্মচারীটিকে হাতের ইশারায় চলে যেতে বললেন।
"কি হয়েছে, স্যার?"
নাইটোন উদ্বিগ্ন হয়ে উঠে
দাঁড়ালো।
"রুথ," ভ্যান আলদীন ঘড়ঘড় স্বরে বললেন।
"মিসেস কেটারিং?"
"খুন হয়েছে!"
"ট্রেনে কোনো
দুর্ঘটনা ঘটেছে?"
ভ্যান আলদীন মাথা নাড়লেন।
"না, এটা থেকে মনে হচ্ছে এর সাথে ডাকাতিও হয়েছে। ওরা কথাটা ব্যবহার করে না, নাইটোন,
কিন্তু আমার বেচারা মেয়েটা খুনই হয়েছে।
"হে, ভগবান,
স্যার!"
ভ্যান আলদীন তাঁর তর্জনী
দিয়ে টেলিগ্রামটার ওপর টোকা দিয়ে বললেন।
"এটা নাইসের
পুলিশের কাছ থেকে এসেছে। প্রথম ট্রেনেই আমি ওখানে যেতে চাই।"
এসব কাজে নাইটোন খুবই
দক্ষ। সে তার ঘড়ির দিকে একবার তাকালো।
"ভিক্টোরিয়া থেকে
পাঁচটায়,
স্যার।"
"ঠিক আছে, নাইটোন,
তুমিও আমার সঙ্গে যাবে। আমার ব্যাক্তিগত কর্মচারী, আর্চারকেও বলো,
তোমার জিনিসপত্র গুছিয়ে নাও। এখানকার সবকিছুও সামলে নিও।
আমি একবার কার্যন স্ট্রিট থেকে ঘুরে আসতে চাই।
কর্কশ শব্দে টেলিফোনটা
বেজে উঠলো,
এবং সেক্রেটারিটি রিসিভারটা তুললো।
"হ্যাঁ; কে বলছেন?"
তারপর ভ্যান আলদীন কে
বললো।
"মিস্টার গোবি, স্যার।"
"গোবি? এখন আমি ওর সাথে দেখা করতে পারবো না। না - দাঁড়াও আমাদের হাতে এখনো অনেক সময়
আছে। ওদের বলো ওকে ওপরে পাঠিয়ে দিতে।"
"আমার হাতে সময় খুব
কম, গোবি। আমাকে বলার মতো কোনো জরুরি কথা আছে কি?"
মিস্টার গোবি একবার ছোট
করে কেশে বলতে থাকলেন।
"মিস্টার
কেটারিংয়ের গতিবিধি,
স্যার, আপনি তাঁর বিষয়ে রিপোর্ট
দিতে বলেছিলেন।"
"হ্যাঁ -
ঠিক।"
"মিস্টার কেটারিং, স্যার,
গতকাল সকালে লন্ডন থেকে রিভিয়েরার দিকে রওনা হয়েছেন।"
"কি?"
তাঁর গলার স্বরে কিছু
একটা মিস্টার গোবি কে নিশ্চয় অবাক করে দিয়েছিলো। সুদক্ষ ভদ্রলোকটি তার নীতি
অনুযায়ী যার সাথে কথা হচ্ছে তাঁর দিকে না তাকিয়ে কথা বলা থেকে সরে এসে, একবার ধানকুবেরটির দিকে ঝট করে তাকিয়ে নিলো।
"সে কোন ট্রেনে
গেছে?"
ভ্যান আলদীন জানতে চাইলেন।
"দ্যা ব্লু ট্রেনে, স্যার।"
মিস্টার গোবি আরেকবার
কাশলেন এবং ম্যান্টেলপিসের ওপর রাখা ঘড়িটার দিকে তাকিয়ে বলতে থাকলেন।
"পার্থেননের নর্তকি, মাদমোয়েজেল মিরেলেও,
একই ট্রেনে গেছেন।"
চ্যাপ্টার ১৪
অ্যাডা ম্যাসনের
কাহিনী
আমি বারবার বলেও আপনাকে
বোঝাতে পারবো না,
মসিয়েঁ, আমাদের ভয়, আমাদের আতঙ্ক,
আর আমাদের আন্তরিক সহানুভূতি যেগুলো আমরা আপনার জন্য অনুভব
করছি।
এইভাবেই তদন্তকারী
ম্যাজিস্ট্রেট,
মসিয়েঁ ক্যারেজ, ভ্যান আলদীন কে সান্তনা
দিলেন। কমিশনার মসিয়েঁ কাউক্স গলা দিয়ে একটা সহানুভূতির আওয়াজ করলেন। ভ্যান আলদীন
আচমকা এক শারীরিক ভঙ্গিমায় ভয়, আতঙ্ক এবং সহানুভূতি কে
ঝেড়ে সরিয়ে দিলেন। এটা হলো নাইসে পরীক্ষক ম্যাজিস্ট্রেটের ঘরের দৃশ্য। ঘরে মসিয়েঁ
ক্যারেজ,
কমিশনার, এবং ভ্যান আলদীন ছাড়াও
আরো একজন ছিলেন । সেই ভদ্রলোকটি এবার কথা
বললেন।
"মসিয়েঁ ভ্যান
আলদীন কাজ চান - দ্রুত কাজ চান।"
"আঃ!" কমিশনারটি
চেঁচিয়ে বললেন,
"আপনার সাথে এখনো আলাপ করানো হয় নি, মসিয়েঁ ভ্যান আলদীন,
ইনি মসিয়েঁ এরকুল পোয়ারো; আপনি নিঃসন্দেহে এনার কথা শুনেছেন। যদিও উনি ওনার পেশা থেকে অবসর নিয়েছেন বেশ
কিছুদিন হলো,
ওনার নাম এখনও ঘরে ঘরে প্রচলিত সবচেয়ে খ্যাতিমান জীবিত
গোয়েন্দা হিসেবে।"
"আপনার সাথে আলাপ
করে খুশি হলাম,
মসিয়েঁ পোয়ারো," ভ্যান আলদীন বললেন,
বহু দিন আগে যে ফর্মুলা পরিত্যাগ করেছিলেন তাতেই আবার
যান্ত্রিক ভাবে ফিরে গেলেন। "আপনি আপনার পেশা থেকে অবসর নিয়েছেন?"
"ঠিক তাই, মসিয়েঁ। এখন আমি পৃথিবীকে উপভোগ করি।"
বেটে খাটো মানুষটা একটা
নাটুকে ভঙ্গিমা করলেন।
"ঘটনাচক্রে মসিয়েঁ
পোয়ারোও দ্যা ব্লু ট্রেনে যাচ্ছিলেন।" কমিশনারটি ব্যাখ্যা করলেন। "এবং
উনি দয়া করে ওনার বিশাল অভিজ্ঞতা দিয়ে আমাদের সাহায্য করতে রাজি হয়েছেন।"
ধনকুবেরটি খুব গভীর ভাবে
পোয়ারোকে দেখলেন। তারপর তিনি অপ্রত্যাশিত ভাবে বললেন:
"আমি খুব ধনী মানুষ
মসিয়েঁ পোয়ারো। সবাই একথা বলে যে একজন ধনী মানুষ বিশ্বাস করে সে নিজের ইচ্ছামতো
সবকিছু বা সবাইকে কিনতে পারে। এটা ঠিক কথা নয়। আমি আমার দিক থেকে একজন বিরাট মানুষ, এবং একজন বিরাট মানুষ আরেকজন বিরাট মানুষের কাছে একটা অনুগ্রহ তো চাইতেই পারে।
পোয়ারো চটপট প্রশংসায়
একবার মাথা নাড়ালেন।
"খুবই সুন্দর
বলেছেন, মসিয়েঁ ভ্যান আলদীন। আমি আপনার সেবায় সম্পূর্ণ নিয়োজিত।"
"ধ্যনবাদ," ভ্যান আলদীন বললেন,
"আমি শুধু একটা কথাই বলবো: আপনার যখনই কোনো প্রয়োজন পড়বে
আমাকে জানাতে দ্বিধা করবেন না, আমি অকৃতজ্ঞ নই। আর এখন, ভদ্রমহোদয়গন,
আসুন কাজ শুরু করি।
"আমি প্রস্তাব দেব," মসিয়েঁ ক্যারেজ বললেন "পরিচারিকাটিকে জিজ্ঞাসাবাদ করা শুরু হোক, অ্যাডা ম্যাসন। যতদূর আমি জানি, তাকে এখানে আনা
হয়েছে।"
"হ্যাঁ," ভ্যান আলদীন বললেন,
"আমার প্যারিস হয়ে আসার সময় তাকে তুলে এনেছি। সে তার
মালকিনের মৃত্যুতে ভীষণ বিচলিত, কিন্তু, সে তার কাহিনী বেশ গুছিয়েই বলেছে।
"তাহলে আমরা তাকে
ডাকি,"
মসিয়েঁ ক্যারেজ বললেন।
তিনি ওনার ডেস্কের উপর
রাখা একটা বেল বাজালেন,
আর কিছুক্ষনের মধ্যে অ্যাডা ম্যাসন ঘরে ঢুকলো।
সে খুব সুন্দরভাবে একটা
কালো রঙের পোশাক পরে আছে,
এবং তার নাকের ডগাটা লাল হয়ে আছে। যাত্রা করার ধূসর
দস্তানাটা পাল্টে সে এক জোড়া কালো সোয়েটার দস্তানা পরে নিয়েছে। কিছুটা আতঙ্কের
সঙ্গে সে পরীক্ষক ম্যাজিস্ট্রেটের ঘরের ভেতর চোখ বোলাতে থাকলো, এবং সেখানে তার মালকিনের বাবাও আছেন দেখে কিছুটা আস্বস্ত হলো। পরীক্ষক
ম্যাজিস্ট্রেট তার সাথে খুবই ভদ্রতা দেখালেন, এবং কিছুক্ষনের মধ্যে
তাকে অনেকটা সাচ্ছন্দ্য বোধ করতে সাহায্য করলেন। পোয়ারোও তাঁকে এব্যাপারে সাহায্য
করছিলেন,
তিনি দোভাষী হিসেবে কাজ করছিলেন, এবং ওনার বন্ধুত্বপূর্ণ ব্যবহার ইংরেজ মহিলাকে অনেকটাই আস্বস্ত করেছিল।
"আপনার নাম অ্যাডা
ম্যাসন; ঠিক তো।"
"আমার নামকরণ
হয়েছিল অ্যাডা বিয়াত্রিস,
স্যার।" ম্যাসন পরিষ্কার ভাবে জানালো।
"ঠিক তাই, আমরা বুঝতে পারছি,
ম্যাসন, এটা খুবই বেদনাদায়ক
ঘটনা।"
"হ্যাঁ, অবশ্যই,
স্যার। আমি অনেক মহিলার কাছেই কাজ করেছি, এবং তারা সবাই আমার কাজে খুশি হয়েছেন। কোনো পরিস্থিতিতেই আমি আশা করি নি, বা স্বপ্নেও ভাবি নি যে কখনো এমন কিছু ঘটতে পারে।"
"না, না,"
মসিয়েঁ ক্যারেজ বললেন।
"স্বাভাবিক ভাবেই, এই ধরণের ঘটনার কথা,
অবশ্য, সাধারণত রবিবারের কাগজেই
দেখতে পাই। আর আমি বুঝেছি যে ওই বিদেশি ট্রেনগুলো -" সে নিজের কথার তোরটা একটা
কথা মনে হতেই থামালো,
যে ভদ্রলোকেদের সামনে সে কথা বলছে তারা সবাই ট্রেনটা যে
দেশের সেই দেশেরই নাগরিক।
"এইবার আমাদের এই
ঘটনার কথায় আসা যাক,"
মসিয়েঁ ক্যারেজ বললেন, "আপনারা যখন লন্ডন থেকে যাত্রা শুরু করলেন, এখানে আমি যা বুঝতে পারছি, তখন আপনার প্যারিসে থাকার কোনো প্রশ্নই ছিল না?"
"ওঃ! না, স্যার,
আমাদের সোজা নাইসে যাবার কথা ছিল।"
"আপনি কি আগে কখনো
আপনার মালকিনের সাথে বিদেশ সফর করেছেন?"
"না, স্যার। দেখুন,
আমি ওনার সাথে কেবল দু মাস হোলো আছি।"
"যখন যাত্রা শুরু
হলো তখন কি উনি একেবারে স্বাভাবিক ছিলেন?"
"তিঁনি যেন একটু
উদ্বেগে ছিলেন,
বিচলিতও ছিলেন, এবং একটু খিটখিটও করছিলেন, সহজে ওনাকে শান্ত করা যাচ্ছিলো না।
মসিয়েঁ ক্যারেজ মাথা
নাড়লেন।
"তাহলে, ম্যাসন আপনার প্যারিসে নেমে যাওয়ার ব্যাপারটা কখন জানতে পারলেন?"
"গারে ডি লিওনে, স্যার। আমার মালকিন ভাবছিলেন ট্রেন থেকে নেমে কিছুক্ষন প্লাটফর্মে পায়চারি
করবেন। তিঁনি করিডরে বেরোচ্ছিলেন এমন সময় হঠাৎই বিস্ময়ে একটা চিৎকার করেন, এবং এক ভদ্রলোক কে সঙ্গে করে নিজের কম্পার্টমেন্টে ফিরে আসেন। তিনি আমার এবং
ওনার কম্পার্টমেন্টের মাঝখানের দরজাটা বন্ধ করে দেন, সে জন্য আমি কিছু দেখতে পাই নি বা কিছু শুনতেও পাই নি, যতক্ষণ না হঠাৎ তিনি আবার ওটা খুলে দেন এবং আমাকে বলেন যে উনি ওনার পরিকল্পনায়
কিছু বদল করেছেন। উনি আমাকে কিছু টাকা দেন এবং সেখানেই নেমে যেতে বলেন এবং রিট্জে
গিয়ে উঠতে বলেন। উনি বলেন ওখানে সবাই ওনাকে চেনেন এবং আমি গেলে আমাকে অবশ্যই থাকার
জন্য একটা ঘর দেবেন। উনি ওখানেই আমাকে অপেক্ষা করতে বলেন যত্তক্ষন না উনি কোনো খবর
দিয়ে জানান,
উনি বলেন কি করতে হবে তা আমাকে তার করে জানাবেন। আমাকে কোনোমতে জিনিসপত্র গুছিয়ে নিয়ে ট্রেন ছাড়ার আগেই
লাফিয়ে নামতে হয়েছিল। একেবারে তাড়াহুড়ো করে।"
"মিসেস কেটারিং যখন
আপনাকে এসব কথা বলছিলেন,
তখন ওই ভদ্রলোক কোথায় ছিলেন?"
"তিঁনি অন্য
কম্পার্টমেন্টে দাঁড়িয়ে ছিলেন, স্যার, জানলা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে।"
"তুমি কে আমাদের
তাঁর একটা বর্ণনা দিতে পারো?"
"বলতে গেলে, স্যার,
আমি ওনাকে খুব অল্প সময়ের জন্য দেখেছি। বেশিরভাগ সময় উনি
আমার দিকে পেছন ফিরে ছিলেন। উনি একজন লম্বা এবং শ্যামবর্ণ ভদ্রলোক; এটাই আমি আপনাদের বলতে পারি। পোশাকের দিক থেকে উনি অন্য যে কোনো ভদ্রলোকের
মতোই একটা ঘন নীল রঙের ওভারকোট ও ধূসর রঙের টুপি পরে ছিলেন।"
"উনি কি ট্রেনের
একজন যাত্রী ছিলেন?"
"আমার মনে হয় না, স্যার,
আমার মনে হয় যাত্রার মাঝখানে উনি মিসেস কেটারিংয়ের সঙ্গে
স্টেশনে দেখা করতে এসেছিলেন। অবশ্যই, উনি একজন যাত্রীও হতে
পারেন; আমি এ ব্যাপারে কখনো ভেবে দেখি নি।"
এই বিকল্প সম্ভবনায় ম্যাসনকে
একটু উদ্বিগ্ন দেখাচ্ছিল।
"আঃ!" মসিয়েঁ
ক্যারেজ হালকা চলে অন্য প্রসঙ্গে চলে গেলেন। "আপনার মালকিন কন্ডাক্টরকে
অনুরোধ করেছিলেন তাঁকে সকাল সকাল ঘুম থেকে তুলে না দেওয়ার জন্য। আপনার কি মনে হয়, এটা ওনার স্বাভাবিক আচরণ ছিল?"
"হ্যাঁ, একেবারেই,
স্যার, মালকিনের রাতে ঘুম হতো না, উনি সকালে বেলা পর্যন্ত ঘুমোতে পছন্দ করতেন, সকালে কখনো প্রাতরাশ করতেন না।
মসিয়েঁ ক্যারেজ আবার
প্রসঙ্গ পরিবর্তন করলেন।
"লাগেজের মধ্যে
একটা গাঢ় লাল রঙের মরক্কো বাক্স ছিল, ছিল না?" তিনি জিজ্ঞেস করলেন,
"সেটা কি আপনার মালকিনের রত্নের বাক্স?"
"হ্যাঁ, স্যার।"
"আপনি কি ওটা
রিট্জে নিয়ে গিয়েছিলে?"
"আমি মালকিনের
রত্নের বাক্স নিয়ে রিট্জে?
নাঃ,
অবশ্যই না, স্যার।" ম্যাসনের
গলায় আতঙ্ক ফুটে উঠলো।
"আপনি ওটা
ক্যারিজেই ছেড়ে গেছিলেন?"
"হ্যাঁ, স্যার।"
"আপনার মালকিনের
কাছে কি অনেকগুলো রত্ন ছিল,
আপনি কি এব্যাপারে কিছু জানেন?"
"বেশ কয়েকটা, স্যার;
আমি এতে মাঝে মাঝে বেশ অস্বস্তি অনুভব করতাম, মানে,
ওই যে বিদেশে যে সাংঘাতিক ডাকাতির গল্পগুলো শোনা যায়
সেজন্যই। আমি জানি,
ওগুলো ইনসিওর করা ছিল, কিন্তু, তাহলেও একটা ভয়ানক ঝুঁকি থেকেই যায়। মালকিন আমাকে বলেছিলেন, শুধু,
ওই রুবিগুলোর দামই কয়েক হাজার পাউন্ড।"
"রুবিগুলো, কোন রুবিগুলো?"
ভ্যান আলদীন হঠাৎ গর্জে উঠলেন।
ম্যাসন তাঁর দিকে ফিরলো।
"আমার মনে হয় আপনিই
ওগুলো ওনাকে দিয়েছিলেন,
স্যার, খুব একটা বেশিদিন আগে নয়।
"হে ভগবান," ভ্যান আলদীন চিৎকার করে উঠলেন, "আপনি কি বলতে চাইছেন যে ওই রুবিগুলো ওর সাথেই ছিল? আমি ওকে ওগুলো ব্যাংকে রেখে যেতে বলেছিলাম।"
ম্যাসন তার বিশেষ গলা খাকরানি
টা একবার দিলো,
যেটা তার মহিলাদের পরিচারিকা হিসেবে কাজের একটা
গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ। এইবার সেটা অনেককিছুই বুঝিয়ে করলো। অনেক সময় ভাষায় সবকিছু
প্রকাশ করা যায় না এটা যেন সবকিছু পরিষ্কার করে দিলো, এবং এটা স্পষ্ট হয়ে গেলো যে ম্যাসনের মালকিন তাঁর নিজের মতেই চলতেন।
"রুথ নিশ্চই পাগল
হয়ে গিয়েছিলো,"
ভ্যান আলদীন বিড়বিড় করে বললেন, "ওর ওপর কিসে ভর করেছিল?"
মসিয়েঁ ক্যারেজ এবার একটা
গলা খাকরানি দিলেন,
এটাও একটা তাৎপর্যপূর্ণ গলা খাকরানি। এটা ভ্যান আলদীনের
মনোযোগ ওনার দিকে ঘুরিয়ে দিলো।
"এখনকার মতো," মসিয়েঁ ক্যারেজ,
ম্যাসনকে বললেন, "আমার মনে হয়,
এইটুকুই। আপনি যদি পাশের ঘরে যান, মাদমোয়েজেল,
ওরা আপনাকে প্রশ্ন উত্তরগুলো পরে শোনাবে, আর তার পর আপনাকে একটা সই করতে হবে।"
ম্যাসন একজন করণিকের সাথে
ঘর থেকে বেরিয়ে গেলো,
ভ্যান আলদীন সঙ্গে সঙ্গে ম্যাজিস্ট্রেটকে বললেন:
"এরপর।"
মসিয়েঁ ক্যারেজ নিজের
ডেস্কের একটা ড্রায়ার খুললেন, একটা চিঠি বার করলেন, এবং সেটা ভ্যান আলাদীনের দিকে এগিয়ে দিলেন।
"এটা
মাদামের হ্যান্ডব্যাগে পাওয়া গিয়েছে।"
"প্রিয়
বন্ধু" (চিঠিতে যা লেখা আছে),
"আমি তোমার কথাই
মেনে চলবো,
দূরদর্শী, বিচক্ষণ হবো - সেই সমস্ত
কিছু হবো,
যা একজন প্রেমিকের কাছে ঘৃণার। প্যারিসে হয়তো অবিবেচকের মতো
কাজ হয়েছিল,
কিন্তু আইলস ডি'অর পৃথিবী থেকে অনেক দূরে, আর তুমি নিশ্চিন্ত থাকতে পারো কোনো কিছুই ফাঁস হবে না। আমি বিখ্যাত রত্নগুলির
উপর যে লেখাটা লিখছি তাতে তোমার এত আগ্রহী হওয়াটা আমার কাছে তোমার এবং তোমার
ঈশ্বরের আশীর্বাদের মতো। ওই রুবিগুলোকে সত্যি সত্যি দেখতে পাওয়া এবং তাদের হাতে
নিতে পারা টা, অবশ্যই,
একটা অসাধারণ সুযোগ। একটা বিশেষ অনুচ্ছেদ আমি 'হার্ট অফ ফায়ার' কে উৎসর্গ করেছি। প্রাণ প্রিয়া আমার! খুব শীঘ্রই আমি তোমার সব বিচ্ছেদ এবং
শুন্যতার দুঃখজনক বছরগুলো মুছিয়ে দেব।
"তোমার চির-প্রিয়,
"আর্মন্ড।"
চ্যাপ্টার ১৫
কমতে ডে লা রোচে
ভ্যান আলদীন নীরবে চিঠিটা
পড়লেন। তাঁর মুখ চাপা রাগে লাল হয়ে উঠলো। যাঁরা তাঁকে লক্ষ্য করছিলেন তাঁরা দেখলেন
তাঁর রগের শিরাটা দপদপ করছে আর তাঁর বড়ো বড়ো হাত দুটি অজান্তেই মুষ্টিবদ্ধ হয়ে
গেছে। ভ্যান আলদীন কোনো কথা না বলে চিঠিটা ফিরিয়ে দিলেন। মসিয়েঁ ক্যারেজ খুব মন
দিয়ে তাঁর ডেস্কের দিকে তাকিয়ে ছিলেন, মসিয়েঁ কাউক্স ওপর দিকে
তাকিয়েছিলেন,
আর মসিয়েঁ এরকুল পোয়ারো খুব যত্ন করে কোটের হাতা থেকে ময়লা
ঝাড়ছিলেন। ভ্যান আলদীনের দিক থেকে চোখ ফিরিয়ে থাকার জন্য তাঁরা বিভিন্ন সব উৎকৃষ্ট
কৌশল অবলম্বন করছিলেন।
মসিয়েঁ ক্যারেজ অবশেষে, তাঁর পদমর্যাদা এবং কর্তব্য অনুযায়ী অপ্রীতিকর বিষয়টা সামাল দিলেন।
"মসিয়েঁ, আপনি হয়তো,"
তিনি বিড়বিড় করে বললেন, "জানেন,
মানে, এই চিঠিটা কে লিখতে পারেন?
"হ্যাঁ, আমি জানি,"
ভ্যান আলদীন গুরুগম্ভীর স্বরে বললেন।
"আঃ?" ম্যাজিস্ট্রেটটি জিজ্ঞাসু ভাবে বললেন।
"একটা বজ্জাত যে
নাকি নিজেকে কমতে ডে লা রোচে বলে থাকে।"
তারপরে একটা নীরবতা; পোয়ারো একটু সামনে ঝুঁকে, বিচারকের ডেস্কের একটা
রুলারকে সোজা করে,
সোজাসুজি ধনকুবেরটিকে প্রশ্ন করলেন।
"মসিয়েঁ ভ্যান
আলদীন এখানে আমার সবাই দায়িত্ববান, খুবই দায়িত্ববান, এই ব্যাপারে কথা বলতে আপনার খুবই কষ্ট হচ্ছে, কিন্তু আমাকে বিশ্বাস করুন, মসিয়েঁ, এখন বিষয়টা গোপন করার সময় নয়। বিচার যদি পেতেই হয়, তাহলে আমাদের সমস্তকিছু জানা দরকার। আপনি একটু ভেবে দেখলে নিজেই পরিষ্কার ভাবে
সত্যটা বুঝতে পারবেন।"
ভ্যান আলদীন দু এক মিনিট
একটু চুপ করে থাকলেন,
তারপর অনিচ্ছা সত্ত্বেও ঘাড় নেড়ে সম্মতি জানালেন।
"আপনি ঠিকই বলেছেন, মসিয়েঁ পোয়ারো,"
তিনি বললেন, "বেদনাদায়ক হলেও,
আমার এটা লুকিয়ে রাখার অধিকার নেই।"
কমিশনারটি একটি স্বস্তির
নিঃস্বাস ফেললেন,
ম্যাজিস্ট্রেটটি নিজের চেয়ারে হেলান দিয়ে বসলেন এবং তাঁর
সরু লম্বা নাকের ওপর চশমার ক্লিপটা ঠিক ঠিক করে বসাতে লাগলেন।
"মসিয়েঁ ভ্যান
আলদীন, আপনি আপনার মতো করেই আমাদের বলুন," তিনি বললেন,
"এই ভদ্রলোকটির ব্যাপারে আপনি যা কিছু জানেন।"
"এটা এগারো কি বারো
বছর আগে - প্যারিসে শুরু হয়েছিল। আমার মেয়ে তখন কিশোরী, আর অন্য সব কিশোরী মেয়েদের মতোই, নির্বোধ, কল্পনাপ্রবণ ধরণের। আমার অজান্তেই তার সাথে এই কমতে ডে লা রোচের মেলা মেশা
শুরু হয়। আপনি হয়তো এর ব্যাপারে শুনে থাকবেন?"
কমিশনারটি এবং পোয়ারো ঘাড়
নাড়িয়ে সম্মতি জানালেন।
"সে নিজেকে কমতে ডে
লা রোচে বলে থাকে,"
ভ্যান আলদীন বলতে থাকলেন, "সে এই খেতাবের অধিকারী কিনা সে ব্যাপারে আমার সন্দেহ আছে।"
"আপনি ওনার নাম
গোথার পঞ্জিকাতে পাবেন না।" কমিশনারটি সম্মত হয়ে বললেন।
"আমি এইটুকুই
আবিষ্কার করতে পেরেছিলাম,"
ভ্যান আলদীন বললেন, "লোকটি সুদর্শন,
সম্ভবত বজ্জাত, মহিলাদের প্রতি মারাত্মক
আকর্ষণশক্তি সম্পন্ন। রুথ তার প্রতি মোহগ্রস্ত হয়ে পরে, কিন্তু আমি শীঘ্রই এই প্রেমের ব্যাপারটা বন্ধ করে দিয়েছিলাম। লোকটি একজন সাধারণ প্রতারকের বেশি কিছু নয়।"
"আপনার ধারণা
একেবারেই ঠিক,"
কমিশনারটি বললেন, "কমতে ডে লা রোচে আমাদের কাছে সুপরিচিত, আমাদের আগেই ওকে গ্রেফতার
করে জেলে পোড়া উচিত ছিল,
কিন্তু দুর্ভাগ্যবসত - সেটা সহজ কাজ নয়; লোকটি অত্যন্ত চতুর,
তার ঘটনাগুলোতে সবসময়ে সোসাইটিতে উঁচু মর্যাদাসম্পন্ন
মহিলারা জড়িয়ে থাকেন। যদি সে তাঁদের ভুল বুঝিয়ে বা তাঁদের ব্ল্যাকমেল্ করে টাকা
পয়সা আদায় করেও থাকে,
তাহলেও, বুঝতেই পারছেন, স্বাভাবিক ভাবেই ওনারা অভিযোগ জানাতে আসেন না। পৃথিবীর চোখে নিজেরা বোকা
প্রতিপন্ন হওয়া,
কখনো না, এতো সম্ভবই না, আর মহিলাদের ওপর ওর অস্বাভাবিক ক্ষমতা।"
"ঠিক তাই," ধনকুবেরটি গম্ভীর স্বরে বললেন। "যাক, যা বলছিলাম, আমি সম্পর্কটা বেশ স্পষ্টভাবে ভেঙে দিয়েছিলাম। আমি রুথকে তার সত্যি পরিচয়টা জানিয়েছিলাম, এবং সত্যিটা তাকে জোর করে বিশ্বাস করাতে হয়েছিল। প্রায় এক বছর পরে রুথের সাথে
তার বর্তমান স্বামীর পরিচয় হয় এবং তারা বিয়ে করে। যতদূর আমি জানতাম ঘটনার এখানেই
পরিসমাপ্তি ঘটেছিলো;
কিন্তু মাত্র এক সপ্তাহ আগে, বিস্ময়কর ভাবে,
আবিষ্কার করি যে আমার মেয়ে আবার কমতে ডে লা রোচের সাথে
মেলামেশা শুরু করেছে। সে ঘন ঘন লন্ডন এবং প্যারিসে তার সঙ্গে দেখা করছে। আমি তার
এই অদূরদর্শিতার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানাই, আমি আপনাদের একথাও জানাতে
চাই, যে আমার জোড়াজুড়িতেই সে তার স্বামীর বিরুদ্ধে ডিভোর্সের আবেদন ফাইল করার জন্য
তৈরি হচ্ছিলো।"
"এটা ইন্টারেষ্টিং," পোয়ারো মোলায়েম স্বরে বিড়বিড় করে বললেন, তাঁর চোখ তখন ওপর দিকে।
ভ্যান আলদীন তীক্ষ্ণ
দৃষ্টিতে তাঁর দিকে তাকালেন, এবং বলতে থাকলেন।
"আমি তাকে
বুঝিয়েছিলাম এই পরিস্থিতিতে কমতের সঙ্গে দেখা সাক্ষাৎ করতে থাকলে কি কি অসুবিধা
হতে পারে। আমি ভেবেছিলাম সে আমার সাথে একমত হয়েছে।
পরীক্ষক ম্যাজিস্ট্রেটটি
সূক্ষ্মভাবে একবার কাশলেন।
"কিন্তু এই চিঠি
অনুযায়ী -" তিনি শুরু করে আবার থেমে গেলেন।
ভ্যান আলদীনের চোয়াল দুটো
শক্ত হয়ে উঠলো।
"আমি জানি, এটা মোটেই ভালো ব্যাপার নয়। যতই অপ্রীতিকর হোক না কেন, সত্যিটা আমাদের স্বীকার করতে হবে। এটা পরিষ্কার যে রুথ প্যারিসে গিয়ে ডে লা
রোচের সাথে দেখা করার পরিকল্পনা করেছিল। আমি সাবধান করার পর, সে নিশ্চই,
কাউন্ট কে চিঠি লিখে দেখা করার জায়গা পরিবর্তন করার পরামর্শ
দিয়েছিলো।"
"আইলস ডি'অর" কমিশনারটি চিন্তিত ভাবে বললেন, "হ্যারেসের ঠিক উল্টোদিকে অবস্থিত, একটা দূরবর্তী এবং মনোরম
জায়গা।"
ভ্যান আলদীন ঘাড় নাড়ালেন।
"হে ভগবান, রুথ কিভাবে এতো মূর্খ হতে পারলো?" তিনি তিক্ত ভাবে চিৎকার করে বললেন।
"রত্নের ওপর বই
লেখার এই সব গল্প! তার নিশ্চই, প্রথম থেকেই রুবিগুলোর
ওপরই নজর ছিল।"
"ওখানে অনেকগুলো
খুব বিখ্যাত রুবি আছে,"
পোয়ারো বললেন, "মূলত ওগুলো রাশিয়ার রাজ্ মুকুটের রত্নের একটা অংশ ছিল; চরিত্রগত ভাবে তারা অদ্বিতীয়, এবং তাদের মূল্যও
অপরিসীম। কিছুদিন ধরে একটা গুজব শোনা যাচ্ছে যে সম্প্রতি সেগুলো একজন আমেরিকানের
হস্তগত হয়েছে। আমরা কি একথা মেনে নিতে পারি, মসিয়েঁ, আপনিই ওগুলো কিনেছিলেন?"
"হ্যাঁ," ভ্যান আলদীন বললেন,
"প্রায় দশ দিন আগে প্যারিসে ওগুলো আমার হাতে আসে।"
"ক্ষমা করবেন, মসিয়েঁ,
কিন্তু এগুলো কেনা নিয়ে আপনি বেশ কিছুদিন ধরেই দর দাম
চালাচ্ছিলেন?"
"দু মাসের কিছু
বেশি দিন ধরে,
কেন?"
"এই খবরগুলো দ্রুত
ছড়িয়ে যায়,"
পোয়ারো বললেন, "এক দল লোক আছেন যারা এইসব রত্নের পেছনে পরে থাকেন।"
অপরজনের মুখটা যন্ত্রনায়
কুঁচেক গেলো।
"আমার মনে পরে
যাচ্ছে,"
তিনি বললেন, "রুথকে যখন ওগুলো দিয়েছিলাম, তখন মজা করে একটা কথা
বলেছিলাম। ওকে বলেছিলার ওগুলো সঙ্গে করে রিভিয়েরাতে নিয়ে না যেতে, আমি চাই না ওর ওপর ডাকাতি হোক বা ওই রত্নাগুলোর জন্য কেউ ওকে হত্যা করুক । হে ভগবান! মানুষ যখন কোনো কথা বলে - বুঝতেও পারে না সেগুলো
কখন সত্যি হয়ে ফিরে আসবে।"
সেখানে একটা সহানুভূতির
নীরবতা নেমে এলো,
আর তখন পোয়ারো একটু বিচ্ছিন্ন ভাবে বললেন।
"আসুন আমরা সমস্ত
তথ্য ঘটনাক্রম অনুযায়ী ঠিকঠাক ভাবে সাজাই। আমাদের বর্তমান ধারণা অনুযায়ী, এইভাবে ঘটনাগুলো ঘটেছিলো। কমতে ডে লা রোচে আপনার রত্নগুলো কেনার ব্যাপারে খবর
পেয়েছিলেন। খুব সহজেই কৌশলে তিনি মাদাম কেটারিংকে রাজি করান পাথরগুলো সঙ্গে করে
নিয়ে আসার জন্য। তিনিই,
তাহলে, সেই লোক, যাকে ম্যাসন প্যারিসে ট্রেনে দেখেছিলেন।"
বাকি তিনজন একমত হয়ে ঘাড়
নাড়লেন।
"মাদাম তাঁকে দেখে
অবাক হয়ে যান,
কিন্তু তিনি শীঘ্রই পরিস্থিতি বুঝে ব্যবস্থা নিলেন। মাসনকে
রাস্তা থেকে সরিয়ে দেওয়া হোলো, এবং ডিনার বাস্কেটের
অর্ডার দেওয়া হোলো।
আমরা কন্ডাক্টরের থেকে
জানতে পারি যে সে প্রথম কম্পার্টমেন্টের বিছানা করেছে, কিন্তু সে দ্বিতীয় কম্পার্টমেন্টে ঢোকে নি, এবং সেখানে একজন লোককে
তার থেকে সহজেই লুকিয়ে রাখাই যায়। এতক্ষন পর্যন্ত কমতের লুকিয়ে থাকাটাই একটা
আশ্চর্যের ছিল। ট্রেনে তাঁর উপস্থিতির খবর মাদাম ছাড়া আর কেউই জানতো না, তিঁনি খুবই সতর্ক ছিলেন যাতে পরিচারিকাটি তাঁর মুখ না দেখতে পায়। খুব বেশি হলে
সে বলতে পারবে যে তিঁনি লম্বা এবং শ্যামলা। এখানে তাঁর চেহারা প্রায় পুরোপুরি
অস্পষ্ট। তাঁরা একাই ছিলেন - ট্রেন রাতের অন্ধকারে ছুটে চলেছিল। কোনো আর্তনাদ হয়
নি, কোনো ধস্তাধস্তি ছিল না, কারন তিঁনি ভেবেছিলেন, ওই লোকটা,
তাঁর প্রেমিক।"
তিঁনি খুব ধীরে ভ্যান
আলদীনের দিকে ঘুরলেন।
"মৃত্যুটা, মসিয়েঁ,
নিশ্চিত প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই হয়েছে। আমার খুব শীঘ্রই এই
প্রসঙ্গে আসছি। কমতে রত্নের বাক্সটা, যেটা প্রায় ওনার হাতের
কাছেই ছিল,
হস্তগত করলো। ট্রেন লিয়োন্সে পৌঁছনোর কিছুক্ষন আগেই ঘটনাটা
ঘটে।"
মসিয়েঁ ক্যারেজ এই বিবরণীতে
সম্মত হয়ে মাথা নাড়লেন।
"একদমই।
কন্ডাক্টরটি ট্রেন থেকে নেমে আসে। আর খুব সহজেই আমাদের এই লোকটি সবার চোখের আড়ালে
ট্রেন থেকে নেমে যায়;
তার পক্ষে অন্য ট্রেনে চেপে প্যারিস বা পছন্দমতো অন্য
যেকোনো জায়গায় চলে যাওয়াটা খুবই সহজ। মাদামের ব্যাগে চিঠিটা না পাওয়া গেলে, তাঁর কথা উঠ্তই না।"
"ব্যাগটা পরীক্ষা
না করাটা তাঁর দিক থেকে একটা ভুল ছিল," কমিশনারটি ঘোষণা করলেন।
"কোনো সন্দেহই নেই
যে তিনি ভেবেছিলেন চিঠিটা নষ্ট করে ফেলা হয়েছে। আমাকে মার্জনা করবেন - মসিয়েঁ -
চিঠিটা রেখে দেওয়াটা পুরো নির্বোধ এবং অবিবেচকের মতো কাজ।"
"তা হলেও," পোয়ারো বিড়বিড় করে বললেন, "এই অবিবেচকের মতো কাজটা কমতের
আগে থেকেই বোঝা উচিত ছিল।"
"মানে?"
"মানে আমরা একটা
ব্যাপারে সবাই একমত,
কমতে ডে লা রোচের একটা বিষয়ের ওপর প্রচুর জ্ঞান: মহিলা
চরিত্র। মহিলাদের এতো ভালোভাবে চেনা সত্ত্বেও, এটা কি করে সম্ভব, তিনি বুঝতে পারলেন না যে মাদাম চিঠিটা রেখে দেবেন?"
"হ্যাঁ - হ্যাঁ," পরীক্ষক ম্যাজিস্ট্রেট সন্দেহ নিয়ে বললেন, "আপনি যা বলছেন তাতে একটা কিছু তো আছে। কিন্তু, বুঝতেই পারছেন,
ওই সময়, একজন লোকের সবক্ষেত্রে
নিজের ওপর নিয়ন্ত্রণ থাকে না। তিনি হয়তো ঠান্ডা মাথায় চিন্তা করতে পারেন নি। হা
ঈশ্বর!" তিনি অনুভূতি মিশিয়ে বললেন, "আমাদের অপরাধীরা যদি ঠান্ডা মাথায় বুদ্ধি করে কাজ করে, তাহলে তাদের আমরা ধরবো কি করে?"
পোয়ারো নিজের মনেই
হাসলেন।
"আমার কাছে এটা
একদম পরিষ্কার একটা কেস,"
অপরজন বললেন, "কিন্তু,
প্রমান করা কঠিন। উনি বারবারই আমাদের হাত পিছলে বেরিয়ে যান, পরিচারিকাটি যদি ওনাকে সনাক্ত না করতে পারে -"
"যেটা প্রায়
অসম্ভব।" পোয়ারো বললেন।
"ঠিক, ঠিক,"
পরীক্ষক ম্যাজিস্ট্রেট তাঁর থুতনিটা একবার ঘসলেন।
"ব্যাপারটা বেশ কঠিন হতে চলেছে।"
"সত্যই যদি তিঁনি
অপরাধটা করে থাকেন -" পোয়ারো শুরু করলেন। মসিয়েঁ কাউক্স ওনাকে মাঝপথে
থামালেন।
"যদি - আপনি যদি
বলছেন?"
"হ্যাঁ, মসিয়েঁ বিচারক,
আমি যদি বলছি।"
অন্যজন তাঁর দিকে খুব
তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকলেন। "আপনি ঠিকই বলেছেন," তিঁনি অবশেষে বললেন,
"আমরা বড্ডো তাড়াতাড়ি এগোচ্ছি। কমতের হয়তো কোনো অ্যালিবাই
থাকা সম্ভব। তাহলে আমরা বোকা হিসেবে প্রমাণিত হবো।"
"আঃ, উদাহরণস্বরূপ,"
পোয়ারো উত্তর দিলেন, "এটার যদিও কোনো গুরুত্বই নেই। উনি যদি অপরাধটা করে থাকেন, স্বাভাবিক ভাবেই,
ওনার একটা অ্যালিবাই থাকবে। কমতের মতো এতো অভিজ্ঞ একজন
সতর্কতা নিতে অবহেলা করবেন না। না, আমি একটা অন্য কারণে
বলছি।"
"আচ্ছা, সেটা কি?"
পোয়ারো খুব জোরদার ভাবে
তর্জনীটি নাচিয়ে বললেন।
"সাইকোলজি।"
"এ্যঁ?" কমিশনারটি বললেন।
"সাইকোলজিটা ঠিক
নেই। কমতে কি একজন বজ্জাত - হ্যাঁ। কমতে কি একজন জোচ্চোর - হ্যাঁ। কমতে মহিলাদের
নিজের শিকার বানায় - হ্যাঁ। তিনি কি মাদামের রত্নগুলো চুরি করতে চেয়েছেন - আবার
হ্যাঁ। তিনি কি এমন একজন মানুষ যিনি খুন করতে পারেন? আমি বলবো না! কমতের মতো মানুষরা একটু ভীতু প্রকৃতির হন; কোনো ঝুঁকি নেন না। উনি সাবধানী, গড়পড়তা খেলা খেলেন, ইংরেজরা যাকে লো ডাউন খেলা বা গটআপ খেলা বলেন। কিন্তু খুন, শতবার না!" তিনি
অসন্তুষ্ট ভঙ্গিতে মাথা নাড়াতে লাগলেন।
পরীক্ষক ম্যাজিস্ট্রেটটি, তবুও,
মনে হয় তাঁর সাথে একমত হতে পারলেন না।
"এই সব ভদ্রলোকের
এরকম একটা দিন আসতেই পারে যেদিন তাদের মাথা কাজ করে নি এবং অজান্তেই অনেকটা দূর এগিয়ে
গেছেন।" তাঁর জ্ঞানী সুলভ পর্যবেক্ষণ। "কোনো সন্দেহই নেই এইরকম কিছু
এখানে ঘটে থাকবে। আপনার সাথে ভিন্নমত না হতে চাইলেও, মসিয়েঁ পোয়ারো -
"এটা শুধুমাত্র
একটা ধারণা।" পোয়ারো তাড়াতাড়ি ব্যাখ্যা করে বললেন, "কেসটা,
অবশ্যই, আপনার হাতে, আর আপনি সেটাই করবেন যা আপনার সঠিক মনে হয়।"
"আমি আমার মনে এ
ব্যাপারটা নিয়ে সন্তুষ্ট যে কমতে ডে লা রোচেই হচ্ছেন সেই লোক, এবং আমাদের তাঁকে ধরতে হবে।" মসিয়েঁ ক্যারেজ বললেন, "আপনি কি আমার সাথে একমত, মসিয়েঁ কমিশনার।"
"একদমই।"
"আর, আপনি মসিয়েঁ ভ্যান আলদীন?"
"হ্যাঁ," ধনকুবেরটি বললেন,
"হ্যাঁ, লোকটি একজন তুখোড় শয়তান, এব্যাপারে কোনো সন্দেহই নেই।"
"আমার মনে হয় না, তার গায়ে হাত দেওয়া খুব একটা সহজ হবে," ম্যাজিস্ট্রেটটি বললেন,
"কিন্তু, আমাদের সেরাটা দিতে হবে।
এই মুহূর্তে টেলিগ্রাফে নির্দেশনাবলী পাঠিয়ে দিতে হবে।"
"আপনাকে সাহায্য
করতে আমায় অনুমতি দিন,"
পোয়ারো বললেন, "আমার কোনো অসুবিধা হবে না।"
"এ্যঁ?"
অন্যেরা তাঁর দিকে তাকিয়ে
থাকলেন, বেটে খাটো মানুষটি তাঁদের দিকে তাকিয়ে উজ্জ্বল ভাবে হাসলেন।
"আমার কাজই হলো
খবরা খবর রাখা,"
তিনি ব্যাখ্যা করে বললেন, "কমতে টি একজন খুবই বুদ্ধিমান মানুষ। এই মুহূর্তে তিনি এন্টিবেসে ভিলা মারিনা
বলে একটা ভিলাতে আছেন,
এই ভিলাটি তিনি লিজে নিয়েছেন।"
চ্যাপ্টার ১৬
পোয়ারো কেসটা নিয়ে
আলোচনা করলেন
সবাই সম্ভ্রমভরে পোয়ারোর
দিকে চাইলেন।
নিঃসন্দেহে বেটে খাটো
মানুষটি সবার কাছ থেকেই যথেষ্ট সম্মান আদায় করে নিয়েছিলেন। কমিশনারটি হাসলেন -
কিছুটা অনুভূতিহীন ভাবে।
"আপনি আমাদের
সবাইকে নিজের কাজ কি করে করতে হয় তার একটা শিক্ষা দিলেন," তিনি চেঁচিয়ে বললেন,
"মসিয়েঁ পোয়ারো পুলিশের থেকেও বেশি জানেন।"
পোয়ারো আত্মতুষ্ট ভাবে ওপর
দিকে তাকিয়ে ছিলেন,
মুখে একটা ছদ্ম বিনয়ের অভিব্যাক্তি।
"আপনারা আর কি
করবেন; এটা আমার ছোটোখাটো একটা শখ," তিনি বিড়বিড় করে বললেন, "খোঁজ খবর রাখা। স্বাভাবিক ভাবেই, এসবের জন্য আমার হাতে
যথেষ্ট সময় থাকে। কাজের চাপে আমাকে নুইয়ে পড়তে হয় না।"
"আঃ!"
কমিশনারটি অপ্রত্যাশিত ভাবে মাথা নাড়াতে নাড়াতে বললেন। "আমার কথা যদি বলেন
-"
তিনি বেশ অতিরঞ্জিত
অঙ্গভঙ্গি করে বোঝাতে চাইলেন তাঁর কাঁধে বোঝার চাপটা কিরকম।
পোয়ারো হঠাৎই ভ্যান
আলাদীনের দিকে ঘুরলেন।
"আপনি কি এই
দৃষ্টিভঙ্গির সাথে একমত,
মসিয়েঁ? আপনার কি মনে হয় নিশ্চিত
ভাবেই কমতে ডে লা রোচেই খুনি?
"কেন, তাইতো মনে হচ্ছে - হ্যাঁ, নিশ্চিত ভাবেই।"
উত্তরটার মধ্যে এমন কিছু
যেন একটা লুকিয়ে ছিল যে পরীক্ষক ম্যাজিস্ট্রেটটি উৎসুক ভাবে আমেরিকানটির দিকে
চাইলেন। ভ্যান আলদীন,
মনে হলো ওনার কৌতূহলী দৃষ্টিতে সজাগ হলেন এবং কিছু
চিন্তাভাবনা,
যাতে তিনি ডুবে ছিলেন, মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলতে
চাইলেন।
"আমার জামাইয়ের কি
খবর?"
তিনি জিজ্ঞেস করলেন। "আপনারা কি তাঁকে খবরটা দিয়েছেন? আমি যতদূর জানি,
সে এখন নাইসে।"
"অবশ্যই, মসিয়েঁ।" কমিশনারটি একটু ইতস্তত করে বললেন, তারপর বিড়বিড় করে খুব গোপনে বললেন:
"আপনি নিশ্চই জানেন, মসিয়েঁ ভ্যান আলদীন,
সে রাতে মসিয়েঁ কেটারিংও দ্যা ব্লু ট্রেনের একজন যাত্রী
ছিলেন?"
ধনকুবেরটি ঘাড় নাড়লেন।
"লন্ডন থেকে রওনা
হওয়ার ঠিক আগেই আমি খবরটা পেয়েছিলাম।" তিনি খুব সংক্ষিপ্ত ভাবে স্বীকার করলেন।
"তিনি আমাদের জানান," কমিশনারটি বলতে থাকেন,
"তাঁর কোনো ধারণাই ছিল না যে তাঁর স্ত্রীও একই ট্রেনে
ছিলেন।"
"আমি নিশ্চিত, সে জানতো না,"
ভ্যান আলদীন গম্ভীর ভাবে বললেন। "কোনোভাবে তার সাথে
ট্রেনে দেখা হয়ে গেলে তাকে এক সাংঘাতিক অপ্রীতিকর অবস্থায় পড়তে হতো।"
তিনজনই তাঁর দিকে
জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকালেন।
"আমি বিষয়টাকে ছোট
করে দেখাতে চাই না।" ভ্যান আলদীন রুক্ষ ভাবে বললেন, "কেউ জানে না আমার বেচারী মেয়েটাকে কী সহ্য করতে হয়েছে। ডেরেক কেটারিং একা ছিল
না। ওর সঙ্গে একজন মহিলাও ছিল।"
"আঃ!"
"নৃত্যশিল্পী -
মিরেলে।"
মসিয়েঁ ক্যারেজ এবং কমিশনারটি
দুজনে দুজনার দিকে তাকিয়ে একবার মাথা নাড়ালেন, যেন আগে তাঁদের মধ্যে যে
কথা হয়েছিল তা যে ঠিক ছিল সেটাকেই নিশ্চিত করলেন। মসিয়েঁ ক্যারেজ নিজের চেয়ারে
হেলান দিয়ে বসলেন,
হাত দুটো জোড়া করলেন এবং ছাদের দিকে তাকিয়ে থাকলেন।
"আঃ!" তিনি
আবার বিড়বিড় করে বললেন,
"চিন্তার বিষয় হোলো।"
তিনি একটু কেসে নিলেন, "বেশ কিছু গুজব শোনা যায়।"
"ভদ্রমহিলাটি," মসিয়েঁ কাউক্স বললেন,
"বেশ কুখ্যাত।"
"আর তাছাড়াও," পোয়ারো মোলায়েম ভাবে বিড়বিড় করে বললেন, "বেশ খরচা সাপেক্ষ।"
ভ্যান আলাদীনের মুখ লাল
হয়ে উঠেছিল।
তিঁনি সামনে ঝুকে টেবিলের
ওপর একটা ঘুসি মারলেন।
"দেখুন," তিনি চেঁচিয়ে বললেন,
"আমার জামাই একজন সাংঘাতিক বদমাস।"
তিনি রাগত চোখে এক এক করে
তিন জনের মুখের দিকে তাকালেন।
"ওঃ, আমি জানি,"
তিনি বলতে থাকলেন, "সুন্দর চেহারা,
আকর্ষণীয় এবং সরল হাবভাব। এ সব কিছুই আমাকে একসময় প্রভাবিত
করেছিল। অনুমান করছি,
খবরটা যখন তাকে দিলেন সে এমন একটা ভান করেছিল যেন তার বুক
ভেঙে যাচ্ছে - এটাই করবে,
যদি না সে আগে থেকেই খবরটা জেনে থাকে।
"ওঃ, ওনার কাছে এটা পুরোপুরি অপ্রত্যাশিত একটা খবর ছিল, তিনি ভয়ঙ্কর বিচলিত হয়ে পড়েছিলেন।"
"ওই ভন্ড যুবককে
ধিক্কার,"
ভ্যান আলদীন বললেন। "অনুমান করছি, সে ভয়ানক শোকের অভিনয় করেছে।"
"ন-না," কমিশনারটি সাবধানতার সাথে বললেন, "এরকমটা বোধহয় ঠিক বলা যায় না - ইয়ে, মসিয়েঁ ক্যারেজ?"
ম্যাজিস্ট্রেটটি তাঁর
আঙুলের ডগা গুলো একসাথে করলেন, এবং চোখ দুটো অর্ধেকটা
বন্ধ করে বললেন।
"প্রচন্ড ধাক্কা, বিস্ময়,
আতঙ্ক - এগুলো, হ্যাঁ।" তিনি
বিচারকের মতো ঘোষণা করলেন,
"ভয়ঙ্কর শোক - না - একথা আমি বলতে পারবো না।"
এরকুল পোয়ারো আর একবার
বললেন।
"একটা কথা জিজ্ঞেস
করতে চাই,
মসিয়েঁ ভ্যান আলদীন, মসিয়েঁ কেটারিং কি
স্ত্রীর মৃত্যুতে লাভবান হবেন?"
"সে প্রায় কুড়ি
লক্ষ্যের মতো লাভবান হবে,"
ভ্যান আলদীন বললেন।
"ডলার?"
"পাউন্ডস। আমি এই
অঙ্কটাই রুথকে তার বিয়ের সময় দিয়েছিলাম। সে কোনো উইল করে নি বা কোনো সন্তানও নেই, তাই টাকাটা স্বামীর কাছেই যাবে।"
"যাকে নাকি সে
ডিভোর্স করতে চলেছিল,"
পোয়ারো বিড়বিড় করে বললেন, "আঃ, হ্যাঁ,
একেবারেই ঠিক।"
কমিশনারটি তাঁর দিকে ঘুরে
এক তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে চেয়ে থাকলেন।
"আপনি কি বলতে চান
-" তিনি বলতে শুরু করলেন।
"আমি কিছুই বলতে
চাই না।" পোয়ারো বললেন, "আমি খালি তথ্যগুলো সাজিয়ে
নিচ্ছি, এইটুকুই।"
ভ্যান আলদীন তাঁর দিকে
উদগ্রীব হয়ে চেয়েছিলেন।
বেটে খাটো মানুষটি উঠে দাঁড়ালেন।
"আমার মনে হয় না
আমি আর আপনাদের বেশি কিছু সাহায্য করতে পারবো, মসিয়েঁ বিচারপতি," তিনি মসিয়েঁ ক্যারেজকে একটা বাও করে, খুব নম্র ভাবে বললেন।
"আপনারা যদি ঘটনা যেমন যেমন ঘটতে থাকবে সেভাবে আমাকে খবর দেন? তাহলে আপনাদের অশেষ দয়া।"
"হ্যাঁ, অবশ্যই - নিশ্চয়।"
ভ্যান আলদীনও উঠে
দাঁড়ালেন।
"আপাতত আপনাদের আর
আমাকে দরকার নেই নিশ্চই?"
"না, মসিয়েঁ;
এখনকার মতো আমাদের যা দরকার ছিল তার সমস্ত তথ্যই আমাদের
জানা হয়ে গেছে।"
"তাহলে, আমি মসিয়েঁ পোয়ারোর সঙ্গে কিছুদূর হাটতে চাই। মানে, ওনার যদি কোনো আপত্তি না থাকে?"
"আমি অভিভূত, মসিয়েঁ,"
বেটে খাটো মানুষটি একটি বাও করে বললেন।
ভ্যান আলদীন একটা লম্বা
সিগার ধরালেন,
পোয়ারোকেও একটা নিতে অনুরোধ করলেন, পোয়ারো নিলেন না,
তার বদলে নিজের একটা ছোট সিগেরেট ধরালেন। খুব কঠিন চরিত্রের
মানুষ হওয়ার কারণে,
ভ্যান আলদীন এর মধ্যেই তাঁর প্রতিদিনকার, স্বভাব সিদ্ধ ভঙ্গিতে ফিরে গিয়েছেন। দু এক মিনিট চুপ চাপ হাঁটার পর, ধনকুবেরটি বললেন:
"একথা ধরে নিচ্ছি, মসিয়েঁ পোয়ারো,
আপনি আর আপনার পেশার মধ্যে নেই।"
"ঠিক তাই, মসিয়েঁ,
আমি এখন পৃথিবীকে উপভোগ করি।"
"তবুও আপনি পুলিশকে
এব্যাপারে সাহায্য করছেন?"
"মসিয়েঁ, একজন ডাক্তার রাস্তা দিয়ে হেটে যাচ্ছেন, এমনসময় যদি একটা দুর্ঘটনা
ঘটে, যখন তাঁর পায়ের কাছে একজন রক্তাক্ত মৃত্যুপথযাত্রী পরে আছেন তখন তিনি কি বলবেন, 'আমি আমার পেশা থেকে অবসর নিয়েছি, তাই আমি আমার হাঁটা
থামাবো না,'?
যদি আমি আগেই নাইসে পৌঁছে যেতাম, আর পুলিশ আমাকে ডেকে পাঠাতো এবং সাহায্য করতে বলতো, তাহলে আমি রাজি হতাম না। কিন্তু এই ঘটনাটা, ঈশ্বর এটা আমার কাঁধে
চাপিয়ে দিয়েছেন।"
"আপনি ঘটনাস্থলে
ছিলেন,"
ভ্যান আলদীন চিন্তিতভাবে বললেন। "আপনি কম্পার্টমেন্টটা
পরীক্ষা করেছেন,
ঠিক কিনা?"
পোয়ারো মাথা নাড়লেন।
"নিঃসন্দেহে, আপনি ওখানে এমন সব জিনিস পত্র দেখেছেন, যেগুলো, বলা যায় কি,
আপনার কাছে ইঙ্গিতপূর্ণ?"
"হতে পারে," পোয়ারো বললেন।
"আশা করি আমি
কোনদিকে ইঙ্গিত করছি আপনি বুঝতে পারছেন? ভ্যান আলদীন বললেন।
"আমার মনে হচ্ছে কমতে ডে লা রোচের বিরুদ্ধে কেসটা একদমই পরিষ্কার, কিন্তু আমি বোকা নই। আমি আপনাকে প্রায় গত এক ঘন্টা ধরে লক্ষ্য করছি, আর আমি বুঝতে পেরেছি আপনার নিজস্ব কোনো মতামতের কারণে আপনি এই ধারণার সাথে
একমত নন?"
পোয়ারো তাঁর কাঁধ
ঝাঁকালেন।
"আমি ভুলও হতে
পারি।"
"তাহলে আমরা এবার
সাহায্যের ব্যাপারটায় আস্তে পারি, যেটা আমি আপনার কাছে
চাইবো। আপনি কি এব্যাপারে আমার হয়ে কাজ করবেন?"
"আপনার জন্য
ব্যাক্তিগত ভাবে?"
"এটাই আমি বোঝাতে
চাইছি।"
পোয়ারো দু এক মিনিট চুপ
করে থাকলেন।
তারপর তিনি বললেন।
"আপনি কি বুঝতে
পারছেন আপনি কি চাইছেন?"
"আমি সেরকমই অনুমান
করছি,"
ভ্যান আলদীন বললেন।
"ভালো কথা," পোয়ারো বললেন,
"আমি রাজি, কিন্তু এ ব্যাপারে, অবশ্যই,
আমি আমার সব প্রশ্নের স্পষ্ট উত্তর চাইবো।"
"হ্যাঁ, নিশ্চই। বুঝতে পেরেছি।"
পোয়ারোর আচরণ বদলে গেলো, তিনি হঠাৎই গম্ভীর এবং কর্মমুখী হয়ে উঠলেন।
"এই ডিভোর্সের
ব্যাপারটা,"
তিনি বললেন, "আপনিই কি তাঁকে সুটটা আনার ব্যাপারে পরামর্শ দিয়েছিলেন?"
"হ্যাঁ।"
"কবে?"
"প্রায় দিন দশেক আগে।
একটা চিঠিতে সে তার স্বামীর আচার আচরণের বিরুদ্ধে আমার কাছে অভিযোগ জানায়, এবং আমি খুব দৃঢ়তার সঙ্গে তাকে জানাই ডিভোর্সই এর একমাত্র সমাধান।"
"সে তার স্বামীর আচার
আচরণের ব্যাপারে কি অভিযোগ করেছিল?"
"তাকে এক কুখ্যাত
মহিলার সাথে বিভিন্ন জায়গায় দেখা গেছে - যার ব্যাপারে আমরা কথা বলছিলাম -
মিরেলে।"
"নৃত্যশিল্পী।
আঃ-হা! আর মাদাম কেটারিং এব্যাপারে আপত্তি জানিয়েছিলেন? উনি কি নিজের স্বামীর প্রতি একনিষ্ঠ ছিলেন?"
"আমি সে কথা বলবো
না,"
ভ্যান আলদীন কিছুটা ইতস্তত করে বললেন।
"তাঁর হৃদয়ে যতটা
না আঘাত লেগেছিলো,
তার অহংকারে তার থেকে বেশি আঘাত লেগেছিলো - আপনি কি একথাই
বলতে চান?"
"হ্যাঁ, আমার মনে হয় আপনি এভাবে ব্যাপারটা দেখতে পারেন।"
"যা বুঝলাম বিয়েটা
প্রথম থেকেই খুব একটা সুখের হয় নি?"
"ডেরেক কেটারিং
ভিতর থেকেই পচা গলা।" ভ্যান আলদীন বললেন, "তার পক্ষে কোনো মহিলাকেই
সুখী করা সম্ভব নয়।"
"সে, আপনারা ওই ইংল্যান্ডে যা বলেন, খুব খারাপ ধরণের লোক।
তাইতো, ঠিক কিনা?"
ভ্যান আলদীন মাথা নাড়লেন।
"তাহলে! আপনি
ম্যাডামকে ডিভোর্সের পরামর্শ দিলেন, তিনি রাজি হলেন; আপনি আপনার আইনজীবীর কাছে পরামর্শ নিলেন। মসিয়েঁ কেটারিং কখন জানতে পারলেন কি
ঘটতে চলেছে?"
"আমি নিজেই তাকে
ডেকে পাঠিয়েছিলাম,
এবং তাকে বিস্তারিত জানিয়েছিলাম আমি কি পদক্ষেপ নিতে
চলেছি।"
"তিনি কি বললেন?" পোয়ারো খুব নরম ভাবে বিড়বিড় করে বললেন।
পুরোনো কথা মনে পড়তে
ভ্যান আলাদীনের মুখ অন্ধকার হয়ে গেলো।
"সে প্রায় নারকীয়
ভাবে নির্লজ্জ।"
"প্রশ্নটার জন্য
মাফ চাইছি,
মসিয়েঁ, তিনি কি নিজেই কমতে ডে লা
রোচের প্রসঙ্গ তোলেন?"
"নাম ধরে নয়," অপরজন অনিচ্ছাকৃত গর্জন করে বললেন, "কিন্তু সে বোঝায় যে এই ব্যাপারটা তার কাছে অজানা নয়।"
"যদি আমি প্রশ্ন
করি, মসিয়েঁ কেটারিংয়ের আর্থিক অবস্থা এখন কেমন?"
"আপনার মনে হোলো
কেন এবাপারটা আমি জানতে পারি?" ভ্যান আলাদিন একটু ইতস্তত
করে জিজ্ঞেস করলেন।
"আমার মনে হোলো
এব্যাপারে আপনি খোঁজ খবর রাখবেন।"
"হ্যাঁ - আপনি
একেবারেই ঠিক,
আমি নিয়েছি। আমি আবিষ্কার করেছি কেটারিং একেবারে খাদের
কিনারায় দাঁড়িয়ে আছে।"
"আর এখন সে কুড়ি
লক্ষ্য পাউন্ডের উত্তরাধিকারী! আশ্চর্য - এটা একটা অদ্ভুত ব্যাপার, তাই না?"
ভ্যান আলদীন খুব তীক্ষ্ণ
ভাবে তাঁর দিকে তাকিয়ে থাকলেন।
"আপনি কি বোঝাতে
চাইছেন?"
"আমি নীতিবোধের কথা
বলছি,"
পোয়ারো বললেন, "আমি বোধহয় দার্শনিকের মতো কথা বলছি। কিন্তু আমরা যেখানে ছিলাম সেখানে যদি ফিরে
যাই। মসিয়েঁ কেটারিং নিশ্চই লড়াই না করে ডিভোর্সটা মেনে নেবেন না?"
ভ্যান আলদীন দু এক মিনিট
কোনো উত্তর দিলেন না,
তারপর তিনি বললেন:
"আমি জানি না তার
ঠিক কি উদ্দেশ্য ছিল।"
"আপনার কি ওনার
সাথে আর কোনো কথা বার্তা হয়েছে?"
আবার একটা ছোট নীরবতা, তারপর ভ্যান আলদীন বললেন, "না।"
পোয়ারো স্তব্ধ হয়ে
দাঁড়িয়ে পড়লেন,
নিজের টুপিটা খুললেন, এবং নিজের হাত বাড়িয়ে
দিলেন।
"প্রার্থনা করি
আপনার দিন ভালো কাটুক,
মসিয়েঁ। আমি আপনার জন্য কিছুই করতে পারবো না।"
"আপনি কি বলতে
চাইছেন?"
ভ্যান আলদীন রাগী স্বরে জানতে চাইলেন।
"আপনি যদি আমায়
সত্যিটা না বলেন,
আমি কিছুই করতে পারবো না।"
"আমি জানি না আপনি
ঠিক কি বোঝাতে চাইছেন।"
"মনে হয় আপনি বুঝতে
পারছেন, আমি আপনাকে পুরোপুরি আস্বস্ত করতে চাই, মসিয়েঁ ভ্যান আলদীন, যে আমি জানি কিভাবে বিচক্ষণতার সাথে সিদ্ধান্ত নিতে হয়।"
"ঠিক আছে, তাহলে,"
ধনকুবেরটি বললেন, "আমি স্বীকার করে নিচ্ছি একটু আগে আমি সত্যি কথা বলছিলাম না। এরপরেও আমার সাথে
আমার জামাইয়ের যোগাযোগ হয়েছিল।"
"আচ্ছা?"
"সত্যি কথা বলতে
গেলে, আমি আমার সেক্রেটারি,
মেজর নাইটোনকে, এই নির্দেশ দিয়ে, ওর সাথে দেখা করতে পাঠিয়েছিলাম, যাতে সে ওকে এই প্রস্তাব
দেয় যে ক্যাশে তাকে একশো হাজার পাউন্ড দেওয়া হবে, যদি সে কেসটাকে বিনা প্রতিরোধে ছেড়ে দেয়।"
"টাকার অঙ্কটা
বিশাল,"
পোয়ারো স্বীকার করে নিয়ে বললেন, "আর আপনার জামাইয়ের কি উত্তর ছিল, মসিয়েঁ?"
"সে জানিয়েছিল যে
আমি জাহান্নামে যেতে পারি।" ধনকুবেরটি সংক্ষেপে উত্তর দিলেন।
"আঃ!" বললেন
পোয়ারো।
তাঁর চেহারায় কোনো রকমের
আবেগের কোনো প্রকাশ ছিল না। সেই মুহূর্তে তিনি শুধু তথ্যগুলো ঠিকঠাক ভাবে সাজিয়ে
নিচ্ছিলেন।
"মসিয়েঁ কেটারিং
পুলিশকে জানিয়েছেন যে ইংল্যান্ড থেকে যাত্রার সময় তাঁর সাথে তাঁর স্ত্রীর দেখা হয়
নি বা কোনো রকম কথা বার্তা হয় নি। আপনি কি একথা বিশ্বাস করেন, মসিয়েঁ?"
"হ্যাঁ, করি,"
ভ্যান আলদীন বললেন, "আমি বলবো,
সে তার সাথে যাতে দেখা না হয় তার জন্য সবরকম চেষ্টা
করতো।"
"কেন?"
"কারণ ওর সঙ্গে
একজন মহিলা ছিলেন।"
"মিরেলে?"
"হ্যাঁ।"
"আপনি এই কথাটা
কিভাবে জানতে পারলেন?"
"আমার একজন লোক আছে, যাকে আমি ওর ওপর নজর রাখতে বলেছিলাম, সে জানিয়েছিল যে তারা
দুজনে ওই ট্রেনে রওনা হয়েছে।"
"হ্যাঁ," পোয়ারো বললেন,
"এক্ষেত্রে, আপনি আগে যা বললেন, সে মাদাম কেটারিংয়ের সাথে অবশ্যই কোনো যোগাযোগের চেষ্টা করবে না।"
বেটে খাটো মানুষটি
কিছুক্ষনের জন্য চুপ করে গেলেন।
ভ্যান আলদীন তাঁর ধ্যান
ভাঙানোর কোনো চেষ্টা করলেন না।
চ্যাপ্টার ১৭
একজন অভিজাত
ভদ্রলোক
"জর্জেস, তুমি আগে কোনোদিন রিভিয়েরা এসেছো?" পরের দিন সকালে পোয়ারো তাঁর খানসামা কে প্রশ্ন করলেন।
জর্জেস একজন ভীষণ রকমের
ইংলিশ, প্রায় আবেগহীন কাঠ কাঠ মুখের অধিকারী।
"হ্যাঁ, স্যার,
আমি এখানে দু বছর আগে এসেছিলাম, যখন আমি লর্ড এডওয়ার্ড ফ্র্যাম্পটনের কাছে কাজ করতাম।"
"আর আজকে," তার মালিক বিড়বিড় করে বললেন, "তুমি এরকুল পোয়ারোর সাথে।
পৃথিবীতে মানুষ কিভাবে উন্নতি করে।"
খানসামাটি এই
পর্যবেক্ষণের কোনো উত্তর দিলো না। কিছুক্ষন চুপ করে থেকে সে জিজ্ঞেস করলো:
"বাদামি লাউঞ্জ
স্যুটটা,
স্যার? আজকে বেশ ঠান্ডা হওয়া
দিচ্ছে।"
"ওয়েস্টকোটে একটা
গ্রিসের দাগ লেগে আছে।" পোয়ারো আপত্তি করলেন, "গত মঙ্গলবার যখন আমি রিট্জে দুপুরের খাবার খাচ্ছিলাম তখন এ লা জেনেটি বলে পদটি
থেকে সোল মাছের ফিলের একটা টুকরো ওখানে ছিটকে পরে।"
"এখন ওখানে কোনো
দাগ নেই,
স্যার।" জর্জ গররাজি হয়ে বললো। "আমি ওটা মিটিয়ে
দিয়েছি।"
"অতি উত্তম," পোয়ারো বললেন,
"আমি তোমার ওপর খুশি হলাম, জর্জেস।"
"ধন্যবাদ, স্যার।"
কিছুক্ষন চুপ করে থাকার
পর, পোয়ারো স্বপ্নালু ভাবে বিড়বিড় করে বললেন:
"ধরো, হে জর্জেস,
যদি তুমি তোমার মৃত মনিব লর্ড এডওয়ার্ড ফ্র্যাম্পটনের মতো
এক সামাজিক পরিমণ্ডলে জন্মাতে, নিজের কাছে কানা কড়িটিও
নেই, একজন অত্যন্ত বড়োলোক মহিলাকে বিয়ে করলে, কিন্তু সেই স্ত্রী তোমাকে
ডিভোর্স করতে চাইলো,
তার যথাযথ ভালো কারণও আছে, তুমি এ ব্যাপারে কি করবে?"
"আমি চেষ্টা করতাম, স্যার,"
জর্জ উত্তর দিলো, "তার মত পরিবর্তন করানোর জন্য।"
"শান্ত ভাবে না
বলপ্রয়োগে?"
জর্জ কে দেখে মনে হলো যেন
সে প্রচন্ড আহত হয়েছে।
"আমাকে ক্ষমা করবেন, স্যার,"
সে বললো, "একজন অভিজাত ভদ্র সন্তান
কখনোই হোইটচ্যাপেলের সবজিওয়ালার মতো ব্যবহার করবে না। সে কখনোই কোনো নিচু কাজ করবে
না।"
"করবে না, তাই না,
জর্জেস? আমিও কি সেই কথা ভাবছি? বোধহয় তুমিই ঠিক।"
দরজায় কেউ টোকা দিলো।
জর্জ দরজার কাছে গিয়ে এক বা দু ইঞ্চি মতো খুলে উঁকি দিলো। নিচু স্বরে বিড়বিড় করে
কিছু কথা বার্তা হোলো,
তারপর খানসামাটি পোয়ারোর কাছে ফিরে এসে বললো। "একটা
চিঠি, স্যার।"
পোয়ারো সেটা নিলেন। পুলিশ
কমিশনার,
মসিয়েঁ কাউক্সের কাছ থেকে এসেছে।
"আমরা কমতে দে লা
রোচেকে জেরা করতে চলেছি। বিচারকের নির্দেশ অনুযায়ী আপনাকে সেই সময় উপস্থিত থাকতে
অনুরোধ করছি।"
"তাড়াতাড়ি, আমার স্যুট,
জর্জেস। আমাকে এখুনি যেতে হবে।"
সোয়া এক ঘন্টা পরে তাঁর
বাদামি স্যুটে ফিট ফাট হয়ে,
পোয়ারো পরীক্ষক ম্যাজিস্ট্রেটের ঘরে ঢুকলেন। মসিয়েঁ কাউক্স
আগে থেকেই সেখানে ছিলেন,
তিনি এবং মসিয়েঁ ক্যারেজ দুজনেই অত্যন্ত ভদ্রতার সঙ্গে
পোয়ারোকে অভিবাদন করলেন।
"ব্যাপারটা কিছুটা
হতাশাজনক,"
মসিয়েঁ কাউক্স বিড়বিড় করে বললেন।
"মনে হচ্ছে যে খুন
হওয়ার আগের দিন কমতে নাইসে পৌঁচেছেন।"
"এটা যদি সত্যি হয়, তাহলে তো আপনাদের ব্যাপারটা সুন্দর ভাবে মিটে যায়," পোয়ারো উত্তর দিলেন।
মসিয়েঁ ক্যারেজ গলাটা
একটু পরিষ্কার করে নিলেন।
"এই অ্যালিবাই
প্রচন্ড রকমের সতর্কতার সাথে তদন্ত ছাড়া আমরা স্বীকার করবো না," তিনি ঘোষণা করলেন। তিনি টেবিলের ওপর বেলটা একবার হাত দিয়ে চাপ দিলেন। আর এক
মিনিটের মধ্যেই একজন লম্বা শ্যামলা লোক, চমৎকার পোশাকে সজ্জিত, কিছুটা উদ্ধত মুখভঙ্গি,
নিয়ে ঘরে ঢুকলো। কাউন্টকে দেখতে এতটাই অভিজাত যে মনে হয় এটা
নেহাতই একটা রটনা বা গুজব যে ওনার বাবা ন্যান্টেসে একজন সামান্য ভুট্টা ব্যাবসায়ী
ছিলেন - যদিও এটাই সত্যি। তাঁর দিকে তাকালে মনে হবে যে তাঁর একাধিক পূর্বপুরুষ
ফরাসি বিপ্লবের সময় গিলোটিনে প্রাণ দিয়েছিলেন।
"ভাদ্রমহোদয়গন আমি
উপস্থিত,"
কাউন্টটি উদ্ধত ভাবে বললো। "আমি কি জানতে পারি কি
ব্যাপারে আপনারা আমার সাথে কথা বলতে চান?"
"দয়া করে বসুন, মসিয়েঁ কমতে,"
পরীক্ষক ম্যাজিস্ট্রেট নম্র ভাবে বললেন। "আমরা মাদাম
কেটারিংয়ের মৃত্যুর ব্যাপারে তদন্ত করছি।"
"মাদাম কেটারিংয়ের
মৃত্যুর ব্যাপারে?
ঠিক বুঝলাম না।"
"আশা করি, মসিয়েঁ কমতে,
আপনি - আঃ! ম্যাডামের সাথে পরিচিত ছিলেন।"
"অবশ্যই, আমি ওনার সাথে পরিচিত ছিলাম। কিন্তু, তার সাথে এ ব্যাপারের কি
সম্পর্ক?"
চোখে একটা চশমা লাগিয়ে, সে ঘরের চার দিকে একটা ঠান্ডা দৃষ্টিতে দেখতে লাগলো, তার দৃষ্টি পোয়ারোর ওপর বেশ খানিকক্ষণের জন্য থেমে থাকলো, তিঁনি তার দিকে সরল,
নিষ্পাপ প্রশংসার দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিলেন, যা কাউন্টের অহংয়ের জন্য বেশ আনন্দদায়ক। মসিয়েঁ ক্যারেজ তাঁর চেয়ারে হেলান
দিয়ে গলাটা একবার পরিষ্কার করে নিলেন।
"আপনি হয়তো জানেন না, মসিয়েঁ কমতে -" তিনি একবার থামলেন - "যে মাদাম কেটারিং খুন হয়েছেন?"
"খুন? হে ঈশ্বর,
কি সাংঘাতিক!"
চমকে ওঠা এবং দুঃখের
প্রকাশটা খুব চমৎকার ভাবে করা হোলো - এতটাই চমৎকার ভাবে যে মনে হোলো পুরোটাই
অকৃত্রিম।
"মাদাম কেটারিংকে
প্যারিস এবং লিওনসের মদ্ধিখানে দম বন্ধ করে খুন করা হয়েছে," মসিয়েঁ ক্যারেজ বলতে থাকলেন, "এবং তাঁর রত্নগুলো চুরি
গিয়েছে।"
"এ অন্যায়!"
কাউন্টটি তপ্ত ভাবে চেঁচিয়ে উঠলো, "এই ট্রেন ডাকাতগুলোর
বিষয়ে পুলিশের কিছু করা উচিত। আজকাল আর কেউই নিরাপদ নয়।
"ম্যাডামের
হ্যান্ডব্যাগে,"
বিচারকটি বলতে থাকলেন, "আমরা ওনাকে লেখা আপনার একটা চিঠি পেয়েছি। মনে হচ্ছে, তিনি আপনার সাথে দেখা করার ব্যবস্থা করেছিলেন।"
কাউন্টটি নিজের কাঁধ
ঝাঁকালো এবং নিজের হাত দুটো ছড়িয়ে দিলো।
"লুকোচুরির আর কি
প্রয়োজন আছে,"
সে খোলাখুলি বললো। "আমরা সবাই এই পৃথিবীরই পুরুষ।
ব্যাক্তিগতভাবে এবং আমাদের মধ্যে, আমি আমাদের সম্পর্কের কথা
স্বীকার করছি।"
"মনে হয়, আপনি ওনার সাথে প্যারিসে দেখা করেছিলেন এবং ওনার সাথেই যাচ্ছিলেন?" মসিয়েঁ ক্যারেজ বললেন।
"আদতে এই
ব্যাবস্থাই ছিল,
কিন্তু মাদামের ইচ্ছা অনুযায়ী এটার পরিবর্তন হয়। হয়েরেসে
ওনার সঙ্গে আমার দেখা হওয়ার কথা ছিল।"
"আপনি কি ট্রেনে
ওনার সাথে গারে ডি লিওনে ১৪ তারিখ বিকেলে দেখা করেন?"
"সম্পূর্ণ বিপরীতে, আমি ঐদিন সকালেই নাইসে পৌঁছেছি, তাই আপনি যা বলছেন তা
অসম্ভব।"
"ঠিকই তো, ঠিকই তো,"
মসিয়েঁ ক্যারেজ বললেন, "আপনি হয়তো,
প্রকৃতপক্ষে, ১৪ তারিখ সন্ধ্যে বেলার
এবং রাতে আপনার গতিবিধির একটা বিবরণী আমাদের দিতে পারবেন।
কাউন্টটি এক মিনিট একটু
চিন্তা করে নিলো।
"আমি রাতের খাবার
প্যারিসের মন্টে কার্লো কাফেতে করেছি। তারপর আমি লে স্পোর্টিংয়ে যাই। আমি কয়েক
হাজার ফ্রান্কস জিতি।" তিনি কাঁধটা একবার ঝাকিয়ে নিলেন। "প্রায় একটা
নাগাদ আমি বাড়ি ফিরে আসি।"
"ক্ষমা করবেন, মসিয়েঁ,
আপনি কিভাবে বাড়িতে ফেরেন?"
"আমার নিজের
দু-সিটের গাড়িতে।"
"আপনার সাথে কি কেউ
ছিল না?"
"না, কেউ না।"
"আপনার এই বিবৃতির
সপক্ষে কি কোনো সাক্ষী আছে?"
"নিঃসন্দেহে আমার
অনেক বন্ধুই ঐদিন সন্ধ্যায় আমাকে ওখানে দেখেছেন। ডিনার আমি একাই করেছিলাম।"
"ভিলাতে যখন ফিরে
আসেন আপনার চাকর কি দরজা খুলে দিয়েছিলো?"
"আমি আমার নিজের
চাবি দিয়ে দরজা খুলে ঢুকি।"
"আঃ!" ম্যাজিস্ট্রেটটি
বিড়বিড় করে বললেন।
আবার তিঁনি তাঁর হাত দিয়ে
বেলটার ওপর আঘাত করলেন। দরজা খুলে গেলো, এবং একজন বেয়ারা হাজির
হলো।
"পরিচারিকা, ম্যাসন কে নিয়ে এসো,"
মসিয়েঁ ক্যারেজ বললেন।
"আচ্ছা, মসিয়েঁ বিচারক।"
অ্যাডা ম্যাসনকে নিয়ে আসা
হলো।
"মাদমোয়েজেল দয়া
করে এই ভদ্রলোককে একটু ভালো করে দেখবেন। আপনার কি মনে হয় ইনিই প্যারিসে আপনার
মালকিনের কম্পার্টমেন্টে ঢুকেছিলেন?"
মহিলাটি বেশ অনেক্ষন ধরে
গভীর ভাবে কাউন্টকে পর্যবেক্ষণ করতে লাগলো, যে নাকি, পোয়ারোর মনে হলো,
এই রকম পর্যবেক্ষণে বেশ অস্বস্তি বোধ করছে।
"আমি বলতে পারবো না, স্যার,
যে আমি নিশ্চিত," ম্যাসন অবশেষে বললো,
"হতেও পারেন, আবার নাও হতে পারেন, বলা খুব শক্ত,
কারণ আমি শুধুমাত্র ওনার পেছন দিকটাই দেখতে পেয়েছিলাম। আমার
মনে হচ্ছে,
এই ভদ্রলোকই।"
"কিন্তু আপনি
নিশ্চিত নন?"
"ন-না," ম্যাসন অনিচ্ছা সত্ত্বেও বললো, "ন-না,
আমি নিশ্চিত নই।"
"আপনি কি এই
ভদ্রলোককে আগে কার্জণ স্ট্রিটে দেখেছেন?"
ম্যাসন তাঁর মাথা নাড়ালো।
"কার্জণ স্ট্রিটে
যে সব অতিথিরা আসেন তাঁদের সাথে আমার দেখা হওয়ার কথা নয়," সে ব্যাখ্যা করলো,
"যদি না তাঁরা বাড়িতে থাকেন।"
"খুব ভালো, এতেই হবে,"
পরীক্ষক ম্যাজিস্ট্রেট তীক্ষ্ণ ভাবে বললেন।
দেখলেই বোঝা যাচ্ছে উনি
একটু হতাশ।
"এক মিনিট," পোয়ারো বললেন। "যদি অনুমতি দেন, তাহলে আমি মাদমোয়েজেলকে
কি একটা প্রশ্ন করতে পারি?"
"অবশ্যই, মসিয়েঁ পোয়ারো - অবশ্যই সর্বতভাবেই পারেন।"
পোয়ারো পরিচারিকাটির দিকে
তাকিয়ে বললেন।
"টিকিটগুলো কি হলো?"
"টিকিটগুলো, স্যার?"
"হ্যাঁ; লন্ডন থেকে নাইসের টিকিটগুলো। ওগুলো আপনার কাছে ছিল না আপনার মালকিনের কাছে
ছিল?"
"নিজের পুলমানের
টিকেটটা মালকিনের কাছেই ছিল, স্যার; বাকিগুলো আমার কাছে ছিল।"
"সেগুলো কোথায়?"
"সেগুলো আমি ফরাসি
ট্রেনের কন্ডাক্টরকে দিয়েছিলাম, স্যার; সে বলেছিলো এটাই নিয়ম। আশা করি আমি ঠিকই করেছি, স্যার।"
"ওঃ, একদম ঠিক,
একদমই ঠিক। খালি বিস্তারিত ভাবে জেনে নিচ্ছিলাম একটু।"
মসিয়েঁ কাউক্স এবং
পরীক্ষক ম্যাজিস্ট্রেটটি দুজনেই তাঁর দিকে কৌতূহলী দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিলেন।
ম্যাসন অনিশ্চিতভাবে দু
এক মিনিট দাঁড়িয়ে থাকলো,
তারপর ম্যাজিস্ট্রেটটি মাথা নাড়িয়ে তাঁকে ঘর থেকে চলে যাওয়ার ইঙ্গিত করলেন, এবং সে বেরিয়ে গেলো।
পোয়ারো একটা টুকরো কাগজে
কিছু লিখে মসিয়েঁ ক্যারেজের হাতে দিলেন। উনি সেটা পড়লেন এবং ওনার ভুরুগুলো সোজা
হয়ে গেলো।
"তাহলে, ভদ্রমহোদয়গন,"
কাউন্ট উদ্ধতভাবে জানতে চাইলো, "আমাকে কে কি আরো অনেক্ষন আটকে রাখবেন?"
"মোটেই না, মোটেই না,"
মসিয়েঁ ক্যারেজ তাড়াতাড়ি, বেশ বন্ধুত্বপূর্ণ ভাবে বললেন। "এই ব্যাপারে আপনার অবস্থান একেবারেই
পরিষ্কার হয়ে গেছে। স্বাভাবিকভাবেই, মাদামের চিঠিটা সম্পর্কে
আপনাকে আমাদের জিজ্ঞাসাবাদ করতেই হতো।"
কাউন্ট উঠে দাঁড়ালো, কোনা থেকে তাঁর চমৎকার দেখতে ছড়িটা নিলো, আর একটা ছোট মতো বাও করে, ঘর থেকে বেরিয়ে গেলো।
"তাহলে, এই ব্যাপার,"
মসিয়েঁ ক্যারেজ বললেন। " আপনি ঠিকই বলেছেন মসিয়েঁ
পোয়ারো - এভাবে হলেই ভালো হবে যাতে ওনার মনে না হয় যে ওনাকে সন্দেহ করা হচ্ছে।
আমার দুজন লোক ওনাকে দিন রাত ফলো করবে, আর এর মধ্যে আমরা ওনার
অ্যালিবাইগুলো যাচাই করে নি। আমার তো মনে হচ্ছে - কি বলবো - পরিস্থিতির ক্রমাগত পরিবর্তন
হওয়ার সম্ভবনা আছে।
"হতে পারে," পোয়ারো চিন্তিত ভাবে একমত হলেন।
"আমি মসিয়েঁ
কেটারিংকে আজ সকালে এখানে আসতে বলেছিলাম," ম্যাজিস্ট্রেটটি বলতে থাকলেন, "যদিও আমার সন্দেহ আছে
আমরা ওনাকে কত কি জিজ্ঞেস করতে পারবো, কিন্তু দু একটা বেশ
সন্দেহজনক পরিস্থিতি -" তিঁনি থামলেন, এবং নিজের নাকটা ঘষতে
লাগলেন।
"যেমন?" পোয়ারো জিজ্ঞেস করলেন।
"যেমন -," ম্যাজিস্ট্রেটটি কাসলেন- "ওই মহিলা যাঁর সাথে উনি যাত্রা করছিলেন, - মাদমোয়েজেল মিরেলে। তিঁনি একটা হোটেলে আছেন, আবার উনি আরেকটি। এটা আমার কাছে - কি বলবো - একটু অদ্ভুত লাগছে।"
"মনে হচ্ছে," মসিয়েঁ কাউক্স বললেন,
"তাঁরা যেন কোনো সাবধানতা অবলম্বন করছেন।"
"এক্কেবারেই," মসিয়েঁ ক্যারেজ উজ্জীবিত হয়ে বললেন, "তাঁদের কি থেকে সাবধান হওয়ার প্রয়োজন পড়লো?"
"সাবধানতার বেশি
বাড়াবাড়ি বেশ সন্দেহজনক,
হুঁ?"
পোয়ারো বললেন।
"ঠিক।"
"আমরা, মনে হয়,"
পোয়ারো বিড়বিড় করে বললেন, "মসিয়েঁ কেটারিংকে দু একটা প্রশ্ন করতেই পারি।"
ম্যাজিস্ট্রেটটি নির্দেশ
দিলেন। আর দু এক মিনিটের মধ্যেই, সুদর্শন, ডেরেক কেটারিং ঘরে প্রবেশ করলো।
"সুপ্রভাত, মসিয়েঁ,"
বিচারকটি ভদ্র ভাবে বললেন।
"সুপ্রভাত," ডেরেক কেটারিং সংক্ষিপ্ত ভাবে বললো। "আপনারা আমাকে ডেকে পাঠিয়েছিলেন, নতুন কিছু কি সামনে এসেছে?"
"দয়া করে বসুন, মসিয়েঁ।"
ডেরেক বসলো এবং টুপি ও
ছড়িটি টেবিলের ওপর ছুড়ে ফেললো।
"তারপর?" তিনি অধৈর্য্য হয়ে জিজ্ঞেস করলেন।
"আমাদের কাছে, এখনো পর্যন্ত,
নতুন কোনো তথ্য নেই।" মসিয়েঁ ক্যারেজ সতর্কতার সাথে বললেন।
"খুবই আশ্চর্যজনক," ডেরেক কেটারিং শুকনো ভাবে বললো, "আপনারা কি আমাকে এটা বলার জন্য ডেকে এনেছেন?"
"আমাদের স্বাভাবিক
ভাবেই মনে হয়েছে,
মসিয়েঁ, আপনার কেসটার অগ্রগতির
বিষয় জানার একটা আগ্রহ থাকবে," ম্যাজিস্ট্রেটটি
তীব্রভাবে বললেন,
"যদি কোনো অগ্রগতি না থাকে তাহলেও।"
"আমরা আপনাকে
কয়েকটা প্রশ্নও করতে চাই।"
"করুন।"
"আপনি কি নিশ্চিত
যে ট্রেনে আপনার স্ত্রীর সাথে আপনার দেখা হয় নি বা কোনো কথা বার্তা হয় নি?"
"আমি আগেই উত্তর
দিয়েছি। হয় নি।"
"নিঃসন্দেহে, নিশ্চয়,
আপনার কোনো কারণ ছিল।" ডেরেক খুব সন্দেহের চোখে তাঁর
দিকে তাকিয়ে ছিল।
"আমি - জানতাম - না
- সে - ওই - ট্রেনে - ছিল।" সে ব্যাখ্যা করলো। প্রতিটা শব্দের মধ্যে বেশ
কিছুটা করে ফাঁক দিয়ে,
যেন কোনো বোকা লোককে বোঝাচ্ছে।
"আপনি এই কথাই
বলেছিলেন,
হ্যাঁ," মসিয়েঁ ক্যারেজ বিড়বিড়
করে বললেন।
ডেরেকের ভুরু দুটো কুঁচকে
গেলো।
"জানতে ইচ্ছা করছে
আপনারা ঠিক কোন দিকে যাচ্ছেন। আমি কি চিন্তা করছি জানেন, মসিয়েঁ ক্যারেজ?"
"আপনি কি চিন্তা
করছেন, মসিয়েঁ?"
"আমার মনে হয় ফরাসি
পুলিশকে অতিরঞ্জিত করে দেখানো হয়। আপনাদের কাছে নিশ্চই এই ট্রেন ডাকাতদের দলের
কোনো তথ্য আছে। এটা ভয়ানক,
যে এরকম কোনো ঘটনা এরকম একটা বিলাসবহুল ট্রেনে ঘটতে পারে, আর ফরাসি পুলিশ এব্যাপারে অসহায়।
"আমরা এব্যাপারে
তদন্ত করছি,
মসিয়েঁ, ভয় পাবেন না।"
"মাদাম কেটারিং, বোধয়,
কোনো উইল করেন নি," পোয়ারো মাঝখানে হঠাৎ করে বললেন। তাঁর আঙুলের ডগাগুলো একসাথে জোড়া ছিল আর তিঁনি
ওপর দিকে তাকিয়ে ছিলেন।
"আমার মনে হয় না সে
কখনো কোনো বানিয়েছে বলে,"
কেটারিং বললো, "কেন?"
"এর ফলে আপনি একটা
সৌভাগ্যের উত্তরাধিকারী হবেন," পোয়ারো বললেন, "বেশ একটা ভালোরকমের সৌভাগ্যের।"
যদিও তাঁর চোখ দুটো তখনও ওপর
দিকেই ছিল,
তবুও তিনি দেখতে পারছিলেন একটা কালো ছোপ ডেরেক কেটারিংয়ের মুখ
ছেয়ে ফেলছে।
"আপনি কি বলতে
চাইছেন, আর কে আপনি?"
পোয়ারো তাঁর হাটু দুটো
আলাদা করে ছড়িয়ে দিলেন,
ওপর দিক থেকে নিজের দৃষ্টি সরিয়ে নিলেন, এবং যুবকের মুখের দিকে পূর্ণ দৃষ্টিতে তাকালেন।
"আমার নাম এরকুল
পোয়ারো,"
তিনি আস্তে করে বললেন, "আর আমি সম্ভবত পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ গোয়েন্দা। আপনি নিশ্চিত ট্রেনে আপনি আপনার
স্ত্রী কে দেখেন নি বা কোনো কথাও বলেন নি?"
"আপনি কি বলতে
চাইছেন? আপনি কি - আপনি কি এই দিকে ইঙ্গিত করতে চাইছেন যে আমি - আমি আমার স্ত্রীকে খুন
করেছি?"
সে হঠাৎ হেসে উঠলো?
"আমার মাথা গরম করা
উচিত হবে না,
এটা অসম্ভব রকমের অযৌক্তিক। কারণ, যদি আমি তাকে খুন করতাম তাহলে আমার তার রত্নগুলো চুরি করার কোনো প্রয়োজন থাকতো
না, থাকতো কি?"
"এটা সত্যি," পোয়ারো বিড়বিড় করে বললেন, অনেকটা যেন মর্মাহত হয়ে।
"আমি একথা ভাবি নি।"
"যদি কোনো পরিষ্কার
খুন ও ডাকাতির কেস থেকে থাকে, তাহলে এটাই সেটা।"
ডেরেক কেটারিং বললো। "বেচারি রুথ, ওই অভিশপ্ত রুবিগুলোই
নিশ্চই এর জন্য দায়ী। আমি জানি, আগেও ওই পাথরগুলোর জন্য
খুন খারাবি হয়েছে।
পোয়ারো হঠাৎই চেয়ারের ওপর
সোজা হয়ে বসলেন। একটা হালকা সবুজ আলো যেন তাঁর চোখে জ্বলে উঠলো। অদ্ভুত ভাবে তাঁকে
যেন একটা চকচকে,
মোটাসোটা বেড়ালের মতো লাগছিলো।
"আর একটা প্রশ্ন
মসিয়েঁ কেটারিং,"
তিনি বললেন। "আপনি আপনার স্ত্রীকে শেষ কবে দেখেছেন?"
"দাঁড়ান বলছি," কেটারিং একটু চিন্তা করে বললো, "খুব সম্ভবত - হ্যাঁ,
প্রায় তিন সপ্তাহ আগে। আমি দুঃখিত, আপনাকে সঠিক তারিখটা বলতে পারবো না।"
"কোনো ব্যাপার না," পোয়ারো শুকনো ভাবে বললেন, "এটাই আমি জানতে
চাইছিলাম।"
"তাহলে," ডেরেক কেটারিং অধৈর্য ভাবে বললো, "আর কিছু?"
তিনি মসিয়েঁ ক্যারেজের
দিকে তাকালেন। পরের জন আবার পোয়ারোর দিকে তাকালেন অনুমতির জন্য, আর সেটা পেলেন একটা হালকা মাথা নাড়ানোর ইঙ্গিতে।
"না, মসিয়েঁ কেটারিং,"
তিনি খুব নম্র ভাবে বললেন, "না, আমার মনে হয় না আপনাকে আর কষ্ট দেওয়ার দরকার আছে। আপনাকে সুপ্রভাত।"
"সুপ্রভাত," কেটারিং বললেন। দরজাটাকে পেছনে সপাটে বন্ধ করে তিনি ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন।
যুবকটি ঘর থেকে বেরিয়ে
যেতেই, পোয়ারো সামনে ঝুকে এলেন এবং বেশ তীক্ষ্ণ ভাবে বললেন। "আমাকে বলুনতো," তিনি দৃঢ় ভাবে বললেন,
"আপনারা এই রুবির ব্যাপারটা মসিয়েঁ কেটারিংকে কখন বলেছেন?"
"আমি ওগুলোর
ব্যাপারে বলি নি,"
মসিয়েঁ ক্যারেজ বললেন। "সবে তো গতকাল দুপুরবেলা মসিয়েঁ
ভ্যান আলদীনের কাছ থেকে আমরা ওগুলোর ব্যাপারে জানতে পারলাম।
"হ্যাঁ; কিন্তু কমতের চিঠিতে ওগুলোর কথা লেখা ছিল।"
মসিয়েঁ ক্যারেজকে দেখে মনে
হচ্ছিলো তিনি ব্যাথা পেয়েছেন।
"স্বাভাবিক ভাবেই
ওই চিঠিটার কথা আমি মসিয়েঁ কেটারিংকে জানাই নি।" তিনি হতবাক হওয়া গলায় বললেন।
"এখনকার অবস্থার সাপেক্ষে সেটা এক সাংঘাতিক অবিবেচকের মতো কাজ হতো।"
পোয়ারো সামনে ঝুকে টেবিলে
একটা টোকা দিলেন।
"তাহলে উনি ওগুলোর
ব্যাপারে জানলেন কি করে?"
তিনি নরমভাবে জানতে চাইলেন। "মাদাম ওনাকে বলেন নি, কারণ ওনার সাথে তাঁর তিন সপ্তাহ দেখা হয় নি। মসিয়েঁ ভ্যান আলদীন বা ওনার
সেক্রেটারি ওগুলোর উল্লেখ করবেন না; ওনাদের সাথে ওঁর
সাক্ষাৎকার পুরো অন্য বিষয়ে চলেছে, আর খবরের কাগজেও ওগুলোর
ব্যাপারে কোনো ইশারা বা প্রসঙ্গ নেই।"
তিঁনি উঠে দাঁড়ালেন এবং নিজের
টুপি এবং ছড়িটি নিলেন।
"তা সত্ত্বেও," তিনি নিজের মনেই বিড়বিড় করে বলতে থাকলেন, "আমাদের ভদ্রলোকটি ওগুলোর ব্যাপারে সবকিছুই জানেন। আমি অবাক হচ্ছি, হ্যাঁ,
অবাক হচ্ছি।"
চ্যাপ্টার ১৮
ডেরেক লাঞ্চ
করলো
ডেরেক কেটারিং সোজা
নেগ্রেসকো গেলো, সেখানে সে দুটো ককটেলের অর্ডার দিলো এবং
দ্রুত সেগুলো শেষ করলো; তারপর সে উদাসী দৃষ্টি দিয়ে ঝলমলে
নীল সমুদ্রর দিকে তাকিয়ে থাকলো। সে যান্ত্রিকভাবে পথচারীদের লক্ষ্য করছিলো -
উত্তেজনাহীন একঘেয়ে জনতা, জঘন্য পোশাকে সজ্জিত, আর বেদনাদায়কভাবে অরুচিকর; সুষ্ঠ কোনোকিছু আজকাল খুব
কমই দেখতে পাওয়া যায়। তবে একজন মহিলা তার থেকে কিছুটা দূরে একটা টেবিলে এসে বসতেই,
সে তার শেষ অনুভূতিটি খুব দ্রুত সংশোধন করে নিলো। তিঁনি পরে আছে কমলা
এবং কালো রঙের অসাধারণ মিষ্টি একটা পোশাক, একটা ছোট টুপি যা
তাঁর মুখটা আংশিক ঢেকে রেখেছে। সে তৃতীয় একটা ককটেলের অর্ডার দিলো; এবং আবার সমুদ্র দেখতে থাকলো, তারপর হঠাৎই সে চমকে
উঠলো। একটা খুব পরিচিত সুগন্ধ তার নাকে এসে প্রবেশ করেছে, সে
ঘুরে তাকালো এবং দেখলো কমলা এবং কালো পোশাক পড়া মহিলা তার পাশে এসে দাঁড়িয়েছেন। সে
এখন তাঁর মুখ দেখতে পাচ্ছে, এবং তাকে চিনতেও পারলো - মিরেলে।
সে হাসছিলো, তার সেই অহংকারী, মোহময়ী
হাসিটা যেটা তার খুবই পরিচিত।
"ডেরেক!"
সে বিড়বিড় করে বললো, "তুমি কি আমাকে দেখে খুশি হও নি?"
সে টেবিলের অপরদিকে বসলো।
"তাহলে
আমাকে স্বাগত জানাও, বোকা কোথাকার," সে ব্যাঙ্গ করে বললো।
"এটা
তো অপ্রত্যাশিত আনন্দের ব্যাপার," ডেরেক বললো,
"তুমি লন্ডন থেকে কবে রওনা হলে?"
সে তার কাঁধ ঝাঁকালো।
"দু
এক দিন আগে।"
"আর
পার্থেনন?"
"আমি
তাদের, ওই কি বলে যেন? - ছুঁড়ে ফেলে
দিয়েছি!"
"সত্যি?"
"তুমি
মোটেই সৌজন্য মান না, ডেরেক।"
"তুমি
কি আমাকে ওরকম হতে আশা করো?"
মিরেলে একটা সিগারেটে
ধরিয়ে ধোয়া ছেড়ে কয়েক মিনিট পরে বললো।
"তোমার
হয়তো, মনে হতে পারে, এতো তাড়াহুড়ো
করাটা মোটেই বুদ্ধিমানের কাজ হয় নি?"
ডেরেক তাঁর দিকে চেয়ে
থাকলো, তারপর নিজের কাঁধ ঝাঁকালো, এবং ভদ্রতা দেখানোর জন্য প্রশ্ন করলো:
"তুমি
কি এখানে লাঞ্চ করতে এসেছো?"
"অবশ্যই।
আমি তোমার সাথেই লাঞ্চ করবো।"
"আমি
অত্যন্ত দুঃখিত," ডেরেক বললো, "আমার একটা খুব জরুরি কাজ আছে।"
"হে
ঈশ্বর! তোমরা পুরুষরা একদন বাচ্চাদের মতো," নৃত্যশিল্পীটি
চিৎকার করে বললো। "সেই যে লন্ডনে তুমি আমার ফ্ল্যাট থেকে রাগ করে বেরিয়ে গেলে,
তখন থেকেই তুমি আমার সাথে একদম একটা দুষ্টু বাচ্চার মতো ব্যবহার
করছো, বিরক্তিকর। আঃ! এটা বিশ্বাস করা যায় না।"
"ওহে
প্রিয়া," ডেরেক বললো, "আমি
সত্যি বুঝতে পারছি না তুমি কি নিয়ে কথা বলছো। লন্ডনে আমরা একমত হয়েছিলাম যে
ইঁদুরেরা একটা ডুবন্ত জাহাজ ছেড়ে পালাচ্ছে, তখন এরকমই একটা
কথা হয়েছিল।"
উদাসীন ভাবে কথাগুলো বলা
সত্ত্বেও, তার মুখটা ম্লান ও বিষন্ন লাগছিলো। মিরেলে
হঠাৎই সামনে ঝুকে এলো।
"তুমি
আমাকে ভোলাতে পারবে না," সে বিড়বিড় করে বললো,
"আমি জানি - আমি জানি তুমি আমার জন্য কি করেছো।"
ডেরেক খুব তীক্ষ্ণ
দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে থাকলো। মিরেলের গলার স্বরের মধ্যে একটা চোরাস্রোত তাঁর
দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে।
সে তার দিকে তাকিয়ে মাথা
নাড়ালো।
"আঃ!
ভয়ের কিছু নেই, আমি যথেষ্ট বুদ্ধি রাখি। তুমি অসাধারণ,
তোমার অসম্ভব সাহস, কিন্তু, তাহলেও, বুদ্ধিটা আমিই তোমাকে সেদিন লন্ডনে
দিয়েছিলাম যখন বলেছিলাম দুর্ঘটনা ঘটতেই পারে। আর তুমি নিশ্চয় এখনো পর্যন্ত কোনো
বিপদে পর নি? পুলিশ নিশ্চয় তোমাকে সন্দেহ করছে না?"
"কি
যা তা -"
"চুপ!
সে একটা পাতলা জলপাই রঙের
হাত তুললো যার কড়ে আঙুলে একটা বড়ো পান্না ছিল।
"তুমি
ঠিকই বলেছো; এরকম প্রকাশ্য জায়গায় এসব কথা বলা আমার উচিত হয়
নি। আমরা আর এব্যাপারে কথা বলবো না। কিন্তু, আমাদের সমস্যা
মিটে গেছে; একসাথে মিলে এবার আমাদের জীবন হবে অপূর্ব - অপূর্ব!"
ডেরেক হঠাৎ হেসে উঠলো -
একটা বাঁকা, অপ্রীতিকর হাসি।
"তাহলে
কি ইঁদুরেরা ফিরে আসছে? কুড়ি লক্ষ্য একটা ফারাক তৈরি করে দেয়
বটে - অবশ্যই করে। আমার জানা উচিত ছিল।" সে আরেকবার হেসে উঠলো। "ওই কুড়ি
লক্ষ খরচ করতে তুমি নিশ্চই আমাকে সাহায্য করবে, করবে না,
মিরেলে? কিভাবে করা যায়, তা তোমার চেয়ে ভালো আর কোন মহিলা জানবে।" সে আরেকবার হেসে উঠলো।
"চুপ!"
নৃত্যশিল্পীটি চেঁচিয়ে উঠলো, "তোমার কি হয়েছে, ডেরেক? দেখো - তোমাকে সবাই ঘুরে ঘুরে দেখছে।"
"আমাকে?
আমি তোমাকে বলবো আমার কি হয়েছে। তোমার সাথে আমার সমস্ত সম্পর্ক শেষ,
মিরেলে। শুনতে পাচ্ছ? শেষ!"
মিরেলে ব্যাপারটা সেভাবে
নিলো না যেভাবে নেবে বলে ডেরেক আশা করেছিল। সে দু এক মিনিট ডেরেকের দিকে তাকিয়ে
থাকলো তারপর মিষ্টি করে হাসলো।
"ছোট
বাচ্চা একটা! তুমি রেগে আছো - তুমি কষ্ট পাচ্ছ, কেন, না আমি বাস্তবাদী বলে। আমি কি তোমায় বলি নি যে তোমায় আমি কতটা পছন্দ করি?"
মিরেলে সামনে ঝুঁকে এলো।
"কিন্তু
আমি তোমাকে চিনি, ডেরেক। আমার দিকে তাকাও? - দেখো, এটা মিরেলে তোমার সাথে কথা বলছে। তাকে ছাড়া তুমি বাঁচবে না, তুমি
নিজেই জানো। তোমায় আমি আগেও ভালোবাসতাম, এখন আরো শতগুন বেশি
ভালোবাসবো। তোমার জীবন আমি অপরূপ বানিয়ে দেব - অপরূপ। মিরেলের মতো আর কেউ
নেই।" ডেরেকের চোখে চোখ রেখে তার চোখগুলো যেন জ্বলছিল। সে দেখলো ডেরেক কেমন যেন
ফেকাসে হয়ে গেলো, নিজের নিঃস্বাস যেন আরো গুটিয়ে নিলো,
এবং তাই দেখে, সে নিজের মনে আত্মতুষ্টির হাসি
হাসতে লাগলো। সে পুরুষদের ওপর নিজের জাদু এবং তার ক্ষমতা জানে।
"সব
মিটমাট হয়ে গেলো," সে মিষ্টি করে বললো, আর একটা ছোট্ট হাসি দিলো। "তাহলে এবার কি আমার সাথে লাঞ্চ করবে,
ডেরেক?"
"না।"
ডেরেক একটা লম্বা স্বাস
টেনে উঠে দাঁড়ালো।
"আমি
দুঃখিত, তোমায় বলেছি - আমার একটা কাজ আছে।"
"তুমি
কি অন্য কারো সাথে লাঞ্চ করবে? বাহ্! আমি বিশ্বাস করি
না।"
"আমি
ওই যে ওই মহিলার সাথে লাঞ্চ করবো।"
সে তাড়াতাড়ি সাদা পোশাক
পড়া যে মহিলা সিঁড়ি দিয়ে উঠছিলেন তাঁর দিকে এগিয়ে গেলো। সে তাঁকে দমবন্ধ করে
জিজ্ঞেস করলো।
"মিস
গ্রে, আপনি কি - আপনি কি আমার সাথে লাঞ্চ করবেন? মনে আছে, আপনি আমাকে লেডি ট্যাম্পলিংয়ের বাড়িতে
দেখেছিলেন।"
ক্যাথেরিন তার দিকে
চিন্তান্বিত ধূসর চোখ দুটো - যা অনেক কিছু বলে, তুলে মিনিট
খানেকের মতো তাকিয়ে থাকলো।
"ধন্যবাদ,"
সে কিছুক্ষন থেমে বললো, "আমার খুবই ভালো
লাগবে।"
চ্যাপ্টার ১৯
এক অপ্রত্যাশিত
অতিথি
কমতে ডে লা রোচে সবে তার
লাঞ্চটা শেষ করেছে,
আজ লাঞ্চে ছিল একটি অমলেট ফাইন্স হার্বস, একটি এন্ট্রেকোট বের্নেইস এবং একটি সাভারিন অ রাম। খুব সাবধানে তার নিখুঁত
কালো গোঁফটা একটা টেবিল ন্যাপকিন দিয়ে মুছতে মুছতে, কমতে টেবিল থেকে উঠে দাঁড়ালো। সে ভিলার বৈঠকখানার ঘরটা পার হতে হতে সেখানে
এদিক ওদিক ছাড়ানো কয়েকটা শিল্প বস্তুর দিকে তাকাচ্ছিলো এবং এবং প্রশংসার সাথে তাদের
তারিফ করছিলো। লুই ১৫ র নস্যির বাক্স, মারি আঁতিয়োনেতের পড়া
সাটিনের জুতো,
এবং আরো অনেক ছোট ছোট জিনিসপত্র কমতের আসে পাশে ছাড়ানো ছিল।
সেগুলো, সে তার সুন্দরী অতিথিদের কাছে, উত্তরাধিকার সূত্রে পাওয়া
সম্পত্তি বলে চালাবে। ছাদে উঠে, সে অন্ধের মতো
ভূমধ্যসাগরের দিকে তাকিয়ে রইলো। এখন আশপাশের দৃশ্যের সৌন্দর্য উপভোগ করার মতো
মেজাজে সে নেই। একটা পুরোপুরি পেকে ওঠা পরিকল্পনা খুব রুক্ষভাবে শুন্যতে পরিণত
হয়েছে, এখন আবার নতুন উপায় খুঁজতে হবে। তার সাদা আঙ্গুলগুলোর ফাঁকে একটা সিগারেট ধরে, একটা বাস্কেট চেয়ারে হাত পা ছড়িয়ে বসে, সে গভীর চিন্তায় ডুবে
গেলো।
হিপ্পোলাইতে, তার চাকর,
কফি এবং কিছু পছন্দের পানীয় নিয়ে এলো। কমতে কয়েকটা বেশ
পুরোনো উত্তম মানের ব্র্যান্ডি নির্বাচন করল।
চাকরটি যখন চলে যাচ্ছিলো, কমতে তাকে একটা ইশারায় দাঁড়াতে বললো। হিপ্পোলাইতে সসম্মানে উদগ্রীব হয়ে
দাঁড়ালো। তার চেহারা খুব একটা আকর্ষণীয় না হলেও, তার সরল সাধাসিধা আচরণ সেটা অনায়াসেই ঢেকে দেয়।
সে এখন সসম্ভ্রম মনোযোগের
একটা ছবি।
"সম্ভবত," কমতে বললো,
"সামনের কয়েক দিনে বেশ কিছু অপরিচিত লোকজন বাড়িতে আসতে
পারেন। তাঁরা তোমার এবং মারিয়ের সাথে ভাব জমানোর চেষ্টা করতে পারেন। তাঁরা হয়তো
তোমাকে আমার সম্পর্কে অনেক রকম প্রশ্ন করবেন।
"আচ্ছা, মসিয়েঁ কমতে।"
"এসব বোধহয় এর
মধ্যেই হয়ে গেছে?"
"না, মসিয়েঁ কমতে।"
"এখানে কোনো অচেনা
লোকজন আসে নি?
তুমি নিশ্চিত?"
"এখানে কেউ আসে নি, মসিয়েঁ কমতে।"
"তাহলে ভালো," কমতে শুকনোভাবে বললো,
"তবে,
তাঁরা আসবেনই - এ ব্যাপারে আমি নিশ্চিত। তাঁরা প্রশ্ন
করবেন।"
হিপ্পোলাইতে তার মনিবের
দিকে কোনো নির্দেশের প্রত্যাশা নিয়ে তাকালো।
কমতে, হিপ্পোলাইতের দিকে না তাকিয়ে, ধীরে ধীরে বলতে থাকলেন।
"তুমি জানো, আমি এখানে গত মঙ্গলবার সকালে পৌঁছেছি। যদি পুলিশ বা অন্য কোনো অনুসন্ধানী
প্রশ্ন করে এই কথা কিন্তু ভুল না। আমি ১৪ তারিখ, মঙ্গলবার পৌঁছেছি - ১৫ তারিখ বুধবার নয়। বুঝেছো?"
"নিখুঁতভাবে, মসিয়েঁ কমতে।"
"এমন একটা ঘটনা
যেখানে একজন মহিলা জড়িত,
সেখানে সবসময় বিচক্ষণতার সাথে চলা উচিত। আমি নিশ্চিত, হিপ্পোলাইতে তুমি একজন
দায়িত্ববান ব্যাক্তি।"
"আমি যথেষ্ট
দায়িত্ববান,
মসিয়েঁ।"
"আর মারিয়ে?"
"মারিয়েও। আমি তার
হয়ে উত্তর দেব।"
"তাহলে ঠিকই আছে," কমতে বিড়বিড় করে বললো।
হিপ্পোলাইতে চলে গেলে, প্রতিফলিত হাওয়ায় বসে কমতে তার কালো কফি তে চুমুক দিতে লাগলো। মাঝে মাঝেই তার
ভুরু কুঁচকে যেতে লাগলো,
একবার সে মাথাটা অল্প নাড়ালো, তারপর আবার দু বার নাড়ালো - এইসব চিন্তা ভাবনার মাঝেই হিপ্পোলাইতে আবার ফিরে
এলো।
"একজন মহিলা, মসিয়েঁ।"
"একজন মহিলা?"
কমতে অবাক হলো। ভিলা
মারিনাতে কোনো মহিলার আসা খুব একটা অস্বাভাবিক কিছু নয়, কিন্তু এই মুহূর্তে,
কমতে ভেবে উঠতে পারলো না, কোন মহিলা আসতে পারেন।
"উনি, বোধহয়,
মসিয়েঁর পরিচিত কেউ নন।" খানসামাটি বিড়বিড় করে বললো।
কমতে আরো বেশি উদগ্রীব
হয়ে পড়লো।
"তাঁকে এখানে নিয়ে
এস, হিপ্পোলাইতে" সে নির্দেশ দিলো।
কিছুক্ষন পরে কমলা এবং
কালো পোশাকে সজ্জিত এক অপরূপা সুন্দরী ছাদে এসে দাঁড়ালো, এবং তার সঙ্গী হয়ে এলো একটি চমৎকার ফুলের উগ্র সুগন্ধ।
"মসিয়েঁ কমতে ডে লা
রোচে?"
"আপনার সেবায়
নিয়োজিত,
মাদমোয়েজেল," কমতে,
একটা বাও করে বললো।
"আমার নাম, মিরেলে। আপনি হয়তো আমার কথা শুনে থাকবেন।"
"আঃ, অবশ্যই,
মাদমোয়েজেল, মাদমোয়েজেল মিরেলের নাচ
কাকে না মুগ্ধ করেছে?
অসাধারণ।"
নৃত্যশিল্পীটি তার
প্রশংসাটা একটা ছোট যান্ত্রিক ছোট হাসির সাথে স্বীকার করলো।
"আমি আপনার কাছে কোন
লৌকিকতা করতে আসি নি,"
সে বলতে শুরু করলো।
"দয়া করে বসুন, আমি আপনাকে অনুরোধ করছি, মাদমোয়েজেল," কমতে একটু চেঁচিয়ে বলে,
একটা চেয়ার এগিয়ে দিলো।
তার মর্যাদাপূর্ণ আচরণ
সত্ত্বেও কমতে কিন্তু তাকে খুব সূক্ষ্মভাবে লক্ষ করে যাচ্ছিলো। মহিলাদের ব্যাপারে
খুব কম জিনিসই আছে যা কমতে জানে না। একথা সত্যি, যে মিরেলের মতো মহিলাদের ব্যাপারে, যারা নিজেরাই শিকারী, তার খুব একটা অভিজ্ঞতা নেই। সে এবং নৃত্যশিল্পীটি, এক ভাবে বলতে গেলে,
একই পাখির পালক। সে জানে, তার ছলা কলা,
মিরেলের ওপর কোনো কাজই করবে না। সে একজন প্যারিস নিবাসী, এবং অত্যন্ত চতুর। যাইহোক, একটা জিনিস লক্ষ্য করা
মাত্র কমতে সেটা নিশ্চিত ভাবেই চিনতে পারলো। সে তক্ষুনি বুঝতে পারলো যে সে একজন
ক্রুদ্ধ মহিলার সামনে আছে,
আর একজন ক্রুদ্ধ মহিলা, কমতে খুব ভালো করে জানে, যতটা প্রয়োজন তার থেকে অনেক বেশি কথা বলে, আর তারা মাঝে মাঝে ঠান্ডা
মাথার ভদ্রলোকেদের লাভের উৎসও হয়।
"আপনার অশেষ করুনা, মাদমোয়েজেল,
যে আজ আমার গরীবখানা এভাবে ধন্য হলো।"
"প্যারিসে আমাদের
পারস্পরিক বন্ধু আছে,"
মিরেলে বললো। "আমি তাদের কাছ থেকেই আপনার ব্যাপারে
জেনেছি, কিন্তু,
আমি আপনার সাথে দেখা করতে এসেছি একটা অন্য কারণে। আমি যবে
থেকে নাইসে এসেছি,
আপনার বিষয়ে শুনেছি - একটু অন্যরকম ভাবে, নিশ্চই বুঝতে পারছেন।
"আঃ," কমতে নরমভাবে বললো।
"আমি নির্দয় ভাবে বলছি," নৃত্যশিল্পীটি বলতে থাকলো, "যদিও, বিশ্বাস করুন মনে মনে আমি আপনার একজন শুভাকাঙ্খী। নাইসে লোকজন বলাবলি করছে, মসিয়েঁ কমতে,
আপনি একজন ইংরেজ মহিলা, মাদাম কেটারিংয়ের, হত্যাকারী।"
"আমি - মাদাম
কেটারিংয়ের হত্যাকারী?
যাঃ! কি অবাস্তব!"
সে উত্তেজিত না হয়ে উদাসভাবে
বলতে থাকলো,
একথা জেনেও যে এতে মিরেলে আরো উত্তেজিত হয়ে উঠবে।
"হ্যাঁ কিন্তু," সে জোর দিয়ে বললো,
"এটাই রটছে, যা আপনাকে বললাম।"
"লোকেরা বলে আনন্দ
পায়,"
কমতে উদাসীনভাবে বিড়বিড় করে বললো, "এই ধরণের ফালতু অভিযোগে গুরুত্ব দেওয়াটা আমার জন্য অযৌক্তিক হবে।"
"আপনি বুঝতে পারছেন
না।" মিরেলে সামনে ঝুঁকে এলো, তার চোখ দুটো জ্বলছিল, "এটা কোনো রাস্তার লোকের ফালতু কথা না, এটা পুলিশের কথা।"
"পুলিশ - আঃ?"
কমতে আর একবার সতর্ক হয়ে, সোজা হয়ে বসলো।
মিরেলে ঘন ঘন জোরে জোরে
মাথা নাড়াতে লাগলো।
"হ্যাঁ, হ্যাঁ,
আপনি আমাকে বিশ্বাস করুন - আমার সবজায়গায় বন্ধু আছে।
আধিকারিক নিজেই -"
বেশ সুন্দর করে কাঁধটা
একবার ঝাকিয়ে,
তিনি কথাটা অসম্পূর্ণ রেখে দিলেন।
"একজন সুন্দরী
মহিলার ব্যাপারে কে আর দায়িত্বজ্ঞানহীনের মতো কাজ করবেন?" কাউন্ট বিনীত ভাবে বিড়বিড় করে বললেন।
"পুলিশ বিশ্বাস করে
আপনি মিসেস কেটারিংকে খুন করেছেন। কিন্তু তারা ঠিক নয়।"
"অবশ্যই তারা ঠিক
নয়।" কমতে সহজেই একমত হলো।
"আপনি একথা বলছেন
বটে, কিন্তু আপনি জানেন না সত্যিটা কি। আমি জানি।"
কমতে কৌতূহলী হয়ে তার
দিকে তাকালো।
"আপনি জানেন মাদাম
কেটারিংকে কে হত্যা করেছে?
আপনি কি একথাই বলছেন, মাদমোয়েজেল?"
মিরেলে তীব্রভাবে মাথা
নাড়াতে লাগলো।
"হ্যাঁ।"
"কে করেছে?" কমতে তীক্ষ্ণভাবে জিজ্ঞেস করলো।
"তাঁর স্বামী।"
তিনি কমতের দিকে ঝুকে এলেন,
একটা নিচু স্বরে যা কিনা রাগে এবং উত্তেজনায় কাঁপছিলো তিনি
বলতে থাকলেন,
"তার স্বামীই তাকে হত্যা করেছে।"
কমতে চেয়ারে হেলান দিয়ে
বসলো, তার মুখটা একটা মুখোশের মতো।
"আপনাকে একটা কথা
জিজ্ঞেস করছি,
মাদমোয়েজেল - আপনি এটা কিভাবে জানতে পারলেন?"
"আমি কিভাবে জানলাম?" মিরেলে হাসতে হাসতে লাফিয়ে উঠে দাঁড়ালো। "সে আগেই বড়াই করে একথা
জানিয়েছিল। সে ধ্বংস হয়ে গিয়েছিলো, দেউলিয়া হয়ে গিয়েছিলো , অসম্মানিত হয়েছিল। একমাত্র তার স্ত্রীর মৃত্যুই তাকে বাঁচাতে পারতো। সে আমাকে
এই কথাই বলেছিলো। সে ওই ট্রেনেই ছিলো - কিন্তু তার স্ত্রী এব্যাপারে জানতো না।
এরকম কেন হবে,
আমি আপনাকে জিজ্ঞেস করছি? এজন্যই যাতে সে চুপি চুপি রাতের বেলা তার স্ত্রীর কম্পার্টমেন্টে ঢুকতে পারে -
আঃ! -" সে তার নিজের চোখ দুটো বন্ধ করে নিলো - "আমি ঘটনাটা ঘটতে দেখতে
পাচ্ছি -"
কাউন্ট কাসলো।
"হতে পারে - হতে
পারে,"
সে বিড়বিড় করে বললো, "কিন্তু তাহলে,
মাদমোয়েজেল, সে নিশ্চিতভাবেই রত্নগুলো
চুরি করতো না?"
"রত্নগুলো! মিরেলে
একটা গভীর স্বাস নিলো। "রত্নগুলো, আঃ! ওই রুবিগুলো
..."
তার চোখ দুটো স্বপ্নময়
হয়ে গেলো,
সেদুটোর মধ্যে যেন একটা দূরের আলো দেখা যাচ্ছিলো। কমতে তার
দিকে কৌতূহলী চোখে তাকিয়েছিলো, আর শতবার ভেবেও অবাক
হচ্ছিলো এই বহুমূল্য পাথরগুলোর কি অদ্ভুত জাদুকরী প্রভাব মহিলা প্রজাতির ওপর।
"আপনি আমাকে কি করতে
বলেন, মাদমোয়েজেল?"
মিরেলে আবার সতর্ক এবং
বাবসায়ীসুলভ হয়ে উঠলো।
"নিশ্চই, খুবই সহজ। আপনি পুলিশের কাছে যাবেন। আপনি তাদের জানাবেন মসিয়েঁ কেটারিংই এই
অপরাধটা করেছেন।"
"আর তাঁরা যদি আমাকে
বিশ্বাস না করেন?
তাঁরা যদি প্রমান চান?" সে তাকে খুব ভালোভাবে নিরীক্ষণ করছিলো।
মিরেলে আলগোছে হেসে উঠলো, এবং তার কমলা কালো ওড়নাটা গায়ে আরেকটু জড়িয়ে নিলো।
"তাঁদের আমার কাছে
পাঠিয়ে দেবেন মসিয়েঁ কমতে,"
সে মোলায়েমভাবে বললো, "আমি তাঁদের যা প্রমান প্রয়োজন দেব।"
এরপর, একটা দুরন্ত ঘূর্ণিঝড়ের মতো, সে চলে গেলো, তার কাজ হয়ে গিয়েছে।
কমতে তার চলে যাওয়ার দিকে
তাকিয়ে ছিল,
তার ভুরুগুলো খুব সূক্ষ্ণভাবে উঠে গিয়েছিলো।
"উনি ভয়ানক খেপে
আছেন,"
সে বিড়বিড় করে বললো, "কি এমন ঘটেছে যাতে উনি এতো বিচলিত? কিন্তু উনি ওনার হাত
পুরোপুরি দেখিয়ে দিলেন। উনি কি সত্যি বিশ্বাস করেন যে মসিয়েঁ কেটারিংই তাঁর স্ত্রীকে
খুন করেছে?
উনি আমাকে এটা বিশ্বাস করাতে চান। উনি এমনকি পুলিশকেও এটা
বিশ্বাস করাতে চান।"
সে নিজের মনেই হাসলো।
পুলিশের কাছে যাওয়ার তার কোনোরকম কোনো ইচ্ছা নেই। সে আরো অনেক রকম সম্ভবনা দেখতে পাচ্ছে; তার হাসি দেখে বোঝা যায়, যে সে সেগুলোর সম্ভাব্য
প্রীতিকর দৃশ্য দেখতে পাচ্ছে।
এই মুহূর্তে, যদিও তার ভুরু দুটি কুঁচকে আছে। মিরেলের কথা অনুযায়ী পুলিশ তাকে সন্দেহ করছে।
এটা সত্যি হতেও পারে আবার নাও হতে পারে।
একজন ক্রুদ্ধ মহিলা, তার উপর আবার নৃত্যশিল্পী গোত্রের, তার কথার সত্যতা নিয়ে
বেশি চিন্তা করার প্রয়োজন নেই। অন্যদিকে ভেতরের খবরাখবর জানতে পারা তার পক্ষে খুবই
সহজ।
সেক্ষেত্রে - তার মুখটা
গম্ভীর মতো হয়ে গেলো - সেক্ষেত্রে তার কিছু সাবধানতা প্রয়োজন।
সে বাড়ির ভেতরে গেলো এবং
হিপ্পোলাইতেকে আর একবার ঘনিষ্ঠভাবে প্রশ্ন করলো যে কোনো অচেনা লোক বাড়িতে এসেছিলো
কিনা। খানসামাটি খুব ইতিবাচক ভাবে আশ্বাস দিলো যে এমন কোনো ঘটনা ঘটে নি। কমতে তার
শোবার ঘরে ঢুকে দেয়ালের ধরে রাখা একটা দেরাজওয়ালা টেবিলের কাছে গিয়ে দাঁড়ালো। সে
তার ঢাকনাটা সরালো,
এবং তার সূক্ষ্ণ আঙ্গুলগুলো একটা পায়রার খোপের মধ্যে একটা
স্প্রিঙের খোঁজ করতে লাগলো।
একটা গোপন ড্রয়ার খুলে
গেলো; তার ভেতরে একটা ছোট ব্রাউন পেপারে মোরা বাক্স ছিল। কমতে সেটা বের করে আনলো এবং
দু এক মিনিটের জন্য সাবধানে নিজের হাতে ওজনটা অনুভব করার চেষ্টা করলো। মাথায় হাত
দিয়ে, একটু মুখ বিকৃতির সঙ্গে সে নিজের একটা চুল ছিঁড়ে আনলো। সে সেটা ড্রয়ারের একটা
ধারের ওপরে রেখে খুব সাবধানে ড্রয়ারটা বন্ধ করলো। ছোট বাক্সটা তখন তার হাতে, সে সেটা নিয়ে নিচের দিকে চললো এবং বাড়ি থেকে বেরিয়ে গ্যারাজে ঢুকলো, যেখানে একটা উজ্জ্বল লাল রঙের দু সিটের গাড়ি দাঁড়িয়ে ছিল। দশ মিনিট পরে সে
মন্টে কার্লোর রাস্তা ধরলো।
সে কয়েক ঘন্টা ক্যাসিনোতে
কাটালো, তারপর শহরে ঢুকলো। তখনি, সে আবার গাড়িতে বসে
মেনটনের দিকে রওনা দিলো। আগে দুপুরবেলা সে নিজের থেকে কিছুটা দূরে একটা ধূসর রঙের
সন্দেহজনক গাড়িকে লক্ষ্য করেছিল। সে এখন আবার সেটা লক্ষ্য করলো। সে নিজের মনেই
হাসলো। রাস্তাটা ধীরে ধীরে চড়াই হয়ে উঠছে। কমতে পা দিয়ে অ্যাকসিলেটরটা জোরে চেপে
ধরলো। ছোট লাল গাড়িটা কমতের নকশা অনুযায়ী বিশেষভাবে বানানো হয়েছে, আর দেখে যা মনে হয় এতে তার থেকেও অনেক বেশী শক্তিশালী ইঞ্জিন আছে। সেটা বেশ
গতির সঙ্গে এগিয়ে গেলো।
এই মুহূর্তে সে পেছনে
ফিরে তাকালো এবং হাসলো;
ধূসর রঙের গাড়িটা পেছনে ফলো করছে। ধুলো উড়িয়ে ছোট লাল
গাড়িটা রাস্তা ধরে ছুটে চললো। সেটা এখন ভয়ানক বেগে চলছে, কিন্তু কমতে প্রথম শ্রেণীর ড্রাইভার।
এবার তারা উতরাইয়ে নামছে, অবিরত এঁকে বেঁকে। এই মুহূর্তে গাড়িটির গতি কমে এসেছে, শেষ পর্যন্ত সেটা একটা ডাকঘরের সামনে এসে থামলো। কমতে গাড়ি থেকে লাফিয়ে নামলো, যন্ত্রপাতির বাক্সটার ঢাকনা খুললো, এবং ব্রাউন পেপারের
বাক্সটা নিয়ে দৌড়ে ডাকঘরে ঢুকে গেলো। দু মিনিট পরে সে আবার গাড়িটা ড্রাইভ করে
মেনটনের দিকে চললো। ধূসর রঙের গাড়িটা যখন পৌঁছলো, কমতে তখন একটা হোটেলের ছাদে বসে ইংলিশ রীতি অনুযায়ী ৫ টার চা পান করছিলো।
পরে, সে আবার মন্টে কার্লোতে ফিরে গেলো, সেখানে ডিনার করলো, এবং আবার বাড়ি ফিরতে ফিরতে প্রায় এগারোটা বেজে গেলো। হিপ্পোলাইতে উৎকণ্ঠিত
মুখে তার সঙ্গে দেখা করার জন্য বেরিয়ে এলো।
"আঃ! মঁসিয়ে কমতে
ফিরে এসেছেন। মঁসিয়ে কমতে কি আমাকে টেলিফোন করার কোনো চেষ্টা করেছিলেন?"
কমতে মাথা নাড়লেন।
"তবুও তিনটের সময়
আমি মঁসিয়ে কমতের কাছ থেকে নির্দেশ পাই তাঁর সঙ্গে নাইসে, নেগ্রেসকোতে দেখা করার জন্য।"
"সত্যি," কমতে বললো,
"আর তুমি গেলে?"
"অবশ্যই, মঁসিয়ে,
কিন্তু নেগ্রেসকোতে মঁসিয়ে কমতের ব্যাপারে কেউ কিছু বলতে
পারলো না - তিনি ওখানে যান নি।"
"আঃ!" কমতে
বললো,
"আর সেই সময়ে মারিয়ে নিশ্চই তার দুপুরবেলার বাজার করতে
বেরিয়েছিল?"
"ঠিক তাই, মঁসিয়ে কমতে।"
"আঃ, ঠিক আছে,"
কমতে বললো, "এটা খুব একটা
গুরুত্বপূর্ণ নয়,
একটা ভুল হয়েছে।"
সে নিজের মনেই হাসতে
হাসতে ওপরে গেলো।
সে নিজের ঘরে পৌঁছে, দরজার ছিটকিনি টেনে দিলো এবং তীক্ষ্ণভাবে চারিদিকে দেখতে লাগলো। সবকিছু যেমন
ছিল তেমনি লাগছে। সে বিভিন্ন ড্রয়ার এবং কাপবোর্ড খুললো। তারপর সে নিজে নিজেই মাথা
নাড়ালো।
জিনিসপত্র যেন ঠিক
তেমনভাবেই সাজানো আছে যেমনভাবে সে তাদের রেখেছিলো, কিন্তু না। বোঝাই যাচ্ছে খুব পুঙ্খানুপুঙ্খ ভাবে কিছু খোঁজাখুঁজি করা হয়েছে।
সে আবার দেরাজওয়ালা
টেবিলটার কাছে গেলো এবং লুকোনো স্প্রিঙে চাপ দিলো। ড্রয়ারটা খুলে গেলো, কিন্তু চুলটা সে যেখানে রেখেছিলো সেখানে নেই। সে ঘন ঘন মাথা নাড়াতে লাগলো।
"আমাদের ফরাসি পুলিশ, তারা অসাধারণ,"
সে নিজের মনেই বিড়বিড় করে বলতে লাগলো - "অসাধারণ।
তাদের চোখে ধুলো দেওয়া অসম্ভব।"
চ্যাপ্টার ২০
ক্যাথেরিন একজন
বন্ধু পেলো
পরদিন সকালে ক্যাথেরিন ও
লেনক্স ভিলা মার্গেরিতের ছাদে বসে ছিল। বয়সের পার্থক্য সত্ত্বেও, তাদের মধ্যে একটা বন্ধুত্বের মতো আবহাওয়া তৈরি হয়েছিল। কিন্তু লেনক্সের মতে, ক্যাথেরিনের পক্ষে ভিলা মার্গেরিতের জীবন অসহ্য হয়ে উঠবে। কেটারিংয়ের কেসটাই
এখন আলোচনার মূল বিষয়। লেডি ট্যাম্পলিং অবলীলায় তাঁর অতিথির সঙ্গে এই কেসের যোগকে
কাজে লাগিয়ে যেটুকু সুবিধা পাওয়া যায় তাই নিচ্ছেন।
বার বার প্রতিবাদ করেও
ক্যাথেরিন লেডি ট্যাম্পলিংয়ের আত্ম-সম্মানে সামান্য আঁচড়ও কাটতে পারে নি। লেনক্স
একটু ছাড়া ছাড়া মনোভাব নিয়ে চলছে, তার মায়ের কার্যকলাপে সে বেশ
মজা পাচ্ছে,
আবার ক্যাথেরিনের মনভাবটাও সহানুভূতির সঙ্গে বিবেচনা করছে।
এই পরিস্থিতে ছুব্বিও কোনো
উপকারে আসছে না,
তার অনির্বান সরল আনন্দ মেটানো অসাধ্যকর, সে বিভিন্ন লোকেদের কাছে এই বলে ক্যাথেরিনের পরিচয় করাচ্ছে যে:
"ইনি মিস গ্রে। আপনি
কি ওই দ্যা ব্লু ট্রেনের ঘটনাটা জানেন? ইনি ওই ঘটনাতে ওতপ্রোত
ভাবে জড়িয়ে ছিলেন! খুনের কয়েক ঘন্টা আগেই ওনার রুথ কেটারিংয়ের সাথে লম্বা
কথাবার্তা হয়েছে! সবই ভাগ্যের ব্যাপার, কি বলেন!"
এই ধরণের বিভিন্ন মন্তব্য
কাথেরিনকে বাধ্য করেছে আজ সকালে কিছু কর্কশ প্রত্যুত্তর দিতে, আর তারা দুজনে ছাড়া আশেপাশে যখন অন্য কেউ নেই তখন লেনক্স ধীরে ধীরে কথা বলতে
বলতে তাকে লক্ষ্য করতে থাকলো:
"আগে কখনো কেউ
আপনাকে নিজের সুবিধার জন্য ব্যবহার করে নি, তাই না? আপনাকে অনেক কিছু শিখতে হবে, ক্যাথেরিন।"
"আমি দুঃখিত, আমি মেজাজ হারিয়ে ফেলেছিলাম। আমি, সাধারণত, হারাই না।"
"এখন আপনাকে মাথা
ঠান্ডা রাখার পদ্ধতি শিখতে হবে। ছুব্বি তো একটা গাধা; ও কোনো ক্ষতি করবে না। মা, যদিও, চেষ্টা করছে,
আপনি মার ওপর যতদূর সম্ভব ততদূর অবধি মেজাজ হারাতে পারেন, কিন্তু তাতে ওঁর ওপর কোনো প্রভাব পড়বে না। উনি বড়ো বড়ো নীল দুঃখী দুঃখী চোখ
তুলে আপনার দিকে তাকাবেন,
কিন্তু আপনার, এক বিন্দুও পরোয়া করবেন
না।"
ক্যাথেরিন এই কন্যাচিত
মন্ত্যব্যের কোনো উত্তর দিলো না, আর লেনক্স বকে চললো:
"আমিও অনেকটা
ছুব্বির মতো। একটা সুন্দর হত্যাকাণ্ডে আনন্দ পাই, আর, তাছাড়া - কি বলবো,
ডেরেকের সাথে পরিচিতি তো একটা পার্থক্য তৈরী করে।"
ক্যাথেরিন মাথা নাড়লো।
"গতকাল আপনি ওনার
সাথে লাঞ্চ করেছিলেন,"
লেনক্স মনে পড়তে প্রশ্ন করলো।
"আপনি কি ওনাকে
পছন্দ করেন,
ক্যাথেরিন?"
ক্যাথেরিন দু এক মিনিট
চিন্তা করলো।
"জানি না," সে খুব আস্তে আস্তে বললো।
"উনি খুবই
আকর্ষণীয়।"
"হ্যাঁ, উনি আকর্ষণীয়।"
"ওনার কোন ব্যাপারটা
আপনার পছন্দ হয় নি?"
ক্যাথেরিন প্রশ্নটার
উত্তর দিলো না,
বা সরাসরিও কিছু বললো না।
"উনি ওনার স্ত্রীর
মৃত্যুর ব্যাপারে কথা বলছিলেন," সে বললো। "উনি বললেন
যে উনি কোনো ভনিতা ছাড়াই বলতে পারেন যে এটা ওনার কাছে একটা দুর্দান্ত ভাগ্যোদয়ের
সুযোগ ছাড়া আর কিচ্ছুটি নয়।"
"আর এটাই আপনাকে
হতবাক করেছে,
মনে হয়," লেনক্স বললো। সে কিছুক্ষন
থামলো, আর তারপর একটা অদ্ভুত গলায় বলতে থাকলো, "উনি আপনাকে পছন্দ করেন,
ক্যাথেরিন।"
"উনি আমাকে খুব ভালো
লাঞ্চ খাইয়েছেন,"
ক্যাথেরিন হাসতে হাসতে বললো।
লেনক্স কিন্তু প্রসঙ্গ
বদলাতে চাইলো না।
"যেদিন উনি এখানে
এসেছিলেন আমি সেই রাত্রেই দেখেছিলাম," সে চিন্তান্বিত হয়ে বলতে থাকলো, "উনি যেভাবে আপনার দিকে তাকাচ্ছিলেন, উনি সাধারণত যে ধরণের
মহিলাদের সাথে মেসেন,
আপনি তা নন - বরং একেবারে উল্টো। ভালো ব্যাপার, এটা অনেকটা ধর্ম কর্মের মতো - একটা বয়সের পরে এসেই যায়।"
"মাদমোয়েজেলের
টেলিফোন,"
বৈঠকখানার জানলায় এসে, মারিয়ে বললো, "মসিয়েঁ এরকুল পোয়ারো আপনার সাথে কথা বলতে চান।"
"আরো নতুন নতুন
চাঞ্চ্যল্যকর ঘটনা। যান,
ক্যাথেরিন, যান আপনার গোয়েন্দার সাথে
সময় কাটিয়ে আসুন।"
মসিয়েঁ এরকুল পোয়ারোর
গলার স্বর খুব পরিস্কারভাবেই ক্যাথেরিনের কানে পৌঁছোচ্ছিলো।
"আপনি কি মাদমোয়েজেল
গ্রে বলছেন?
মাদমোয়েজেল, আপনাকে আমি মসিয়েঁ ভ্যান
আলদীনের,
মানে মাদাম কেটারিংয়ের বাবার একটা বার্তা আপনাকে দিতে চাই।
উনি আপনার সাথে একটু কথা বলতে চান, সেটা ভিলা মার্গেরিতে
অথবা ওনার হোটেলে,
যেখানে আপনার সুবিধা সেখানেই হতে পারে।
ক্যাথেরিন কিছুক্ষন
চিন্তা করলো,
তার মনে হলো ভ্যান আলদীনের পক্ষে ভিলা মার্গেরিতে তে আসা
কষ্টকর এবং অপ্রয়োজনীয় দুটোই। লেডি ট্যাম্পলিং যদিও এই আগমনকে উচ্ছাসের সাথে
নিতেন। একজন কোটিপতির সাথে আলাপের সুযোগ উনি কিছুতেই হাতছাড়া করতেন না। সে
পোয়ারোকে জানালো,
যে সেই বরং নাইসে আসবে।
"অসাধারণ, মাদমোয়েজেল। আমি নিজেই একটা গাড়িতে করে আপনাকে নিয়ে আসবো। আমরা কি পৌনে এক
ঘন্টার মধ্যে রওয়ানা হতে পারি?"
পোয়ারো একদম ঠিক সময়
হাজির হলেন। ক্যাথেরিন তাঁর জন্য অপেক্ষা করছিলো, তিনি আসতেই গাড়িতে উঠে রওয়ানা দিলো।
"তারপর, মাদমোয়েজেল,
সব কেমন চলছে?"
সে ওনার ঝিকিমিকি করা
চোখের দিকে চাইলো,
এবং তার প্রথম উপলদ্ধিতেই বুঝতে পারলো যে মসিয়েঁ এরকুল পোয়ারোর
মধ্যে একটা দুর্দান্ত আকর্ষণীয় ব্যাপার আছে।
"এটা আমাদের নিজস্ব
গোয়েন্দা উপন্যাস,
তাই না?" পোয়ারো বললেন। "আমি
আপনাকে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলাম যে এটা আমরা দুজনে একসাথে পড়বো। আর আমাকে - আমি
সবসময় আমার প্রতিশ্রুতি রক্ষা করি।"
"আপনার অশেষ করুণা," ক্যাথেরিন বিড়বিড় করে বললো।
"আরে, আপনি আমাকে নিয়ে মস্করা করছেন; কিন্তু আপনি এই কেসের
অগ্রগতির বিষয়ে নিশ্চই জানতে চান, চান না বলুন?"
ক্যাথেরিন স্বীকার করলো
যে সে জানতে চায়,
আর পোয়ারো তার সামনে সংক্ষেপে কমতে ডে লা রোচের একটা
প্রতিকৃতি আঁকার প্রচেষ্টা করতে লাগলেন।
"আপনার কি মনে হয়
উনিই ওনাকে খুন করেছেন?"
ক্যাথেরিন চিন্তান্বিত ভাবে জিজ্ঞেস করলো।
"এটা একটা
ধারণা।" পোয়ারো সাবধানে বললেন।
"আপনি নিজে এটা
বিশ্বাস করেন?"
"আমি সেকথা বলি নি। আর আপনি, মাদমোয়েজেল, আপনার কি মনে হয়?"
ক্যাথেরিন তার মাথা
নাড়লো।
"আমি কি করে জানবো? আমি এসব ব্যাপারে কিছুই জানি না। কিন্তু আমি একথা বলবো যে -"
"হ্যাঁ," পোয়ারো উৎসাহিত হয়ে বললেন।
"মানে - আপনি যা
বললেন তাতে কাউন্টকে সেই ধরণের লোক বলে মনে হলো না যারা সত্যি সত্যি কাউকে খুন
করতে পারে।"
আঃ! খুব ভালো," পোয়ারো চিৎকার করে বললেন, "আপনি আমার সাথে একমত, আমিও এই কথাটাই বলেছি।"
তিঁনি তার দিকে
তীক্ষ্ণভাবে দেখতে থাকলেন। "কিন্তু একটা কথা বলুন, আপনার সাথে কি ডেরেক কেটারিংয়ের আলাপ হয়েছে?"
"আমার সাথে ওনার
লেডি ট্যাম্পলিংয়ের বাড়িতে আলাপ হয়েছে, আর গতকাল আমি ওনার সাথে
লাঞ্চ করেছি।"
"যদিও একটা
অস্বস্তিকর বিষয়,"
পোয়ারো মাথা নাড়তে নাড়তে বললেন, "কিন্তু মহিলারা - তাঁরা ওনাকে পছন্দ করে, তাই না?"
তিনি ক্যাথেরিনের দিকে
চোখ পিটপিট করলেন এবং সে হাসলো।
"উনি এমন একজন মানুষ
যাঁকে যেকোনো জায়গাতেই চোখে পড়বে," পোয়ারো বলতে থাকলেন, "নিঃসন্দেহে আপনি ওনাকে দ্যা ব্লু ট্রেনে লক্ষ্য করেছিলেন?"
"হ্যাঁ, আমি ওনাকে দেখেছিলাম।"
"রেস্তোরার কোচে?"
"না, আমি ওনাকে কখনোই খাবার সময় দেখি নি। আমি ওনাকে একবারই দেখেছিলাম - তাঁর
স্ত্রীর কম্পার্টমেন্টে ঢুকতে।"
পোয়ারো ঘাড় নাড়লেন।
"অদ্ভুত ব্যাপার,"
তিঁনি বিড়বিড় করে বললেন, "আপনি মনে হয় বলেছিলেন যে আপনি জেগেই ছিলেন, মাদমোয়েজেল, এবং লিয়োন্সে তে জানলা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে ছিলেন? আপনি কি কমতে ডে লা রোচের মতো কোনো লম্বা শ্যামলা লোককে ট্রেন থেকে নামতে
দেখেন নি?"
ক্যাথেরিন তার মাথা নাড়লো, "আমার মনে হয় না,
আমি ঐরকম কাউকে দেখেছি বলে," সে বললো। "টুপি এবং ওভারকোট পড়া একজন অল্পবয়স্ক ছেলে ট্রেন থেকে নেমেছিল, কিন্তু সে নেমে চলে যায় নি, প্লাটফর্মে পায়চারি
করছিলো। পায়জামা এবং ওভারকোট পড়া একজন দাড়িওয়ালা মোটা ফরাসি ভদ্রলোক ছিল, যে নাকি এক কাপ কফি চাইছিলো। আর এছাড়া শুধুমাত্র ট্রেন অ্যাটেনডেন্টরাই ছিল।"
পোয়ারো বেশ কয়েকবার তাঁর
মাথা নাড়ালেন। "শুনুন,
ব্যাপারটা হলো," তিঁনি গোপনীয় ভাবে বলতে থাকলেন, "কমতে ডে লা রোচের একটা অ্যালিবাই আছে। অ্যালিবাই একটা জঘন্য ব্যাপার, আর সবসময়ে একটা গভীর সন্দেহ তৈরি করে। কিন্তু আমরা পৌঁছে গেছি!"
তারা সরাসরি ভ্যান
আলদীনের সুইটে গেলো,
সেখানে নাইটোনের সাথে তাদের দেখা হলো। কিছু সাধারণ
কথাবার্তার পর নাইটোন বললো "আমি মিস্টার ভ্যান আলদীনকে জানাচ্ছি যে মিস গ্রে
এসেছেন।"
সে দ্বিতীয় একটা দরজা
দিয়ে পাশের ঘরে গেলো। একটা নিচু স্বরে কথাবার্তা শোনা গেলো, আর তারপর ভ্যান আলদীন ঘরে ঢুকলেন এবং ক্যাথেরিনের দিকে হাত বাড়িয়ে এগিয়ে গেলেন, একই সাথে একটা তীক্ষ্ণ অন্তর্ভেদী দৃষ্টিতেও তাকে দেখতে থাকলেন।
"আপনার সাথে আলাপ
করে খুশি হলাম মিস গ্রে,"
তিঁনি খুব সরল ভাবে বললেন। আপনি রুথের ব্যাপারে কি জানাতে
পারেন তা শোনার জন্য আমি উদগ্রীব হয়ে আছি।"
ধনকুবেরটির সহজ সরল
ব্যবহার ক্যাথেরিনের খুবই ভালো লাগলো। তার মনে হলো সে সত্যিকারের একটা শোকের
পরিবেশের মধ্যে আছে,
বাইরে এটার কোনো প্রকাশ না থাকাটা সেটাকে যেন আরো বাস্তব
করে তুলেছে।
তিঁনি একটা চেয়ার টেনে
আনলেন।
"এখানে বসুন, আর আমাকে এই ঘটনার ব্যাপারে সবকিছু বলুন।"
পোয়ারো এবং নাইটোন
বিচক্ষণতার সাথে পাশের একটা ঘরে গেলেন, এবং ক্যাথেরিন ও ভ্যান
আলদীনকে একসাথে একা ছেড়ে দেওয়া হলো। ক্যাথেরিন কোনোরকম কোনো বাধা ছাড়াই নিজের মতো
বলে গেলো। সে খুব সাধারণ ভাবে তার এবং রুথ কেটারিংয়ের মধ্যে যেমন যেমন কথাবার্তা
হয়েছিল তার যতদূর মনে আছে ঠিক তেমন তেমনি বলে গেলো। তিঁনি চুপ করে চেয়ারে হেলান
দিয়ে, এক হাতে চোখ ঢেকে,
তার কথা শুনলেন।
তার যখন শেষ হলো, তিঁনি খুব শান্তভাবে বললেন, "ধন্যবাদ, বাছা।"
তাঁরা দুজনেই দু এক মিনিট
চুপ করে বসে থাকলেন।
ক্যাথেরিনের মনে হলো
সহানুভূতি কথাটা এখানে যথাযোগ্য হবে না। ধনকুবেরটি যখন কথা বলতে শুরু করলেন, তখন একটা অন্য স্বরে তিঁনি বলছিলেন:
"আমি আপনার কাছে
কৃতজ্ঞ, মিস গ্রে। আমার মনে হয় তার জীবনের শেষ কয়েক ঘন্টায় রুথের মনকে শান্ত করার জন্য
আপনি কিছু একটা করেছিলেন। এবার আমি আপনাকে কিছু জিজ্ঞেস করতে চাই। আপনি জানেন -
মসিয়েঁ পোয়ারো আপনাকে বলবেন - আমার বেচারী মেয়েটা কিভাবে একটা বদমাইসের সাথে জড়িয়ে
পড়েছিল। যে লোকটার কথা সে আপনাকে বলেছিলো - যে লোকটার সাথে সে দেখা করতে যাচ্ছিলো।
আপনার বিচার অনুযায়ী,
আপনার কি মনে হয় আপনার সাথে কথা হওয়ার পর তার কি মত
পরিবর্তন হতে পারতো?
আপনার কি মনে হয় সে আবার ফিরে আসতে চেয়েছিলো?"
"সৎভাবে বলতে গেলে
আমি ঠিক বলতে পারবো না। সে নিশ্চিতভাবেই কোনো একটা সিদ্ধান্তে পৌঁছেছিল, এবং তার ফলাফল কল্পনা করে সে প্রফুল্ল হয়ে উঠেছিল।"
"আপনি কি কোনো আভাস
পেয়েছিলেন যে সে ওই অনভিপ্রেত লোকটির সাথে কোথায় দেখা করতে যাচ্ছিলো - প্যারিসে না
হ্যারেসে?
ক্যাথেরিন মাথা নাড়লো।
"সে এব্যাপারে কিছুই
বলে নি।"
"আঃ!" ভ্যান
আলদীন চিন্তান্বিত ভাবে বললেন, "আর এটাই একটা
গুরুত্বপূর্ণ জিনিস। ঠিক আছে, সময়ই বলবে।"
তিঁনি উঠে গেলেন এবং
পাশের ঘরের দরজাটা খুলে দিলেন। পোয়ারো এবং নাইটোন ফিরে এলেন।
ক্যাথেরিন ধনকুবেরটির সাথে
লাঞ্চ করার নিমন্ত্রণ ফিরিয়ে দিলো, এবং নাইটোন তার সাথে নিচে
গিয়ে তাকে অপেক্ষারত গাড়িতে তুলে দিলো।
সে ফিরে এসে পোয়ারো এবং
ভ্যান আলদীনকে গভীর আলোচনায় মগ্ন দেখলো।
"যদি আমরা জানতে
পারতাম,"
ধনকুবেরটি চিন্তিত ভাবে বললেন, "রুথ কি সিদ্ধান্তে পৌঁছেছিল। সেটা আধা ডজনের মধ্যে যেকোনো একটা হতে পারে। সে
হয়তো প্যারিসে ট্রেন থেকে নেমে আমাকে তার করতে পারতো। সে হয়তো ফ্রান্সের দক্ষিণে
যেতে পারতো এবং সেখানে কাউন্টের সাথে দেখা করতে পারতো। আমরা অন্ধকারে - একেবারে
অন্ধকারে। কিন্তু পরিচারিকাটির কথা অনুযায়ী সে কাউন্টকে প্যারিসের স্টেশনে দেখে যুগপৎ
বিস্মিত এবং হতাশ দুটোই হয়েছিল। এটা কোনো আগে থেকে করা পরিকল্পনার অংশ ছিল না -
তুমি আমার সাথে একমত তো,
নাইটোন?"
সেক্রেটারিটি শুরু করলো, "আমাকে ক্ষমা করবেন,
মিস্টার ভ্যান আলদীন, আমি ঠিক শুনছিলাম
না।"
"দিবাস্বপ্ন, নাকি?"
ভ্যান আলদীন বললেন, "তুমি তো ঠিক এমনটা নও। আমার মনে হয় ওই মেয়েটা তোমার মাথা ঘুরিয়ে দিয়েছে।"
নাইটোন লজ্জা পেলো।
"উনি একজন খুবই ভালো
মেয়ে,
" ভ্যান আলদীন চিন্তিত ভাবে বললেন, "খুবই ভালো। তুমি কি ওর চোখ দুটো লক্ষ্য করেছো?"
"যে কোনো পুরুষই," নাইটোন বললো,
"ওঁর চোখ দুটো লক্ষ্য করতে বাধ্য।"
চ্যাপ্টার ২১
টেনিস খেলায়
বেশ কয়েকদিন কেটে গেছে।
এক দিন সকালে ক্যাথেরিন একা একাই হাটতে বেরিয়েছিল, ফিরে এসে দেখলো লেনক্স কিছু একটা কারণে তার দিকে তাকিয়ে হাসছে।
"আপনার তরুণ
ভদ্রলোকটি আপনাকে ফোন করেছিল, ক্যাথেরিন"।
"আমার তরুণ
ভদ্রলোকটি কে?"
"নতুন একজন - রুফুস
ভ্যান আলদীনের সেক্রেটারি। আপনি ওখানেও নিজের একটা ছাপ ফেলেছেন মনে হয়। আপনি একজন গুরতর রকমের হৃদয়
ভঙ্গকারী হয়ে উঠছেন। প্রথমে ডেরেক কেটারিং আর এখন এই তরুণ নাইটোন। মজার ব্যাপারটা
হলো, ওনাকে আমার খুব ভালোভাবে মনে আছে। উনি মায়ের যুদ্ধ কালীন হাসপাতালে ছিলেন, যেটা মা এখানে চালান। আমি তখন আট বছরের বাচ্চা।"
"উনি কি খুব গভীর
ভাবে আহত হয়েছিলেন?"
"পায়ে গুলি
লেগেছিলো,
যদি ঠিকঠাক মনে করার চেষ্টা করি - বেশ খারাপ অবস্থাই ছিল।
ডাক্তাররাও একটু ঘেটে ফেলেছিলেন। ডাক্তারেরা বলেছিলেন ওনাকে খোঁড়াতে হবে না, কিন্তু উনি যখন এখান থেকে যান তখন পুরোপুরি খুঁড়িয়ে চলছিলেন।"
লেডি ট্যাম্পলিং বেরিয়ে
এলেন এবং তাদের সাথে যোগ দিলেন।
"তুমি কি কাথেরিনকে
মেজর নাইটোনের ব্যাপারে বলছিলে?" তিনি জিজ্ঞেস করলেন।
"খুবই ভালো মানুষ! প্রথমে আমি ওনাকে চিনতে পারি নি - এতজন ছিলেন - কিন্তু এখন
সব মনে পরে গেছে।"
"উনি আগে এতটা
গুরুত্বপূর্ণ ছিলেন না যে প্রথমেই মনে পড়বে।" লেনক্স বললো, "এখন যেহেতু উনি একজন আমেরিকান ধনকুবেরের সেক্রেটারি, তাই ব্যাপারটা পুরোপুরি আলাদা।"
"সোনা!" লেডি
ট্যাম্পলিং একটা ভর্ৎসনা করার গলায় বললেন।
"মেজর নাইটোন কি
ব্যাপারে ফোন করেছিলেন?"
ক্যাথেরিন জিজ্ঞেস করলো।
"উনি জিজ্ঞেস করলেন
আপনি কি আজ দুপুরে টেনিস খেলা দেখতে যাবেন। যদি যান, উনি গাড়ি নিয়ে আপনাকে নিতে আসবেন। মা এবং আমি আপনার হয়ে সানন্দে এই প্রস্তাব
স্বীকার করে নিয়েছি। আপনি যখন ধনকুবেরটির সেক্রেটারির সাথে সময় কাটাবেন, তখন আমার সাথে ধনকুবেরটির আলাপ করার সুযোগ করে দিতে পারবেন। ওনার বয়স এখন
প্রায় ষাট বছর,
আন্দাজে, তাই উনি নিশ্চই আমার মতো
একজন অল্পবয়স্ক ভালো মিষ্টি মেয়েকে পছন্দ করবেন।"
"আমি মিস্টার ভ্যান
আলদীনের সাথে দেখা করতে চাই," লেডি ট্যাম্পলিং খুব
আগ্রহের সাথে বললেন। "ওনার সম্পর্কে এতো কথা শোনা যায়। পশ্চিমি দুনিয়ার
সূক্ষ্ণ রুক্ষ চেহারা - " তিনি বলতে থাকলেন - "দুর্দান্ত আকর্ষণীয়," তিনি বিড়বিড় করে বললেন।
"মেজর নাইটোন
কিন্তু খুব নির্দিষ্ট করে বলেছেন, এটা মিস্টার ভ্যান
আলদীনের আমন্ত্রণ।" লেনক্স বললো, "উনি এতবার করে এইকথাটা বললেন যে তাতেই আমি একটা মরা ইঁদুরের গন্ধ পেলাম। আপনি
এবং নাইটোন খুব সুন্দর জুটি হবেন, ক্যাথেরিন। হে সন্তান
সন্ততি, ঈশ্বর আপনাদের আশীর্বাদ করুন।"
ক্যাথেরিন হেসে উঠলো এবং
ওপরে গেলো পোশাক পরিবর্তন করতে।
নাইটোন লাঞ্চের ঠিক পরেই
হাজির হলো এবং লেডি ট্যাম্পলিংয়ের তাকে চিনতে পাড়ার ব্যাপারটা যথেষ্ট পুরুষালি
ভাবে মোকাবিলা করলো।
যখন তারা কানের দিকে
ড্রাইভ করে যাচ্ছিলো সে কাথেরিনকে একটা মন্ত্যব্য করলো: "লেডি ট্যাম্পলিংয়ের
খুব অল্পই পরিবর্তন হয়েছে।"
"আচরনে না চেহারায়?"
"দুটোই। উনি অবশ্যই, মনে হয়,
চল্লিশের বেশ ওপরেই হবেন, কিন্তু তবুও,
এখনো উনি অসাধারণ সুন্দরী একজন মহিলা।"
"ঠিক তাই," ক্যাথেরিন একমত হলো।
"আমি খুব খুশি
হয়েছি আপনি আজ এলেন বলে,"
নাইটোন বলতে থাকলো, "মসিয়েঁ পোয়ারোও ওখানে থাকবেন। কি অসাধারণ একজন বেটে খাটো মানুষ উনি। আপনি কি
ওনাকে ঘনিষ্ঠ ভাবে চেনেন,
মিস গ্রে?"
ক্যাথেরিন তার মাথা
নাড়লো। "এখানে আসার পথে ট্রেনে ওনার সাথে আমার আলাপ হয়েছে। আমি একটা গোয়েন্দা
উপন্যাস পড়ছিলাম,
আর আমি এরকম কিছু একটা বলেছিলাম যে বাস্তবিক জীবনে এসব কিছু
হয় না - অবশ্যই,
আমি জানতাম না উনি কে।"
"উনি একজন অসাধারণ
মানুষ,"
নাইটোন ধীরে ধীরে বললো, "এবং উনি কিছু অসাধারণ কাজকর্ম করেছেন। ওনার মধ্যে একটা প্রতিভা আছে যে কোনো
জিনিসের একদম গোড়ায় পৌঁছনোর, আর একদম শেষ পর্যন্ত কেউ
আন্দাজই করতে পারে না যে উনি আসলে কি চিন্তা করছেন। আমার মনে আছে, আমি ইয়র্কশায়ারের একটা বাড়িতে থাকতাম, আর লেডি ক্লানরাভনের গয়না
চুরি গেছিলো। প্রথমে মনে হয়েছিল এটা
একটা সাধারণ ডাকাতি,
কিন্তু স্থানীয় পুলিশকে ব্যাপারটা ঘোল খাইয়ে দিয়েছিলো। আমি
তাঁদের এরকুল পোয়ারোর সাথে যোগাযোগ করতে বলি, আর বলি যে উনিই একমাত্র
ওনাদের সাহায্য করতে পারবেন, কিন্তু ওনারা স্কটল্যান্ড
ইয়ার্ডের ওপরেই ভরসা রাখেন।
"তারপর কি হলো?" ক্যাথেরিন কৌতূহলী হয়ে প্রশ্ন করলো।
"গয়নাগুলো আর পাওয়া
যায় নি।" নাইটোন শুকনো ভাবে বললো।
"আপনি সত্যি সত্যি
ওনাকে বিশ্বাস করেন?"
"অবশ্যই। কমতে ডে
লা রোচে খুবই চালাক লোক। সে বেশিরভাগ সময়ে এড়িয়ে যেতে পেরেছে। কিন্তু আমার মনে হয় এরকুল পোয়ারো হচ্ছেন তার যোগ্য
প্রতিদ্বন্দ্বী।"
"কমতে ডে লা রোচে," ক্যাথেরিন চিন্তান্বিত ভাবে বললো, "তাহলে আপনি মনে করেন উনিই এই কাজ করেছেন।"
"অবশ্যই।"
নাইটোন তার দিকে অবাক হয়ে তাকালো, "আপনার মনে হয় না?"
"ওঃ হ্যাঁ," ক্যাথেরিন তাড়াতাড়ি বললো, "এটাই, মানে,
যদি না এটা শুধুমাত্র একটা সাধারণ ট্রেন ডাকাতি হয়।"
"হতে পারে, অবশ্যই,"
অপরজন একমত হলো, "কিন্তু আমার মনে হয় কমতে ডে লা রোচেই এক্ষেত্রে সবথেকে ভালোভাবে খাপ
খায়।"
"আর তাছাড়া ওনার
একটা অ্যালিবাই আছে।"
"ওঃ অ্যালিবাই," নাইটোন হেসে উঠলো,
তার মুখটা একটা কিশোরের আকর্ষণীয় হাসি মুখে পরিণত হলো।
"আপনি স্বীকার
করেছেন যে আপনি গোয়েন্দা গল্প পড়েন, মিস গ্রে। আপনি দেখবেন যে
যার কাছে একদম নিখুঁত অ্যালিবাই আছে তার দিকেই সাধারণত গভীর সন্দেহটা যায়।"
"আপনার কি মনে হয়
বাস্তবিক জীবনে এরকমই হয়?"
ক্যাথেরিন হাসতে হাসতে জিজ্ঞেস করলো।
"কেন নয়? গল্প তো বাস্তবের ওপরেই দাঁড়িয়ে থাকে।"
"কিন্তু তার থেকে
অনেক উচ্চতর,"
ক্যাথেরিন প্রস্তাব করলো।
"হতে পারে, যাক গে,
আমি যদি অপরাধী হতাম এরকুল পোয়ারোকে আমার পেছনে মোটেই পছন্দ
করতাম না।"
"আমিও একটুও না," ক্যাথেরিন বললো,
এবং হেসে উঠলো।
পৌঁছে তাদের পোয়ারোর সাথে
দেখা হলো। সেদিন যেহেতু বেশ গরম ছিল তিনি একটা সাদা ডাক স্যুট পরে ছিলেন, তার সাথে বোতামের গর্তে একটা সাদা ক্যামেলিয়া।
"স্বাগতম, মাদমোয়েজেল,"
পোয়ারো বললেন, "আমাকে বেশ ইংরেজদের মতো দেখাচ্ছে, তাই না?"
"আপনাকে চমৎকার
দেখাচ্ছে,"
ক্যাথেরিন সুকৌশলে বললো।
"আপনি আমাকে নিয়ে
মস্করা করেছেন,"
পোয়ারো উদারভাবে বললেন, "কিন্তু যাই হোক,
পোয়ারো বাবাই শেষ হাসিটা হাসেন।"
"মিস্টার ভ্যান
আলদীন কোথায়?"
নাইটোন জিজ্ঞেস করলো।
"উনি আমাদের সাথে
আমাদের সিটে দেখা করবেন। সত্যি কথা বলতে গেলে, বন্ধু, উনি আমার ওপরে খুব একটা খুশি নন। ওঃ, এই আমেরিকানরা - চুপ চাপ, শান্ত ভাবে চিন্তা করা,
এসব এদের মাথায় ঢোকে না! মিস্টার ভ্যান আলদীন চাইছেন আমি
অপরাধীদের পেছনে পেছনে নাইসের গলি ঘুঁজিতে ছুটে বেড়াই।"
"আমিও মনে মনে তাই
ভাবছিলাম এটা খুব একটা খারাপ চিন্তাধারা নয়।" নাইটোন দেখে শুনে বললো।
"এটা আপনার ভুল," পোয়ারো বললেন,
"এইসব ক্ষেত্রে একজনের কর্মশক্তির পরিবর্তে কৌশলের প্রয়োজন
হয়। টেনিসে সবার সাথে দেখা হয়ে যায়। এটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। আঃ, এই যে মিস্টার কেটারিং।"
ডেরেক আচমকাই তাঁদের
সামনে এসে উদয় হলো। তাকে ছন্নছাড়া এবং ক্ষুব্ধ বলে মনে হলো, যেন কোনো একটা কিছু ঘটেছে যাতে সে খুবই বিচলিত। সে এবং নাইটোন দুজনে দুজনকে খুব শীতল ভাবে অভিবাদন করলো।
পোয়ারো একাই যেন এই চাপা
উত্তেজনার ব্যাপারটা খেয়ালই করলেন না । এবং তিনি বেশ প্রফুল্ল ভাবে বকবক করে
সবাইকে স্বচ্ছন্দ করার একটা প্রশংসনীয় প্রচেষ্টা করছিলো। এরজন্য তিনি ছোট ছোট
প্রশংসাও করছিলেন।
"এটা কিন্তু
অসাধারণ একটা ব্যাপার,
মসিয়েঁ কেটারিং, আপনি এতো ভালো ফরাসি
বলেন।" তিনি পর্যবেক্ষণ করে বললেন - "আপনি চাইলে, আপনাকে লোকে একজন ফরাসি পুরুষ বলেও ভুল করতে পারে। একজন ইংরেজের জন্য এটা একটা
বিরল কৃতিত্ব।"
"আহা, আমিও যদি পারতাম,"
ক্যাথেরিন বললো, "আমি জানি আমার ফরাসি যন্ত্রণাদায়ক ভাবে ব্রিটিশ ঘেঁষা।"
তাঁরা তাঁদের সিটের কাছে
পৌঁছলেন এবং যে যার জায়গায় বসলেন, আর প্রায় সঙ্গে সঙ্গে
নাইটোন লক্ষ্য করলো তার নিয়োগকারী কোর্টের ওপর প্রান্ত থেকে তাকে কিছু ইশারা করছেন, এবং তাঁর সঙ্গে কথা বলার জন্য উঠে গেলেন।
"আমার তো এই তরুণ
লোকটিকে বেশ লাগে,"
সেক্রেটারিটি উঠে গেলে, পোয়ারো একটা ঝলমলে হাসির
সাথে বললেন,
"আর আপনার, মাদমোয়েজেল?"
"আমারও ওনাকে বেশ
ভালো লাগে।"
"আর আপনার, মসিয়েঁ কেটারিং?"
কিছু যুৎসই মন্তব্য ডেরেকের
মুখে উঠে এসেছিলো,
কিন্তু সে তাড়াতাড়ি নিজেকে সংযত করলো, বেলজিয়ান ভদ্রলোকের ঝিকিমিকি চোখে সে এমন কিছু একটা দেখেছিলো যা তাকে সঙ্গে
সঙ্গে সাবধান করে দিলো। সে খুব সাবধানে শব্দ চয়ন করে বলতে শুরু করলো
"নাইটোন খুব ভালো
মানুষ,"
সে বললো। কয়েক মুহূর্তের জন্য ক্যাথেরিনের মনে হলো পোয়ারো
যেন আশাহত হলেন।
"উনি আপনার একজন
খুব বড় ভক্ত,
মসিয়েঁ পোয়ারো," সে বললো,
ওনার সম্পর্কে নাইটোন যা যা বলছিলো সেগুলোও সে কিছু কিছু
বললো। তার মজা লাগছিলো এটা দেখে যে বেটে খাটো মানুষটা যেন পাখির মতো হাওয়ায়
ভাসছিলেন,
তাঁর বুক ফুলে উঠছিলো, আর একটা মেকি বিনয়ের ভাব
যা নাকি কাউকেই বোকা বানাতে পারবে না।
"এব্যাপারে আমার
একটা কথা মনে পরে গেলো,
মাদমোয়েজেল, " তিনি হঠাৎ করে বললেন,
"আপনার সাথে আমার একটা ছোট কাজের কথা ছিল, আপনি যখন ট্রেনে ওই দুর্ভাগা মহিলাটির সাথে কথা বলছিলেন, আমার মনে হয়,
আপনার একটা সিগারেট কেস পরে গিয়েছিলো।"
ক্যাথেরিন খুব অবাক হয়ে
গেলো,
"আমার এরকম মনে হয় না," সে বললো। পোয়ারো পকেট থেকে একটা নরম নীল চামড়ার সিগারেট কেস বার করলো, যাতে সোনালী রঙে "K" আদ্যক্ষর টা লেখা ছিল।
"না, এটা আমার নয়।" ক্যাথেরিন বললো।
"আঃ, হাজারবার ক্ষমা প্রার্থনা, এটা নিঃসন্দেহে মাদামের
নিজের। 'K'
নিশ্চয়, কেটারিংয়ের আদ্যক্ষর।
আমাদের সন্দেহ ছিল,
কারণ তাঁর ব্যাগে আরেকটা সিগারেট কেস ছিল, এবং তাঁর দুটো সিগারেট কেস দেখে বেশ অদ্ভুত লাগছিলো।"
তিনি হঠাৎ ডেরেকের দিকে
ঘুরলেন,
"আশাকরি, আপনি নিশ্চই জানেন, এটা আপনার স্ত্রীর কেস কি না?
ডেরেককে দেখে মনে হলো সে খানিকক্ষণের
জন্য হতবাক হয়ে গেছে। সে অল্প তোতলাতে তোতলাতে উত্তর দিলো, "আমার মনে হয়,
আমি - আমি জানি না।"
"কোনোরকম ভাবে, এটা কি আপনার হওয়া সম্ভব?"
"অবশ্যই না। এটা
যদি আমার হতো তাহলে আমার স্ত্রীর কাছে এটার যাওয়া সম্ভবই হতো না।"
পোয়ারোকে যেন অনেক বেশি
খোলামেলা এবং শিশুর মতো মনে হচ্ছিলো।
"আমি ভেবেছিলাম
আপনি যখন আপনার স্ত্রীর কম্পার্টমেন্টে গেছিলেন তখন ওটা ওখানে ফেলে এসেছিলিন," তিনি খোলাখুলি ভাবে ব্যাখ্যা করে বললেন।
"আমি সেখানে যাই
নি। আমি এটা ইতিমধ্যে পুলিশকে প্রায় ডজন খানেক বার বলেছি।"
"হাজার বার ক্ষমা
চাইছি,"
পোয়ারো ক্ষমাপ্রার্থীর মতো বললো। "আসলে, মাদমোয়েজেল,
বলেছিলেন যে উনি আপনাকে ঢুকতে দেখেছিলেন।"
উনি একটু অপ্রস্তুত
অবস্থায় থেমে গেলেন।
ক্যাথেরিন ডেরেকের দিকে
তাকালো। তার মুখটা প্রায় ফেকাসে হয়ে গেছে, কিন্তু সেটা তার কল্পনাও
হতে পারে। তার হাসিটা,
যখন দেখা গেলো, অনেকটাই স্বাভাবিক
লাগছিলো।
"আপনার ভুল হয়েছিল, মিস গ্রে।" সে খুব সহজ ভাবে বললো। "পুলিশ আমাকে যা জানিয়েছে তার
থেকে মনে হয় আমার কম্পার্টমেন্টটা ছিল আমার স্ত্রীর কম্পার্টমেন্টের থেকে একটা বা
দুটো আগে পরে - যদিও আমি সেই সময় এব্যাপারে কিছুই জানতাম না। আপনি হয়তো আমাকে
নিজের কম্পার্টমেন্টে ঢুকতে দেখেছেন। ভ্যান আলদীন এবং নাইটোনকে আসতে দেখেই সে উঠে
দাঁড়ালো।
"আমাকে এখন যেতে
হবে,"
সে ঘোষণা করলো, "কোনো মূল্যেই আমি আমার শশুরমশাই কে সহ্য করতে পারি না।"
ভ্যান আলদীন খুব বিনয়ের
সাথে ক্যাথেরিন কে স্বাগত জানালেন, কিন্তু পরিষ্কার ভাবেই
ওনার মেজাজ কিছুটা রুক্ষ ছিল।
"আপনি টেনিস খেলা
দেখতে বেশ পছন্দ করেন মনে হচ্ছে, মসিয়েঁ পোয়ারো," তিনি গর্জন করে বললেন।
"হ্যাঁ, এটা আমার কাছে বেশ আনন্দদায়ক," পোয়ারো শান্ত ভাবে
চেঁচিয়ে বললো।
"এটা আপনি ফ্রান্সে
আছেন বলে চলে যাচ্ছে,
"ভ্যান আলদীন বললেন, "স্টেটসএ আমরা খুব কঠিন জিনিস দিয়ে তৈরী। ওখানে মনোরঞ্জনের আগে কাজ আসে।"
পোয়ারো কোনো রাগ করলেন না; তার বদলে,
তিনি বিরক্ত ধনকুবেরটির দিকে তাকিয়ে গোপনীয় ভাবে মৃদু, মৃদু হাসতে লাগলেন।
"ক্ষিপ্ত হবেন না, আমি আপনাকে অনুরোধ করছি। সবারই নিজস্ব পদ্ধতি আছে। আমার ক্ষেত্রে, আমি দেখেছি একসাথে মনোরঞ্জন এবং কাজের মিশ্রণই হচ্ছে আনন্দ এবং তৃপ্তিদায়ক।"
তিনি অপর দুজনের দিকে
একবার দেখলেন। তারা নিজেদের মধ্যে কথাবার্তায় ডুবে আছে। পোয়ারো সন্তুষ্টিতে মাথা নাড়ালেন, তারপর ধনকুবেরটির দিকে ঝুঁকলেন, এবং এই সময় নিজের গলার
স্বরটা আরো নিচুতে নামালেন।
"শুধু মনোরঞ্জনের
কারণে আমি এখানে আসি নি,
মসিয়েঁ ভ্যান আলদীন। আমাদের ঠিক উল্টোদিকে অসুস্থ, বৃদ্ধ লোকটাকে দেখুন - যার মুখটা হলদেটে মতো এবং একটা সম্ভ্রান্ত ধরণের দাড়ি
আছে।"
"হ্যাঁ, উনি কে?"
"উনি," পোয়ারো বললেন,
"হচ্ছেন মসিয়েঁ পাপপুলাউস।"
"আচ্ছা, একজন গ্রিক?"
"আপনি যা বললেন -
একজন গ্রিক। উনি প্রাচীন জিনিসপত্রের একজন ব্যাপারী, ওনার সুনাম সারা পৃথিবী জুড়ে। প্যারিসে ওনার একটা ছোট দোকান আছে, আরো অনেক বিষয়ে পুলিশ ওনাকে সন্দেহ করছে।"
"কি?"
"চুরি যাওয়া
জিনিসপত্রের খরিদ্দার হিসেবে, বিশেষ করে রত্নের। রত্ন পুনরায়
কাটা এবং তাদের পুনরায় সেট করার ব্যাপারে সবকিছুই ওনার নখদর্পনে। ইউরোপের
উচ্চতমদের এবং দুষ্কৃতী জগতের নিম্নতমদের সঙ্গে ওনার ওঠা বসা।"
ভ্যান আলদীন হঠাৎই
পোয়ারোর দিকে নতুন ভাবে মনোযোগ দিয়ে দেখতে লাগলেন।
"আচ্ছা?" তিনি জানতে চাইলেন,
তাঁর গলায় একটা নতুন সুর।
"আমি নিজেকে প্রশ্ন
করলাম,"
পোয়ারো বললেন, "আমি,
এরকুল পোয়ারো -" তিনি নাটকীয় ভাবে নিজের বুক চাপড়িয়ে -
"নিজেকে প্রশ্ন করলাম হঠাৎ মসিয়েঁ পাপপুলাউস নাইসে এলেন কেন?"
ভ্যান আলদীন মুগ্ধ। কিছু
সময়ের জন্য ওনার পোয়ারোর ওপর সন্দেহ হয়েছিল মনে হয়েছিল যে বেটে খাটো মানুষটা বোধহয়
তাঁর কাজ ভুলে গেছেন,
এই একটা মাত্র ইঙ্গিতে, ক্ষনিকের মধ্যে, তিনি তাঁর পুরোনো অভিমতে ফিরে গেলেন। তিনি সোজা সুজি বেটে খাটো গোয়েন্দাটির
দিকে তাকালেন।
"আপনার কাছে আমি
ক্ষমা চাইছি,
মসিয়েঁ পোয়ারো।"
পোয়ারো একটা অসামান্য
ভঙ্গিমাতে হাত নেড়ে ক্ষমাপ্রার্থনাটাকে একপাশে সরিয়ে দিলেন।
"ধুৎ!" তিনি
চেঁচিয়ে উঠলেন,
"এসবের কোনো গুরুত্ব নেই, শুনুন, মসিয়েঁ ভ্যান আলদীন;
আপনার জন্য কিছু খবর আছে।"
ধনকুবেরটি খুব
তীক্ষ্ণভাবে তাঁর দিকে তাকিয়েছিলেন, তাঁর সমস্ত কৌতূহল জেগে
উঠেছে।
পোয়ারো মাথা নাড়ালেন।
"আমি বলতে চাই। এবং
আপনিও নিশ্চই শুনতে আগ্রহী হবেন। আপনি জানেন, মসিয়েঁ ভ্যান আলদীন যে
নির্দেশক বিচারকের সঙ্গে সাক্ষাৎকারের পর থেকেই কমতে ডে লা রোচের ওপর নজর রাখা
হয়েছে। তার পরের দিন,
তাঁর অনুপস্থিতিতে, পুলিশ ভিলা মারিনাতে
অনুসন্ধান চালিয়েছে।"
"আচ্ছা," ভ্যান আলদীন বললেন,
"তারা কি কিছু পেয়েছিলো? বাজি রাখছি কিছুই পায়
নি।"
পোয়ারো তাঁকে ছোট একটা
বাও করলেন।
"আপনার অনুমান একদম
সঠিক, মসিয়েঁ ভ্যান আলদীন। তারা সন্দেহজনক কিছুই পায় নি। কিছু পাওয়ার আশাও করা হয়
নি। কমতে ডে লা রোচে আপনারই বলা বাগধারা অনুযায়ী, গতকাল জন্মায় নি। সে একজন অঢেল অভিজ্ঞতাসম্পন্ন ধুরন্ধর ভদ্রলোক।"
"হ্যাঁ, বলে যান,"
ভ্যান আলদীন গর্জে উঠলেন।
"হতে পারে, নিশ্চই,
কমতের কাছে লুকোনোর মতো সন্দেহজনক কিছু নেই। কিন্তু
সম্ভবনাটা নাকচ করা যায় না। যদি, তাঁর লুকোনোর কিছু থাকে, তাহলে সেটা কোথায়?
বাড়িতে নয় - পুলিশ খুব ভালোভাবে খুঁজে দেখেছে। তাঁর নিজের
কাছেও নয়,
কারণ তিনি জানেন যেকোনো মুহূর্তেই তাঁকে গ্রেফতার করা হতে
পারে। তাহলে বাকি থাকে - তাঁর গাড়ি। আমি যেমন বললাম, ওনার ওপরে নজর রাখা হচ্ছিলো। পরের দিন ওনাকে ফলো করে মন্টে কার্লোতে যাওয়া হয়।
সেখান থেকে উনি,
নিজেই ড্রাইভ করে মেনটনের দিকে যান। ওনার গাড়ি খুবই শক্তিশালী, তিঁনি তাঁর অনুসরণকারীদের থেকে বেশ অনেকটা দূরত্ব বজায় রাখতে সক্ষম হন, আর প্রায় মিনিট পনেরোর জন্য তিঁনি একবারে তাদের চোখের আড়ালে চলে যান।"
"আর সেই সময় আপনি
অনুমান করছেন তিঁনি রাস্তার ধারে কিছু একটা লুকিয়ে রাখেন?" ভ্যান আলদীন গভীর আগ্রহী হয়ে জিজ্ঞেস করলেন।
"রাস্তার ধারে, না। এটা বিশ্বাসযোগ্য নয়। কিন্তু এবার শুনুন - আমাকে, আমি মসিয়েঁ ক্যারেজকে একটা ছোট পরামর্শ দিয়েছি। উনি অত্যন্ত খুশি মনেই সেটা
গ্রহণ করেছেন। আসে পাশের প্রতিটা ডাকঘরে খোঁজ নিয়ে দেখা হচ্ছে কেউ কমতে ডে লা
রোচেকে চেনেন কিনা। কারণ,
দেখুন, মসিয়েঁ, কোনো জিনিস কে লুকোনোর সবথেকে ভালো পদ্ধতি হচ্ছে সেটাকে ডাকে পাঠিয়ে
দেওয়া।"
"তাহলে?" ভ্যান আলদীন জানতে চাইলেন; তাঁর মুখ আগ্রহ এবং
প্রত্যাশায় বিশেষ ভাবে উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে।
"তারপর -"
একটা নাটকীয় ভঙ্গিমাতে পোয়ারো তাঁর পকেট থেকে ঢিলেঢোলা ভাবে ব্রাউন পেপারে মোরা
একটা বাক্স বার করলেন যেটা থেকে সুতোগুলো আগেই খুলে দেওয়া হয়েছে।
"সেই মিনিট পনেরোর
মধ্যে, আমাদের খাঁটি ভদ্রলোকটি এই বাক্সটিই ডাকে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন।"
"ঠিকানাটা?" অপরজন তীক্ষ্ণভাবে জানতে চাইলেন।
পোয়ারো মাথা নাড়লেন।
"আমাদের হয়তো কিছু
জানাতে পারতো,
কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত কিছুই জানা যায় নি। বাক্সটা ঐরকম একটা
ছোট খবরের কাগজের দোকানে পাঠানো হয়েছিল যেখানে চিঠি এবং পার্সেল রাখা থাকে যতক্ষণ
না কেউ সামান্য একটা কমিশন দিয়ে সেটা নিতে আসছে।"
"আচ্ছা, কিন্তু ভেতরে কি আছে?"
ভ্যান আলদীন অধৈর্য হয়ে জিজ্ঞেস করলেন।
পোয়ারো ব্রাউন পেপারটা
খুলে ফেললেন এবং একটা চৌকো কার্ডবোর্ডের বাক্স বার করে আনলেন। তিঁনি আশপাশে একবার
দেখে নিলেন।
"এটাই সঠিক সময়," তিঁনি চুপি চুপি বললেন,
"সবাই টেনিস খেলা দেখতে ব্যাস্ত। দেখুন, মসিয়েঁ।"
তিঁনি এক সেকেন্ডের কম
সময়ের মধ্যে বাক্সটার ঢাকনাটা খুলে ফেললেন। সাংঘাতিক রকমের আশ্চর্য হওয়ার এক
বিস্ময়কর চিৎকার ধনকুবেরের মুখ থেকে বেরিয়ে এলো। তাঁর মুখ একদম চকের মতো সাদা হয়ে
গেছে।
"হে ভগবান!"
তিঁনি গভীর স্বাস নিয়ে বললেন, "রুবিগুলো।"
তিনি হতবাক হয়ে মিনিট
খানেকের মতো বসে থাকলেন। পোয়ারো বাক্সটা আবার পকেটে ঢুকিয়ে ফেললেন। তারপর হঠাৎই
ধনকুবেরটি তাঁর সমাধিস্থ অবস্থা থেকে বেরিয়ে এলেন; তিঁনি পোয়ারোর দিকে ঝুকে তাঁর হাতটা এতো জোরে চেপে ধরলেন যে বেটে খাটো মানুষটার
মুখটা ব্যাথায় কুঁচকে গেলো।
"এটা অসাধারণ," ভ্যান আলদীন বললেন,
"অসাধারণ! আপনিই শ্রেষ্ঠ, মসিয়েঁ পোয়ারো। সর্বকালের
জন্য, আপনিই শ্রেষ্ঠ।"
"এটা কিছুই না," পোয়ারো বিনীতভাবে বললেন। "সম্ভাব্য ঘটনাবলীর জন্য আগে থেকেই ঠিক করে রাখা
ক্রমানুসার,
পদ্ধতি - শুধুমাত্র এইটুকুরই প্রয়োজন।"
"এখন তাহলে, আমি আশা করি,
কমতে ডে লা রোচেকে গ্রেফতার করা হয়েছে?" ভ্যান আলদীন খুব উদগ্রীব হয়ে জানতে চাইলেন।
"না," পোয়ারো বললেন।
"কিন্তু কেন? এর থেকে বেশি আর কি চান?"
"কমতের অ্যালিবাই
এখনো অটল।"
"কিন্তু এটা
অর্থহীন।"
"হ্যাঁ," পোয়ারো বললেন,
"আমার মনে হয় অর্থহীন, কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত
আমাদের সেটা প্রমান করতে হবে।"
"এর মধ্যে সে
আপনাদের আঙুলের ফাঁক দিয়ে গলে যাবে।"
পোয়ারো খুব জোরে জোরে
মাথা নাড়তে থাকলেন।
"না," তিঁনি বললেন,
"তিঁনি একাজ করবেন না। একটা জিনিস যা কমতে কোনোদিনও বিসর্জন
দিতে পারবেন না তা হলো তাঁর সামাজিক অবস্থান। যেকোনো মূল্যে তাঁকে থামাতে হবে এবং
নির্লজ্জভাবে সকলের সামনে তাঁকে উন্মোচন করতে হবে।"
ভ্যান আলদীন তবুও
অসন্তুষ্ট।
"কিন্তু আমি বুঝতে
পারছি না -"
পোয়ারো একটা হাত তুললেন, "আমাকে একটু সময় দিন,
মসিয়েঁ। আমাকে, আমার একটা সামান্য ধারণা
আছে। অনেকেই এরকুল পোয়ারোর সামান্য ধারণা নিয়ে মস্করা করেছেন - কিন্তু সবাই ভুল
প্রমাণিত হয়েছেন।"
"আচ্ছা," ভ্যান আলদীন বললেন,
"এগিয়ে যান। সামান্য ধারণাটা কি?"
পোয়ারো কিছুক্ষন চুপ করে
থেকে বললেন:
"আগামীকাল সকাল
এগারোটায় আমি আপনার হোটেলে আসবো। ততক্ষন পর্যন্ত কাউকে কিছু বলা যাবে না।"
চ্যাপ্টার ২২
প্রাতরাশে মসিয়েঁ
পাপপুলস
মসিয়েঁ পাপপুলস প্রাতরাশ
করছিলেন। উল্টোদিকে তাঁর মেয়ে জিয়া বসেছিল।
বসার ঘরের দরজায় একটা
টোকার শব্দ শোনা গেলো,
এবং একজন ছোকরা চাকর একটা কার্ড নিয়ে এসে মসিয়েঁ পাপপুলসকে
দিলো। সেটা পড়তেই,
তাঁর ভুরু দুটো ওপরে উঠে গেলো, এবং তারপর তিনি সেটা তাঁর মেয়েকে দিলেন।
"হুম!"
চিন্তিতভাবে নিজের বাঁ কান চুলকোতে চুলকোতে মসিয়েঁ পাপপুলস বললেন, "এরকুল পোয়ারো। চিন্তার ব্যাপার।"
বাবা এবং মেয়ে দুজনে
দুজনের দিকে তাকিয়ে থাকলো।
"কালকে টেনিস মাঠে
আমি ওনাকে দেখেছিলাম,"
মসিয়েঁ পাপপুলস বললেন, "জিয়া,
এই ব্যাপারটা আমার খুব একটা ভালো বলে মনে হচ্ছে না।"
"উনি কিন্তু একবার
তোমাকে সাহায্য করেছিলেন,"
তাঁর মেয়ে তাঁকে মনে করিয়ে দিলো।
"সেকথা ঠিক," মসিয়েঁ পাপপুলস মেনে নিলেন, "আমি এটাও শুনেছি যে উনি
এখন কাজ থেকে অবসর নিয়েছেন।"
বাবা ও মেয়ের মধ্যে
কথাবার্তা এতক্ষন নিজেদের ভাসাতে হচ্ছিলো। মসিয়েঁ পাপপুলস এবার ছোকরা চাকরটির দিকে
তাকিয়ে ফরাসিতে বললেন :
"ভদ্রলোককে ওপরে
নিয়ে এস।"
মিনিট কয়েক পরে, পরিপাটি ভাবে সজ্জিত,
এবং প্রফুল্ল মনে একটা ছড়ি ঘোরাতে ঘোরাতে এরকুল পোয়ারো ঘরে
ঢুকলেন।
"প্রিয় মসিয়েঁ
পাপপুলস।"
"প্রিয় মসিয়েঁ
পোয়ারো।"
"এবং মাদমোয়েজেল
জিয়া।" পোয়ারো অনেকটা নিচু হয়ে তাকে একটা বাও করলেন।
"যদি অনুমতি দেন তো
আমরা আমাদের প্রাতঃরাশটা শেষ করি," আর এক কাপ কফি ঢেলে
মসিয়েঁ পাপপুলস বললেন। "আপনি - আসলে! - একটু সকাল সকাল এসে পড়েছেন।"
"খুবই লজ্জার
ব্যাপার,"
পোয়ারো বললেন, "কিন্তু,
বুঝলেন তো, আমি আসলে একটু চাপে
আছি।"
"হুম!" মসিয়েঁ
পাপপুলস বললেন,
"আপনি তাহলে কোনো একটা কারণে এসেছেন?"
"খুবই গুরুত্বপূর্ণ
একটা কারণে,"
পোয়ারো বললেন, "মাদাম কেটারিংয়ের মৃত্যুর ব্যাপারে।"
"দাঁড়ান, মনে করতে দিন,"
মসিয়েঁ পাপপুলস নির্দোষভাবে ওপর দিকে তাকিয়ে থাকলেন।
"উনিই সেই মহিলা না যাঁর দ্যা ব্লু ট্রেনে মৃত্যু হয়েছিল? আমি খবরের কাগজে এব্যাপারে পড়েছিলাম, কিন্তু সেখানে তো কোনো
অপরাধের উল্লেখ ছিল না।"
"তদন্তের সুবিধার
জন্য,"
পোয়ারো বললেন, "আসল ব্যাপারটা চেপে যাওয়াই ঠিক হবে বলে মনে করা হয়েছে।"
কিছুক্ষন একটা স্তব্ধতা।
"আমি আপনাকে কিভাবে
সাহায্য করতে পারি,
মিস্টার পোয়ারো?" ব্যাবসায়ীটি খুব বিনীত ভাবে জিজ্ঞেস করলেন।
"সেটাই বলতে চাই," পোয়ারো বললেন,
"আমি মূল বিষয়ে আসছি।" তিঁনি তাঁর পকেট থেকে সেই
বাক্সটা বার করলেন,
যেটা কাননেসে দেখিয়েছিলেন, আর সেটা খুলে,
রুবিগুলো বার করে টেবিলের ওপর রেখে পাপপুলসের দিকে ঠেলে
দিলেন।
যদিও পোয়ারো তাঁকে খুব
সূক্ষ্ণভাবে লক্ষ্য করছিলেন, কিন্তু বয়স্ক মানুষটার
মুখের একটা পেশিও কাঁপলো না। তিঁনি রত্নগুলো নিলেন এবং নির্লিপ্ত ভাবে সেগুলো
পরীক্ষা করতে থাকলেন,
তারপর তিঁনি জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে পোয়ারোর দিকে তাকালেন:
"দুর্দান্ত, তাই না?"
পোয়ারো জিজ্ঞেস করলেন।
"বেশ চমৎকার," মসিয়েঁ পাপপুলস বললেন।
"এগুলোর দাম কি রকম
হবে, আপনার কি মনে হয়?"
গ্রীকটির মুখের পেশিগুলো
একটু কেঁপে উঠলো।
"এটা কি আপনাকে
বলতেই হবে,
মসিয়েঁ পোয়ারো?" তিঁনি প্রশ্ন করলেন।
"আপনি অত্যন্ত চতুর, মসিয়েঁ পাপপুলস। না,
বলতে হবে না। সত্যি বলতে কি,
এগুলো দাম মোটেই পাঁচ লক্ষ ডলার নয়।"
পাপপুলস হেসে উঠলেন, এবং পোয়ারোও ওনার সাথে হাসতে লাগলেন।
"নকল হিসেবে," ওগুলো পোয়ারোকে ফেরত দিয়ে, পাপপুলস বললেন, "আমি বলবো,
এগুলো, বেশ চমৎকার। এই প্রশ্ন
করাটা কি অসমীচীন হবে,
মসিয়েঁ পোয়ারো, যে আপনি এগুলো কোথায়
পেলেন?"
"মোটেই না," পোয়ারো বললেন,
"আপনার মতো একজন পুরোনো বন্ধুকে বলতে কোনো বাধা নেই। এগুলো
কমতে ডে লা রোচের কাছে ছিল।"
মসিয়েঁ পাপপুলসের ভুরু
দুটি বেশ স্পষ্ট ভাবেই ওপরে উঠে গেলো।
"অবশ্যই," তিঁনি বিড়বিড় করে বললেন।
পোয়ারো সামনে একটু ঝুকে
এলেন এবং একটা নিষ্পাপ কিন্তু মোহময় ভাব করলেন।
"মসিয়েঁ পাপপুলস," তিঁনি বললেন,
"আমি আমার হাতের তাস টেবিলে ফেলছি। আসল রত্নগুলো মাদাম
কেটারিংয়ের কাছ থেকে দ্যা ব্লু ট্রেনে চুরি হয়ে যায়। এবার আমি প্রথমেই একটা কথা
আপনাকে জানাতে চাই: এই রত্নগুলো উদ্ধারের ব্যাপারে আমি তেমন আগ্রহী নই। এটা
পুলিশের ব্যাপার। আমি পুলিশের হয়ে কাজ করছি না, ভ্যান আলদীনের হয়ে কাজ
করছি। মাদাম কেটারিংকে যে খুন করেছে আমি তাকে ধরতে চাই। রত্নগুলোর ব্যাপারে আমার
আগ্রহ ততোদূরই যতটা আমাকে সেই লোকটাকে ধরতে সাহায্য করবে। বুঝতে পেরেছেন?"
শেষের শব্দ দুটো বেশ
দৃঢ়তার সাথে উচ্চারণ করা হলো। মসিয়েঁ পাপপুলসের মুখে কোনো পরিবর্তন দেখা গেলো না, তিনি শান্ত ভাবে বললেন,
"বলে যান।"
"আমার মনে হয়েছিল, মসিয়েঁ,
সম্ভবত, নাইসে রত্নগুলোর হাতবদল
হবে - হয়তো তা হয়েও গেছে।"
"হুম!" মসিয়েঁ
পাপপুলস বললেন।
তিনি চিন্তিত ভাবে নিজের
কফিতে চুমুক দিচ্ছিলেন,
এবং ওনাকে স্বাভাবিকের থেকে একটু বেশি মহৎ এবং পৌরুষদীপ্ত
লাগছিলো।
"আমি নিজের মনেই
বলছিলাম,"
পোয়ারো প্রাণবন্ত ভাবে বলতে থাকলেন, "কি সৌভাগ্য! আমার পুরোনো বন্ধু, মসিয়েঁ পাপপুলস, এখন নাইসে। উনি আমায় সাহায্য করবেন।"
"আর আপনার কি মনে
হয়, আমি আপনাকে কিভাবে সাহায্য করতে পারি?" মসিয়েঁ পাপপুলস ঠান্ডা গলায় জিজ্ঞেস করলেন।
"আমি মনে মনেই
বলছিলাম,
মসিয়েঁ পাপপুলস, নিশ্চই এখানে ব্যাবসার
কাজে এসেছেন।"
"সেটা একদমই ঠিক না," মসিয়েঁ পাপপুলস বললেন,
"আমি এখানে স্বাস্থ উদ্ধারে এসেছি - ডাক্তারের
পরামর্শে।"
তিনি অযথা একটু কাসলেন।
"এটা শুনে আমি
অত্যন্ত অবাক হচ্ছি।" পোয়ারো কিছুটা অকৃত্রিম সহানুভূতির সাথে উত্তর দিলেন।
"কিন্তু তবুও যদি ভাবা যায়। একজন রাশিয়ান গ্রান্ড ডিউক, একজন অস্ট্রেলিয়ান আর্চডাচেস অথবা একজন ইতালিয়ান রাজকুমারকে যদি পারিবারিক
রত্ন বিক্রি করতে হয় - তাঁরা কার কাছে যাবেন? মসিয়েঁ
পাপপুলসের কাছে,
ঠিক কিনা? সমস্ত পৃথিবীতে উনি এই
কারণেই বিখ্যাত যে একমাত্র উনিই বিচক্ষণতার সঙ্গে এই ধরণের বিষয় সামলাতে পারেন।
অপরজন একটা বাও করলেন।
"আপনি আমায় তোষামোদ
করছেন।"
"বিচক্ষণতা, একটা একটা দারুন বিষয়,"
পোয়ারো চিন্তিতভাবে বললেন, এবং প্রত্যুত্তরে গ্রিক ভদ্রলোকের মুখে খুব দ্রুত একটা হাসি খেলে গেলো।
"আমিও,
বিচক্ষণতার সঙ্গে কাজ করতে পারি।"
দুজনে দুজনার চোখে চোখ
রেখে তাকিয়ে থাকলেন।
তারপর পোয়ারো ধীরে ধীরে, অবশ্যই খুব যত্নের সঙ্গে শব্দ চয়ন করে বলতে থাকলেন।
"আমি মনে মনে
এইকথাই বলছিলাম,
যে: রত্নগুলো যদি নাইসে হাতবদল হয়ে থাকে, মসিয়েঁ পাপপুলসের কাছে নিশ্চয় এ বিষয়ে খবর থাকবে। রত্নের পৃথিবীতে যেকোনো দেয়া
নেয়ার খবর ওনার কাছে থাকে।
মসিয়েঁ পাপপুলস বললেন, "হুম!",
আর তারপর একটা ক্রসঁয়্ নিয়ে ব্যাস্ত হয়ে পড়লেন।
"বুঝতেই পারছেন, পুলিশরা,"
মসিয়েঁ পোয়ারো বললেন, "এব্যাপারে ঢুকবে না। এটা ব্যাক্তিগত বিষয়।"
"বেশ কিছু গুজব
শোনা যাচ্ছে।" মসিয়েঁ পাপপুলস সাবধানে স্বীকার করলেন।
"যেমন?" পোয়ারো অনুরোধ করলেন।
"আমার সেগুলো
জানানোর কি কোনো কারণ আছে?"
"হ্যাঁ," পোয়ারো বললেন,
"আমার মনে হয় আছে। আপনার মনে থাকবে, মসিয়েঁ পাপপুলস,
সতেরো বছর আগে একটি বিশেষ বস্তু আপনার হাতে এসেছিলো, একজন - মানে - বেশ বিশিষ্ট ব্যাক্তি সেটা জামানত হিসেবে রেখেছিলো। আপনার
হেফাজত থেকে সেটা অকারণে খোয়া যায়। আপনি, যদি সঠিক ভাষায় বর্ণনা
করি, বেশ ঝামেলায় ফেঁসে গেছিলেন।"
তাঁর চোখ ধীরে ধীরে ঘুরতে
ঘুরতে মেয়েটির ওপর এসে পড়লো। সে তার কাপ এবং প্লেট একপাশে সরিয়ে রেখেছিলো, আর কনুই দুটো টেবিলের ওপর রেখে দুই হাতের ওপর থুতনিটা রেখে সে খুব আগ্রহের
সাথে কথাগুলো শুনছিলো। চোখটা তার ওপর রেখে তিঁনি বলতে থাকলেন:
"সেই সময়ে আমি
প্যারিসে ছিলাম। আপনি আমাকে ডেকে পাঠান। আপনি নিজেকে আমার হাতে সপেঁ দেন। আপনি
বলেছিলেন,
আমি যদি আপনাকে সেই বিশেষ বস্তুটি উদ্ধার করে দিতে পারি, আপনি আমার কাছে আমরণ কৃতজ্ঞ থাকবেন। এরপর, আমি আপনাকে বস্তুটি
উদ্ধার করে দি।"
মসিয়েঁ পাপপুলসের একটা
বিরাট দীর্ঘশ্বাস পড়লো।
"আমার কর্মজীবনের
একটি অপ্রীতিকর অধ্যায়।" তিঁনি বিড়বিড় করে বললেন।
"সতেরো বছর একটা
লম্বা সময়,"
পোয়ারো চিন্তিত ভাবে বললেন, "কিন্তু আমি বিশ্বাস করি যে এব্যাপারে আমি একদম সঠিক, মসিয়েঁ,
আপনাদের জাতি ভোলে না।"
"একজন গ্রিক?" একটা শ্লেষাত্মক হাসির সাথে পাপপুলস বিড়বিড় করে বললেন।
"আমি গ্রিক হিসেবে
এটা বোঝাতে চাই নি,"
পোয়ারো বললেন।
সেখানে কিছুক্ষনের জন্য
একটা নিস্তব্ধতা নেমে এলো,
আর তারপর বৃদ্ধ মানুষটি গর্বের সঙ্গে নিজেকে তুলে ধরলেন।
"মসিয়েঁ পোয়ারো, আপনি ঠিক বলেছেন,"
তিনি ধীরে ধীরে বললেন। "আমি একজন ইহুদি, আর আপনি যেমন বললেন,
আমাদের জাতি ভোলে না।"
"আপনি আমায় সাহায্য
করবেন তাহলে?"
"রত্নের ব্যাপারে, মসিয়েঁ,
আমি কিছুই করতে পারবো না।"
বৃদ্ধ মানুষটি, পোয়ারো কিছুক্ষন আগে যেমনটি করেছিলেন, যত্ন করে নিজের শব্দ চয়ন
করছিলেন।
"আমি কিছুই জানি
না। আমি কিছু শুনি নি,
কিন্তু হয়তো আমি আপনার একটা উপকার করতে পারবো - সেটা সম্ভব
যদি আপনি ঘোরদৌড়ে আগ্রহী থাকেন তবে।"
"কিছু বিশেষ পরিস্থিতিতে
হতেও পারি।" তাঁর দিকে স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে পোয়ারো বললেন।
"লংচ্যাম্পসে একটা
ঘোড়া দৌড়োচ্ছে,
যেটার ওপর, আমার মনে হয়, মনোযোগ দেওয়া দরকার। আমি নির্দিষ্টভাবে কিছু বলতে পারছি না, বুঝতেই পারছেন;
এই খবরটা অনেক হাত ঘুরে তবে এসেছে।"
তিঁনি থামলেন, পোয়ারোর দিকে স্থির দৃষ্টি রেখে, যেন তিঁনি নিশ্চিত হবার
চেষ্টা করলেন যে পোয়ারো ব্যাপারটা উপলব্ধি করতে পেরেছে কিনা।
"অবশ্যই, অবশ্যই,"
পোয়ারো মাথা নাড়তে নাড়তে বললেন।
"ঘোড়ার নামটা হোল," হেলান দিয়ে এবং আঙুলের ডগাগুলো একসাথে ঠেকিয়ে, মসিয়েঁ পাপপুলস বললেন,
"মারকুইস, আমার মনে হয়, যদিও আমি নিশ্চিত নই,
যে এটা একটা ইংরেজ ঘোড়া, কি বলো, জিয়া?"
"আমারও তাই মনে
হয়।" মেয়েটি বললো।
পোয়ারো দ্রুত উঠে
দাঁড়ালেন।
"আপনাকে ধন্যবাদ
জানাই, মসিয়েঁ,"
তিঁনি বললেন। "এই প্রাপ্তি যেন ইংরেজরা যাকে বলে
একেবারে আস্তাবল থেকে পাওয়া ইঙ্গিত। বিদায়, মসিয়েঁ, আর অজস্র ধন্যবাদ।"
তিঁনি মেয়েটির দিকে ঘুরলেন।
"বিদায়, মাদমোয়েজেল জিয়া। মনে হচ্ছে যেন গতকালই প্যারিসে আপনার সাথে দেখা হলো। কিন্তু
এরমধ্যে প্রায় দু বছর পেরিয়ে গেছে।"
"ষোল এবং তেত্রিশের
মধ্যে একটা পার্থক্য আছে,"
জিয়া দুঃখের সাথে বললো।
"আপনার ক্ষেত্রে নয়," পোয়ারো বীরদর্পে ঘোষণা করলেন। "সম্ভব হলে আপনি এবং আপনার বাবা যদি একদিন
রাতে আমার সাথে ডিনার করেন তাহলে বেশ ভালো হয়।"
"আমরা আনন্দিত
হবো।" জিয়া উত্তর দিলো।
"তাহলে আমরা
এব্যাপারে আয়োজন করবো,"
পোয়ারো ঘোষণা করলো, "আর এখন - আমি বিদায় নিচ্ছি।"
পোয়ারো গুন্ গুন্ করে একটা
সুর ভাঁজতে ভাঁজতে রাস্তা ধরে হাঁটছিলেন। তিঁনি প্রফুল্ল ভাবে ছড়ি ঘোরাচ্ছিলেন, আর দু এক বার নিজের মনেই শান্তভাবে হেসে উঠছিলেন। সামনেই যে ডাকঘরটা পেলেন
তিঁনি তাতেই ঢুকলেন এবং একটা টেলিগ্রাম পাঠালেন।
তিঁনি কিছুটা সময় নিলেন
শব্দগুলো সাজাতে,
সেগুলো একটা কোডে ছিল এবং স্মৃতি থেকে মনে করে করে তাঁকে
টেলিগ্রামটা বানাতে হলো। সেটার বিষয়টা হলো হারিয়ে যাওয়া স্কার্ফ-পিন সম্পর্কে, এবং সেটা পাঠানো হচ্ছিলো স্কটল্যান্ড ইয়ার্ডে, ইন্সপেক্টর জ্যাপ্ কে। ডিকোড করলে, সেটা খুব সংক্ষিপ্ত এবং
নির্দিষ্ট। "মারকুইস নামের লোকটির সম্পর্কে যা কিছু জানা যায় আমাকে সমস্ত
কিছু ওয়্যার করে জানান।"
চ্যাপ্টার ২৩
একটা নতুন তত্ত্ব
ঠিক এগারোটার সময় পোয়ারো
ভ্যান আলদীনের হোটেলে পৌঁছলেন। ধনকুবেরটি তখন একাই ছিলেন।
"আপনি একদম সময়
মেনে চলেন,
মসিয়েঁ পোয়ারো," তিনি উঠে গোয়েন্দাটিকে স্বাগতম জানাতে জানাতে হাসি মুখে বললেন।
"আমি সবসময়
সময়নিষ্ঠ,"
পোয়ারো বললেন, "নির্ভুলতা - সবসময় এটার দিকে আমার নজর থাকে। ক্রমবিন্যাস এবং পদ্ধতি ছাড়া
-"
তিনি থেমে গেলেন।
"ওহ,
খুব সম্ভবত এগুলো আমি আপনাকে আগেও বলেছি। আসুন আর সময় নষ্ট
না করে আমরা আমার আসার কারণটা নিয়ে বসি।"
"আপনার সামান্য
ধারণা?"
"হ্যাঁ, আমার সামান্য ধারণা।" পোয়ারো হাসলেন। "প্রথমত, মসিয়েঁ,
আমি আরেকবার পরিচারিকাটি, অ্যাডা ম্যাসনকে কিছু প্রশ্ন করতে চাই। উনি কি এখানে আছেন?"
"হ্যাঁ, উনি এখানেই আছেন।"
"হুম!"
ভ্যান আলদীন খুব কৌতূহলের
সাথে তাঁর দিকে তাকিয়ে ছিলেন। তিনি একটা ঘন্টি বাজালেন, এবং একজন বেয়ারাকে পাঠালেন ম্যাসনকে খুঁজে আনতে।
পোয়ারো তাঁর স্বাভাবিক
নম্রতার সাথে তাকে অভিবাদন জানালেন, এগুলো এই শ্রেণীর মানুষদের
ওপর যথেষ্ট প্রভাব ফেলে।
"শুভ দ্বিপ্রহর, মাদমোয়েজেল,"
তিঁনি আনন্দের সাথে বললেন। "দয়া করে বসুন, মসিয়েঁর অনুমতি নিয়ে আপনাকে বসতে অনুরোধ করছি।"
"হ্যাঁ, হ্যাঁ,
ও মেয়ে, বস।" ভ্যান আলদীন
বললেন।
"ধন্যবাদ, স্যার,"
ম্যাসন প্রাথমিক ভাবে জানালো, এবং সে চেয়ারের একদম সামনের প্রান্তে কোনোরকমে বসলো। তাকে আগের থেকে অনেকটা
রোগা এবং অসুস্থ লাগছিলো।
"আমি আপনাকে আরো
কয়েকটা প্রশ্ন করতে এসেছি,"
পোয়ারো বললেন, "আমাদের ঘটনাটার মুলে পৌঁছনো প্রয়োজন। আবার আমি ট্রেনের আগন্তুকের প্রশ্নে ফিরে
যাবো। আপনাকে আমরা কমতে ডে লা রোচেকে দেখিয়েছি। আপনি বলেছেন উনি হলেও হতে পারেন, কিন্তু আপনি নিশ্চিত নন।"
"আমি যেটা বলেছিলাম, স্যার,
আমি ভদ্রলোকের মুখ দেখি নি। সেটাই ব্যাপারটাকে আরো কঠিন করে
তুলেছে।"
পোয়ারো চোখ মুখ উজ্জ্বল
হয়ে উঠলো এবং মাথা নাড়লেন।
"ঠিক, একদমই সঠিক। আমি সমস্যাটা ভালো করেই বুঝতে পারছি। এবার, মাদমোয়েজেল,
আপনি বলেছেন, আপনি প্রায় গত দু মাস
যাবৎ মাদাম কেটারিংয়ের কাছে কাজ করছেন। এই সময়ের মধ্যে আপনার মালিককে আপনি কতবার
দেখেছেন?"
ম্যাসন দু এক মিনিট
চিন্তা করে বললো:
"মাত্র দু বার, স্যার।"
"আর সেটা কাছ থেকে, না অনেক দূর থেকে?"
"একবার, স্যার,
উনি কার্জণ স্ট্রিটে এসেছিলেন। আমি ওপরের তলায় ছিলাম, রেলিঙের ওপর থেকে উঁকি মেরে ওনাকে নিচে হলে দেখেছিলাম, ব্যাপারগুলো জানার পর - মানে যা হয়, বুঝতেই পারছেন, আমি একটু কৌতূহলী ছিলাম।" ম্যাসন তার সেই বিচক্ষণ কাশিটা দিয়ে শেষ করলো।
"আর আরেক বার?"
"সেটা পার্কে, স্যার,
আমি অ্যানির - একজন গৃহপরিচারিকা, সাথে ছিলাম,
স্যার, আর সে আমায় মালিককে দেখায়
উনি একজন বিদেশী মহিলার সাথে হাটছিলেন।"
আবার পোয়ারো মাথা
নাড়ালেন।
"শুনুন, ম্যাসন,
এই আগন্তুক, যাকে গারে ডি লিওনে ক্যারেজে
আপনার মালকিনের সাথে কথা বলতে দেখেছিলেন, কি করে বুঝতে পারলেন উনি
আপনার মালিক নন?"
"মালিক, স্যার?
ওহ,
আমার মনে হয় না উনি ছিলেন।"
"কিন্তু আপনি
নিশ্চিত নন।" পোয়ারো একই বিষয়ে বলতে থাকলেন।
"আসলে - আমি
এব্যাপারে ভাবি নি,
স্যার।"
ধারণাটা শুনে মাসনকে পরিষ্কার
ভাবে খুব বিচলিত লাগছিলো।
"আপনি শুনেছেন
আপনার মালিক ওই ট্রেনে ছিলেন। এটা তো খুবই স্বাভাবিক, যে উনিই করিডোর দিয়ে এসেছিলেন।"
"কিন্তু যে ভদ্রলোক
মাদামের সাথে কথা বলছিলেন উনি নিশ্চিতভাবেই বাইরে থেকে এসেছিলেন, স্যার। তাঁর পরনে রাস্তায়
বেরোনোর পোশাক ছিল। একটা ওভারকোট এবং একটি সফ্ট হ্যাট।"
"ঠিক তাই, মাদমোয়েজেল,
কিন্তু এক মিনিট একটু চিন্তা করে বলুন তো। ট্রেন সবে মাত্র গারে
ডি লিওনে পৌঁচেছে। অনেক যাত্রী স্টেশনে পায়চারি করতে নেমেছে। আপনার মালকিনও সেটাই
করতে যাচ্ছিলেন,
আর সেইজন্য নিশ্চয় তাঁর পশমের কোটটা পড়েছিলেন, ঠিক কিনা?"
"হ্যাঁ, স্যার।" ম্যাসন একমত হলো।
"আপনার মালিকও, তাহলে,
একই কাজ করেছিলেন। ট্রেনটা গরম ছিল, কিন্তু বাইরে স্টেশনে ঠান্ডা ছিল। উনি নিজের ওভারকোট এবং হ্যাট পড়েছিলেন এবং
ট্রেনের ধার দিয়ে হাঁটছিলেন হঠাৎই আলোকোজ্জ্বল জানলা দিয়ে উনি মাদাম কেটারিংকে
দেখেন। তার আগে পর্যন্ত ওনার কোনো ধারণাই ছিল না যে উনি ওই ট্রেনেই আছেন।
স্বাভাবিক ভাবেই,
উনি ক্যারেজে চড়েন এবং কম্পার্টমেন্টে যান। তিঁনি ওনাকে
দেখে আশ্চর্য হন ও একটা বিস্ময়কর চিৎকার করেন এবং তাড়াতাড়ি দুই কম্পার্টমেন্টের
মদ্ধিখানের দরজাটা বন্ধ করে দেন কারণ সম্ভবত তাঁদের কথাবার্তা একান্তই ব্যাক্তিগত
ছিল।"
তিঁনি চেয়ারে হেলান দিয়ে
বসলেন এবং দেখতে থাকলেন কিভাবে ধীরে ধীরে তাঁর পরামর্শ প্রভাব বিস্তার করছে। ম্যাসন যে শ্রেণীতে পরে তাদের ক্ষেত্রে কখনোই তাড়াহুড়ো করতে
নেই তা এরকুল পোয়ারোর থেকে বেশি আর কেউ জানে না।
ওনার তাকে এখন সময় দেওয়ার
প্রয়জন নিজের পূর্বকল্পিত ধারণাটা থেকে বেরিয়ে আসার জন্য। তিন মিনিট পরে সে কথা
বললো:
"হ্যাঁ, অবশ্যই স্যার,
এরকমটা হতে পারে। আমি এভাবে কখনো ভাবি নি। মালিক লম্বা এবং
শ্যামলা,
আর প্রায় একই রকমের শারীরিক গঠন। হ্যাট এবং কোটটা দেখেই আমি
বলেছিলাম ভদ্রলোকটি বাইরে থেকে এসেছেন। হ্যাঁ, উনি মালিক হতে পারেন।
এরমধ্যে যেকোনো একটা হতে পারে, আমি নিশ্চিত।"
"অসংখ্য ধন্যবাদ, মাদমোয়েজেল। আপনাকে আমার আর দরকার পড়বে না। আঃ, আর একটা জিনিস শুধু।" তিঁনি তাঁর পকেট থেকে সেই সিগারেটার বাক্সটা বার
করলেন যেটা আগে কাথেরিনকে দেখিয়েছিলেন। "এটা কি আপনার মালকিনের বাক্স?" তিঁনি ম্যাসনকে জিজ্ঞেস করলেন।
"না, স্যার,
এটা মালকিনের নয় - অন্তত -"
তাকে হঠাৎই বিভ্রান্ত
লাগছিলো। পরিষ্কারভাবে একটা ধারণা যেন তার মনের ভেতর থেকে উঠে আসছিলো।
"হ্যাঁ," পোয়ারো উৎসাহ নিয়ে বললেন।
"আমার মনে হয়, স্যার,
আমি ঠিক নিশ্চিত নই, তবু মনে হচ্ছে - এই
বাক্সটাই মালকিন কিনেছিলেন মালিককে দেওয়ার জন্য।"
"হুম!" পোয়ারো
অস্পষ্টভাবে বললেন।
"কিন্তু উনি ওটা
ওনাকে দিয়েছিলেন কিনা। তা অবশ্যই, বলতে পারবো না।"
"একদমই," পোয়ারো বললেন,
"একদমই। এতেই হবে, আসা করি, মাদমোয়েজেল। আপনাকে শুভ দ্বিপ্রহর।"
অ্যাডা ম্যাসন বিচক্ষণতার
সাথে বিদায় নিলো,
যাওয়ার সময় নিঃশব্দে দরজাটা বন্ধ করে দিয়ে গেলো।
পোয়ারো ভ্যান আলদীনের
দিকে তাকালেন,
মুখে একটা হালকা হাসি। ধনকুবেরটিকে বজ্রাহত লাগছিলো।
"আপনার মতে - আপনার
মতে ডেরেক করেছে?"
তিঁনি জিজ্ঞেস করলেন। "কিন্তু - সমস্তকিছু তো অন্যদিকে
নির্দেশ করছে। কেন,
কাউন্টটি তো হাতেনাতে ধরা পড়েছে রত্নগুলো শুদ্ধ।"
"না।"
"কিন্তু, আপনি আমাকে বলেছিলেন -"
"আমি আপনাকে কি
বলেছিলাম?"
"রত্নগুলোর সম্পর্কে, আপনি ওগুলো আমাকে দেখিয়েছিলেন।"
"না।"
ভ্যান আলদীন তাঁর দিকে
তাকিয়ে থাকলেন।
"আপনি বলতে চান
আপনি ওগুলো আমাকে দেখান নি।"
"না।"
"গতকাল, টেনিস মাঠে।"
"না।"
"আপনি কি পাগল হয়ে
গেছেন, মসিয়েঁ পোয়ারো,
নাকি আমি?"
"আমরা কেউই পাগল নই," গোয়েন্দাটি বললেন,
"আপনি আমাকে একটা প্রশ্ন করেছেন; আমি উত্তর দিয়েছি। আপনি প্রশ্ন করলেন আমি কি আপনাকে গতকাল রত্নগুলো দেখাই নি? আমি উত্তর দিলাম - না। আপনাকে যা দেখিয়েছিলাম, ভ্যান আলদীন,
সেগুলো প্রথম শ্রেণীর নকল, একজন বিশেষজ্ঞ ছাড়া আসলের সঙ্গে সেগুলোর পার্থক্য করা অসম্ভব।
চ্যাপ্টার ২৪
পোয়ারো পরামর্শ
দিলেন
জিনিসটা ঠিকঠাক বুঝতে
ধনকুবেরটির কয়েক মিনিট লাগলো। তিনি হতবাক হয়ে পোয়ারোর দিকে তাকিয়ে ছিলেন। বেঁটে
খাটো বেলজিয়ানটি তাঁর দিকে বিনীতভাবে মাথা নাড়ালেন।
"হ্যাঁ," তিনি বললেন,
"এইটা পুরো পরিস্থিতিটা বদলে দেয়, কি বলেন?"
"নকল!"
তিনি সামনে ঝুকে এলেন।
"প্রথম থেকেই, মসিয়েঁ পোয়ারো,
আপনার এই ধারণাটা ছিল? প্রথম থেকেই আপনি এই
দিকেই যাচ্ছিলেন?
আপনি কখনো একথা বিশ্বাস করেন নি যে কমতে ডে লা রোচে খুনটা
করেছেন?"
"আমার সন্দেহ ছিল," পোয়ারো ধীরে ধীরে বললো,
"আমি আপনাকে সেকথা জানিয়েছিলাম। ডাকাতি সঙ্গে হিংস্রতা এবং
খুন -" তিনি জোরে জোরে মাথা নাড়াতে লাগলেন -"না, এটা মেনে নেওয়া একটু কঠিন। এটা ঠিক কমতে ডে লা রোচের ব্যাক্তিত্বের সঙ্গে
সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়।"
"কিন্তু আপনি
বিশ্বাস করেন যে উনি রুবিগুলো চুরি করতে চেয়েছিলেন।"
"অবশ্যই। এ
ব্যাপারে কোনো সন্দেহই নেই। দেখুন, আমি আপনাকে আমি যেমন ভাবে
দেখছি তেমন ভাবে পুরো ঘটনাটা বলছি। কমতে রুবিগুলোর ব্যাপারে জানতেন তিঁনি সেইমতোই নিজের
পরিকল্পনা করেছিলেন। আপনার মেয়েকে ওই রুবিগুলো সঙ্গে করে নিয়ে আসতে বাধ্য করার
জন্য, তিঁনি বই লেখার একটা কাল্পনিক গল্প তৈরী করলেন। তিনি আগে থেকেই ঐগুলোর নকল
তৈরি করে রেখেছিলেন। এটা একদমই পরিষ্কার যে, উনি ওগুলো বদলে দেবার
পরিকল্পনাতে ছিলেন,
ঠিক কিনা। মাদাম, আপনার মেয়ে, রত্নের ব্যাপারে বিশেষজ্ঞ ছিলেন না। হয়তো বেশ অনেকদিন পরে উনি আবিষ্কার করতে
পারতেন কি হয়েছে। আর সেটা তিনি জানতে পারার পর - মানে - আমার মনে হয় না উনি কমতেকে
অভিযুক্ত করতেন বলে। তাহলে অনেক কিছুই বেরিয়ে পড়তো। ওনার কাছে তাঁর লেখা বহু চিঠি
পত্র আছে। হ্যাঁ,
একদমই, কমতের দিক থেকে এটা একটা
খুব নিরাপদ পরিকল্পনা ছিল - যা হয়তো আগেও সফল ভাবে কাজ করেছে ।"
"হ্যাঁ, একদম পরিষ্কার,"
ভ্যান আলদীন চিন্তিত ভাবে বললেন।
"এটা কমতে ডে লা
রোচের ব্যাক্তিত্বর সাথে পুরোপুরি খাপ খায়," পোয়ারো বললেন।
"হ্যাঁ, কিন্তু এখন -" ভ্যান আলদীন জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে ওনার দিকে তাকালেন।
"সত্যি সত্যি কি হয়েছিল? আমাকে সেটা বলুন, মসিয়েঁ পোয়ারো।"
পোয়ারো তাঁর কাঁধ
ঝাঁকালেন।
"এটা একদম সহজ," তিনি বললেন,
"কমতের আগেই অন্য কেউ এই কাজটা করেছে।"
তারপর সেখানে একটা লম্বা
নীরবতা।
ভ্যান আলদীন মনে মনে
ঘটনাগুলো উল্টে পাল্টে দেখছিলেন। যখন তিঁনি মুখ খুললেন তখন তাঁর মনে আর কোনো সংশয়
নেই।
"আপনি কবে থেকে
আমার জামাইকে সন্দেহ করছেন,
মসিয়েঁ পোয়ারো?"
"প্রথম থেকেই। তাঁর
উদ্দেশ্যও ছিল এবং সুযোগও ছিল। সবাই ধরেই নিয়েছিল মাদামের কম্পার্টমেন্টের আগন্তুক
ছিলেন কমতে ডে লা রোচে। আমিও তাই ভেবেছিলাম। তারপর আপনি কথা প্রসঙ্গে জানালেন আপনি
একবার কমতে কে আপনার জামাই বলে ভুল করেছিলেন। সেখান থেকেই আমি বুঝলাম যে ওনাদের উচ্চতা
এবং দৈহিক গঠন প্রায় এক,
এবং গায়ের রংও প্রায় সমান। এটাই আমার মাথায় কিছু অদ্ভুত
চিন্তা ঢুকিয়ে দিলো। পরিচারিকাটি আপনার মেয়ের সাথে খুব অল্প দিন হলো আছে। তার
পক্ষে মিস্টার কেটারিংয়ের চেহারা দেখে চিনতে পারা প্রায় অসম্ভব, যেহেতু তিঁনি কার্জন স্ট্রিটে থাকেন না; আগন্তুক তাই খুব
সাবধানতার সাথে সবসময় নিজের মুখ অন্যদিকে ঘুরিয়ে রেখেছিলেন।"
"আপনি বিশ্বাস করেন
সে - ওকে হত্যা করেছে,"
ভ্যান আলদীন কর্কশ ভাবে জিজ্ঞেস করলেন।
পোয়ারো তাড়াতাড়ি একটা হাত
তুললেন।
"না, না, আমি সেকথা বলি নি - কিন্তু এটা একটা সম্ভাবনা - একটা খুব জোরদার সম্ভবনা। উনি খুব কঠিন এক পরিস্থিতিতে ছিলেন, খুব কঠিন এক পরিস্থিতি,
দেউলিয়া হবার হুমকির সামনে। এই একটা রাস্তা ওনার সামনে
ছিল।"
"কিন্তু রত্নগুলো
কেন নিলো?"
"অপরাধটাকে সামান্য
একটা ট্রেন ডাকাতি হিসেবে দেখানোর জন্য। নাহলে সন্দেহটা সোজাসুজি তাঁর ওপরেই পরবে।"
"যদি তাই হয়, তাহলে রুবিগুলো নিয়ে কি করেছে?"
"সেটা দেখবার বিষয়।
অনেকগুলো সম্ভাবনা আছে। নাইসে একজন ভদ্রলোক আছেন যিনি সাহায্য করতে পারেন, সেই ভদ্রলোক যাঁকে টেনিস মাঠে আপনাকে দেখিয়েছিলাম।"
তিঁনি উঠে দাঁড়ালেন, ভ্যান আলদীনও উঠলেন এবং তাঁর হাতটা বেঁটে খাটো লোকটির কাঁধে রাখলেন।
তিঁনি যখন কথা বলতে শুরু
করলেন তখন আবেগে তাঁর গলাটা রূঢ় হয়ে উঠেছে।
"রুথের খুনি কে
আপনি খুঁজে বের করুন,"
তিঁনি বললে, "আমি শুধু এটাই চাই।"
পোয়ারো নিজেকে তুলে
ধরলেন।
"এটা আপনি এরকুল
পোয়ারোর হাতে ছেড়ে দিন,"
তিঁনি অপূর্ব ভাবে বললেন, "কোনো ভয় নেই। আমি সত্যিটা খুঁজে বের করবো।"
তিঁনি নিজের টুপি থেকে
কিছু পেঁজা তুলোর টুকরো ঝেড়ে ফেললেন, ধনকুবেরটির দিকে তাকিয়ে
একটা আশ্বাস দেওয়ার হাসি হাসলেন, এবং ঘর থেকে বেরিয়ে
গেলেন। যদিও,
সিঁড়ি দিয়ে যখন নামছিলেন তখন তাঁর মুখে আত্মবিশ্বাসটা যেন
কিছুটা হালকা হয়ে এসেছিলো।
"সবকিছুই ভালো ভাবে
চলছে,"
তিঁনি নিজের মনেই বিড়বিড় করছিলেন, "কিন্তু কিছু সমস্যা আছে। হ্যাঁ, খুব বড় বড় সমস্যা।"
তিঁনি হোটেল থেকে বেরিয়ে যেতে যেতে আচমকা থমকে দাঁড়ালেন। একটা গাড়ি দরজার সামনে
এসে দাঁড়িয়েছে । তার ভেতরে ক্যাথেরিন গ্রে
ছিল, এবং ডেরেক কেটারিং পাশে দাঁড়িয়ে খুব আন্তরিকভাবে কিছু বলছিলো।
দু এক মিনিট পরে গাড়িটি
চলে গেলো এবং ডেরেক কেটারিং ফুটপাথে দাঁড়িয়ে সেইদিকে তাকিয়ে থাকলো। তার মুখে এক
অদ্ভুত অভিব্যাক্তি। সে হঠাৎ কাঁধ নাড়িয়ে একটা ধৈর্য্যচ্যুত হবার অঙ্গভঙ্গি করলো, একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললো,
এবং ঘুরতেই দেখতে পেলো কনুইয়ের কাছে এরকুল পোয়ারো দাঁড়িয়ে
আছেন। না চাইতেও সে খুবই অবাক হয়ে গেলো। দুজন মানুষ একে অপরের দিকে তাকিয়ে থাকলো।
পোয়ারো এক এবং অবিচল ভাবে,
এবং ডেরেক হালকা চালে অস্বীকার করার ভঙ্গিতে। সে যখন কথা
বলতে শুরু করলো তার উপহাসের পেছনে একটা হালকা ব্যাঙ্গাত্মক সুরও ছিল, এবং এই সময়ে তার ভুরু দুটোকে কিছুটা তুলে সে কথা বলছিলো।
"রাদ্যার এ ডিয়ার, কি বলেন?"
সে হালকা চলে বললো।
তার আচরণ একেবারেই
স্বাভাবিক ছিল।
"হ্যাঁ," পোয়ারো চিন্তিতভাবে বললেন, "এই কথাটা মাদমোয়েজেল
ক্যাথেরিনের জন্য একেবারে যথাযোগ্য। এই উপমাটা একটা ইংরেজি শব্দবন্ধ, এবং মাদমোয়েজেল কাথেরিনেও, একজন পুরোপুরি ইংরেজ
মহিলা।"
ডেরেক কোনো উত্তর না দিয়ে
চুপ করে থাকলো।
"তা সত্ত্বেও উনি
খুবই সহানুভূতিশীল,
ঠিক কিনা?"
"হ্যাঁ," ডেরেক বললো,
"ওনার মতো মহিলা আর খুব একটা বেশি নেই।"
সে খুব আস্তে আস্তে কথা
বলছিলো, যেন অনেকটা নিজের মনেই বলছিলো। পোয়ারো উল্লেখযোগ্য ভাবে মাথা নাড়লেন। তারপর
তিঁনি অপরজনের দিকে ঝুকে অন্য একটা গলায় কথা বলতে লাগলেন, একটা শান্ত,
গম্ভীর গলা যা ডেরেক কেটারিংয়ের কাছে একেবারে নতুন।
"আপনি একজন বৃদ্ধ
মানুষকে ক্ষমা করবেন,
মসিয়েঁ, যদি সে এমন কিছু বলে ফেলে
যাতে আপনার তাকে বেহায়া বলে মনে হয়। ইংরেজিতে একটা কথা আছে। সেটা হলো 'নতুন কোনো জিনিসকে আপন করে নেওয়ার আগে, পুরোনো ভালোবাসাকে ছেড়ে
দেওয়াই মঙ্গলের'।"
কেটারিং রেগে ওনার দিকে
ঘুরে দাঁড়ালো। "আপনি কি বলতে চাইছেন কি?"
"আপনি আমার ওপর রাগ
করতে পারেন,"
পোয়ারো শান্তভাবে বললেন, "এটা আমি আশা করেছিলাম। আর এতে আমি কি বোঝাতে চাইছি - আমি বোঝাতে চাইছি, মসিয়েঁ,
ওখানে দ্বিতীয় আরেকটা গাড়ি দাঁড়িয়ে আছে এবং তাতে একজন মহিলা
আছেন। আপনি যদি মাথাটা ঘোরান দেখতে পাবেন।
ডেরেক সঙ্গে সঙ্গে ঘুরে
দাঁড়ালো। তার মুখ রাগে অন্ধকার হয়ে গেলো।
"মিরেলে, অতি জঘন্য!" সে বিড়বিড় করে বললো, "আমি এখুনি -"
সে যা করতে চলেছিল পোয়ারো
তাতে বাধা দিলেন।
"আপনি ওখানে যেটা
করতে চলেছেন সেটা কি ঠিক হবে?" তিঁনি সতর্ক করে জিজ্ঞেস
করলেন। তাঁর চোখে একটা উজ্জ্বল সবুজ আলো চক চক করছিলো। কিন্তু ডেরেক সতর্কতার
চিহ্ন লক্ষ্য করলো না। তার আচরণে বোঝা যায় তার সমস্ত প্রতিরোধ ভেঙে গেছে।
"ওর সাথে আমার
ছাড়াছাড়ি হয়ে গেছে,
আর ও সেটা ভালোমতোই জানে।" ডেরেক রাগে চিৎকার করে উঠলো।
"আপনি ওনাকে ছেড়ে
দিয়েছেন,
সত্যি, কিন্তু উনি কি আপনাকে
ছেড়ে দিয়েছেন?"
ডেরেক হঠাৎই কর্কশভাবে
হেসে উঠলো।
"ও চেষ্টা করলেও
কুড়ি লক্ষ পাউন্ডকে ছাড়তে পারবে না।" সে নিষ্ঠূর ভাবে বিড়বিড় করে বললো, "এব্যাপারে মিরেলের ওপর ভরসা রাখতে পারেন।"
পোয়ারো তাঁর ভুরু দুটো
ওপরে তুলে দিলেন।
"আপনার বিচারধারা
নিন্দনীয়,"
তিঁনি বিড়বিড় করে বললেন।
"তাই নাকি?" তার হঠাৎ চওড়া হাসিতে কোনো আনন্দ ছিল না। "আমি এই পৃথিবীতে
যথেষ্ট দিন কাটিয়েছি,
মসিয়েঁ পোয়ারো, এই কথাটা বুঝতে যে
মহিলারা সবাই একই রকমের।" তার মুখটা হঠাৎই একটু নরম হয়ে এলো। "সবাই শুধু
একজন ছাড়া।"
সে পোয়ারোর চোখে চোখ রেখে
উদ্ধত ভাবে তাকালো। একটা সতর্কতার দৃষ্টি তার চোখে ফুটে উঠেই, মিলিয়ে গেলো। সে বললো,
"ওই উনি," এবং ক্যাপ মার্টিনের দিকে
তার মাথাটা ঝাকালো।
"হুম!" পোয়ারো
বললেন।
তাঁর নিখুঁত ভাবে হিসেবি
শান্ত আচরণ অপর ব্যাক্তিটির উগ্র মেজাজটাকে আরো উসকে দেওয়ার জন্য।
"আমি জানি আপনি কি
বলবেন,"
ডেরেক খুব দ্রুত বললো, "আমি যে ধরণের জীবন কাটিয়েছি, তাতে এটা সত্যি যে আমি
ওনার যোগ্য নই। আপনি বলবেন যে আমার এসব চিন্তা করারই অধিকার নেই। আপনি বলবেন যে
এটা কোনো ব্যাক্তির সুনাম একবার ক্ষুন্ন হলে তা আর ফিরে পাওয়া যায় না - আমি জানি
যেখানে আমার স্ত্রী মাত্র কয়েকদিন আগেই মারা গেছেন, খুন হয়েছেন,
সেখানে এভাবে বলাটা নিতান্তই অভদ্রতা।"
সে শ্বাস নেওয়ার জন্য
থামলো, পোয়ারো তার থামার সুযোগে অভিযোগের সুরে মন্তব্য করলেন।
"কিন্তু, আমিতো কিছুই বলি নি।"
"আপনি নিশ্চই
বলবেন।"
"ওহ!" পোয়ারো
বললেন।
"আপনি বলবেন যে
কাথেরিনকে বিয়ে করার কোনো জাগতিক সম্ভানাই আমার নেই।"
"না," পোয়ারো বললেন,
"আমি সে কথা বলবো না। আপনার যথেষ্ট দুর্নাম আছে, হ্যাঁ,
কিন্তু মহিলাদের মনে - এটা তাদের কাছে কোনো বাধা নয়। আপনি
যদি একজন দুর্দান্ত চরিত্রবান পুরুষ হতেন, কঠোর নৈতিকতার সাথে যে এমন
কিছুই করে নি যা তার করা উচিত নয়, আর - সম্ভবত যা প্রয়োজন
তার পুরোটাই করেছেন - তাহলে! আপনার সাফল্য নিয়ে আমার গভীর সন্দেহ থাকতো। বুঝতেই
পারছেন, নৈতিকতার দাম,
প্রেমের ক্ষেত্রে নেই। বিধবা মহিলাদের কাছে, অবশ্য,
এর যথেষ্ট মূল্য আছে।
ডেরেক কেটারিং অবাক হয়ে
তাঁর দিকে তাকিয়ে থাকলো,
তারপর সে পিছনে ঘুরে অপেক্ষা রত গাড়িটির দিকে চলতে লাগলো।
পোয়ারো কিছুটা আগ্রহ নিয়ে
তার দিকে তাকিয়ে থাকলেন। তিনি দেখলেন একজন সুন্দরী গাড়ি থেকে শরীরে ওপরের ভাগটা
বার করলেন এবং কথা বলতে শুরু করলেন।
ডেরেক কেটারিং থামলেন না, তিনি টুপিটা তুললেন এবং সোজা পেরিয়ে গেলেন।
"তাহলে এই ব্যাপার," মসিয়েঁ এরকুল পোয়ারো বললেন, "এবার আমার, মনে হয়,
বাড়িতে ফেরার সময় হয়েছে।"
বাড়ি ফিরে তিনি দেখলেন
অপ্রতিরোধ্য জর্জ ট্রাউজারগুলো ইস্তিরি করছে।
"বেশ সুন্দর দিন, জর্জেস,
কিছুটা ক্লান্তিকর, কিন্তু উত্তেজনাহীন
নয়।" তিঁনি বললেন।
জর্জ এই মন্তব্যগুলো তার
স্বাভাবিক কাঠ কাঠ ধরণের অভিবাক্তিতেই নিলো।
"অবশ্যই, স্যার।"
"একজন অপরাধীর
ব্যাক্তিত্ব,
জর্জেস, বেশ আকর্ষণীয় ব্যাপার।
বহু খুনি অদ্ভুত রকমের চমৎকার ব্যাক্তিত্বের অধিকারী।"
"আমি বহুবার শুনেছি, স্যার,
ডাক্তার ক্রিপেন ছিলেন একজন মিষ্টিকথা বলা ভদ্রলোক। তবুও
তিঁনি তাঁর স্ত্রীকে কিমা বানানোর মতো করে কেটেছিলেন।"
"তোমার উদাহরণগুলো
সবসময় একদম সঠিক,
জর্জেস।"
খানসামাটি কোনো উত্তর
দিলো না,
এমন সময় টেলিফোন বেজে উঠলো। পোয়ারো রিসিভারটা তুললেন।
"অ্যালো - অ্যালো -
হ্যাঁ, হ্যাঁ,
এরকুল পোয়ারো বলছি, কে বলছেন?"
"নাইটোন বলছি। আপনি
লাইনটা এক মিনিট ধরবেন,
মসিয়েঁ পোয়ারো? মিস্টার ভ্যান আলদীন
আপনার সাথে কথা বলতে চান।
কিছুক্ষন নিস্তব্ধতার পর, ধনকুবেরটির গলা ভেসে এলো।
"মসিয়েঁ পোয়ারো
বলছেন কি?
আমি আপনাকে শুধুমাত্র এই কথাটা জানাতে ফোন করলাম যে ম্যাসন
একটু আগে আমার কাছে এসেছিলো তার নিজস্ব মতামত জানাতে। সে ব্যাপারটা নিয়ে চিন্তা
করছিলো, আর সে বলছে যে সে প্রায় নিশ্চিত প্যারিসের আগন্তুক ডেরেক কেটারিংই ছিল। তার
আচরণের মধ্যে যেন চেনা কিছু একটা ছিল, সে বলছে, সে এখন সেটা ঠিক ধরতে পারছে না। তাকে এখন বেশ নিশ্চিত বলেই মনে হচ্ছে।
"আঃ," পোয়ারো বললেন,
"ধন্যবাদ, মসিয়েঁ ভ্যান আলদীন, এটা আমাদের এগোতে সাহায্য করবে।"
তিঁনি রিসিভারটা নামিয়ে
রাখলেন, আর দু এক মিনিট দাঁড়িয়ে থাকলেন তাঁর মুখে একটা অদ্ভুত হাসি। জর্জকে একটা
উত্তরের জন্য তাঁকে দুবার করে জিজ্ঞেস করতে হলো।
"হুম!" পোয়ারো
বললেন,
"তুমি যেন আমাকে কি বলছিলে?"
"আপনি কি এখানেই
লাঞ্চ করবেন,
নাকি বেরোবেন?"
"কোনোটাই না," পোয়ারো বললেন,
"আমি বিছানায় যাবো আর একটা ভেষজ চা খাবো। যা হওয়ার ছিল তাই
হয়েছে, আর যা হওয়ার তাই যখন হয়, আমার আবেগ জেগে
ওঠে।"
চ্যাপ্টার ২৫
অবাধ্যতা
ডেরেক কেটারিং যখন গাড়িটা
পেরিয়ে যাচ্ছিলো,
মিরেলে গাড়ি থেকে শরীরে ওপরের ভাগটা বার করলো।
"ডেরেক - তোমার
সঙ্গে আমার কিছু জরুরি কথা আছে -"
কিন্তু, টুপিটা তুলে,
ডেরেক না থেমে সোজা তাকে পেরিয়ে চলে গেলো।
সে যখন নিজের হোটেলে
পৌঁছলো, দারোয়ানটি তার কাঠের ঘর থেকে বেরিয়ে এসে তাকে একটা বার্তা দিলো।
"একজন ভদ্রলোক
আপনার সাথে দেখা করার জন্য অপেক্ষা করছেন।"
"কে তিনি?" ডেরেক জিজ্ঞেস করলো।
"আমাকে ওনার নাম
বলেন নি,
মসিয়েঁ, কিন্তু বলেছেন যে আপনার
সাথে খুব জরুরি কাজ আছে,
এবং উনি অপেক্ষা করতে চান।"
"উনি কোথায়?"
"ছোট বৈঠকখানার ঘরে, মসিয়েঁ। উনি আরামকক্ষটাই পছন্দ করলেন, যেহেতু ওটা অনেকটা
নিরিবিলি।"
ডেরেক মাথা নাড়লেন, এবং সেইদিকে চললেন।
ছোট বৈঠকখানার ঘরটাতে
অতিথি ছাড়া আর কেউ ছিল না,
ডেরেক ঢুকতেই তিনি উঠে দাঁড়ালেন এবং সরল বৈদেশিক মাধুর্যের
সাথে একটা বাও করলেন। ঘটনাচক্রে, ডেরেক কমতে ডে লা রোচেকে
একবারই দেখেছে,
কিন্তু তবুও অভিজাত এবং সম্ভ্রান্ত ব্যাক্তিটিকে চিনতে কোনো
অসুবিধা হলো না,
এবং রাগে তার ভুরুদুটি কুঁচকে গেলো। সমস্ত রকমের বেহায়াপনা
সত্ত্বেও!
"কমতে ডে লা রোচে, তাই না?"
সে বললো, "আমার মনে হয় এখানে এসে
আপনি নিজের সময় নষ্ট করেছেন।"
"আশা করি সেটা ঠিক
নয়,"
কমতে খুশি খুশি মুখে বললো।
তার সাদা দাঁতগুলো চক চক
করে উঠলো।
কমতের আকর্ষক ব্যবহার
সাধারণত নিজের লিঙ্গের ওপর কোনো কাজ করে না। সমস্ত পুরুষই, কোনো ব্যতিরেক ছাড়া,
তাকে মন থেকে ঘৃণা করে। এরমধ্যেই ডেরেক কেটারিংয়ের ভেতর
কাউন্টটিকে ঘর থেকে ঘাড় ধাক্কা দিয়ে বার করে দেওয়ার একটা স্বতন্ত্র ইচ্ছে মাথা চারা
দিছিলো। এই মুহূর্তে এইরকম একটা কেলেঙ্কারি বেশ দুর্ভাগ্যপূর্ণ হবে সেই চিন্তাই
তাকে ঠেকিয়ে রেখেছিলো। সে আবার নতুন করে অবাক হলো এই কথা ভেবে, যে রুথ এই ব্যাক্তিটিকে কিভাবে পছন্দ করতে পারে, আর সে নিশ্চিতভাবেই পছন্দ করতো। একজন লোচ্চা, লোচ্চারও অধম। সে প্রবল ঘৃণার সাথে কাউন্টের চমৎকার ভাবে পরিচর্যা করা হাতের
দিকে তাকিয়ে থাকলো।
"আমি," কমতে বললো,
"একটা ছোট কাজের ব্যাপারে এসেছি। আশাকরি, আপনার জন্য এটা যুক্তিপূর্ণ হবে, যদি আমার কথাটা
শোনেন।"
ডেরেকের আবার তাকে ঘাড়
ধাক্কা দিয়ে বের করে দেওয়ার প্রবল একটা ইচ্ছে হলো, আবার সে নিজেকে নিরস্ত করলো। হুমকির একটা প্রচ্ছন্ন ইঙ্গিত তার নজর এরাই নি, কিন্তু সে সেটাকে তার নিজের মতো করে ব্যাখ্যা করে নিয়েছিল। অনেকগুলো কারণে
কমতে কি বলতে চায় সেটা শোনাটাই ভালো মনে হচ্ছে।
সে বসলো এবং অধৈর্য ভাবে
তার আঙ্গুলগুলো দিয়ে টেবিলের ওপর বাজাতে লাগলো।
"ঠিক আছে," সে তীক্ষ্ণ ভাবে বললো,
"ব্যাপারটা কি?"
সঙ্গে সঙ্গে খোলা ময়দানে
নেমে পড়াটা কমতের স্বভাবসিদ্ধ নয়।
"প্রথমেই আপনার
সাম্প্রতিক প্রিয়জন হারানোর শোকে আমার আন্তরিক সমবেদনা জানাই।"
"যদি কোনো
বেহায়াপনা দেখি,"
ডেরেক শান্তভাবে বললো, "আপনাকে ওই জানলা দিয়ে ছুড়ে ফেলে দেব।"
সে কমতের পাশের জানালাটার
দিকে মাথাটা নাড়িয়ে ইঙ্গিত করলো, অপরজন অস্বস্তিতে একটু
নড়ে উঠলেন।
"আমি আমার বন্ধুদের
আপনার কাছে পাঠাবো,
মসিয়েঁ, যদি আপনি সেটাই চান," সে অভিমান করে বললো।
ডেরেক হাসলো।
"একটা ডুয়েল, তাই তো?
প্রিয় কাউন্ট, আমি আপনাকে এতটা গুরুত্ব
দিই না। কিন্তু আপনাকে প্রমেনাদে দেশ এংলাইসে নাকে খত দেয়াতে যথেষ্ট আনন্দ পাবো।
কমতে মেজাজ খারাপ করতে
একদমই আগ্রহী ছিলেন না। সে খালি ভুরু দুটো তুলে বিড়বিড় করলো।
"ইংরেজরা
বর্বর।"
"ঠিক আছে," ডেরেক বললো,
"আমাকে আপনার কি বলার আছে?"
"আমি খোলাখুলি ভাবে
বলতে চাই,"
কমতে বললো, "আমি সোজাসুজি বিষয়ে আসবো।
সেটাই আমাদের দুজনের পক্ষে ভালো হবে, ঠিক কিনা?"
আবার সে তার সহমত হবার
ভঙ্গিতে হাসলো।
"শুরু করুন," ডেরেক সংক্ষিপ্তভাবে বললো।
কমতে ওপর দিকে তাকালো, আঙুলের ডগাগুলো একসাথে করলো এবং নরম সুরে বিড়বিড় করে বলতে লাগলো।
"আপনি অনেকগুলো
টাকার অধিকারী হয়েছেন,
মসিয়েঁ।"
"এর সঙ্গে আপনার কি
সম্পর্ক?"
কমতে নিজেকে তুলে ধরলো।
"মসিয়েঁ, আমার নাম কলংকিত করা হচ্ছে! আমাকে জঘন্য অপরাধের জন্য - সন্দেহ করা হচ্ছে -
অভিযুক্ত করা হচ্ছে।"
"অভিযোগটা আমার দিক
থেকে আসে নি,"
ডেরেক ঠাণ্ডাভাবে বললো, "আগ্রহী পক্ষ হিসেবে আমি কোনো মতামত দিই নি।"
"আমি নির্দোষ," কমতে বললো,
"ঈশ্বরের নাম শপথ করে বলছি -" সে তার হাত দুটো ওপরের
দিকে তুললো - "যে আমি নির্দোষ।"
"আমার মনে হয়, মসিয়েঁ ক্যারেজ,
নির্দেশক বিচারক, এই কেসের দায়িত্বে আছেন," ডেরেক নম্রভাবে ইঙ্গিত করলো।
কমতে গুরুত্ব দিলো না।
"আমি অন্যায়ভাবে
শুধুমাত্র এমন একটা অপরাধে অভিযুক্ত যা আমি করি নি তাই নয়, আমার টাকা পয়সারও খুব প্রয়োজন।"
সে নরমভাবে এবং ইঙ্গিতপূর্ণভাবে
একটা কাশি দিলো।
ডেরেক উঠে দাঁড়ালো।
"আমি এইটারই
অপেক্ষা করছিলাম,"
সে আস্তে করে বললো, "একটা ব্ল্যাকমেল করা নরপশু কোথাকার! আমি আপনাকে একটা কানা করিও দেব না। আমার
স্ত্রী মৃত,
যত কলঙ্কই আপনি ছড়ান না কেন তাকে এখন আর ছুঁতে পারবে না।
আমার এটা বলার মতো সাহস আছে যে, সে আপনাকে বোকার মতো চিঠি
লিখেছিলো। আমি যদি সেগুলো এইমুহূর্তে একটা ভালো অঙ্ক দিয়ে আপনার থেকে কিনেও নিই, আমি নিশ্চিত তার দু একটা আপনি রেখে দেবেন; আর আমি আপনাকে একথা বলবো, মসিয়েঁ ডে লা রোচে,
ব্ল্যাকমেইলিং একটা কুৎসিত কথা ইংল্যান্ডে এবং ফ্রান্সেও।
এটাই আমার উত্তর। শুভ দ্বিপ্রহর।"
"এক মিনিট -"
ডেরেক ঘর থেকে বেরিয়ে যাওয়ার জন্য তৈরি হতেই কমতে একটা হাত বাড়িয়ে দিলো।
"আপনি ভুল করছেন,
মসিয়েঁ। আপনি পুরোপুরি ভুল করছেন। আমি, আশা করি,
একজন, 'ভদ্রলোক।'"
ডেরেক হাসলো।
"একজন মহিলার আমাকে
লেখা যে কোনো চিঠিই আমার কাছে পবিত্র।" সে মাহাত্মের এক সুন্দর ভঙ্গিমাতে
নিজের মাথাটাকে পেছনে হেলিয়ে দিলো। "আমি আপনার কাছে যে প্রস্তাবটা রাখছি তা
একেবারেই অন্য ধরণের। আমি,
যা বললাম, খুবই অভাবের মধ্যে আছি, আর আমার বিবেক আমাকে বাধ্য করতে পারে পুলিশের কাছে কিছু তথ্য পৌঁছে দেওয়ার
জন্য।"
ডেরেক ধীরে ধীরে ঘরে ফিরে
এলো।
"আপনি কি বলতে
চাইছেন?"
কমতের সহমত হওয়ার হাসিটা
আরেকবার তার মুখে ফুটে উঠলো।
"নিশ্চিতভাবেই
খুঁটিনাটির মধ্যে যাওয়ার কোনো প্রয়োজন নেই।" সে আস্তে করে বললো, "কথায় আছে,
তাকেই খোঁজ অপরাধে যে সবথেকে লাভবান হয়েছে, ঠিক কিনা?
আমি যেমন একটু আগে বললাম, আপনি কিছুদিন আগে অনেকগুলো টাকার অধিকারী হয়েছেন।"
ডেরেক হেসে উঠলো।
"পুরোটা যদি এই হয়ে
থাকে -" সে অবজ্ঞার সাথে বললো।
কিন্তু কমতে তার মাথা
ঝাঁকাচ্ছিলো,
"কিন্তু এটাই পুরোটা নয়, হে প্রিয় স্যার, আমি আপনার কাছে আসতাম না যদিনা আমার কাছে এর থেকে আরো নিখুঁত এবং বিস্তারিত
তথ্য থাকতো। গ্রেফতার হওয়া এবং খুনের বিচারাধীন আসামি হওয়াটা, মসিয়েঁ,
মেনে নেওয়া যায় না।
ডেরেক তার আরো কাছে সরে
এলো। তার মুখে রাগের যে ভয়ঙ্কর অভিব্যাক্তি ফুটে উঠেছে তাতে কমতে নিজে থেকেই দু এক
পা পিছিয়ে গেলো।
"আপনি কি আমাকে ভয়
দেখছেন?"
যুবকটি রেগে প্রশ্ন করলো।
"আপনি এ ব্যাপারে
আর কিছুই শুনতে পাবেন না।" কমতে তাকে আশ্বাস দিলো।
"আমি যত বড় বড়
মিথ্যে কথা শুনেছি,
তার মধ্যে -"
কমতে হাত তুলে থামতে
নির্দেশ করলো।
"আপনি ভুল করছেন। এটা মিথ্যে কথা নয়। আচ্ছা, আপনাকে বিশ্বাস করানোর জন্য আপনাকে আমি এই কথাটা জানাবো। খবরটা আমি বিশেষ একজন
মহিলার কাছ থেকে পেয়েছি। খুনটা যে আপনিই করেছেন তাঁর কাছেই সেই অকাট্ট প্রমাণটা
আছে।"
"মহিলা? কে?"
"মাদমোয়েজেল মিরেলে।"
যেন আচমকা আঘাতে ডেরেক
কিছুটা পিছিয়ে গেলো।
"মিরেলে," সে বিড়বিড় করে বললো।
এটাই তার সুবিধাজনক
পরিস্থিতি বুঝে কমতে দ্রুত তার নিজের ব্যাপারটা নিয়ে চাপ দিলো।
"তুচ্ছ এক লক্ষ
ফ্রাঙ্কস,"
সে বললো, "এর বেশি আর চাই না।"
"হুম?" ডেরেক অন্যমনস্কভাবে বললো।
"আমি বলছিলাম কি, মসিয়েঁ,
তুচ্ছ এক লক্ষ ফ্রাঙ্কসই আমার বিবেককে - সন্তুষ্ট
করবে।"
ডেরেক যেন নিজেকে গুছিয়ে
নিচ্ছিলো। সে উদগ্রীব হয়ে কমতের দিকে তাকিয়ে ছিল।
"আপনি কি এখনই আমার
উত্তর চান?"
"দয়া করে যদি বলেন, মসিয়েঁ।"
"তাহলে সেটা হলো, আপনি জাহান্নামে যেতে পারেন, বুঝেছেন?"
কমতে এতটা হতচকিত হয়ে
পড়েছিল যে তার মুখ থেকে কথাই বেরোচ্ছিল না, তাকে সেই অবস্থায় রেখে, ডেরেক পেছনে ঘুরে ঘর থেকে দ্রুত বেরিয়ে গেলো।
হোটেল থেকে বেরিয়ে সে
একটা ট্যাক্সি ডাকলো এবং মিরেলের হোটেলের দিকে চললো।
খোঁজ নিতে, সে জানতে পারলো যে নৃত্যশিল্পীটি এইমাত্র ফিরে এসেছেন। ডেরেক দারোয়ানটিকে তার
কার্ডটি দিলো।
"এটা মাদমোয়েজেলের
কাছে নিয়ে যাও এবং জিজ্ঞেস করে এস উনি আমার সঙ্গে দেখা করবেন কিনা।"
কিছুক্ষন পেরিয়ে গেলো, তারপর ডেরেককে একটা ছোকরা চাকরের পেছনে যেতে বলা হলো।
নৃত্যশিল্পীটির ঘরের
কাছাকাছি আসতেই একটা বিদেশী সুগন্ধের ঢেউ ডেড়েকের নাকে এসে লাগলো। ঘরটা কার্নেশন, অর্কিড এবং লজ্জাবতী লতায় ঠাসা। মিরেলে একটা ফোমের মতো লেস দেওয়া ড্রেসিং গাউন
পরে জানলার কাছে দাঁড়িয়ে ছিল।
সে তার দিকে এগিয়ে এলো, তার হাত দুটো বাইরের দিকে ছাড়ানো।
"ডেরেক - তুমি আমার
কাছে এসেছো। আমি জানতাম তুমি আসবে।"
সে জড়িয়ে ধরা হাত দুটো
সরিয়ে দিলো এবং কঠিন দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে থাকলো।
"তুমি কমতে ডে লা
রোচেকে আমার কাছে কেন পাঠিয়েছ?"
সে তার দিকে অবাক
দৃষ্টিতে তাকালো,
যা নাকি অকৃত্রিম বলে মনে হলো।
"আমি? কমতে ডে লা রোচেকে তোমার কাছে পাঠিয়েছি? কিন্তু কেন?"
"স্পষ্টতই -
ব্ল্যাকমেল করার জন্য।"
আবার সে অবাক হয়ে তাকিয়ে
থাকলো। তারপর হঠাৎই সে হাসতে শুরু করলো এবং মাথা নাড়তে লাগলো।
"অবশ্যই। এটাই
প্রত্যাশিত ছিল। ওই লোকটা,
এই কাজই করবে। আমার বোঝা উচিত ছিল। না, ডেরেক,
নিশ্চিতভাবেই, আমি ওনাকে পাঠাই
নি।"
সে খুব তীক্ষ্ণভাবে
মিরেলের দিকে তাকিয়ে ছিল,
যেন সে তার মনের ভেতরের কথা পড়তে চাইছে।
"আমি তোমাকে বলবো," মিরেলে বললো,
"আমি লজ্জিত, কিন্তু আমি তোমাকে বলবো।
তুমি বুঝতে চেষ্টা করো,
আগের দিন, আমি রাগে ক্ষিপ্ত হয়ে
গিয়েছিলাম,
ভালোরকম ক্ষিপ্ত -" সে একটা সাবলীল ভঙ্গিমা করলো। আমার প্রকৃতি, খুব একটা ধৈর্যশীল নয়।
আমি তোমার ওপর প্রতিশোধ নিতে চাইছিলাম, তাই আমি কমতে ডে লা রোচের
কাছে গেছিলাম,
আর তাকে পুলিশের কাছে গিয়ে অমুক অমুক এবং অমুক অমুক বলতে
বলি। কিন্তু ভয়ের কিছু নেই,
ডেরেক। আমি পুরোপুরি আমার বুদ্ধি হারিয়ে ফেলি নি; প্রমাণটা শুধুমাত্র আমার কাছেই আছে। আমার কথা ছাড়া পুলিশ কিছুই করতে পারবে না, বুঝতে পেরেছো?
আর এবার - এবার?"
তার দিকে একটা আবেগ
ঘনীভূত চোখে তাকিয়ে,
মিরেলে তার কাছে আরো ঘনিষ্ট হয়ে এলো।
সে মিরেলেকে একটা ধাক্কা
দিয়ে তার থেকে দূরে সরিয়ে দিলো। মিরেলে সেখানে দাঁড়িয়ে থাকলো, তার বুক দ্রুত ওঠানামা করছে, তার চোখ সরু হয়ে বেড়ালের
চোখের আকার নিয়েছে।
"সাবধান, ডেরেক,
খুব সাবধান। তুমি আমার কাছে ফিরে এসেছো, আসো নি?"
"আমি তোমার কাছে
কখনোই ফিরে আসবো না।" ডেরেক স্থিরভাবে বললো।
"হুম!"
নৃত্যশিল্পীটিকে এখন
পুরোপুরি একটা বেড়ালের মতো লাগছিলো। তার চোখের পাতাগুলো ঝিকমিক করছিলো।
"তাহলে আরেকজন
মহিলা আছে?
ওই যার সঙ্গে তুমি সেদিন লাঞ্চ করলে। তাহলে, আমিই ঠিক?"
"আমি ঠিক করেছি ওই
মহিলাকে আমায় বিয়ে করার প্রস্তাব দেব। তোমারও এটা জানা উচিত।"
"ওই পরিপাটি ইংরেজ
মহিলা! তোমার কি মনে হয় আমি এটা এক মুহূর্তের জন্যও মেনে নেবো? আঃ, না।" তার সুন্দর নমনীয় দেহ কেঁপে উঠলো।
"শোনো, ডেরেক,
লন্ডনে আমাদের যা কথাবার্তা হয়েছিল তা কি তোমার মনে আছে? তুমি বলেছিলে একমাত্র যা তোমাকে বাঁচাতে পারবে তা হচ্ছে তোমার স্ত্রীর মৃত্যু।
তুমি দুঃখ করেছিলে তার স্বাস্থ বেশ ভালো বলে। তার পরেই অ্যাকসিডেন্টের বুদ্ধিটা
তোমার মাথায় আসে। আর অ্যাকসিডেন্টের থেকেও বেশি কিছু।
"অনুমান করছি," ডেরেক অবজ্ঞার সঙ্গে বললো, "এই কথাবার্তাগুলোই তুমি
কমতে ডে লা রোচের কাছে পুনরাবৃত্তি করেছিলে।"
মিরেলে হেসে উঠলো।
"আমি কি বোকা? পুলিশ কি এরকম মাথামুন্ডুহীন একটা গল্প নিয়ে কিছু করতে পারে? দেখো - আমি তোমাকে একটা শেষ সুযোগ দেব। তুমি ওই ইংরেজ মহিলাকে ত্যাগ করো। আমার
কাছে ফিরে এস। আর তারপর,
প্রিয়, আমি আর কখনো, কখনো নিঃস্বাস -"
"নিঃস্বাস কি?"
সে মৃদু ভাবে হাসলো, "তুমি ভাবছো কেউ তোমাকে দেখে নি -"
"তুমি কি বলতে
চাইছো?"
"আমি যা বললাম, তুমি ভাবছো কেউ তোমাকে দেখে নি - কিন্তু আমি তোমাকে দেখেছি, ডেরেক,
বন্ধু আমার; আমি তোমাকে মাদামের, তোমার স্ত্রীর কম্পার্টমেন্ট থেকে বেরোতে দেখেছি সেই রাতে, ট্রেন লিয়োন্স পৌঁছনোর ঠিক আগে। আর আমি এরথেকেও বেশি কিছু জানি। আমি জানি তুমি
তার কম্পার্টমেন্ট থেকে যখন বেরিয়ে এলে সে তখন মৃত।"
সে মিরেলের দিকে স্থির
দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকলো। তারপর যেন স্বপ্নের ঘোরে আছে এমনভাবে খুব ধীরে ধীরে ঘুরে
দাঁড়িয়ে সে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলো, সে যেন অল্প অল্প দুলে
দুলে হাটছিলো।
চ্যাপ্টার ২৬
একটা সতর্কবার্তা
"তাহলে, ব্যাপারটা হোল," পোয়ারো বললেন,
"যে আমরা খুবই ভালো বন্ধু এবং আমাদের মধ্যে কোনো লুকোছাপা
নেই।"
ক্যাথেরিন মাথাটা ঘুরিয়ে
তাঁর দিকে তাকালো। তাঁর গলায় কিছু একটা ছিল, যেন কোনো
গুরুগম্ভীর বিষয়ের একটা চোরাস্রোত, যেটা সে আগে শোনে নি।
তাঁরা মন্টে কার্লোর একটা বাগানে বসেছিল। ক্যাথেরিন তার বন্ধুদের সাথে এসেছিলো,
ঢুকতেই তাদের সাথে নাইটোন এবং পোয়ারো সাথে দেখা হয়ে যায়। লেডি
ট্যাম্পলিং নাইটোনকে দখল করে নেন এবং তাকে পুরোনো দিনের কথাবার্তায় অভিভূত করে দেন,
ক্যাথেরিনের মনে একটা হালকা সন্দেহ আছে যে এর বেশিরভাগটাই বানানো।
তাঁরা দুজনে একটু দূরে এগিয়ে গেছেন, লেডি ট্যাম্পলিং হাত
দিয়ে যুবকটির বাহুটি ধরে আছেন। নাইটোন ঘাড় ঘুরিয়ে বার দুয়েক দেখার চেষ্টা করেছে,
আর তাদের দেখে পোয়ারো চোখ চিকচিক করে উঠেছে।
"অবশ্যই, আমরা বন্ধু," ক্যাথেরিন বললো।
"প্রথম থেকেই আমরা
একে অপরের প্রতি সহানুভূতিশীল," পোয়ারো
চিন্তিতভাবে বললেন।
"যখন থেকে আপনি
আমাকে বলেন যে 'গোয়েন্দা উপন্যাস' বাস্তব
জীবনেও ঘটে।"
"আর আমি ঠিক কথাই
বলেছিলাম, সত্যি কিনা?" তিঁনি
জোরালো ভাবে আঙ্গুল নাড়িয়ে তাকে চ্যালেঞ্জ করলেন। "আমরা এরকমই একটার মধ্যে
হাবুডুবু খাচ্ছি। আমার জন্য এটা খুবই স্বাভাবিক ব্যাপার - আমার কাছে এটা একটা
প্রতিদিনকার কাজ - কিন্তু আপনার জন্য এটা আলাদা। হ্যাঁ," তিঁনি প্রতিদ্ধনির মত যোগ করলেন, "আপনার জন্য
এটা আলাদা।"
ক্যাথেরিন খুব
তীক্ষ্ণভাবে পোয়ারোর দিকে তাকিয়ে থাকলেন। যেন তিঁনি তাকে সতর্ক করছেন, তাকে যেন একটা ভয়ানক কিছুর ব্যাপারে ইশারা করছেন, যেটা তার দৃষ্টি এড়িয়ে গেছে।
"একথা কেন বলছেন যে
আমি এটার মদ্ধিখানে আছি? এটা সত্যি যে, মৃত্যুর
আগে মিসেস কেটারিংয়ের সঙ্গে আমার কিছু কথাবার্তা হয়েছিল, কিন্তু
এখন - এখন তো এটা মিটে গেছে। আমি আর এই কেসটার সাথে যুক্ত নই।"
"আঃ, মাদমোয়েজেল, মাদমোয়েজেল, আমরা কি কখনো বলতে পারি যে, 'আমি আর এটার সাথে বা
ওটার সাথে যুক্ত নই'?"
ক্যাথেরিন অবিশ্বাসের
সাথে তাঁর দিকে ঘুরে দাঁড়ালো।
"কি ব্যাপার?" সে জিজ্ঞেস করলো, "আপনি যেন
আমাকে কিছু একটা বলতে চাইছেন - বরং কিছু একটা যেন বোঝাতে চাইছেন। আমি ইশারার মানে
বোঝার মতো চালাক চতুর নই। আমি বলবো তার থেকে বরং সোজাসুজি বলে দিন যা বলতে
চাইছেন।"
পোয়ারো দুঃখিতভাবে তার
দিকে তাকালেন। "আঃ, এটা কিন্তু ইংরেজি," তিঁনি নিচু স্বরে অস্পষ্টভাবে করে বললেন, "সব
কিছুই সাদা কালোতে আছে, সব কিছু পরিষ্কার এবং ভালোভাবে
বর্ণনা করা আছে। কিন্তু জীবনটা, সেরকম নয়, মাদমোয়েজেল। এখানে এমন অনেক জিনিস আছে যা এইমুহূর্তে নেই, কিন্তু আগে থেকেই তাদের ছায়া পড়েছে।"
তিঁনি সিল্কের একটা লম্বা
রুমাল দিয়ে ভুরুগুলো মুছলেন এবং নিচু গলায় অস্পষ্টভাবে বললেন, "আঃ, এইখানেই আমি কাব্যিক হয়ে পড়ি।
আসুন, আপনি যেমন বললেন, আমরা শুধুমাত্র,
সঠিক তথ্যগুলো নিয়ে আলোচনা করি। আর, সঠিক তথ্য
বলতে, বলুন তো মেজর নাইটোনের ব্যাপারে আপনার কি মনে হয়?"
"আমার ওনাকে অবশ্যই
খুব ভালো লাগে," ক্যাথেরিন খুব আবেগপূর্ণভাবে বললো,
"উনি খুবই মনোরঞ্জক একজন মানুষ।"
পোয়ারো একটা দীর্ঘশ্বাস
ফেললেন।
"কি হলো?" ক্যাথেরিন জিজ্ঞেস করলো।
"আপনি এমন
আন্তরিকভাবে উত্তর দিলেন," পোয়ারো বললেন, "আপনি যদি উদাসীন গলায় বলতেন 'বেশ ভালোই তো,' তাহলে, জানেন তো, হয়তো আমি
একটু বেশি খুশি হতাম।"
ক্যাথেরিন কোনো উত্তর
দিলো না। তার একটু অস্বস্তি লাগছিলো। পোয়ারো স্বপ্নালুভাবে বলতে লাগলো: "তবুও, কে জানে নারীর মনের কথা? মনের কথা
লুকোনোর জন্য তাদের অনেক উপায় আছে - আর আন্তরিকতা হয়তো এরকমই একটা উত্তম
উপায়।"
তিঁনি একটা দীর্ঘশ্বাস
ফেললেন।
"আমি বুঝতে পারছি না
-" ক্যাথেরিন বলতে শুরু করলো।
তিঁনি তাকে থামিয়ে দিলেন।
"আপনি বুঝতে পারছেন
না কেন আমি এমন নির্লজ্জর মতো কথা বলছি, মাদমোয়েজেল?
আমি একজন বৃদ্ধ মানুষ আর মাঝে মাঝে - খুব একটা ঘন ঘন নয় - কিছু কিছু
মানুষের সাথে আমার পরিচয় হয় যাদের জন্য আমি সবসময় মঙ্গল কামনা করি। আমরা বন্ধু,
মাদমোয়েজেল। আপনি নিজেই সেকথা বলেছেন। আর ব্যাপারটা শুধুমাত্র এই যে
- আমি আপনাকে সুখী দেখতে চাই।"
ক্যাথেরিন স্থিরদৃষ্টিতে
সামনের দিকে সোজাসুজি তাকিয়ে থাকলো। তার কাছে একটা ছাপা কাপড়ের ছাতা ছিল তার সরু
দিকটা দিয়ে সে তার পায়ের কাছে পাথরটার নক্সাটার ওপর বোলাচ্ছিলো।
"আমি আপনাকে মেজর
নাইটোনের ব্যাপারে একটা প্রশ্ন করেছিলাম, এবার আমি
আপনাকে আরেকটা প্রশ্ন করবো। আপনি কি ডেরেক কেটারিংকে পছন্দ করেন?"
"আমি তাঁকে সামান্যই
চিনি," ক্যাথেরিন বললো।
"এটা এই প্রশ্নের
কোনো উত্তর হলো না।"
"আমার এটাই মনে
হয়।"
তার গলার স্বরে এমন কিছু
একটা ছিল, যা তাঁকে আঘাত করেছিল, তিঁনি ক্যাথেরিনের দিকে তাকিয়ে থাকলেন। তারপর গম্ভীরভাবে ধীরে ধীরে মাথা
নাড়াতে থাকলেন।
"হয়তো আপনি ঠিকই
বলছেন, মাদমোয়েজেল। দেখুন, এই
যে আমি আপনার সাথে কথা বলছি এই পৃথিবীতে আমি কিন্তু অনেক কিছুই দেখেছি, আমি জানি দুটো জিনিস আছে যা সত্যি। একজন ভালো পুরুষ মানুষ একজন খারাপ
মহিলার প্রতি ভালোবাসার জন্য বরবাদ হয়ে যেতে পারে - আবার উল্টো দিকটাও সত্যি। একজন
খারাপ পুরুষ মানুষও সমানভাবে একজন ভালো মহিলার প্রতি ভালোবাসার জন্য বরবাদ হয়ে
যেতে পারে।"
ক্যাথেরিন খুব
তীক্ষ্ণভাবে তাকালো।
"আপনি যখন বরবাদ
বললেন -"
"আমি তার দৃষ্টিকোণ
থেকে বুঝিয়েছি। অন্য সব কিছুর মতো একজনকে অপরাধীকে অপরাধের ক্ষেত্র সর্বান্তকরণে
নিয়োজিত হতে হবে।"
"আপনি আমাকে সতর্ক
করতে চাইছেন," ক্যাথেরিন নিচু গলায় বললো,
"কিন্তু কার থেকে?"
"আমার পক্ষে আপনার
মনের কথা জানা সম্ভব নয়, মাদমোয়েজেল; যদি
সম্ভব হতো তাহলেও নিশ্চয় আমাকে জানতে দিতে
চাইতেন না। আমি শুধু এই কথাই বলবো। কিছু পুরুষ আছেন যাদের প্রতি মহিলাদের এক
অদ্ভুত রকমের আকর্ষণ আছে।"
"কমতে ডে লা রোচে," ক্যাথেরিন একটু হেসে, বললো।
"আরো অনেকে আছেন -
কমতে ডে লা রোচের থেকে অনেক বেশি বিপজ্জনক। তাঁদের এমন অনেক গুন আছে যা খুবই
আকর্ষক - বেপরোয়া, সাহসী, স্পর্ধা। আপনি
মুগ্ধ হয়ে যাবেন, মাদমোয়েজেল; আমি
দেখতে পারছি, কিন্তু আমার মনে হয় এটা এর থেকে আর বেশি কিছু
নয়। আশাকরি। এই লোকটি যার সম্পর্কে আমি বলছি, তার
অনুভূতিগুলো কিন্তু একেবারে সত্যি, কিন্তু একই সঙ্গে -"
"কি?"
তিঁনি উঠে দাঁড়িয়ে
ক্যাথেরিনের দিকে তাকিয়ে থাকলেন। তারপর তিঁনি একটা নিচু, স্বতন্ত্র গলায় বললেন:
"আপনি হয়তো, একজন চোরকে, ভালোবাসতেও পারেন, মাদমোয়েজেল, কিন্তু একজন হত্যাকারীকে নয়।"
এটা বলেই তিঁনি তাড়াতাড়ি
ওখান থেকে চলতে শুরু করলেন ক্যাথেরিনকে ওখানেই বসে থাকতে দিয়ে।
তিঁনি ক্যাথেরিনের একটি
ছোট দীর্ঘশ্বাস শুনতে পেলেন কিন্তু তাতে কোনো মনোযোগ দিলেন না। তাঁর যা বলার ছিল
তা বলা হয়ে গেছে। তাঁর শেষ অকাট্য বাক্যাংশটা হজম করার জন্য তিঁনি তাকে ওখানেই
ছেড়ে এলেন।
ডেরেক কেটারিং, ক্যাসিনো থেকে সূর্যালোকে বেরিয়ে এসে, তাকে
বেঞ্চে বসে থাকতে দেখলো, এবং তার পাশে এসে বসলো।
"আমি জুয়া খেলছিলাম," সে মৃদু হেসে বললো, "অসফলভাবে
জুয়া খেলছিলাম। সমস্ত কিছুই হেরে গেছি - সমস্ত কিছু, মানে,
আমার কাছে যা ছিল।"
ক্যাথেরিন উদ্বিগ্ন মুখে
তার দিকে তাকালো। তার আচরণে নতুন কিছু একটা দেখে সে সঙ্গে সঙ্গে সচকিত হয়ে উঠেছিল।
ছোট ছোট সূক্ষ্ণ কিছু ইঙ্গিত একটা চাপা উত্তেজনাকে কিছুতেই ঢাকা দিতে পারছে না।
"আমার মনে হয় আপনি
চিরকালই একজন জুয়াড়ি। জুয়ার মনোবৃত্তি আপনাকে আকর্ষণ করে।
"চিরটা কাল এবং
সমস্ত দিক থেকেই কি আমি একজন জুয়াড়ি? আপনি
একদম ঠিক। আপনি কি এরমধ্যে উত্তেজক কিছু পান না? সমস্ত কিছুর
ঝুঁকি নেওয়া একটা ছোড়ার ওপর - এর মতো আর কিছুই নেই।"
নিজেকে শান্ত এবং অবিচলিত
বলে বিশ্বাস করলেও, ক্যাথেরিন উত্তর দেওয়ার জন্য একটা মৃদু
রোমাঞ্চ অনুভব করছিলো।
"আমি আপনার সাথে কথা
বলতে চাই," ডেরেক বলতে থাকলো, "আর কে জানে, আবার কবে সুযোগ পাবো? একটা ধারণা ঘুরে বেড়াচ্ছে যে আমি আমার স্ত্রীকে খুন করেছি - না, দয়া করে বাধা দেবেন না। যদিও, এটা পুরোপুরি
হাস্যকর।" সে দু এক মিনিটের জন্য থামলো তারপর আবার ভেবেচিন্তে কথা বলতে শুরু
করলো। "পুলিশ এবং এখানকার স্থানীয় কর্তৃপক্ষকে সামলানোর জন্য আমাকে - মানে -
কিছু শিষ্টাচারের ভান করতে হয়। তবে আমি আপনার সাথে কোনরকম ভান করতে করতে চাই না। আমি
টাকাকে বিয়ে করতে চেয়েছিলাম। আমি টাকার সন্ধানেই ছিলাম যখন আমার সাথে প্রথম রুথ
ভ্যান আলদীনের পরিচয় হয়। তাকে অনেকটা রোগা পাতলা ম্যাডোনার মতো দেখতে ছিল, আর আমি - সত্যি বলতে কি - সমস্ত রকমের ভালোভাবে থাকার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম
- কিন্তু খুব বিচ্ছিরি ভাবে মোহভঙ্গ হয়। আমার স্ত্রী যখন আমাকে বিয়ে করে তখন সে
অন্য একজনকে ভালোবাসতো। সে আমার সামান্যতম পরোয়াও করতো না। ওহ, আমি কোনো অনুযোগ করছি না; এটা পুরোপুরি একটা
সম্মানজনক চুক্তি ছিল। সে লেকোনবুরি চাইতো আমি টাকা চাইতাম। ঝামেলাটা শুরু হলো
রুথের আমেরিকান রক্ত থেকে। আমার জন্য বিন্দুমাত্র পরোয়া না করেও সে সবসময় চাইতো যে
আমি তার সমস্ত আশা আকাঙ্খা পূরণ করি। সময়ে অসময়ে প্রায় সে আমাকে একথা বলেছে যে সে
আমাকে কিনে নিয়েছে এবং আমি তারই অধীনস্ত। ফলাফল হলো আমি তার সাথে জঘন্য ব্যবহার
করতে শুরু করলাম। আমার শশুর মশাই আপনাকে হয়তো সেকথা জানাবেন, আর তিঁনি এব্যাপারে একদমই ঠিক। রুথের মৃত্যুর সময়, আমি
পুরোপুরি বিপর্যয়ের মুখে ছিলাম।" সে হঠাৎ হেসে উঠলো। "একজন তখনি
পুরোপুরি বিপর্যয়ের মুখে পরে যখন সে রুফুস ভ্যান আলদীনের মতো মানুষের বিরুদ্ধে
দাঁড়ায়।"
"আর তারপর?" ক্যাথেরিন একটা নিচু স্বরে জিজ্ঞেসা করলো।
"আর তারপর," ডেরেক তার কাঁধ ঝাকালো, "রুথ
খুন হলো - অত্যন্ত সঠিক মুহূর্তে অপ্রত্যাশিত ভাবে।"
সে হেসে উঠলো, তার হাসির শব্দ যেন কাথেরিনকে আঘাত করছিলো। ক্যাথেরিন কুঁকড়ে
গেলো।
"হ্যাঁ," ডেরেক বললো, "ওটা মোটেই
রুচিসম্মত নয়। কিন্তু খুবই সত্যি। এবার আমি আপনাকে আরো বেশি কিছু বলতে চলেছি।
আপনাকে প্রথম দেখার মুহূর্তে থেকেই আমি জানতাম যে পৃথিবীতে আমার যোগ্য মহিলা
একমাত্র আপনি। আমি - আপনার থেকে ভয়ে ভয়ে ছিলাম। আমার মনে হয়েছিল আপনি আমার জন্য
দুর্ভাগ্য বয়ে নিয়ে আসবেন।"
"দুর্ভাগ্য?" ক্যাথেরিন তীক্ষ্ণ গলায় জিজ্ঞেসা করলো।
সে স্থির দৃষ্টিতে তার
দিকে তাকিয়ে থাকলো। "আপনি কথাটাকে এইভাবে পুনরাবৃত্তি করলেন কেন? আপনি কি ভাবছেন?"
"লোকে আমায় যা যা
বলেছে আমি সেই সব কথাগুলো ভাবছিলাম।"
ডেরেক হঠাৎ মুচকি হেসে
উঠলো। "তারা আমার সম্পর্কে আপনাকে অনেক কিছুই জানাবে, হে বন্ধু, আর তার অনেকটাই সত্যি। হ্যাঁ,
আর খুব খারাপ জিনিসগুলোও - যা আমি আপনাকে কোনোদিনও বলতে পারবো না।
আমি চিরকালই একজন জুয়াড়ি - আর আমি বেশ কিছু লম্বা বাজিও ধরেছি। আমি সেগুলো এখন বা
অন্য কোনো সময় আপনার কাছে স্বীকার করতে পারবো না। অতীতের ব্যাপার ভুলে যাওয়াই ভালো।আমি চাই যে আপনি এই কথাটা বিশ্বাস করুন। আমি আপনার কাছে শপথ
করে বলছি যে আমি আমার স্ত্রীকে খুন করি নি।"
সে কথাগুলো যথেষ্ট
আন্তরিকতার সাথে বললেও, তাদের মধ্যে কোথাও যেন একটা নাটকীয়তার
ছোঁয়া রয়ে গেছিলো। সে তার বিচলিত চাহুনির দিকে তাকিয়ে বলে যেতে লাগলো:
"আমি জানি, আগেরদিন আমি মিথ্যে কথা বলেছিলাম, আমি
আমার স্ত্রীর কম্পার্টমেন্টেই গেছিলাম।"
"হুম," ক্যাথেরিন বললো।
"আমি কেন গেছিলাম
সেটা বোঝানো বেশ কঠিন, কিন্তু আমি চেষ্টা করছি। আমি একটা আবেগের
বসে কাজটা করে ফেলেছিলাম। দেখুন, আমি মোটামুটি ভাবে আমার
স্ত্রীর ওপর নজর রাখছিলাম। ট্রেনে আমি সবার চোখের আড়ালেই ছিলাম। মিরেলে জানিয়েছিল আমার স্ত্রী কমতে ডে লা রোচের সাথে
প্যারিসে দেখা করবে। কিন্তু, যতদূর আমি লক্ষ্য
করেছিলাম, সেরকমটা ঘটে নি। আমি বেশ লজ্জিত ছিলাম, হঠাৎ মনে হলো এটা নিয়ে ওর সঙ্গে একটা হেস্তনেস্ত হয়ে যাওয়া দরকার, তাই আমি দরজাটা ঠেলে ঢুকলাম।
সে কিছুক্ষন থামলো।
"তারপর," ক্যাথেরিন খুব মোলায়েমভাবে বললো।
"রুথ বাঙ্কের ওপর
ঘুমোচ্ছিলো - ওর মুখটা অন্যদিকে ঘোরানো ছিল - আমি খালি ওর মাথার পেছন দিকটা দেখতে
পারছিলাম। আমি অবশ্যই, ওকে জাগাতে পারতাম। কিন্তু হঠাৎই বিপরীত
একটা চিন্তা মাথায় এলো। নতুন কি আর বলার বাকি আছে, যা আমরা
আগে শত বার বলি নি? ঘুমন্ত অবস্থায় ওকে এতো শান্ত লাগছিলো। আমি যতটা সম্ভব নিঃশব্দে কম্পার্টমেন্ট থেকে বেরিয়ে
আসি।"
"পুলিশকে মিথ্যে
বলার কারণ কি?" ক্যাথেরিন জিজ্ঞেসা করলো।
"কারণ আমি পুরোপুরি
বোকা নই। আমি প্রথম থেকেই বুঝেছিলাম যে, কার্যকারণের
দিক থেকে দেখলে, আমিই আদর্শ খুনি। আমি যদি একবার স্বীকার করি
যে খুনের ঠিক আগেই আমি ওর কম্পার্টমেন্টে ঢুকেছিলাম, তাহলে
চিরকালের জন্য আমার সমস্ত কিছু শেষ।"
"আচ্ছা।"
কিন্তু ক্যাথেরিন কি কিছু
বুঝেছিলো? সে নিজেই বলতে পারবে না। সে ডেরেকের
ব্যাক্তিত্বের প্রতি একটা চৌম্বক আকর্ষণ অনুভব করছিলো, কিন্তু
তার মধ্যে আরেকটা কিছু ছিল যা তাকে আটকাচ্ছিলো, তাকে পেছনে
টেনে রাখছিলো
"ক্যাথেরিন -"
"হ্যাঁ?"
"আপনি জানেন আমি
আপনাকে পছন্দ করি। আপনি - আপনি কি আমাকে পছন্দ করেন?"
"আমি - আমি জানি
না।"
দুর্বলভাবে বলা। হয় সে জানতো অথবা সে জানতো না।
যদি - শুধু যদি -
সে মরিয়া হয়ে এদিক ওদিক
তাকাতে থাকলো যদি কোনো সাহায্য পাওয়া যায়। এজন ফর্সা লম্বা মানুষকে - মেজর
নাইটোনকে খোঁড়াতে খোঁড়াতে তাড়াহুড়ো করে তাদের দিকে আসতে দেখে তার মুখে একটা হালকা রঙের
অভ্যাস দেখা গেলো।
তাকে স্বাগত জানানোর সময়
ক্যাথেরিনের গলায় যেন একটা স্বস্তি এবং অপ্রত্যাশিত উষ্ণতার ছোয়া পাওয়া গেলো।
ডেরেক মুখ ঘুরিয়ে থাকলো, তার মুখ বজ্রগর্ভ মেঘের মতোই অন্ধকার।
"লেডি ট্যাম্পলিং কি
ছোট ছোট বাজি ধরেন?" নাইটোন খুব সহজভাবে বললো,
"আমাকে তাঁর সাথে যোগ দিতেই হবে এবং কোনো দ্বিধা থাকলে তাঁকে
আমার মতামত জানতে হবে।"
সে পেছনে ঘুরে দাঁড়ালো আর
তাদের ছেড়ে এগিয়ে গেলো। ক্যাথেরিন আবার বসে পড়লো। তার হৃদস্পন্দন খুব দ্রুত গতিতে
এবং অসমভাবে চলতে লাগলো, কিন্তু তার পাশে বসা শান্ত, কিছুটা লাজুক পুরুষটির সাথে সাধারণ কথাবার্তা বলতে বলতে সে তার
আত্মনিয়ন্ত্রণ ফিরে পেলো।
তারপর সে একটা আতঙ্কের
সঙ্গে উপলব্ধি করলো যে ডেরেকের মতো নাইটোনও তার কাছে নিজের হৃদয় খুলে দিয়েছিলো, কিন্তু বেশ অন্যরকম ভাবে।
সে লজ্জাবনত ছিল এবং
তোতলাচ্ছিলো। কথাগুলো থেমে থেমে বলছিলো এবং কোনো রকমের বাগ্মিতা ছিল না।
"প্রথম দেখার
মুহূর্ত থেকেই - আমার - আমার এতো তাড়াহুড়ো করা উচিত নয় - কিন্তু ভ্যান আলদীন যে
কোনো দিন এখন থেকে চলে যেতে পারেন, আর আমি
হয়তো দ্বিতীয় কোনো সুযোগ পাবো না। আমি জানি এতো তাড়াতাড়ি আপনার পক্ষে আমাকে পছন্দ
করা সম্ভব নয় - সেটা অসম্ভব। আমি বলবো এটা আমার দিক থেকে একটা প্রবল সম্ভাবনা।
আমার কিছু ব্যাক্তিগত সম্পত্তি আছে, খুব একটা বেশি কিছু নয় -
না, এখনই উত্তর দেবেন না। আমি জানি আপনার উত্তর কি হবে।
কিন্তু যদি আমাকে হঠাৎ করে চলে যেতে হয় সেক্ষেত্রে আমি আপনাকে জানাতে চাই যে - আমি
আপনাকে পছন্দ করি।"
ক্যাথেরিন কেঁপে উঠেছিল -
আবেগাপ্লুত হয়ে পড়েছিল। তার ব্যবহার এতটাই ভদ্র এবং আকর্ষণীয় ছিল।
"আরেকটা বিষয় আছে।
আমি আর একটা কথাই বলতে চাই যে যদি - যদি কখনো কোনো সমস্যায় পড়েন, আমি যেকোনো কিছু করতে -"
সে ক্যাথেরিনের হাত নিজের
হাতে নিলো, মিনিট খানেক চেপে ধরে থাকলো, তারপর ছেড়ে দিয়ে পেছনে আর না ফিরে ক্যাসিনোর দিকে দ্রুত হাঁটা লাগলো।
ক্যাথেরিন তার চলে যাওয়ার
দিকে তাকিয়ে, পুরোপুরি স্থিরভাবে বসে থাকলো। ডেরেক
কেটারিং - রিচার্ড নাইটোন - দুজন পুরুষ একে ওপরের থেকে এতো আলাদা। নাইটোনের মধ্যে
একটা যত্নশীল ব্যাপার আছে - যত্নশীল এবং নির্ভরযোগ্য। ডেরেককে দেখতে গেলে - তখন
হঠাৎই ক্যাথেরিনের একটা অদ্ভুত অনুভতির অনুভব হলো। তার মনে হলো ক্যাসিনোর বাগানের
সিটটাতে সে আর একটা নেই, তার পাশে যেন আরেকজন কেউ দাঁড়িয়ে
আছে, আর সেই একজন হলেন মৃতা, রুথ
কেটারিং। তার আরো মনে হলো রুথ যেন চেষ্টা করছে - প্রচন্ড চেষ্টা করছে - তাকে কিছু
বলতে। প্রতিমূর্তিটা এতটাই অদ্ভুত, এতটাই প্রাণবন্ত যে
সেটাকে সরিয়ে দেওয়া সম্ভব নয়। সে নিশ্চিত যে রুথ কেটারিংয়ের আত্মা তাকে গুরুতর
কিছু জানাতে চায়। প্রতিমূর্তিটা মিলিয়ে গেলো। ক্যাথেরিন উঠে দাঁড়ালো, কিছুটা কাঁপছিলো। রুথ কেটারিং এতো ভয়ানকভাবে চেষ্টা করে কি বলতে চাইছিলো?
চ্যাপ্টার ২৭
মিরেলের সাথে
সাক্ষাৎকার
ক্যাথেরিনের কাছ থেকে
বিদায় নিয়ে নাইটোন এরকুল পোয়ারোর খোঁজে চললো, একটা রুমে তাঁকে সে
প্রফুল্ল মনে,
জোর সংখ্যার ওপর বাজি ধরতে দেখতে পেলো। নাইটোন গিয়ে তাঁর
সাথে যোগ দিলো,
আর দেখলো তেত্রিশ নম্বর উঠেছে, আর পোয়ারোর ধরা বাজি ভেসে গেলো।
"দুর্ভাগ্য!"
নাইটোন বললো,
"আপনি কি আরেকবার বাজি লাগাবেন?"
পোয়ারো মাথা নাড়ালেন।
"এই মুহূর্তে আর
নয়।"
"আপনি কি জুয়া খেলা
পছন্দ করেন?"
নাইটোন কৌতূহলী হয়ে জিজ্ঞেস করলো।
"না রুলেটটা পছন্দ
করি না।"
নাইটোন তাঁর দিকে দ্রুত একবার
তাকালো। তার নিজের মুখও বেশ বিচলিত লাগছিলো। সে থেমে থেমে, তাঁর প্রতি পূর্ণ সম্মানের সঙ্গে বলতে লাগলো।
"আচ্ছা, আপনি কি ব্যাস্ত,
মসিয়েঁ পোয়ারো? নাহলে কয়েকটা কথা আছে
আপনাকে জিজ্ঞেস করতাম।"
"আমি আপনার সমস্ত
কথা শুনতে প্রস্তুত। চলুন বাইরে যেতে আপত্তি নেই তো? সূর্যের তাপটা এখন বেশ আরামপ্রদ।"
তাঁরা দুজনে বাইরে বেরিয়ে
হাঁটতে থাকলেন,
আর নাইটোন একটা বড়ো শ্বাস নিলো।
আমি রিভিয়েরাকে ভালোবাসি," সে বললো,
"আমি প্রথম এখানে এসেছিলাম বারো বছর আগে, যুদ্ধের সময়,
যখন আমাকে লেডি ট্যাম্পলিংয়ের হসপিটালে পাঠানো হয়েছিল।
ফ্ল্যান্ডার্স থেকে এখানে এসে, স্বর্গে এলাম বলে মনে
হয়েছিল।"
"ঠিকই মনে হয়েছিল," পোয়ারো বললেন।
"যুদ্ধটা যেন কত
দিন আগেকার কথা মনে হচ্ছে!" নাইটোন চিন্তিতভাবে বললো।
তাঁরা চুপচাপ কিছুক্ষন
রাস্তা ধরে হাঁটলেন।
"আপনি বোধহয় কিছু
বলতে চান?"
পোয়ারো জিজ্ঞেস করলেন।
নাইটোন খুব অবাক হয়ে তাঁর
দিকে তাকালো।
"আপনি ঠিকই বলেছেন," সে স্বীকার করলো,
"যদিও, জানি না আপনি এটা কি করে
বুঝতে পারলেন।"
"এটা বোঝা খুবই
সহজ।" পোয়ারো শুস্ক স্বরে বললো।
"আমি জানতাম না যে
আমি এতটা স্বচ্ছ।"
"মানুষের চেহারা
এবং হাবভাব লক্ষ্য করাই আমার কাজ," বেটে খাটো মানুষটি সম্ভ্রমের
সঙ্গে ব্যাখ্যা করলেন।
"আমি বলতে চাই কি, মসিয়েঁ পোয়ারো। আপনি এই নৃত্যশিল্পী মহিলাটির কথা শুনেছেন - মিরেলে।"
"যিনি মসিয়েঁ ডেরেক
কেটারিংয়ের বিশেষ বান্ধবী?"
"হ্যাঁ, উনিই;
আর একথা জানার পর, বুঝতেই পারছেন, মিস্টার ভ্যান আলদীন স্বাভাবিক ভাবেই তাঁর বিরুদ্ধে পক্ষপাতদুষ্ট। উনি ভ্যান
আলদীনকে চিঠি লিখেছিলেন সাক্ষাৎকারের জন্য। উনি আমাকে একটা সংক্ষিপ্ত প্রত্যাখ্যান
জানিয়ে চিঠি লিখতে বলেন,
যা অবশ্যই আমি লিখে দি। আজ সকালে মিরেলে হোটেলে আসেন এবং
ওপরে তাঁর কার্ডটা পাঠান,
একথা জানিয়ে যে অবিলম্বে তাঁর মিস্টার ভ্যান আলাদীনের সাথে
দেখা করা বিশেষ ভাবে জরুরি এবং গুরুত্বপূর্ণ।"
"আপনি আমার কৌতূহল
জাগিয়ে তুলেছেন,"
পোয়ারো বললেন।
"মিস্টার ভ্যান
আলদীন রাগে অগ্নিশর্মা হয়ে গিয়েছিলেন। তিনি আমাকে নিচে কি বার্তা পাঠাতে হবে
জানিয়ে দিয়েছিলেন। আমি ওনার সাথে সহমত ছিলাম না। আমার মনে হয়েছিল, হয়তো,
এই মহিলা, মিরেলে আমাদের কোনো
গুরুত্বপূর্ণ তথ্য দিতে পারেন। আমরা জানি উনি দ্যা ব্লু ট্রেনে ছিলেন, উনি হয়তো কিছু দেখেছিলেন বা শুনেছিলেন যেটা জানা আমাদের জন্য খুবই
গুরুত্বপূর্ণ। আপনি কি আমার সাথে একমত নন, মসিয়েঁ পোয়ারো?"
"নিশ্চই," পোয়ারো শুস্ক স্বরে বললেন। "মসিয়েঁ ভ্যান আলদীন, বলতে গেলে,
খুবই বোকার মতো আচরণ করেছেন।"
"আপনি যে বিষয়টা
বুঝেছেন তাতে আমি ভীষণ খুশি হয়েছি," সেক্রেটারিটি বললো। "এবার আমি আপনাকে কিছু কথা বলতে চাই, মসিয়েঁ পোয়ারো। মিস্টার ভ্যান আলদীনের অবিবেচকের মতো ব্যাবহারে আমি এতটা আঘাত
পেয়েছিলাম যে আমি ব্যাক্তিগত ভাবে নিচে যাই এবং ওই মহিলার সাথে সাক্ষাৎ করি।"
"তাই নাকি?"
"সমস্যাটা হলো উনি
শুধুমাত্র ভ্যান আলদীনের সাথেই দেখা করার ব্যাপারে জোর দিচ্ছিলেন। আমি ওনার
বার্তাটা যতটা সম্ভব তরল করে দিয়েছিলাম। সত্যি বলতে কি - আমি ওনাকে বার্তাটা একেবারে অন্যরকম ভাবে দিয়েছিলাম। আমি
বলেছিলাম মিস্টার ভ্যান আলদীন এখন এতো ব্যাস্ত যে ওনার সাথে দেখা করতে পারছেন না, কিন্তু ওনার যদি কিছু বলার থাকে তাহলে আমাকে বলতে পারেন। এতে অবশ্য, উনি রাজি হন নি,
এবং আর কিছু না বলেই উনি চলে যান। কিন্তু আমার খুব নিশ্চিতভাবে
সন্দেহ হচ্ছে,
মসিয়েঁ পোয়ারো যে ওই মহিলা নিশ্চই কিছু জানেন।"
"এটা খুবই
গুরুত্বপূর্ণ,"
পোয়ারো শান্তভাবে বললেন। "আপনি কি জানেন উনি কোথায়
থাকছেন?"
"হ্যাঁ।"
নাইটোন হোটেলের নামটা বললো।
"ভালো," পোয়ারো বললেন,
"আমরা এখনই ওখানে যাবো।"
সেক্রেটারিটিকে দ্বিধান্বিত
লাগছিলো।
"আর মিস্টার ভ্যান
আলদীন?"
সে সংশয় নিয়ে জিজ্ঞেস করলো।
"মসিয়েঁ ভ্যান
আলদীন একজন একগুঁয়ে মানুষ,"
পোয়ারো শুস্ক স্বরে বললেন। "আমি একগুঁয়ে মানুষদের সাথে
তর্ক করি না। আমি কাজ করে যাই। আমরা এখুনি গিয়ে ওই মহিলার সাথে দেখা করবো। আমি
ওনাকে বলবো আপনি মসিয়েঁ ভ্যান আলাদিনের হয়ে কাজ করার ক্ষমতাপ্রাপ্ত, আর ওখানে আপনি আমার কথার কোনো বিরোধিতা করবেন না।"
নাইটোনকে তখনো একটু
দ্বিধাগ্রস্ত লাগছিলো,
কিন্তু পোয়ারো তাঁর ইতস্তত ভাবকে কোনো পাত্তাই দিলেন না।
হোটেলে, তাদের জানানো হলো মাদমোয়েজেল হোটেলেই আছেন, আর পোয়ারো তাঁর এবং
নাইটোনের কার্ডে পেন্সিল দিয়ে "মিস্টার ভ্যান আলদীনের কাছ থেকে" লিখে
ওপরে পাঠিয়ে দিলেন।
বার্তা এলো যে মাদমোয়েজেল
মিরেলে তাঁদের সাথে দেখা করবেন।
তাঁদের নৃত্যশিল্পীটির ঘর
অবধি পৌঁছে দেওয়ার পর থেকে,
পোয়ারোই প্রধান ভূমিকা নিলেন।
"মাদমোয়েজেল," তিঁনি অনেকটা নিচু হয়ে বাও করে, অস্পষ্টভাবে নিচু স্বরে
বললেন,
"আমরা একখানে মসিয়েঁ ভ্যান আলাদিনের তরফ থেকে এসেছি।"
"কিন্তু! উনি নিজে
কেন এলেন না?"
"উনি অসুস্থ," পোয়ারো মিথ্যা করে বললেন, " উনি দি রিভিয়েরা থ্রোটে
আক্রান্ত,
কিন্তু আমি, আমি ওনার হয়ে কাজ করার
ক্ষমতাপ্রাপ্ত,
এবং মেজর নাইটোনও, ওনার সেক্রেটারি। যদিনা, অবশ্য,
মাদমোয়েজেল সপ্তাহ দুয়েক মতো অপেক্ষা করতে রাজি
থাকেন।"
একটা ব্যাপারে অবশ্য
পোয়ারো একরকম নিশ্চিত ছিল,
যে মিরেলের মতো মেজাজের মহিলার কাছে 'অপেক্ষা'
শব্দটা অভিশাপের মতো।
"তাই নাকি, আমি বলবো,
মেসিউ," সে চিৎকার করে বললো, "আমি ধৈর্য ধরে আছি। আমি হাতে হাত দিয়ে বসে আছি। আর সেটা কিসের জন্য? যাতে আমি অপমানিত হতে পারি! হ্যাঁ, অপমানিত! আঃ! সে কিভাবে
ভাবলো যে মিরেলের সাথে এরকম ব্যবহার করা যাবে? পুরোনো দস্তানার মতো তাকে
ছুড়ে ফেলা যাবে। আমি বলছি,
আজ পর্যন্ত আপনি এমন কোনো পুরুষ পাবেন না যে নাকি মিরেলের
থেকে ক্লান্ত। চিরকাল আমিই তাদের থেকে ক্লান্ত হয়ে পড়ি।"
সে ঘরের এদিক থেকে ওদিক
হাটতে লাগলো,
তার কৃশকায় দেহ রাগে কাঁপছিলো। একটা ছোট টেবিল তার হাঁটার
পথের ফাঁকা জায়গাতে বাধা দিচ্ছিলো এবং সে সেটাকে এক কোনায় ছুড়ে ফেলে দিলো, সেটা দেয়ালে ধাক্কা খেয়ে চূর্ণ হয়ে গেলো।
"এইটাই আমি ওর সাথে
করবো,"
সে চিৎকার করে বললো, "আর এটাও!"
একটা লিলি ভর্তি কাঁচের
বাটি তুলে নিয়ে সে ঝাঁঝরির দিকে ছুড়ে দিলো, সেটা শত টুকরো হয়ে ভেঙে
গেলো।
নাইটোন তারদিকে একটা
ঠান্ডা, অপ্রসন্ন ব্রিটিশ দৃষ্টি নিয়ে তাকিয়েছিলো। তার নিজেকে অপ্রস্তুত এবং
অস্বস্তিকর পরিস্থিতির মধ্যে লাগছিলো। পোয়ারো,
অন্যদিকে, ঝিকিমিকি করা চোখে
দৃশ্যটা পুরোপুরি উপভোগ করছিলেন।
"আঃ, অসাধারণ!" তিনি চিৎকার করে বললেন, "দেখাই যাচ্ছে - মাদাম বেশ মেজাজি।"
"আমি একজন শিল্পী," মিরেলে বললো,
"প্রত্যেক শিল্পীরই একটা মেজাজ আছে। আমি ডেরেককে সাবধান
করেছিলাম,
কিন্তু ও শুনলো না।" সে হঠাৎই পোয়ারোর দিকে ঘুরে দাঁড়িয়ে বললো, "একথা সত্যি,
ঠিক কিনা, যে সে ওই ইংলিশ মহিলাকে
বিয়ে করতে চায়?"
পোয়ারো একটা কাশি দিলেন।
"আমি বলবো," তিনি নিচু স্বরে অস্পষ্টভাবে বললেন, "যে উনি তাঁকে প্রচন্ডভাবে ভালোবাসেন।"
মিরেলে তাঁদের দিকে এগিয়ে
এলো।
"সে তার স্ত্রীকে
খুন করেছে,"
সে চিৎকার করে বললো। "এইবার - আপনারা জানলেন! সে আমাকে
আগেই বলেছিলো যে সে এরকম কিছু করতে চায়। সে একটা কানা গলির শেষ প্রান্তে পৌঁছে
গেছিলো - জাহান্নামে! সেখান থেকে বেরিয়ে আসার জন্য সে সবথেকে সোজা পথটাই বেছে
নেয়।"
"আপনি বলছেন মসিয়েঁ
কেটারিংই তাঁর স্ত্রীকে হত্যা করেছেন।"
"হ্যাঁ, হ্যাঁ,
হ্যাঁ। আমি কি আপনাদের সেইকথাই বললাম না?"
"পুলিশের," পোয়ারো নিচু স্বরে অস্পষ্টভাবে বললেন, "তথ্য প্রমানের প্রয়োজন হবে - মানে - এই জবানবন্দির।"
"আমি আপনাকে বলছি, আমি ওকে সেইদিন রাতে ট্রেনে ওর স্ত্রীর কম্পার্টমেন্ট থেকে বেরিয়ে আসতে
দেখেছি।"
"কখন?" পোয়ারো তীক্ষ্ণ স্বরে জিজ্ঞেস করলেন।
"ট্রেন লিয়োন্স
পৌঁছনোর ঠিক আগে।"
"আপনি শপথ নিয়ে
একথা বলতে পারবেন,
মাদমোয়েজেল?"
এখন যিনি কথা বলছেন তিঁনি
একজন অন্য পোয়ারো,
তীক্ষ্ণ এবং দৃঢ়সংকল্প।
"হ্যাঁ।"
তারপর কয়েক মুহূর্তের
নীরবতা। মিরেলে জোরে জোরে শ্বাস নিচ্ছিলো, আর তার দৃষ্টি, অর্ধেক বেপরোয়া,
অর্ধেক ভয়ের চিহ্ন নিয়ে একজনের থেকে অন্যজনের মুখের ওপর
ঘুরে বেড়াচ্ছিল।
"এটা খুবই গুরুতর
একটা ব্যাপার,
মাদমোয়েজেল," গোয়েন্দাটি বললেন। "আপনি বুঝতে পারছেন তো কতটা গুরুতর?"
"নিশ্চই, আমি বুঝতে পারছি।"
"খুব ভালো," পোয়ারো বললেন,
"তাহলে, মাদমোয়েজেল, বুঝতেই পারছেন,
আর এক মুহূর্ত সময় নষ্ট করা উচিত হবে না। আপনি, আশা করি,
এই মুহূর্তে আমাদের সাথে একবার পরীক্ষক ম্যাজিস্ট্রেটের
অফিসে যাবেন।"
মিরেলে একটু অবাক হয়ে
গেলো। সে ইতস্তত করছিলো,
কিন্তু, পোয়ারো যেমন আগেই বুঝতে
পেরেছিলেন,
তার আর পালানো কোনো উপায় নেই।
"ভালো কথা," সে অস্ফুট স্বরে বললো,
"আমি কোটটা নিয়ে আসছি।"
ঘরে যখন কেবল মাত্র তাঁরা
দুজনে ছিলেন পোয়ারো এবং নাইটোন একে ওপরের দিকে দৃষ্টি বিনিময় করলেন।
"কাজটা তখনি করা
উচিত - যখন কি যেন বলে?
- লোহা গরম আছে।" পোয়ারো অস্ফুট স্বরে বললেন, "উনি মেজাজি মহিলা,
হয়তো, আর এক ঘন্টার মধ্যে, ওনার অনুতাপ জেগে উঠবে,
এবং উনি পিছিয়ে আসবেন। আমাদের যে রকম ভাবে হোক সেটা আটকাতে
হবে।
মিরেলে ফিরে এলো, একটা বালি রঙের ভেলভেটের রাপার জড়িয়ে যা নাকি লেপার্ডের চামড়া থেকে ছাঁটা, তাকে যেন একজন লেপার্ড কন্যার মতো লাগছিলো, ধূসর এবং বিপজ্জনক। তার
চোখ দুটো তখনো রাগে এবং দৃঢ়তায় জ্বলছিল।
তাঁরা মসিয়েঁ কাউক্স এবং
পরীক্ষক ম্যাজিস্ট্রেটকে একসাথেই পেলেন। পোয়ারো প্রথমে একটা ছোট ভূমিকা দিলেন, এবং তারপর মাদমোয়েজেল,
মিরেলেকে বিনয়ের সাথে তাঁর কাহিনীটা শোনাতে আহ্বান করা হলো।
সেটা সে প্রায় একই ভাবে বর্ণনা করলো যেভাবে সে পোয়ারো এবং নাইটোনের কাছে বর্ণনা
করেছিল, যদিও আগের থেকে যথেষ্ট সংযত আচরণের সাথে।
"এটা একটা অসাধারণ
কাহিনী, মাদমোয়েজেল,"
মসিয়েঁ ক্যারেজ ধীরে ধীরে বললেন। তিঁনি নিজের চেয়ারে হেলান
দিয়ে বসলেন,
নাকের ওপর চশমার ক্লিপটা একটু ঠিক করলেন, আর তারপর নৃত্যশিল্পীটির দিকে গভীর এবং অনুসন্ধিৎসু দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকলেন।
"আপনি আমাদের
বিশ্বাস করতে বলছেন যে মসিয়েঁ কেটারিং আপনার সামনে আগেই অপরাধের ব্যাপারটা বড়াই
করে বলেছিলেন?"
"হ্যাঁ, হ্যাঁ,
সে বলেছিলো যে, উনি খুবই সুসাস্থের
অধিকারিণী । যদি ওনাকে মরতে হয় তাহলে সেটা দুর্ঘটনা হতে হবে - সে নিজেই সব
ব্যবস্থা করবে বলেছিলো।"
"আপনি নিশ্চয় জানেন, মাদমোয়েজেল,"
মসিয়েঁ ক্যারেজ কঠিন স্বরে বললেন, "তথ্য প্রমানের ক্ষেত্রে আপনি নিজেকে একজন আনুসাঙ্গিক হিসেবে পেস করছেন।"
"আমি? কিন্তু,
এটা একদমই সামান্য কোনো ব্যাপার নয়, মসিয়েঁ। আমি বক্তব্যটাকে কখনো গুরুত্ব দিয়ে ভাবীই নি। আঃ না, অবশ্যই! আমি পুরুষদের চিনি, মসিয়েঁ; তারা বেশিরভাগ সময়ে অনেক উল্টো পাল্টা বকে। তারা যা বলে সব যদি আক্ষরিক অর্থে
নিতে হয় তাহলে একটা উদ্ভট পরিস্থিতির সৃষ্টি হবে।
পরীক্ষক ম্যাজিস্ট্রেটের
ভুরু দুটি ওপরে উঠে গেলো।
"তাহলে আমরা ধরে
নেবো কি,
আপনি মসিয়েঁ কেটারিংয়ের হুমকিটাকে সাধারণ কথা বলেই মনে করেছিলেন? আপনাকে প্রশ্ন করতে পারি কি, মাদমোয়েজেল, কেন আপনি লন্ডনের সমস্ত কাজ ছেড়ে রিভিয়েরা এলেন?"
মিরেলে তাঁর দিকে আবেগঘন
কালো চোখে তাকালো।
"আমি যে মানুষটাকে
ভালোবাসি,
তার সাথে থাকতে চেয়েছিলাম," সে সরল গলায় বললো। "সেটা কি খুবই অস্বাভাবিক?"
পোয়ারো খুব মৃদুভাবে একটা
প্রশ্ন করলেন।
"তাহলে, কি আপনি,
মসিয়েঁ কেটারিংয়ের ইচ্ছাতেই ওনার সাথে নাইসে এসেছেন?"
মিরেলে এই প্রশ্নটার
উত্তর দিতে যেন একটু অস্বস্তি বোধ করছিলো। সে দৃশ্যতই কিছুটা ইতস্তত করছিলো উত্তর
দেবার আগে। কিন্তু যখন সে বলতে শুরু করলো, তখন সে বেশ উদ্ধত, নিস্পৃহ ভঙ্গিতে কথা বলছিলো।
"এসব ক্ষেত্রে আমি
নিজের ইচ্ছাতেই চলি,
মসিয়েঁ," সে বললো।
উত্তরটা যে কোনোমতেই কোনো
উত্তরই নয় তা তিনজনেই বুজতে পারলেন। তাঁরা কিছু বললেন না।
"আপনি প্রথম কখন
থেকে বিশ্বাস করতে শুরু করলেন যে মসিয়েঁ কেটারিংই তাঁর স্ত্রীকে হত্যা করেছেন?"
"যেরকম আপনাদের আমি
বলেছি, মসিয়েঁ,
ট্রেন লিয়োন্সে পৌঁছনোর ঠিক আগে আমি মসিয়েঁ কেটারিংকে
দেখেছিলাম ওনার স্ত্রীর কম্পার্টমেন্ট থেকে বেরিয়ে আসতে। তখন তার মুখে একটা অদ্ভুত
অভিব্যাক্তি ছিল - আঃ! সেই মুহূর্তে আমি ঠিক বুঝতে পারি নি - একটা ভূতগ্রস্ত এবং
ভয়াবহ একটা অভিব্যাক্তি। আমি কোনোদিন ভুলবো না।"
তার গলার স্বর খুব
উচ্চগ্রামে পৌঁছে গেলো,
আর হাত দুটো সে এক অসাধারণ ভঙ্গিমায় ছুড়ে দিলো।
"ঠিক তাই," মসিয়েঁ ক্যারেজ বললেন।
"পরে, ট্রেন যখন লিয়োন্স ছেড়ে এসেছে এবং জানতে পারলাম মাদাম কেটারিং মৃত তখন - তখন
আমি বুঝলাম!"
"আর তবুও - আপনি
পুলিশের কাছে গেলেন না,
মাদমোয়েজেল," কমিশনারটি মৃদুভাবে বললেন।
মিরেলে চমৎকৃত ভাবে তাঁর
দিকে তাকালো,
সে যে ভূমিকা পালন করছিলো তাতে সে নিজেকে পরিষ্কার ভাবে
উপভোগ করছিলো।
"আমি কি আমার
প্রেমিককের সাথে বিশ্বাসগতকতা করবো?" সে প্রশ্ন করলো,
"আঃ,
না,
একজন মহিলাকে একাজ করতে বলবেন না।"
"তাহলে এখন -"
মসিয়েঁ কাউক্স ইঙ্গিত করলেন।
"এখনকার পরিস্থিতি
আলাদা। ও আমার সাথে বিস্বাসঘাতকতা করেছে! আমি কি তা মুখ বুজে সহ্য করবো?"
পরীক্ষক ম্যাজিস্ট্রেটটি
তাকে লক্ষ্য করলেন।
"ঠিকই তো, ঠিকই তো,"
তিনি মোলায়েমভাবে অস্ফুট স্বরে বললেন।
"এবার, মাদমোয়েজেল,
আপনি যদি একবার লিখিত বয়ানটা দেখে নেন, যা আপনি আমাদের বললেন,
সেটাই সঠিকভাবে আছে কিনা, এবং তারপর এটায় একটা সই করে দেন।"
মিরেলে নথিপত্রের ওপর
বেশি সময় নষ্ট করলো না।
"হ্যাঁ, হ্যাঁ,"
সে বললো, "এটা ঠিক আছে।" সে
উঠে দাঁড়ালো। "আপনাদের নিশ্চই আর আমাকে প্রয়োজন হবে না, মেসিউ।"
"বর্তমানে, না, মাদমোয়েজেল।"
"আর ডেরেককে কি গ্রেফতার
করা হবে?"
"খুব শীঘ্রই, মাদমোয়েজেল।"
মিরেলে নিষ্ঠুরভাবে হাসলো
এবং পশমের চাদরটা আরো ভালোভাবে জড়িয়ে নিলো।
"আমাকে অপমান করার
আগে তার এব্যাপারে ভাবা উচিত ছিল," সে চিৎকার করে বললো।
"আরেকটা ছোট
ব্যাপার আছে -" পোয়ারো মার্জনা চাওয়ার ভঙ্গিতে একটা কাশি দিয়ে বললেন -
"শুধু কয়েকটা খুঁটিনাটি ব্যাপারে জানার আছে।"
"হ্যাঁ?"
"আপনার কেন মনে হলো
ট্রেন যখন লিয়োন্স ছাড়ছে তখন মাদাম কেটারিং মৃত?"
মিরেলে স্থিরভাবে তাকিয়ে
থাকলো।
"কিন্তু তিনি
ততক্ষনে মৃত।"
"সত্যিই কি?"
"হ্যাঁ, অবশ্যই,
আমি -"
সে আচমকাই থেমে গেলো।
পোয়ারো তাকে খুব মনোযোগ দিয়ে লক্ষ্য করছিলেন, এবং তার চোখে যে সতর্ক ভাবটা
ফুটে উঠলো তা লক্ষ্য করলেন।
"আমাকে সেরকমই বলা
হয়েছিল, সবাই তাই বলছিলো।"
"ওহ," পোয়ারো বললেন,
"আমি জানতাম না পরীক্ষক ম্যাজিস্ট্রেটের অফিসের বাইরে একথা
কেউ উল্লেখ করেছে বলে।"
মিরেলে কে একটু অস্থির
মতো লাগছিলো।
"এরকম কথাবার্তা
শুনতে পাওয়া যায়,"
সে অস্পষ্টভাবে বললো, "এগুলো ঘুরে বেড়ায়। আমাকে কেউ একটা বলেছিলো। আমি ঠিক মনে করতে পারছি না কে
বলেছিলো।"
সে দরজার দিকে হাঁটা
লাগলো। মসিয়েঁ কাউক্স ঝাঁপিয়ে পড়লেন দরজাটা তার জন্য খুলে দেওয়ার জন্য, আর সেটা তিনি করলেনও,
পোয়ারোর গলাটা আরেকবার আর এক ধাপ চড়লো।
"আর রত্নগুলো? মার্জনা করবেন,
মাদমোয়েজেল। ওগুলোর ব্যাপারে কি কিছু বলতে পারবেন?"
"রত্নগুলো? কোন রত্নগুলো?"
"মহান ক্যাথেরিনের
রুবিগুলো। আপনি যখন এতো কথা শুনেছেন, ওগুলোর ব্যাপারেও নিশ্চই
শুনেছেন।"
"আমি কোনো রত্নের
ব্যাপারে কিছু জানি না,"
মিরেলে তীক্ষ্ণ স্বরে বললো।
সে দরজাটা পেছনে বন্ধ করে
দিয়ে, বেরিয়ে গেলো। মসিয়েঁ কাউক্স তাঁর চেয়ারে ফিরে এলেন, পরীক্ষক ম্যাজিস্ট্রেটটি একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন।
"কি রাগ!"
তিনি বললেন,
"কিন্তু বেশ চটকদার শয়তান। উনি যা বলছেন তাতে কি কোনো সত্যি
আছে? আমার সন্দেহ আছে।"
"ওনার কাহিনীতে
কিছু সত্যি,
অবশ্যই আছে," পোয়ারো বললেন,
"মিস গ্রের বক্তব্য থেকে সেটা আমরা নিশ্চিত করেছি। ট্রেন
লিয়োন্সে ঢোকার ঠিক আগে উনি করিডোরের দিকে তাকিয়েছিলেন এবং মসিয়েঁ কেটারিংকে ওনার
স্ত্রীর কম্পার্টমেন্টে ঢুকতে দেখেছিলেন।"
"ওনার বিরুদ্ধে
কেসেটা একদমই পরিষ্কার মনে হচ্ছে," কমিশনারটি একটা বড়ো শ্বাস
ফেলে বললেন,
"খুবই দুর্ভাগ্যজনক।" তিনি বিড়বিড় করে বললেন।
"এ কথা কেন বলছেন?" পোয়ারো জিজ্ঞেস করলেন।
"আমার জীবনের
লক্ষ্য ছিল কমতে ডে লা রোচেকে গারদে পোড়া। এবারে, মনে হয়েছিল আমরা ওনাকে বাগে পেয়েছি। এখন অন্য আরেকজন - ব্যাপারটা মোটেই স্বস্তিদায়ক
নয়।"
মসিয়েঁ ক্যারেজ তাঁর
নাকটা ঘষতে লাগলেন।
"যদি কোনো ভুলচুক
হয়,"
তিনি খুব সতর্কতার সাথে লক্ষ্য করছিলেন, "তাহলে একটা খুবই বিশ্রী পরিস্থিতি হবে। মসিয়েঁ কেটারিং অভিজাত সম্প্রদায়ের
মধ্যে পড়েন। এটা খবরের কাগজে ছাপা হবে। যদি আমরা কোনো ভুল করি -" তিনি আসন্ন
অশুভ ঘটনার চিন্তায় কাঁধ ঝাঁকালেন।
"এবার রত্নগুলোর
কথায় আসা যাক,"
কমিশনারটি বললেন, "আপনার কি মনে হয়,
রত্নগুলো নিয়ে উনি কি করেছেন?"
"উনি, অবশ্যই,
ধোঁকা দেওয়ার জন্যই ওগুলো নিয়েছিলেন," মসিয়েঁ ক্যারেজ বললেন,
"ওগুলো কাছে রাখা নিশ্চই ওনার জন্য খুব অসুবিধাজনক এবং ওগুলোর
থেকে রেহাই পাওয়াও খুবই কঠিন।"
পোয়ারো হাসলেন।
"রত্নগুলোর
ব্যাপারে আমার একটা নিজস্ব ধারণা আছে। আচ্ছা, মেসিউ, একটা কথা বলুন,
আপনারা মারকুইস বলে কোনো লোকের সম্পর্কে কি কিছু জানেন?"
কমিশনারটি উত্তেজিত হয়ে সামনে
ঝুকে এলেন।
"মারকুইস," তিনি বললেন,
"মারকুইস? আপনার মনে হয় উনি এই
ব্যাপারে জড়িত,
মসিয়েঁ পোয়ারো?"
"আমি জিজ্ঞেস করছি, আপনি ওনার ব্যাপারে কি জানেন।"
কমিশনারটি মুখটা বিকৃত
করে একটা অভিবাক্তিপূর্ণ হাসি দিলেন।
"আমরা যতটা চাই
ততটা জানি না,"
তিনি বেদনার সাথে পর্যবেক্ষণের কথা বলতে লাগলেন, "উনি পেছন থেকে কাজ করেন, বুঝতে পারছেন। ওনার ভাড়া
করা লোক আছে যারা নোংরা কাজগুলো করে। কিন্তু উনি একজন উচ্চপদস্থ ব্যাক্তি। উনি
অপরাধীদের শ্রেণী থেকে আসেন নি।"
"একজন ফরাসি কি?"
"হ্যাঁ, এটুকু আমরা বিশ্বাস করি। কিন্তু আমরা নিশ্চিত নই। তিনি ফ্রান্সে, ইংল্যান্ডে,
আমেরিকাতে কাজ করেছেন। সুইজারল্যান্ডে গত শরৎ কালে পর পর
কয়েকটা ডাকাতি হয়েছিল,
যেগুলোর জন্য ওনাকেই দায়ী বলে মনে হয়েছিল। দেখতে গেলে সমস্ত
দিক থেকেই উনি একজন দুর্দান্ত ব্যাক্তি, সমান
দক্ষতায় চোস্ত ইংরেজি এবং ফরাসি বলেন এবং উনি ঠিক কোন দেশের সেটা একটা
রহস্য।"
পোয়ারো মাথা নাড়ালেন, এবং বিদায় নেওয়ার জন্য উঠে দাঁড়ালেন।
"আপনি কি এব্যাপারে
আমাদের আর কিছু জানাতে পারেন না, মসিয়েঁ পোয়ারো?" কমিশনারটি আর্জি জানালেন।
"এই মুহূর্তে, না,"
পোয়ারো বললেন, "কিন্তু,
সংবাদ হয়তো হোটেলে আমার জন্য অপেক্ষা করছে।"
মসিয়েঁ ক্যারেজকে দেখে
মনে হচ্ছিলো উনি যেন অস্বস্তিতে আছেন। "যদি মারকুইস এর মধ্যে জড়িত থাকেন
-" তিনি শুরু করলেন কিন্তু তারপর থেমে গেলেন।
"এটা আমাদের ধ্যান
ধারণা সব গোলমাল করে দেবে।" মসিয়েঁ কাউক্স অনুযোগ করলেন।
"এটা আমার ধারণায়
কোনো গোলমাল করছে না,"
পোয়ারো বললেন, "তার চেয়ে বরং,
এটা আমার ধারণাগুলোর সাথে বেশ সুন্দর খাপ খায়। বিদায়, মেসিউ,
যদি আমার কাছে কোনো গুরুত্বপূর্ণ খবর আসে আমি সঙ্গে সঙ্গে
তা আপনাদের কাছে পৌঁছে দেব।"
তিঁনি গম্ভীর মুখে নিজের
হোটেলের দিকে চললেন। তাঁর অনুপস্থিতিতে তাঁর নামে একটা টেলিগ্রাম এসেছিলো। পকেট
থেকে একটা কাগজ কাটার ছুড়ি বের করে, তিঁনি সেটা কেটে খুললেন।
একটা লম্বা টেলিগ্রাম ছিল,
এবং সেটাকে ধীরে পকেটে ঢোকানোর আগে তিঁনি দুবার করে পড়লেন। ওপরতলায়, জর্জ তার মালিকের জন্য অপেক্ষা করছিলো।
"আমি ক্লান্ত, জর্জেস,
ভীষণ ক্লান্ত। আমার জন্য একটা ছোট চকোলেটের পটের অর্ডার
দেবে?"
চকোলেটের অর্ডার দেওয়া
হলো এবং তা এসেও গেলো,
আর জর্জ সেটা তার মালিকের হাতের কাছে একটা ছোট টেবিল সাজিয়ে
দিলো। সে যখন চলে যাওয়ার জন্য তৈরি হচ্ছিলো, পোয়ারো বললেন:
"আমি জানি, জর্জেস ইংলিশ অভিজাততন্ত্র সম্পর্কে তোমার বেশ ভালো জ্ঞান আছে?" পোয়ারো বিড়বিড় করে বললেন।
জর্জ মার্জনা চাওয়ার
ভঙ্গিতে হাসলো।
"আশা করি, আছে বললে অত্যুক্তি হয় না, স্যার," সে উত্তর দিলো।
"মনে হয় তুমি এই
মতটাই পোষণ করো,
জর্জেস, যে অপরাধীরা কোনো
ব্যাতিক্রম ছাড়াই নিচু শ্রেণী থেকে আসে।"
"সব সময় নয়, স্যার। ডিউক অফ ডেভিজের এক অল্প বয়স্ক ছেলেকে নিয়ে একবার ভয়ানক ঝামেলা হয়েছিল।
সে ইটন থেকে সন্দেহজনক ভাবে নিপাত্তা হয়, আর তারপর অনেকবার সে
ভয়ানক উদ্বেগের কারণ ঘটায়। পুলিশ ক্লেপটোম্যানিয়ার মতটা মেনে নেয় নি। একজন অত্যন্ত
চতুর অল্পবয়স্ক ভদ্রলোক,
স্যার, কিন্তু প্রথম থেকে শেষ
পর্যন্ত সে অসৎ,
মানে আপনি যদি আমার কথা ধরেন। তার বাবা তাকে অস্ট্রেলিয়ায় পাঠিয়ে দেয়, আর আমি শুনেছি সেখানে সে অন্য একটা নামে অভিযুক্ত হয়েছিল। খুবই অস্বাভাবিক, স্যার,
কিন্তু এটা ঘটেছে। যুবক ভদ্রলোকটির, বলার অপেক্ষা রাখে না,
টাকা পয়সার কোনো অভাব ছিল না।"
পোয়ারো ধীরে ধীরে মাথা
নাড়ালেন।
"উত্তেজনার আকাঙ্খা," তিন নিচু স্বরে অস্পষ্টভাবে বললেন, "আর মস্তিষ্কে কোথাও ছোট একখানি গিঁট ছিল। আমি এখন ভাবছি -"
তিঁনি টেলিগ্রামটা বার
করে আরেকবার পড়তে লাগলেন।
"তারপর লেডি মেরি
ফক্সের মেয়ে,"
খানসামাটি স্মৃতিচারণের মেজাজে বলতে লাগলো, "সে জঘন্য ভাবে কিছু ব্যাবসায়ীদের প্রতারিত করেছিল। সেরা পরিবারগুলোর জন্য খুবই
উদ্বেগের ব্যাপার। যদি বলেন তো, আরো অনেক অদ্ভুত কেস আছে, যা আমি বলতে পারি।"
"তোমার অভিজ্ঞতা
বিশাল, জর্জেস,"
পোয়ারো অস্ফুট স্বরে বললেন। আমি মাঝে মাঝে ভাবি কেবলমাত্র
উপাধিযুক্ত পরিবারগুলোর সাথে থাকার পর আমার কাছে খানসামা হিসেবে যোগ দিয়ে তুমি
হয়তো নিজের অবমাননা করেছো। আমি তোমার দিক থেকে এটাকে ভালোবাসা আর উত্তেজনার জন্য
ধরে নিচ্ছি।
"ঠিক তা নয়, স্যার,"
জর্জ বললো, "আমি দৈবাৎ সোসাইটি
স্নিপেটস এ দেখেছিলাম যে আপনাকে বাকিংহাম প্যালেসে স্বাগত জানানো হচ্ছে। এটা ঠিক
সেই সময়ে যখন আমি নতুন কাজ খুজছিলাম। শোনা যায় যে, মহামান্য মহারাজের,
আপনার ওপর অপার করুনা এবং আপনার সাথে তাঁর বন্ধুত্ব এবং
আপনার ক্ষমতার ওপর ওনার খুব উচ্চ ধারণা।"
"আঃ!" পোয়ারো
বললেন,
"যে কেউ কোনো একটা ঘটনার কারণ জানতে উৎসুক হতেই পারেন।"
তিনি কিছুক্ষন কোনো একটা
চিন্তায় ডুবে থাকলেন আর তারপর বললেন:
"তুমি কি
মাদমোয়েজেল পাপপুলাউস কে ফোন করেছিলে?"
"হ্যাঁ, উনি এবং ওনার বাবা আনন্দের সাথে আজ রাতে আপনার সাথে ডিনার করতে রাজি
হয়েছেন।"
"হুম," পোয়ারো চিন্তিত ভাবে বললেন। উনি চকোলেটটা খাওয়া শেষ করলেন, কাপ এবং প্লেটটা পরিষ্কারভাবে ট্রের মদ্ধিখানে রাখলেন, আর খুব শান্ত ভাবে বললেন, অনেকটা যেন খানসামাটির
বদলে নিজেকেই বলছিলেন।
"আমার প্রিয় জর্জেস, কাঠবেড়ালি,
বাদাম সংগ্রহ করে। সে শরৎকালে সেগুলো সঞ্চয় করে যাতে পরে সে
সেগুলোর সুবিধা নিতে পারে। মনুষ্যজাতিকে সফল হতে হলে, জর্জেস,
প্রাণিজগতে আমাদের নিচের তলায় যারা আছে তাদের থেকে আমাদের
শিক্ষা নিতে হবে। আমি সবসময়ে সেই কাজই করেছি। আমি বেড়াল সেজেছি, ইঁদুরের গর্তের দিকে নজর রাখার জন্য। আমি ভালো কুকুর সেজে গন্ধের পেছন পেছন
গেছি, আর কখনোই সূত্রের পদচিহ্নের ওপর থেকে নাক সরাই নি। আর, প্রিয় জর্জেস,
আমি কাঠবেড়ালিও সেজেছি। আমি কিছু সূত্র এখানে সঞ্চয় করে
রেখেছি, কিছু সূত্র ওখানে রেখেছি। আমি এবার আমার ভাণ্ডারে যাবো এবং বিশেষ একটি বাদাম
নিয়ে আসবো,
একটা বাদাম, যা আমি সঞ্চয় করেছিলাম -
দাড়াও দেখে নিতে দাও,
সতেরো বছর আগে। বুঝতে পারছো, জর্জেস?"
"আমি চিন্তাই করতে
পারছি না,
স্যার," জর্জ বললো, "যে বাদাম এভাবে এতদিন রেখে দেওয়া যায়, যদিও আমি একথা জানি যে
একজন বোতল অনেক রকম ভাবে সঞ্চয় করতে পারে।"
পোয়ারো তার দিকে তাকিয়ে
হাসলেন।
চ্যাপ্টার ২৮
পোয়ারো কাঠবেড়ালির
ভূমিকায়
পোয়ারো আগে থেকে প্রায়
পঁয়তাল্লিশ মিনিট অতিরিক্ত সময় নিয়ে তাঁর ডিনারের অ্যাপয়েন্টমেন্ট রাখার জন্য
বেরোলেন। কারণ তাঁর একটা উদ্দেশ্য ছিল। গাড়িটা তাঁকে সোজা মন্টে কার্লোতে নিয়ে
যাওয়ার বদলে কেপ মার্টিনে লেডি ট্যাম্পলিংয়ের বাড়ি নিয়ে গেলো, সেখানে তিনি মিস গ্রের সাথে দেখা করতে চাইলেন। মহিলারা পোশাক পরিবর্তন করছিলেন
তাই পোয়ারোকে একটা ছোট বৈঠকখানার ঘরে অপেক্ষা করতে অনুরোধ করা হলো, আর সেখানেই তিন চার মিনিট পরে লেনক্স ট্যাম্পলিং তাঁর সাথে দেখা করতে এলো।
"ক্যাথেরিনের এখনো
দেখা করার জন্য পুরোপুরি প্রস্তুত হয়ে উঠতে পারে নি," সে বললো। "আমি কি ওনাকে কোনো বার্তা পৌঁছে দেব, নাকি উনি নিচে নামা অবধি আপনি অপেক্ষা করবেন?"
পোয়ারো চিন্তান্বিত ভাবে
তার দিকে তাকালেন। তিনি উত্তর দিতে দু এক মিনিট নিলেন, যেন বিশাল বড়োসড়ো কিছু তাঁর সিদ্ধান্ত এর ওপর নির্ভর করছে। স্পষ্টতই এই সহজ
প্রশ্নটার উত্তর যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ।
"না," তিনি অবশেষে বললেন,
"না,
মনে হয় না তার প্রয়োজন আছে, আমি মাদমোয়েজেল ক্যাথেরিনের সাথে দেখা করার জন্য অপেক্ষা করবো। আবার, হয়তো,
অপেক্ষা না করলেই ভালো হতো। এসব জিনিস কখনো কখনো বেশ
কঠিন।"
লেনক্স বিনীতভাবে অপেক্ষা
করতে থাকলো,
তার ভুরুগুলো কিছুটা ওপরে উঠে গেছিলো।
"আমার কাছে একটা
খবর আছে,"
পোয়ারো বলতে থাকলেন। "আপনি, আশা করি,
এই কথাটা আপনার বান্ধবীকে জানাবেন যে, স্ত্রীকে হত্যা করার অভিযোগে মসিয়েঁ কেটারিং আজ রাতে গ্রেফতার হয়েছেন।"
"আপনি আমাকে এই
কথাটা কাথেরিনকে জানাতে বলছেন?" লেনক্স প্রশ্ন করলো। তার
খুব জোরে জোরে নিঃস্বাস পড়ছিলো, যেন সে এতক্ষন দৌড়োচ্ছিলো, পোয়ারোর মনে হলো,
তার মুখটা, সাদাটে হয়ে গেছে এবং তাকে
অবসন্ন লাগছিলো - পরিবর্তনটা দৃশ্যতই বেশ ভালোভাবে চোখে পড়ছিলো।
"আপনি যদি দয়া করে
কথাটা ওনাকে জানান,
মাদমোয়েজেল।"
"কেন?" লেনক্স বললো,
"আপনার কি মনে হয় ক্যাথেরিন এতে বিচলিত হবেন? আপনার কি মনে হয় তিনি ওনার জন্য চিন্তিত?"
"আমি জানি না, মাদমোয়েজেল,"
পোয়ারো বললেন। "দেখুন, আমি অকপটে স্বীকার করছি। নিয়মের দিক থেকে, আমিই সবকিছু জানি, কিন্তু এই ব্যাপারে,
আমি - বলতে গেলে, কিছুই জানি না। আপনি, হয়তো,
আমার থেকে বেশিই জানেন।"
"হ্যাঁ," লেনক্স বললো,
"আমি জানি - কিন্তু স্বাভাবিক ভাবেই আমি আপনাকে বলবো
না।"
সে দু এক মিনিট চুপ করে
থাকলো, তার অন্ধকারাচ্ছন্ন ভুরু গুলো কুঁচকে একসাথে হয়ে গিয়েছিলো।
"আপনি বিশ্বাস করেন
যে তিঁনি একাজ করেছেন?"
সে আচমকা জিজ্ঞেসা করলো। পোয়ারো তাঁর কাঁধ ঝাঁকালেন।
"পুলিশ তো তাই
বলছে।"
"হুম," লেনক্স বললো,
"আপনি কি কিছু লোকাচ্ছেন? তাহলে এই ব্যাপারে
লোকানোর মতো কিছু আছে।"
আবার সে চুপ করে গেলো, ভুরু দুটি কুঁচকে গেলো। পোয়ারো শান্তভাবে বললেন:
"আপনি ডেরেক
কেটারিংকে অনেকদিন থেকে চেনেন, তাই না?"
"ছোটবেলা থেকেই
মাঝেমধ্যে দেখা হয়েছে,"
লেনক্স রূঢ়ভাবে বললো।
পোয়ারো কোনো কথা না বলে
বেশ কয়েকবার মাথা নাড়ালেন।
আচমকা একটা ঝটকায় লেনক্স
তার সামনে একটা চেয়ার টেনে আনলো এবং তাতে বসে পড়লো, তার কনুইগুলো টেবিলে এবং মুখটা দুই হাতের ওপর রাখা। এই ভাবে বসে সে সরাসরি টেবিলের
অপরপ্রান্তে পোয়ারোর দিকে তাকালো।
"তারা এগোনোর জন্য
কি পেয়েছে?"
সে জানতে চাইলো। "খুনের উদ্দেশ্য,
আশা করি। সম্ভবত, তাঁর স্ত্রীর মৃত্যুর
কারণে পাওয়া টাকা পয়সা।"
"উনি কুড়ি লক্ষ
পেয়েছেন।"
"আর যদি উনি মারা
না যেতেন তাহলে ডেরেক হয়তো দেউলিয়া হয়ে যেতেন?"
"হ্যাঁ।"
"কিন্তু এখানে
নিশ্চই আরো কিছু আছে,"
লেনক্স বলতে থাকলো। "তিঁনি একই ট্রেনে যাত্রা করছিলেন, সেটা আমি জানি,
কিন্তু - এটাই অভিযোগটাকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য যথেষ্ট
নয়।
"'K' লেখা একটা সিগারেটে কেস যেটা মিসেস কেটারিংয়ের নয় কিন্তু তাঁর কামড়াতে পাওয়া
গিয়েছে, আর দুজন ওনাকে দেখেছে মিসেস কেটারিংয়ের কম্পার্টমেন্টে ঢুকতে এবং বেরোতে, ট্রেন লিয়োন্সে ঢোকার ঠিক আগে।"
"কোন দু জন?"
"আপনার বান্ধবী মিস
গ্রে তাদের মধ্যে একজন। অপরজন হচ্ছেন মাদমোয়েজেল মিরেলে, নৃত্যশিল্পী।"
"আর তিঁনি, ডেরেক,
তিঁনি এব্যাপারে কি বলছেন?" লেনক্স তীক্ষ্ণভাবে জানতে চাইলো।
"তিঁনি তার স্ত্রীর
কম্পার্টমেন্টে ঢোকার ব্যাপারটা পুরোপুরি অস্বীকার করেছেন," পোয়ারো বললেন।
"বুদ্ধু
একটা!" লেনক্স ভুরু কুঁচকে, স্পষ্টভাবে বললো।
"আপনি বললেন,
লিয়োন্সে ঢোকার ঠিক আগে? কেউ কি জানে কখন - কখন
তাঁর মৃত্যু হয়েছে?"
"ডাক্তারির লক্ষণ
গুলো যে খুব সঠিক হবে এমনটা নয়," পোয়ারো বললেন, "তাঁরা এই দিকেই চিন্তা করছেন যে মৃত্যুটা ট্রেন লিয়োন্স ছাড়ার পর হওয়াটা
অসম্ভব। আর আমরা এইটুকুই জানি, যে ট্রেন লিয়োন্স ছাড়ার
কয়েক মুহূর্ত পরেই মিসেস কেটারিংকে মৃত অবস্থায় পাওয়া যায়।"
"আপনি এটা কিভাবে
জানলেন?"
পোয়ারো হাসছিলেন
আশ্চর্যজনক ভাবে নিজের ওপরেই।
"অন্য কেউ তাঁর
কম্পার্টমেন্টে যান এবং তাঁকে মৃত অবস্থায় দেখেন।"
"কিন্তু তারা
সঙ্গেসঙ্গে চিৎকার করে ট্রেনের সবাইকে জাগিয়ে তোলে না?"
"না।"
"এটা কেন?"
"নিঃসন্দেহে তাদের নিজস্য
কোনো কারণ ছিল।"
লেনক্স তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে
তাঁর দিকে তাকিয়ে থাকলো।
"আপনি কি কারণটা
জানেন?"
"হ্যাঁ - আমার
সেরকমই মনে হয়।"
লেনক্স স্থির হয়ে বসে
ঘটনাগুলো নিজের মনেই ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে চিন্তা করছিলো। পোয়ারো চুপ করে বসে তাকে লক্ষ্য
করছিলেন। অবশেষে তিঁনি দেখলেন যে তার গালে একটা হালকা রং লেগেছে, আর তার চোখগুলো চক চক করছে।
"আপনি ভাবছেন, ট্রেনের ভেতরকার কেউ ওনাকে খুন করেছে, কিন্তু সেটা নাও হতে
পারে। ট্রেন যখন লিয়োন্সে থেমে ছিল তখন যদি কেউ ট্রেনে ওঠে তাহলে তাদের কে আটকাবে? তারা সোজা তাঁর কম্পার্টমেন্টে যেতে পারে, তাঁকে শ্বাসরোধ করে খুন
করতে পারে,
আর রুবিগুলো নিয়ে কেউ কিছু বোঝার আগেই ট্রেন থেকে আবার নেমে
যেতে পারে। উনি হয়তো আসলে ট্রেন যখন লিয়োন্স স্টেশনে দাঁড়িয়ে ছিল তখন খুন হয়েছেন।
তাহলে ডেরেক যখন ঢুকেছিলেন তখন উনি বেঁচে ছিলেন, আবার অন্যরা যখন দেখেন তখন মৃত।"
পোয়ারো তাঁর চেয়ারে হেলান
দিয়ে বসলেন। উনি একটা গভীর স্বাস নিলেন। উনি মেয়েটার দিকে তাকিয়ে তিনবার মাথা
নাড়ালেন,
তারপর একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন।
"মাদমোয়েজেল," তিঁনি বললেন,
"আপনি যা বললেন তা একদম ঠিক - খুবই সত্যি। আমি অন্ধকারে
হাতড়াচ্ছিলাম,
আর আপনি আমাকে একটা আলো দেখালেন। একটা জায়গা ছিল যা আমাকে
বিভ্রান্ত করেছিল আপনি সেটা সহজ করে দিলেন।"
তিঁনি উঠে দাঁড়ালেন।
"আর ডেরেক?" লেনক্স বললো।
"কে জানে?" পোয়ারো কাঁধ ঝাকিয়ে বললেন, "কিন্তু তবুও আমি আপনাকে
বলবো, মাদমোয়েজেল। আমি সন্তুষ্ট নই; না, আমি - এরকুল পোয়ারো,
আমি এখনো সন্তুষ্ট নই। হয়তো আজ রাতেই আমি আরো কিছু জানতে পারবো।
অন্তত, গিয়ে চেষ্টাটা করি।"
"আপনি কারো সাথে
দেখা করতে যাচ্ছেন?"
"হ্যাঁ।"
"কেউ একজন যে কিছু
একটা জানে?"
"কেউ একজন কিছু
একটা জানতেই পারে। এব্যাপারে কোনো সম্ভানাই নাকচ করা উচিত হবে না। বিদায়, মাদমোয়েজেল।"
লেনক্স তাঁর সাথে দরজা
অবধি এগিয়ে দিতে এলো।
"আমি কি - কোনো
সাহায্য করলাম?"
সে জিজ্ঞেস করলো।
সিঁড়ি দিয়ে নামতে নামতে
যখন মুখ তুলে তাঁর থেকে উঁচুতে দরজায় দাঁড়িয়ে থাকা তার দিকে তাকালেন পোয়ারো মুখটা
নরম হয়ে এলো।
"হ্যাঁ, মাদমোয়েজেল,
আপনি সাহায্য করেছেন। যদি অন্ধকার ঘনিয়ে আসে, তবে এই কথাটা মনে রাখবেন।"
গাড়িটা ছাড়ার পর তিঁনি
আবার ভুরু কুঁচকে চিন্তায় ডুবে গেলেন, কিন্তু তাঁর চোখে সেই
হালকা সবুজ আলোটা ছিল যেটা আসন্ন সাফল্য কে চিহ্নিত করে। তিঁনি মিলিত হওয়ার জায়গায়
পূর্বনির্দিষ্ট সময়ের কয়েক মিনিট পরে পৌঁছলেন, আর দেখলেন মসিয়েঁ
পাপপুলাউস এবং তাঁর মেয়ে তাঁর আগেই পৌঁছে গেছেন। তাঁর মার্জনা চাওয়াটা ছিল
সংখ্যাতীত,
আর ভদ্রতা এবং ছোট ছোট ব্যাপারের প্রতি তাঁর নজরদারিতে
তিঁনি নিজেকেও ছাপিয়ে গেলেন। গ্রিক ভদ্রলোকটিকে নির্দিষ্টভাবে এই সন্ধ্যায় সৌম্য
এবং অভিজাত বংশের পুরুষের মতো লাগছিলেন, একজন দুঃখময় সমাজপতি যার
জীবন নিষ্পাপ,
জিয়াকে খুবই সুন্দরী এবং হাসিখুশি লাগছিলো। ডিনারটা খুবই
ভালো কাটলো। পোয়ারো তাঁর নিজের সেরা এবং উজ্জ্বল ভূমিকায় ছিলেন। তিঁনি ছোট ছোট
আকর্ষণীয় গল্প বলছিলেন,
জোকস বলছিলেন, তিঁনি জিয়া পাপপুলাউসের
মনোমুগ্ধকর প্রশংসা করছিলেন, এবং তিঁনি নিজের
কর্মজীবনের কিছু আকর্ষণীয় ঘটনাও শোনালেন। খাদ্যতালিকা খুব যত্নকরে নির্বাচন করা
হয়েছিল, এবং ওয়াইনও অসাধারণ ছিল।
ডিনারের শেষে মসিয়েঁ
পাপপুলাউস বিনম্র ভাবে জিজ্ঞেস করলেন: "আর আপনাকে যে টিপটা দিয়েছিলাম? ঘোড়ার ওপর আপনার ছোট্ট বাজিটা কি লাগিয়েছিলেন?"
"আমি আমার - মানে -
বুকিদের সাথে কথাবার্তা চালাচ্ছি," পোয়ারো উত্তর দিলেন।
দুজনেই দুজনের চোখের দিকে
চোখ রাখলেন।
"একটা খুবই পরিচিত
ঘোড়া, তাই না?"
"না," পোয়ারো বললেন,
"এটা হচ্ছে সেটা, যাকে আমাদের ইংরেজ
বন্ধুরা বলে,
কালো ঘোড়া।
"হুম!" মসিয়েঁ
পাপপুলাউস চিন্তিত ভাবে বললেন।
"আসুন এবার আমরা
ক্যাসিনোতে ঢুকি আর রুলেট টেবিলে ছোট খাটো বাজি ধরে নিজেদের ভাগ্য পরীক্ষা করি," পোয়ারো উচ্ছসিত ভাবে চিৎকার করে বললেন।
ক্যাসিনোতে ঢুকে দলটা ভাগ
হয়ে গেলো,
মসিয়েঁ পাপপুলাউস একটু দূরে সরে যেতে, পোয়ারো জিয়ার প্রতি পুরোপুরি নিবেদিতপ্রাণ হয়ে গেলেন।
পোয়ারোর ভাগ্য ততটা
সুপ্রসন্ন্য না হলেও জিয়ার ভাগ্য কিন্তু বেশ ভালো চলছিল, আর শীঘ্রই সে কয়েক হাজার ফ্রাঙ্কস জিতে নিলো।
পোয়ারোর চোখ ঝিকিমিকি করে
উঠলো।
"অসাধারণ!"
তিনি চিৎকার করে বললেন,
"আপনি আপনার বাবার সুযোগ্য কন্যা, মাদমোয়েজেল জিয়া। কখন থামতে হবে সেটা বুঝতে পাড়া। ওহ, এটাও একটা শিল্প।"
তিনি ঘরের চারিদিকে
তাকালেন।
"আমি আপনার বাবাকে
কোথাও দেখতে পারছি না,"
তিনি অগোছলভাবে মন্তব্য করলেন। "আমি আপনার গায়ে জড়ানো
চাদরটা নিয়ে আসছি,
মাদমোয়েজেল, আর তারপর আমরা বাগানে
বেড়াতে যাবো।"
তিনি, অবশ্য,
সোজা ক্লোক রুমের দিকে গেলেন না। কিছুক্ষন আগে মসিয়েঁ
পাপপুলাউসের বেরিয়ে যাওয়াটা তাঁর তীক্ষ্ণ দৃষ্টি এরায় নি।
কূটবুদ্ধিধারী গ্রীকটির
হঠাৎ কি হলো জানতে তিনি উদগ্রীব ছিলেন। অপ্রত্যাশিতভাবে বড়ো ঢোকার হলটায় তাঁকে উনি
দেখতে পেয়ে গেলেন। তিঁনি একটা পিলারের ধারে দাঁড়িয়ে, সবেমাত্র পৌঁছনো একজন মহিলার সাথে কথা বলছিলেন। মহিলাটি হলেন মিরেলে।
পোয়ারো চুপ চাপ কারো কোনো
কৌতূহল না জাগিয়ে হালটাকে ঘুরে এলেন। তিঁনি দুজনের অগোচরে, পিলারের অপরদিকে এসে দাঁড়ালেন, দুজনে এমন উত্তেজিত ভাবে
কথা বলছিলেন - অথবা,
বলা ভালো, নৃত্যশিল্পীটি কথা বলছিলো, এবং পাপপুলাউস মাঝে মাঝে এক আধটি শব্দ বা অঙ্গভঙ্গি করে উত্তর দিচ্ছিলেন।
"আমি বলছি আমার সময়
প্রয়োজন,"
নৃত্যশিল্পীটি বলছিলো, "আপনি যদি আমায় সময় দেন,
আমি টাকাটা জোগাড় করবো।"
"অপেক্ষা করাটা
-" গ্রীকটি নিজের কাঁধ ঝাঁকালেন - "বেশ বিশ্রী ব্যাপার।"
"শুধুমাত্র কিছুটা
সময়,"
অন্যজন প্রার্থনা করলো, "আঃ! কিন্তু আপনাকে দিতেই হবে! এক সপ্তাহ - দশ দিন - এইটুকুই চাইছি। আপনি আপনার
কাজের ব্যাপারে নিশ্চিন্ত থাকতে পারেন। টাকাটা আসছেই।"
পাপপুলাউস কিছুটা সরে
এলেন এবং অস্বস্তিকরভাবে আসেপাশে তাকাচ্ছিলেন - আচমকা নিষ্পাপ মুখ নিয়ে পোয়ারোকে
নিজের কনুইয়ের কাছে দাঁড়িয়ে থাকতে আবিষ্কার করলেন।
"আঃ! আপনি এখানে, মসিয়েঁ পাপপুলাউস। আমি আপনাকে খুজছিলাম। একটু মাদমোয়েজেল জিয়া কে নিয়ে বাগানে
ঘুরতে যাওয়ার অনুমতি দেবেন কি? শুভ সন্ধ্যা, মাদমোয়েজেল,"
তিনি অনেকটা নিচু হয়ে মিরেলেকে বাও করলেন।"হাজার
মার্জনা আমি সঙ্গে সঙ্গে আপনাকে দেখতে পাই নি।"
নৃত্যশিল্পীটি তাঁর
অভিবাদনটি যেন কিছুটা অধৈর্যের সাথে নিলো। তার কথার মদ্ধিখানে বাধা পড়ায় সে পরিষ্কারভাবে বিরক্ত। ইঙ্গিতটা বুঝতে পোয়ারোর
মোটেই সময় লাগলো না। পাপপুলাউস এরই মধ্যে বিড়বিড় করে বলেছিলো: "নিশ্চই -
হ্যাঁ নিশ্চই,"
পোয়ারো অবিলম্বে ওখান থেকে সরে গেলেন। তিনি জিয়ার গায়ে
দেওয়ার চাদরটা নিলেন এবং একসাথে তাঁরা দুজনে বাগানে ঘুরে বেড়াতে লাগলেন।
"এইখানেই
আত্মহত্যার ঘটনাটা ঘটেছিলো,"
জিয়া বললো।
পোয়ারো তাঁর কাঁধ
ঝাঁকালেন। "একটা কথা বলা হয়। পুরুষেরা খুব বোকা, ঠিক কিনা,
মাদমোয়েজেল? খাওয়ার জন্য, পান করার জন্য,
পরিষ্কার বাতাসে নিঃস্বাস নেওয়ার জন্য, এরকম মনোরম জায়গা আর নেই, মাদমোয়েজেল। একজন
বোকাই শুধুমাত্র কোনো টাকা পয়সা না থাকার
কারণে এই সমস্ত কিছু ছেড়ে চলে যেতে পারে - অথবা হৃদয়ের বেদনার কারণে। ভালোবাসা, কিন্তু অনেক মৃত্যুর কারণ, ঠিক কিনা?"
জিয়া হাসলো।
"আপনি ভালোবাসা নিয়ে
হাসবেন না,
মাদমোয়েজেল," পোয়ারো তার দিকে খুব জোরে জোরে তর্জনীটি নাড়িয়ে বললেন। "আপনারা যারা
অল্পবয়স্ক এবং সুন্দরী।"
"মোটেই তেমনটা নয়," জিয়া বললো,
"আপনি ভুলে যাচ্ছেন, মসিয়েঁ পোয়ারো, আমার তেত্রিশ চলছে। আমি আপনার সাথে খোলামেলা ভাবে কথা বলছি কারণ তা না হলে ব্যাপারটা
সুখকর হতো না। আপনি আমার বাবাকে যে কথা বলছিলেন যে, ঠিক সতেরো বছর আগে একবার প্যারিসে আপনি আমাদের সাহায্য করেছিলেন।"
"আপনার দিকে তাকালে, মনে হয় যেন এই সেদিনকার ঘটনা," পোয়ারো সাহসীভাবে বললেন।
"আপনি তখনও পুরোপুরি এইরকমই ছিলেন, মাদমোয়েজেল, আর একটু পাতলা,
আর একটু ফেকাসে, আর একটু বেশি গম্ভীর।
সোলো বছর বয়সী এবং শৈশব সদ্য পেরিয়ে এসেছেন। ছোটোখাটো শিশুটিও নন আবার ঠিক মহিলাও
নন। আপনি খুবই সুমধুর ছিলেন, খুবই কমনীয় ছিলেন, মাদমোয়েজেল জিয়া;
দ্বিধাহীনভাবে, অন্য সকলেও এই কথাই মনে
করতো।"
"সোলো বছর বয়সে," জিয়া বললো,
"একজন সরল এবং বোকা হয়।"
"হতে পারে," পোয়ারো বললেন,
"হ্যাঁ, এটা হতেই পারে। সোলো বছর
বয়সে একজন সহজেই সবকিছু বিশ্বাস করে, ঠিক কিনা? লোকে তাকে যা বলে সে তাই বিশ্বাস করে।
যে দৃষ্টিতে মেয়েটির পাশ
ফিরে তাঁর দিকে তাকালো তা যদি তিঁনি দেখেও থাকেন, তিঁনি ভান করলেন যেন কিছুই দেখেন নি। তিনি স্বপ্নালুভাবে বলতে থাকলেন: সব দিক
থেকে দেখতে গেলে,
সেটা একটা অদ্ভুত ঘটনা ছিল। আপনার বাবা, মাদমোয়েজেল,
কখনোই সেই ঘটনার ভেতরকার সত্যি ব্যাপারটা বোঝেন নি।"
"না?"
"উনি যখন আমাকে
বিস্তারিত ভাবে কি হয়েছিল জানাতে বললেন, ওনাকে জানানোর জন্য আমি
এই কথাটাই বলেছিলাম: 'কোনোরকম কোনো কেলেঙ্কারি ছাড়াই, আপনার যা খোয়া গিয়েছিলো
আমি তা ফিরিয়ে নিয়ে এসেছি। আপনি এব্যাপারে আর কোনো প্রশ্ন করতে পারবেন না।' আপনি জানেন,
মাদমোয়েজেল, কেন আমি একথা বলেছিলাম?"
"আমার কোনো ধারণা
নেই,"
মেয়েটি শীতলভাবে বললো।
"কারণ একটা ফেকাসে
মতো, পাতলা মতো,
গম্ভীর মতো, ছোট্ট শিশুর জন্য আমার
বুকের মধ্যে একটা নরম জায়গা ছিল।
"আমি বুঝতে পারছি
না আপনি কি ব্যাপারে কথা বলছেন?" জিয়া রেগে চিৎকার করে
বললো।
"সত্যিই কি পারছেন
না, মাদমোয়েজেল?
আপনি কি আন্তোনিও পিরেজিওকে ভুলে গেছেন?"
তিনি তার দ্রুত নিঃস্বাস
নেওয়ার শব্দ পেলেন - অনেকটা খাবি খাওয়ার মতো।
"সে দোকানে সহকারীর
কাজ করতে এসেছিলো,
কিন্তু এভাবে সে যা চাইছিলো তা পেতো না। একজন সহকারীর কি
তার মনিবের মেয়ের দিকে চোখ তুলে তাকানোর সাহস থাকে? যদি না সে যুবক এবং সুদর্শন হয় এবং তার মুখ অনর্গল চলে। আর যেহেতু তারা সারাটা
সময় শুধুমাত্র দুজন দুজনের প্রতি ভালোবাসা নিয়েই মেতে থাকতো না, বরং মাঝে মাঝে এমন বিষয় নিয়েও আলোচনা করতো যাতে দুজনেরই আগ্রহ আছে - যেমন সেই
নির্দিষ্ট আকর্ষণীয় বস্তুটি যা মসিয়েঁ পাপপুলাউসের অধিকারে সাময়িকভাবে এসেছিলো। আর
যেহেতু, আপনি বললেন,
মাদমোয়েজেল, অল্প বয়স্করা বোকা হয় এবং
সহজেই অন্যকে বিশ্বাস করে,
তাই তাকে বিশ্বাস করা সহজ ছিল আর সেই নির্দিষ্ট বস্তুটি
দেখানোর জন্য,
বস্তুটি কোথায় রাখা আছে তার হদিশ তাকে দেওয়া। আর পরে যখন
সেটা চুরি হয়ে গেলো - যখন সেই অবিশ্বাস্য বিপর্যয় নেমে এলো। হায়! সেই অসহায় ছোট্ট
শিশুটি। কি সাংঘাতিক এক পরিস্থিতিতে সে পড়েছিল। সে অত্যন্ত ভয় পেয়েছিলো, ছোট্ট অসহায় একজন। বলা উচিত নাকি বলা উচিত না? আর তারপরে সেই অসাধারণ মানুষটি এলেন, এরকুল পোয়ারো। যেন একটা
অলৌকিক ঘটনা ঘটলো,
যেভাবে বিষয়গুলো পরপর নিজেদের সাজালো। উত্তরাধিকার সূত্রে
পাওয়া অমূল্য বস্তুটি ফিরে এলো এবং কেউ কোনো বেখাপ্পা প্রশ্নও করলো না।"
জিয়া প্রচন্ড বেগে ঘুরে
দাঁড়ালো।
"আপনি এটা জানতেন? কে বলেছিলো?
সেটা কি - সেটা কি আন্তোনিও?"
পোয়ারো মাথা নাড়লেন।
"কেউ বলে নি আমাকে," তিনি শান্তভাবে বললেন। "আমি অনুমান করেছিলাম। এবং এটা একদম সঠিক অনুমান, ঠিক কিনা,
মাদমোয়েজেল? দেখুন, যদি আপনার সঠিক ভাবে অনুমান করার ক্ষমতা না থাকে, তাহলে আপনি ভালো গোয়েন্দা হতে পারবেন না।"
মেয়েটি কয়েক মিনিট কোনো
কথা না বলে তাঁর পাশে হাটতে থাকলো। তারপর সে একটা কঠিন গলায় বললো:
"তাহলে, আপনি এ ব্যাপারে কি করতে চান, এটা কি আপনি আমার বাবাকে
জানিয়ে দেবেন?"
"না," পোয়ারো তীক্ষ্ণ স্বরে বললেন, "অবশ্যই, না।"
সে কৌতূহল নিয়ে তাঁর দিকে
তাকিয়ে থাকলো।
"আপনি কি আমার কাছ
থেকে কিছু চান?"
"আমি আপনার সাহায্য
চাই, মাদমোয়েজেল।"
"আপনার হঠাৎ মনে
হলো কেন যে আমি আপনাকে সাহায্য করতে পারবো।"
"আমি এরকমটা মনে
করি না। আমি শুধুমাত্র আশা করি।"
"আর যদি আমি আপনাকে
সাহায্য না করি,
তাহলে - আপনি আমার বাবাকে জানিয়ে দেবেন?"
"অবশ্যই না, অবশ্যই না,
মাদমোয়েজেল। আপনি এরকমটা চিন্তাও করবেন না, মাদমোয়েজেল। আমি একজন ব্ল্যাকমেলার নই। আমি আপনার গুপ্ত কথা আপনার মাথায়
ঠেকিয়ে আপনাকে ভয় দেখাবো না।
"যদি আমি আপনাকে
সাহায্য করতে রাজি না নই -" মেয়েটি ধীরে ধীরে বলতে শুরু করলো।
"তাহলে আপনি রাজি
হন নি, এখানেই শেষ।"
"তাহলে কেন -"
সে থেমে গেলো।
"শুনুন, তাহলে আমি আপনাকে বলি কেন। মহিলারা, মাদমোয়েজেল, উদার হন। যদি কেউ তাঁদের জন্য কিছু করেন এবং তাঁদের সামনে এমন সুযোগ আসে যে
প্রতিদানে তাঁদের সেই একজনের জন্য কিছু করতে হবে, তবে তাঁরা সেটা অবশ্যই করেন। আমি একবার আপনার প্রতি উদারতা দেখিয়েছিলাম, মাদমোয়েজেল। যখন আমি সমস্ত কথা বলে দিতে পারতাম, তখন আমি আমার মুখ বন্ধ রেখেছিলাম।"
তারপর আরেকবার নীরবতা, তারপর মেয়েটি বললো,
"আগের দিন আমার বাবা আপনাকে একটা ইঙ্গিত দিয়েছিলেন।"
"সেটা তাঁর অশেষ
দয়া।"
"আমার মনে হয় না," জিয়া ধীরে ধীরে বললো,
"তার সাথে আমি আর কিছু যোগ করতে পারবো।"
পোয়ারো যদি হতাশ হয়েও
থাকেন তিনি সেটা দেখালেন না। তাঁর মুখের একটা পেশীও নড়লো না।
"ঠিক আছে!"
তিনি উৎফুল্লভাবে বললেন,
"তাহলে আসুন আমরা অন্য কোনো বিষয় নিয়ে কথা বলি।"
তারপর তিনি সানন্দে কথা
বলে যেতে লাগলেন। কিন্তু,
মেয়েটা যেন একটু অন্যমনস্ক হয়ে ছিল, এবং তার উত্তরগুলো যেন অনেকটা যান্ত্রিক ছিল আর সবসময় সঠিক হচ্ছিলো না।
"মসিয়েঁ পোয়ারো?"
"বলুন, মাদমোয়েজেল।"
"আমি - আমি আপনাকে
সাহায্য করতে চাই যদি সম্ভব হয়।"
"আপনি খুবই দয়ালু, মাদমোয়েজেল - খুবই দয়ালু।"
আবার একটা নীরবতা। পোয়ারো
তার ওপর কোনো চাপ দিলেন না। তিনি সন্তুষ্ট মনে অপেক্ষা করতে থাকলেন এবং তাকে নিজের
মতো সময় নিতে দিলেন।
"আচ্ছা," জিয়া বললো,
"আমি আপনাকে শুধু শুধু কেনই বা বলবো না? আমার বাবা সাবধানী - খুবই সাবধানী থাকেন কি বলছেন তা নিয়ে। কিন্তু আমি জানি
আপনার কাছে এর কোনো প্রয়োজন নেই। আপনি বলেছেন, আপনি শুধুমাত্র
হত্যাকারীকেই খুঁজছেন,
রত্নগুলো নিয়ে আপনি তেমন উদ্বিগ্ন নন। আমি আপনাকে বিশ্বাস
করি। আপনি একদম সঠিক ভাবেই অনুমান করেছিলেন যে আমরা রুবিগুলোর জন্যই নাইসে এসেছি।
পরিকল্পনা অনুযায়ী সেগুলো এখানেই হস্তান্তরিত হয়। আমার বাবার কাছেই সেগুলো এখন
আছে। আমাদের রহস্যময় খরিদ্দারটি কে সে ব্যাপারে উনি আপনাকে আগের দিন একটা ইঙ্গিত
দিয়েছেন।"
"মারকুইস?" পোয়ারো নরম গলায় অস্ফুট স্বরে বললেন।
"হ্যাঁ, মারকুইস।"
"আপনি কখনো
মারকুইসকে দেখেছেন,
মাদমোয়েজেল জিয়া?"
"একবার," মেয়েটি বললো,
"কিন্তু খুব ভালোভাবে নয়," সে যোগ করলো। "একটা চাবির ফুটো দিয়ে দেখেছিলাম।"
"ওটা খুবই
অসুবিধাজনক।" পোয়ারো সহানুভূতির সঙ্গে বললো, "কিন্তু তাহলেও আপনি তাকে দেখেছেন। আরেকবার দেখলে কি তাকে চিনতে পারবেন?"
জিয়া তার মাথা নাড়ালো।
"সে একটা মুখোশ পরে
ছিল,"
সে ব্যাখ্যা করলো।
"যুবক না বৃদ্ধ?"
"তার চুল সাদা রঙের
ছিল। সেটা পরচুলা হতেও পারে, আবার নাও হতে পারে। সেটা
খুবই সুন্দরভাবে লাগানো ছিল। কিন্তু আমার মনে হয় না সে বৃদ্ধ। তার হাঁটাচলা যুবকের
মতো, এবং গলাও।"
"তার গলা?" পোয়ারো চিন্তিতভাবে বললেন। "আঃ, তার গলা! আপনি আবার তার
গলা শুনলে চিনতে পারবেন,
মাদমোয়েজেল জিয়া?"
"হয়তো পারবো," মেয়েটি বললো।
"আপনি তার প্রতি
কৌতূহলী ছিলেন,
তাই না? আর সেটাই আপনাকে চাবির
ফুটোর কাছে নিয়ে গিয়েছিলো।"
জিয়া মাথা নাড়লো।
"হ্যাঁ, হ্যাঁ। আমি কৌতূহলী ছিলাম। তার সম্পর্কে এতো কিছু শোনা যায় - সে কোনো সাধারণ
চোর নয় - সে যেন একটা ঐতিহাসিক অথবা কাল্পনিক চরিত্র।
"হ্যাঁ," পোয়ারো চিন্তিতভাবে বললেন, "হ্যাঁ, হয়তো তাই।"
"কিন্তু আপনাকে ঠিক
এই কথাটা বলা আমার উদ্দেশ্য ছিল না," জিয়া বললো,
"শুধুমাত্র অন্য আরেকটা ছোট তথ্য জানাতে চেয়েছিলাম যা আমার
মনে হয়েছিল - মানে - আপনার কাজে লাগবে।"
"হ্যাঁ?" পোয়ারো উৎসাহিত হয়ে বললেন।
"রুবিগুলো, যে কথা বললাম এখানে নাইসে আমার বাবাকে হস্তান্তরিত করা হয়। যে ওগুলো বাবার
হাতে তুলে দিয়েছে তাকে আমি দেখি নি, কিন্তু -"
"হ্যাঁ?"
"আমি খালি একটা
জিনিস জানি। যে সে একজন মহিলা।"
চ্যাপ্টার ২৯
বাড়ি থেকে একটা
চিঠি
"প্রিয় ক্যাথেরিন,
"যেহেতু তুমি এখন
তোমার প্রখ্যাত এবং প্রিয় বন্ধুদের সঙ্গে সময় কাটাতে ব্যাস্ত, মনে হয় না আমাদের খাবরাখবরে তোমার কোনো উৎসাহ থাকবে বলে; কিন্তু আমি সবসময় মনে করে এসেছি যে তুমি একজন বুদ্ধিমতী মহিলা, আর হয়তো তোমাকে নিয়ে যতটা কল্পনা করি তার থেকেও কম অহংকারী। এখানে সবকিছু
প্রায় একইরকম আছে। নতুন কিউরেটকে নিয়ে ভয়ঙ্কর সমস্যা তৈরী হয়েছে, তার নামে প্রচুর কলঙ্ক। আমার মত অনুসারে, সে একজন রোমানের থেকে
কোনো অংশে কম নয়। সবাই ভিকারের কাছে এই নিয়ে বলেছে, কিন্তু তুমি জানো ভিকার কিরকম - শুধুমাত্র খৃস্টীয় দানধ্যান নিয়ে ব্যাস্ত কোনো
ঠিকঠাক আধ্যাত্মিক ব্যাপারে উৎসাহ নেই। ইদানিং কাজের লোক নিয়ে আমি খুবই ঝামেলায়
আছি। অ্যানি মেয়েটা কোনো কাজের নয় - স্কার্ট হাঁটুর ওপরে আর কোনো ভদ্রস্থ উলের
মোজাও পড়বে না। এদের মধ্যে একজনকেও কোনকিছু বলতে গেলে শুনতে চায় না। বাতের প্রচন্ড
যন্ত্রনা নিয়ে আমার কোনোরকমে কেটে যাচ্ছে, আর ডাক্তার হ্যারিস আমাকে
লন্ডনের বিশেষজ্ঞকে দেখানোর জন্য জোরাজুরি করছিলেন - তিন গিনির অপচয় তার ওপর
ট্রেনের ভাড়া,
আমি তাকে এই কথাই বলেছিলাম; কিন্তু বুধবার অবধি অপেক্ষা করার পর আমি সস্তায় ফেরার একটা উপায় পাই। লন্ডনের
ডাক্তারটি গম্ভীর মুখ করে সোজাসুজি কোনো কথা না বলে গোলগোল কথা বলে যাচ্ছিলো, শেষে আমি তাকে বললাম,
ডাক্তার, আমি একজন সরল মহিলা, আর কথাবার্তা আমাকে সরলভাবে বললেই ভালো হয়। এটা কি ক্যান্সার, না ক্যান্সার নয়। আর তারপর তাকে বাধ্য হয়ে হ্যাঁ বলতে হলো। তারা বললো এক বছর
সেবাশুশ্রূষার মধ্যে কাটাতে হবে, আর খুব বেশি ব্যাথাও হবে
না, যদিও আমি নিশ্চিত আমিও অন্যান্য খৃস্টান মহিলাদের মতোই ব্যাথা সহ্য করতে পারি। আমার বেশিরভাগ বন্ধুদের মৃত্যু অথবা চলে যাওয়ার ফলে, মাঝেমাঝে জীবনে খুবই একাকিত্ব অনুভব করি। মাঝে মাঝে মনে হয়, বাছা,
তুমি সেইন্ট মেরি মিডে থাকলেই ভালো হতো, আর এটা কিন্তু সত্যি। যদি তুমি এই সম্পত্তি না পেতে আর যদিনা ওই উঁচু সোসাইটিতে
থাকতে যেতে,
আমি তোমাকে আমার দেখাশোনার জন্য বেচারি জেন যা বেতন দিতো
তার দ্বিগুন বেতন দিতাম;
কিন্তু এখন - এখন আর যা পাওয়া সম্ভব নয় তা চেয়ে দুঃখ করা
উচিত নয়। তাসত্ত্বেও, পরিস্থিতি যদি কখনো তোমার বিপরীত হয় - আর তা যেকোনো সময়ে হতে
পারে। এই ধরণের অগুন্তি গল্প শোনা যায় যেখানে জাল অভিজাত পুরুষ সেজে মেয়েদের করার
পর তাদের টাকাপয়সা হস্তগত করে নিয়ে তাদের চার্চের দরজায় ফেলে পালিয়ে গেছে। আমি
বলবো এরকম কিছু তোমার সাথে ঘটা সম্ভব নয় কারণ তুমি যথেষ্ট বুদ্ধিমতী, কিন্তু কে জানে;
আগে কখনও এধরণের মনোযোগ না পাওয়ার ফলে হয়তো সহজেই তোমার মাথা
ঘুরে যেতে পারে। তাই,
বাছা, যদি কিছু ঘটে, মনে রেখো এখানে চিরকালের জন্য তোমার একটা বাড়ি আছে; আর আমি এমন একজন মহিলা যে শুধু সরলভাবে কথাই বলে না তারসাথে একজন দয়ালু, সহানুভূতিশীল এবং বন্ধুত্বপূর্ণ মহিলাও বটে।
"তোমার স্নেহশীল
পুরোনো বন্ধু,
"অ্যামেলিয়া ভিনের
"পুনশ্চ: খবরের
কাগজে একটা খবরে তোমার এবং তোমার তুতো বোন ভিসকাউন্টেস ট্যাম্পলিংয়ের উল্লেখ
দেখলাম, আমি সেটা কেটে আমার সংগ্রহের মধ্যে রেখে দিয়েছি। আমি রবিবার প্রার্থনা
করেছিলাম যাতে তুমি অহংকার এবং মিথ্যা গৌরবের থেকে রক্ষা পাও।"
ক্যাথেরিন এই
বৈশিষ্টপূর্ণ চিঠিটা বার দুয়েক পড়লো, তারপর সে সেটা নামিয়ে
রাখলো আর স্থির দৃষ্টিতে,
তার শোয়ার ঘরের জানলা দিয়ে ভূমধ্যসাগরের নীল জলের দিকে
তাকিয়ে থাকলো। তার গলার মধ্যে যেন সে একটা অদ্ভুত পিন্ডের উপস্থিতি অনুভব করতে
লাগলো। সেইন্ট মেরি মিডের জন্য একটা মনকেমন তাকে ছেয়ে ফেললো। প্রতি দিনের ছোট ছোট, বোকা বোকা,
কাজগুলো - আর তা সত্ত্বেও - বাড়ি। তার ইচ্ছে করছিলো মাথাটা
নিচু করে হাতের ওপর রাখতে আর খুব করে কাঁদতে।
সেই মুহূর্তে, লেনক্স,
ঢুকে পরে তাকে রক্ষা করলো।
"হ্যালো, ক্যাথেরিন,"
লেনক্স বললো, "বলছি - কি ব্যাপার?"
"কিছু না," ক্যাথেরিন মিস ভিনের চিঠিটা নিয়ে তার হাতব্যাগে ঢুকিয়ে বললো।
"আপনাকে কেমন
অদ্ভুত লাগছে,"
লেনক্স বললো, "বলছি - আশাকরি আপনি কিছু মনে করবেন না - আমি আপনার গোয়েন্দা বন্ধু, মসিয়েঁ পোয়ারোকে,
ফোন করেছিলাম, আর তাঁকে আমাদের সাথে
নাইসে লাঞ্চ করার জন্য অনুরোধ করেছি। আমি ওনাকে বলেছি যে আপনি ওনার সাথে দেখা
করতে চান,
কারণ আমার মনে হয়েছিল উনি আমার কথা বললে আসবেন না।"
"তুমি কি ওনার
সঙ্গে দেখা করতে চাইছিলে?"
ক্যাথেরিন জিজ্ঞেস করলো।
"হ্যাঁ," লেনক্স বললো,
"আমি ওনাকে আমার হৃদয় দান করেছি। আমি বেড়ালের মতো সবুজ
চোখওয়ালা কোনো পুরুষ মানুষ আগে কোনোদিনও দেখি নি।"
"ঠিক আছে," ক্যাথেরিন বললো। সে অলসভাবে কথা বলছিলো। গত কয়েকদিন বেশ বিরক্তিকর ভাবে
কাটছিলো। ডেরেক কেটারিংয়ের গ্রেফতারিই এখন সমস্ত আলোচনার মূল বিষয়, আর দ্যা ব্লু ট্রেনের রহস্য সমস্ত কাল্পনিক দৃষ্টিকোণ থেকে পুঙ্খানুপুঙ্খ ভাবে
আলোচিত হচ্ছে।
"আমি গাড়ির জন্য
বলে দিয়েছি,"
লেনক্স বললো, "আর আমি মাকে মিথ্যে বা অন্যকিছু একটা বলে দিয়েছি - দুর্ভাগ্যবশত কি বলেছি সেটা
এখন আর মনে করতে পারছি না;
কিন্তু এটা কোনো গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নয়, কারণ মা কিছু মনে রাখতে পারে না। যদি মা জানতে পারে আমরা কোথায় যাচ্ছি, তাহলে মাও যেতে চাইবে,
আর মসিয়েঁ পোয়ারোকে চাপ দিয়ে কথা বার করার চেষ্টা
করবে।"
মেয়ে দুটি নেগ্রেসকো পৌঁছে
দেখলো পোয়ারো অপেক্ষা করছেন।
তিঁনি তাদেরকে পুরোপুরি
ফরাসি ভদ্রতায় অভ্যর্থনা করলেন, আর তাদের ওপর এতরকম
প্রশংসার বর্ষণ করছিলেন যে তারা হেসে কুল পাচ্ছিলো না, এতসব সত্ত্বেও খাবারের সময়টা খুব একটা মধুর ছিল না। ক্যাথেরিন একটু স্বপ্নালু
এবং অন্যমনস্ক ছিল,
আর লেনক্স তো ঝড়ের মতো কথা বলে যাচ্ছিলো, মাঝে মাঝে কিছুক্ষনের নীরবতার সাথে। তারা যখন ছাদে বসে কফিতে চুমুক দিচ্ছিলো
লেনক্স সোজাসুজি ভাবে পোয়ারোকে আক্রমণ করলো।
"সবকিছু কেমন চলছে? আপনি নিশ্চই জানেন আমি কি বলতে চাইছি?"
পোয়ারো তাঁর কাঁধ
ঝাঁকালেন,
"তারা তাদের পথেই চলবে," তিঁনি বললেন।
"আর আপনি তাদেরকে
তাদের পথেই চলতে দিচ্ছেন?"
তিঁনি একটু দুঃখিতভাবে
লেনক্সের দিকে তাকালেন।
"আপনি অল্পবয়সী, মাদমোয়েজেল,
কিন্ত কিছু জিনিস আছে যেখানে তাড়াহুড়ো চলে না - মঙ্গলময়
ঈশ্বর, প্রকৃতি এবং বয়স্ক মানুষ।"
"বাজে কথা!"
লেনক্স বললো। "আপনি মোটেও বয়স্ক নন।"
"হুম, আপনি যা বলছেন তা খুবই সুন্দর।"
"ওই যে মেজর নাইটোন," লেনক্স বললো। ক্যাথেরিন তাড়াতাড়িই করে একবার ঘুরে দেখে নিয়ে আবার সোজা হয়ে
বসলো।
"উনি ভ্যান আলদীনের
সঙ্গে এসেছেন,"
লেনক্স বলতে থাকলো," মেজর নাইটোনের কাছ থেকে আমি একটা বিষয়ে কিছু কথা জানতে চাই। এক মিনিটও লাগবে
না।"
সেখানে যখন শুধুমাত্র
তাঁরা দুজনে ছিলেন,
পোয়ারো সামনে ঝুকে নিচু স্বরে অস্ফুটভাবে কাথেরিনকে বললেন:
"আপনি অন্যমনস্ক, মাদমোয়েজেল,
আপনার মন, এখন অনেক দূরে, তাই না?"
"শুধুমাত্র
ইংল্যান্ড অবধি,
তার থেকে দূরে নয়।"
"আচমকা একটা আবেগের
বসে, সে আজকে সকালে পাওয়া চিঠিটা বার করলো এবং সেটা তাঁর হাতে দিলো পড়তে ।"
"এটাই প্রথম বার্তা
যা আমার পুরোনো জীবন থেকে এসেছে; কি জানি কেন - এটা এতো
কষ্ট দিচ্ছে।"
তিঁনি চিঠিটা পরে তাকে
আবার ফেরত দিলেন। "তাহলে আপনি আবার সেইন্ট মেরি মিডে ফিরে যাচ্ছেন?" তিঁনি ধীরে ধীরে জিজ্ঞেস করলেন।
"না, আমি যাচ্ছি না,"
ক্যাথেরিন বললো, "কেন যাবো?"
"হুম," পোয়ারো বললেন,
"আমার ভুল। আমাকে ছোট্ট একটা মিনিটের জন্য একটু মার্জনা
করবেন।"
তিঁনি উঠে যেখানে লেনক্স
ট্যাম্পলিং ভ্যান আলদীন এবং নাইটোনের সাথে কথা বলছিলো সেই দিকে চললেন।
আমেরিকানটিকে বৃদ্ধ এবং
ম্লান লাগছিলো। তিঁনি পোয়ারোকে সংক্ষিপ্তভাবে মাথা হেলিয়ে অভিবাদন করলেন কিন্তু আর
কোনো উদ্দীপনা দেখা গেলো না।
তিঁনি যখন লেনক্সের কিছু
মন্ত্যবের উত্তর দিচ্ছিলেন,
পোয়ারো নাইটোনকে একটা ধারে নিয়ে গেলেন।
"মসিয়েঁ ভ্যান
আলদীনকে অসুস্থ লাগছে,"
তিঁনি বললেন।
"আপনি অবাক হচ্ছেন?" নাইটোন প্রশ্ন করলো,
"ওনার চিন্তার বিষয়টা হলো, ডেরেক কেটারিংয়ের গ্রেফতার হওয়ার কেলেঙ্কারিটা যেন সবকিছুর ওপর একটা ঢাকা দিয়ে
দিয়েছে। এমনকি উনি অনুতাপ করছেন আপনাকে সত্যিটা খুঁজে বার করতে বলেছিলেন
বলে।"
"ওনার ইংল্যান্ডে
ফিরে যাওয়া উচিত,"
পোয়ারো বললেন।
"আমরা আগামী
পরশুদিন যাচ্ছি।"
"এটা ভালো খবর," পোয়ারো বললেন।
সে ইতস্তত করছিলো, আর ছাদের অন্যদিকে যেখানে ক্যাথেরিন বসেছিল সেই দিকে তাকাচ্ছিলো।
"আমি চাই," তিঁনি নিচু গলায় অস্ফুট স্বরে বললেন, "যে আপনিই এটা মিস গ্রেকে বলুন।"
"ওনাকে কি বলবো?"
"যে আপনি - মানে
মসিয়েঁ ভ্যান আলদীন ইংল্যান্ডে ফিরে যাচ্ছেন।"
নাইটোনকে একটু
দ্বিধান্বিত লাগছিলো,
কিন্তু শীঘ্রই সে ছাদের অন্যদিকে গিয়ে ক্যাথেরিনের সাথে যোগ
দিলো।
পোয়ারো তাকে যেতে দেখে
সন্তুষ্টিতে মাথা নাড়ালেন আর তারপর লেনক্স এবং আমেরিকানটির সাথে যোগ দিলেন। দু এক
মিনিট পরে তাঁরা অন্যদের সাথে যোগ দিলেন। কয়েক মিনিট সাধারণ কথাবার্তা হলো, তারপর ধনকুবের এবং তাঁর সেক্রেটারি বিদায় নিলেন। পোয়ারোও বিদায় নেওয়ার জন্য
তৈরি হলেন।
"আপনাদের আতিথেয়তার
জন্য হাজার ধন্যবাদ,
মাদমোয়েজেলদ্বয়," তিঁনি চিৎকার করে বললেন, "এটা সবথেকে চমৎকার লাঞ্চ
ছিল। এবং তাছাড়াও,
এটা আমার প্রয়োজন ছিল!" তিঁনি নিজের বুক ফুলিয়ে বুকের
ওপর চাপড় মারলেন। "আমি এখন একজন সিংহ - একটা দৈত্য। আঃ! মাদমোয়েজেল ক্যাথেরিন, আমি কি হতে পারি আপনি তা এখনো দেখেন নি। আপনি ভদ্র, শান্ত এরকুল পোয়ারোকে দেখেছেন; কিন্তু আরেকজন এরকুল
পোয়ারো আছে। এবার আমি নির্মম ভাবে তর্জন গর্জন করবো, ধমকি দেব,
যারা আমার কথা শুনবে তাদের বুকে ভয় ঢুকিয়ে দেব।
তিঁনি তাদের দিকে একটা
আত্মতৃপ্তির ভঙ্গিতে তাকালেন, এবং তাদের দুজনকেই মুগ্ধ
বলে মনে হচ্ছিলো,
যদিও লেনক্স তার নিচের ঠোটটা কামড়াচ্ছিল, আর ক্যাথেরিনের মুখের কোনাটা একটু সন্দেহজনক ভাবে বেঁকে ছিল।
"আর আমি এরকমটা
করবোই,"
তিঁনি গম্ভীর ভাবে বললেন। "আর অবশ্যই, আমি সফল হবো।"
তিঁনি কয়েক পা এগোতেই
ক্যাথেরিনের ডাকে আবার তাঁকে ঘুরে দাঁড়াতে হলো।
"মসিয়েঁ পোয়ারো, আমি - আমি আপনাকে জানাতে চাই। আমার মনে হয় আপনার কথাই সঠিক ছিল। আমি প্রায়
অবিলম্বে ইংল্যান্ডে ফিরে যাচ্ছি।"
পোয়ারো তীব্রভাবে তার
দিকে তাকিয়ে থাকলেন,
আর তাঁর সেই সরাসরি দৃষ্টির সামনে ক্যাথেরিন লজ্জিত হয়ে
পড়লো।
"বুঝলাম," তিঁনি গম্ভীরভাবে বললেন।
"আমার মনে হয় না
আপনি বুঝেছেন,"
ক্যাথেরিন বললো।
"আপনি যা ভাবছেন
আমি তাঁর থেকে বেশি জানি,
মাদমোয়েজেল," তিঁনি শান্তভাবে বললেন।
তিঁনি ঠোঁটের ওপর একটা
অদ্ভুত ছোট হাসি নিয়ে এগিয়ে গেলেন। একটা অপেক্ষারত গাড়িতে উঠে, তিঁনি এন্টিবশের দিকে চললেন।
হিপ্পোলাইতে, কমতে ডে লা রোচের কাঠ কাঠ মুখের চাকর, ভিলা মারিনাতে তাঁর
মনিবের সুন্দর দেখতে কাট-গ্লাসের টেবিলটা পালিশ করতে ব্যাস্ত ছিল। কমতে ডে লা রোচে
নিজে সেইদিনকার জন্য মন্টে কার্লোতে গেছেন।
হঠাৎ জানলা দিয়ে তাকিয়ে, হিপ্পোলাইতে একজন আগন্তুককে দ্রুত গতিতে হলের দরজার দিকে আসতে দেখলো।
আগন্তুকটি হিপ্পোলাইতের কাছে এতটা অন্যধরণের, যে সে অভিজ্ঞ হওয়া
সত্ত্বেও,
ঠিক বুঝতে পারলো না। সে তাঁর স্ত্রী, মারিয়েকে,
যে নাকি রান্নাঘরে ব্যাস্ত ছিল, ডেকে লোকটিকে দেখালো।
"আবার পুলিশ নয়তো?" মারিয়ে উদ্বিগ্ন স্বরে বললো।
"নিজেই দেখো," হিপ্পোলাইতে বললো।
"নিশ্চিতভাবেই
পুলিশ নয়,"
সে ঘোষণা করলো। "আমি খুশি।"
"তারা কিন্তু
আমাদের খুব একটা জ্বালাতন করে নি।" হিপ্পোলাইতে বললো, "এমন কি,
মসিয়েঁ কমতের সাবধানবাণীটি ছাড়া, আমি চিন্তাও করতে পারতাম না যে মদের দোকানের অপরিচিত ব্যাক্তিটি কে ছিলেন।
হলের ঘন্টাটা বাজলো আর
হিপ্পোলাইতে,
তার গম্ভীর এবং ভদ্র ব্যাক্তিত্বের সাথে, দরজাটা খুলতে গেলো।
"দুঃখের সঙ্গে
জানাচ্ছি,
মসিয়েঁ লে কমতে, এখন বাড়িতে নেই।"
লম্বা গোঁফওয়ালা ছোটোখাটো
মানুষটি শান্ত ভঙ্গিতেও উজ্জ্বল হয়ে উঠলেন।
"আমি সেটা জানি," তিঁনি উত্তর দিলেন,
"তুমি তো হিপ্পোলাইতে ফ্ল্যাভেলে, তাই না?"
"হ্যাঁ, মসিয়েঁ,
এটাই আমার নাম।"
"আর তোমার স্ত্রী, মারিয়ে ফ্ল্যাভেলে?"
"হ্যাঁ, মসিয়েঁ,
কিন্তু -"
"আমি তোমাদের
দুজনের সাথেই কথা বলতে চাই,"
অচেনা লোকটি বললো এবং সে টুক করে হিপ্পোলাইতের পাশ কাটিয়ে
হলে ঢুকে পড়লো।
"তোমার স্ত্রী
নিশ্চই রান্নাঘরে আছে,"
তিনি বললেন, "আমি সেখানেই যাবো।"
হিপ্পোলাইতে ঠিক ভাবে
নিঃস্বাস নেওয়ার আগেই,
অপরজন হলের পেছনদিকে সঠিক দরজাটা দিয়ে বেরিয়ে প্যাসেজ হয়ে
রান্নাঘরে পৌঁছলেন,
যেখানে মারিয়ে হাঁ করে তাঁর দিকে তাকিয়েছিলো।
"এই তো," বলে অপরিচিত ব্যাক্তিটি, একটা কাঠের হাতলওয়ালা
চেয়ারে গিয়ে বসলেন,
"আমি এরকুল পোয়ারো।"
"হ্যাঁ, মসিয়েঁ?"
"তোমরা কি নামটা
শুনেছ?"
"কোনোদিনও শুনি
নি।" হিপ্পোলাইতে বললো।
"তোমাদের বলতে
বাধ্য হচ্ছি যে তোমরা কোনো খোজঁখবরই রাখো না। এটা পৃথিবীর একজন মহান ব্যাক্তির
নাম।"
তিনি একটা দীর্ঘশ্বাস
ফেলে হাতদুটো বুকের ওপর ভাঁজ করে রাখলেন।
হিপ্পোলাইতে এবং মারিয়ে
অস্বস্তি নিয়ে তাঁর দিকে তাকিয়ে ছিল। তারা বুঝতেই পারছিলো না এই অপ্রত্যাশিত এবং
সাংঘাতিক অদ্ভুত অতিথিকে নিয়ে কি করবে।
"মসিয়েঁ চাইছেন
-" হিপ্পোলাইতে যান্ত্রিকভাবে অস্ফুট স্বরে বললো।
"আমি জানতে চাইছি
তোমরা পুলিশকে মিথ্যা কথা কেন বললে।"
"মসিয়েঁ," হিপ্পোলাইতে চেঁচিয়ে উঠলো, "আমি - পুলিশকে মিথ্যা কথা
বলেছি? আমি এরকম কাজ কখনোই করি নি।"
মসিয়েঁ পোয়ারো তাঁর মাথা
নাড়লেন।
"তোমার কথা মিথ্যা," তিনি বললেন,
"মিথ্যে তুমি বহুবার বলেছো। দাড়াও দেখছি।" তিনি পকেট
থেকে একটা ছোট নোটবুক বার করে তাতে দেখতে থাকলেন। "আঃ, হ্যাঁ,
কম করে সাত বার তো বটেই, আমি তোমাদের পরে
শোনাচ্ছি।"
একটা অমায়িক আবেগহীন গলায়
তিনি সাতটি জবানবন্দির বিবরণ পরে যেতে লাগলেন।
হিপ্পোলাইতে অবাক হয়ে
গেছিলো।
"কিন্তু আগেকার এই ব্যর্থতাগুলো
নিয়ে আমি কথা বলতে আসি নি,"
পোয়ারো বললেন, "খালি,
প্রিয় বন্ধুরা, নিজেদের বেশি চালাক ভাবার
অভ্যেসটা ত্যাগ করো। এবার আমি নির্দিষ্টভাবে একটা মিথ্যায় আসছি যেটা নিয়ে আমি
উদ্বিগ্ন - তোমাদের জবানবন্দি যে কমতে ডে লা রোচে ভিলাতে ১৪ই জানুয়ারী সকালে
পৌঁচেছেন।"
"কিন্তু এটা মিথ্যা
নয়, মসিয়েঁ;
এটাই সত্যি। মসিয়েঁ লে কমতে ১৪ই, মঙ্গলবার এখানে পৌঁচেছেন। এটাই তো, মারিয়ে, ঠিক কিনা?"
মারিয়ে আগ্রহের সাথে
সম্মতি জানালো।
"হুম, হ্যাঁ,
ঠিক তাই তো। আমার পরিষ্কারভাবে মনে আছে।"
"হুম," পোয়ারো বললেন,
"আর সেদিন তোমাদের প্রিয় মনিবকে দুপুরে কি খেতে দিয়েছিলে?"
"আমি -"
মারিয়ে থেমে,
মনে করার চেষ্টা করলো।
"অদ্ভুত," পোয়ারো বললেন,
"কিভাবে একজন কিছু জিনিস মনে রাখে - আবার অন্যান্য জিনিস
ভুলে যায়।"
তিঁনি সামনে ঝুঁকে এলেন
এবং নিজের মুষ্ঠি দিয়ে টেবিলের ওপর জোরে একটা ঘুসি মারলেন; তাঁর চোখ রাগে জ্বলছিল।
"হ্যাঁ, হ্যাঁ,
আমি যে কথা বলছিলাম। তোমরা মিথ্যা কথা বলছো আর ভাবছো কেউ
কিছু জানে না। কিন্তু দুজন আছেন যাঁরা জানেন। হ্যাঁ - দুজন। একজন মঙ্গলময় প্রভু
-"
তিনি স্বর্গের দিকে নিজের
হাত তুললেন,
আর তারপর আবার চেয়ারে ঠিক করে বসে চোখ বন্ধ করে তিনি
স্বস্তির সাথে অস্ফুট স্বরে বললেন:
"আর আরেকজন হচ্ছেন
এরকুল পোয়ারো।"
"আমি আপনাকে
আস্বস্ত করছি,
মসিয়েঁ, আপনি পুরোপুরি ভুল করছেন।
মসিয়েঁ লে কমতে সোমবার সকালে প্যারিস থেকে রওনা হয়েছেন -"
"হ্যাঁ সত্যি," পোয়ারো বললেন,
" দ্রুত গতির ট্রেনে। আমি জানি না যাত্রার মাঝপথে উনি কোথায়
নেমেছিলেন। হয়তো তোমরাও এ সম্পর্কে জানো না। তোমরা যেটা জানো যে উনি বুধবার সকালে
এখানে পৌঁচেছিলেন,
মঙ্গলবার সকালে নয়।
"মসিয়েঁ, ভুল করছেন,"
মারিয়ে দৃঢ়ভাবে বললো।
পোয়ারো উঠে দাঁড়ালেন।
"তাহলে আইন তার
পথেই চলবে,"
তিনি বিড়বিড় করে বললেন, "দুঃখের ব্যাপার।"
"আপনি কি বলতে
চাইছেন, মসিয়েঁ?"
মারিয়ে একটা অস্বস্তি নিয়ে প্রশ্ন করলো।
"মিসেস কেটারিং, যে ইংরেজ মহিলা খুন হয়েছেন, তাঁর খুনের সহযোগী হিসেবে
তোমরা গ্রেফতার হবে।"
"খুন!"
লোকটির মুখ চকের মতো সাদা
হয়ে গেলো,
এবং তার হাটু দুটো কাঁপতে লাগলো। মারিয়ে হাত থেকে রুটি
বানানোর বেলুনটা ফেলে দিয়ে কাঁদতে শুরু করে দিলো।
"কিন্তু এতো অসম্ভব
- অসম্ভব। আমি ভেবেছিলাম -"
"যেহেতু তোমরা
তোমাদের গল্প থেকে সরবে না,
তাহলে আমার আর কিছুই বলার নেই। আমার মনে হয় তোমরা দুজনেই
বুদ্ধিহীন।"
তিঁনি দরজার দিকে ঘুরতেই
একটা কাঁপা কাঁপা গলা তার পথ আটকালো।
"মসিয়েঁ, মসিয়েঁ,
একটু দাঁড়ান। এটা যে এরকম একটা ব্যাপার সে বিষয়ে আমার -
আমার কোনো ধারণা ছিল না। আমি - আমি ভেবেছিলাম এটা কোনো একজন মহিলা সংক্রান্ত বিষয়।
আগেও মহিলাদের নিয়ে পুলিশের সাথে বিশ্রী ঘটনা ঘটেছে। কিন্তু খুন - সেটা তো পুরো
অন্যরকম একটা বিষয়।"
"আমি আর তোমাদের
ওপর ধৈর্য রাখতে পারছি না।" পোয়ারো চিৎকার করে বললেন, তিঁনি তাদের দিকে ঘুরে রাগে হিপ্পোলাইতের মুখের সামনে নিজের মুঠি ঝাকাতে
লাগলেন। "আমি কি সারাদিন
এখানেই আটকে থাকবো,
গোটা দুই এইরকম মূর্খের সাথে? আমি সত্যিটা শুনতে চাই। যদি সেটা তোমরা আমাকে না বলো, তাহলে সেটা তোমাদের দৃষ্টিভঙ্গি। শেষ বারের মতো জিজ্ঞেস করছি, মসিয়েঁ লে কমতে ভিলা মারিনাতে কখন পৌঁচেছিলেন - মঙ্গলবার সকালে না বুধবার
সকালে?"
"বুধবার," লোকটি হাঁফাতে হাঁফাতে বললো, আর তার পেছন থেকে মাথা নাড়িয়ে
মারিয়ে তার সমর্থন জানালো।
পোয়ারো দু এক মিনিট তাদের
দিকে তাকিয়ে থাকলেন,
তারপর গম্ভীরভাবে মাথাটা একদিকে হেলালেন।
"বাছারা, তোমরা বুদ্ধিমানের মতো কাজ করেছো," তিঁনি শান্তভাবে বললেন,
"একটা সাংঘাতিক সমস্যায় ফেঁসে যাওয়ার খুব কাছাকাছি পৌঁছে
গিয়েছিলে তোমরা।"
নিজের মনেই হাসতে হাসতে, তিঁনি ভিলা মারিনা থেকে বেরিয়ে এলেন।
"আমাদের অনুমান সত্যি
প্রমাণিত হয়েছে,"
তিঁনি নিজের মনেই বিড়বিড় করে বললেন, "আমি কি অন্যদের ওপরেও একটা সুযোগ নেবো?"
মসিয়েঁ এরকুল পোয়ারোর
কার্ড যখন মিরেলের কাছে পৌঁছে দেওয়া হলো তখন সন্ধ্যা ছটা বাজে।
সে কিছুক্ষন সেটার দিকে
তাকিয়ে থেকে মাথাটা নাড়ালো। পোয়ারো ঘরে ঢুকে দেখলো যে সে জোরে জোরে ঘরের এমাথা
ওমাথা পায়চারি করছে। সে রেগে তাঁর দিকে ঘুরে তাকালো।
"তাহলে?" সে চিৎকার করে বললো,
"তাহলে? এখন কি? আপনি কি আমার ওপর যথেষ্ট অত্যাচার করেন নি, আপনারা সবাই? আপনারা কি আমাকে আমার বেচারি ডেরেকের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করতে বাধ্য করেন নি? আরো কি চান?"
"খালি, ছোট একটা প্রশ্ন,
মাদমোয়েজেল। ট্রেন লিয়োন্স ছাড়ার পর, আপনি যখন মিসেস কেটারিংয়ের কম্পার্টমেন্টে ঢুকলেন -"
"সে আবার কি?"
পোয়ারো তার দিকে একটা
হালকা ভর্ত্সনার দৃষ্টিতে তাকালেন আর তারপর আবার শুরু করলেন।
"যা বলছিলাম যখন
আপনি মিসেস কেটারিংয়ের কম্পার্টমেন্টে ঢুকলেন -"
"আমি কখনোই ঢুকি
নি।"
"আর যখন তাঁকে
দেখলেন -"
"আমি কখনই দেখি
নি।"
"হুম, নিষ্পাপ!"
তিঁনি রেগে তার দিকে ঘুরে
দাঁড়ালেন এবং তাকে চিৎকার করে বললেন, যাতে সে ভয়ে পেয়ে পিছিয়ে
যায়।
"আপনি কি আমাকে
মিথ্যা বলে পার পাবেন?
আমি বলছি আমি সশরীরে সেখানে উপস্থিত থাকার মতো করেই জানি যে
ঠিক কি ঘটেছিলো। আপনি তাঁর কম্পার্টমেন্টে
ঢুকেছিলেন এবং দেখলেন যে তিঁনি মৃত। আমি বলছি এটা আমি জানি। আমাকে মিথ্যা বলাটা খুবই বিপজ্জনক। সাবধান, মাদমোয়েজেল,
মিরেলে।"
তাঁর দৃষ্টির দিকে তাকিয়ে
মিরেলের চোখে দ্বিধান্বিত ভাব ফুটে উঠলো এবং সে চোখ নামিয়ে নিলো।
"আমি - আমি জানি না
-" সে অনিশ্চিতভাবে শুরু করে থেমে গেলো।
"আমি খালি একটা
ব্যাপার নিয়ে চিন্তা করছি,"
পোয়ারো বললেন, "আমি ভাবছি,
মাদমোয়েজেল, আপনি যে জিনিসটা
খুঁজছিলেন সেটা কি পেয়েছিলেন অথবা নাকি -"
"নাকি কি?"
"অথবা নাকি অন্য
একজন আপনার আগেই কাজটা সেরে ফেলেছিলো।"
"আমি আর কোনো
প্রশ্নের উত্তর দেব না,"
নৃত্যশিল্পীটি চেঁচিয়ে বললো। সে নিজেকে পোয়ারোর বাধা দেওয়ার
জন্য তোলা হাত থেকে ছাড়িয়ে নিলো, এবং উন্মাদের মতো মাটিতে
লুটিয়ে পরে,
চিৎকার করতে লাগলো এবং কাঁদতে লাগলো। একজন ভয়ার্ত পরিচারিকা
দৌড়ে এলো।
এরকুল পোয়ারো নিজের কাঁধ
ঝাঁকালেন,
ভুরু দুটি তুললেন, এবং নিঃশব্দে ঘর থেকে
বেরিয়ে গেলেন।
কিন্তু তাঁকে সন্তুষ্ট
লাগছিলো।
চ্যাপ্টার ৩০
মিস ভিনের নিজের মত
জানালেন
ক্যাথেরিন মিস ভিনেরর
শোয়ার ঘরের জানলা দিয়ে বাইরে তাকিয়েছিলো। বৃষ্টি পড়ছিলো, মুষলধারে নয়,
কিন্তু যেন শান্ত, অভিজাত নাছোড়বান্দা
ধরণের। জানলা দিয়ে সামনের বাগানের একটা ফালি দেখা যায় যার মাঝ দিয়ে একটা রাস্তা
গেট পর্যন্ত চলে গেছে আর তার দুদিকে ফুলের বাগিচা, যেখানে পরে গোলাপ ও হাইসিনথ্ ফুটবে। মিস ভিনের বিশাল একটা ভিক্টোরিয়ান খাটে
শুয়ে আছেন। প্রাতরাশের অবশিষ্ট পরে আছে এমন একটা ট্রেকে ঠেলে একপাশে সরানো আছে আর
তিনি এখন ব্যাস্ত নিজের চিঠিপত্রগুলো খুলতে এবং সেগুলো সম্পর্কে শ্লেষাত্মক
মন্ত্যব্য করতে।
ক্যাথেরিনের হাতেও একটা
খোলা চিঠি যদিও সে সেটা দ্বিতীয় বারের জন্য পড়ছিলো। এটাতে রিট্জ হোটেল প্যারিসের ডেটের
স্ট্যাম্প দেওয়া আছে।
"প্রিয় মাদমোয়েজেল
ক্যাথেরিন (এটা এভাবে শুরু হয়েছে),
"বিশ্বাস করি আপনি
সুস্থই আছেন এবং শীতের ইংল্যান্ডে ফিরে যাওয়াটা আপনার পক্ষে খুব বেশি হতাশাজনক হয়
নি। আমাকে,
অনলস প্রচেষ্টার সাথে আমার অনুসন্ধান চালিয়ে নিয়ে যেতে
হচ্ছে। মনে করবেন না যে আমি এখানে ছুটি কাটাচ্ছি। খুব তাড়াতাড়ি আমি ইংল্যান্ডে
যাবো, আশা করছি তখন আবার আপনার সাথে দেখা করার সৌভাগ্য হবে। ঠিক এই রকমটাই হওয়া উচিত, ঠিক কিনা?
লন্ডনে পৌঁছে আমি আপনাকে চিঠি দেব। আপনার কি মনে আছে এই
কাজে আমরা সহকর্মী?
এটা যে আপনি ভালোভাবেই জানেন তা আমি বাস্তবিক ভাবেই মনে করি।
"আপনার অনুভূতির
প্রতি আমার শ্রদ্ধা এবং আনুগত্যর ওপর আস্বস্ত থাকবেন, মাদমোয়েজেল।
"এরকুল
পোয়ারো"
ক্যাথেরিনের ভুরুগুলো
কিছুটা কুঁচকে গেলো। যেন চিঠিটার কোনো একটা কিছু তাকে বিভ্রান্ত এবং কৌতূহলী করে
তুলেছে।
"অবশ্যই এটা
সমবেতসঙ্গীত দলের ছেলেদের পিকনিক," মিস ভিনেরর দিক থেকে শোনা
গেলো। "টমি সন্ডারস এবং আলবার্ট ডাইকসকে বাদ দিয়ে দেওয়া উচিত, আর ওরা যতক্ষণ না চাঁদা দিচ্ছে ততক্ষন আমিও দেব না। জানি না ছেলে দুটো রবিবার
চার্চে কি করছে বলে মনে করে। টমি একবার 'O God, make speed to save us,' গাওয়ার পর আর মুখ খোলে নি, আর আলবার্ট ডাইকস যদি না
একটা মিন্ট হাম্বাগ চোষে,
তাহলে আমার নাক আর চিরকালীন সেই নাকই নয়।"
"আমি জানি ওরা
অসহ্যকর,"
ক্যাথেরিন সহমত হলো।
তারপর সে তার দ্বিতীয়
চিঠিটি খুললো,
এবং হঠাৎ করে তার গালে একটা রক্তিম আভা ফুটে উঠলো। ঘরের
ভেতর মিস ভিনেরর গলার আওয়াজ যেন অনেকে দূর থেকে আসছে বলে মনে হলো।
যখন সে আবার নিজের
চারপাশের পরিস্থিতির সচেতনার মধ্যে ফিরে এলো ততক্ষনে মিস ভিনের একটা লম্বা বক্তৃতা
বিজয়িনীর মতো শেষ করার পর্যায় পৌঁছেছেন।
"আর আমি তাকে বললাম, 'কখনোই হতে পারে না। এটা ঘটনা যে, মিস গ্রে হচ্ছেন লেডি
ট্যাম্পলিংয়ের নিজের তুতো বোন।' তুমি এটাকে কি ভাবছো?"
"আপনি কি আমার জন্য
আমার যুদ্ধ লড়ছিলেন?
আপনি অত্যন্ত মিষ্টি একজন মানুষ।"
"ইচ্ছা করলে তুমি
এটাকে এভাবেও দেখতে পারো। উপাধিতে কিছু আসে যায় বলে আমি মনে করি না। ভিস্কারের
স্ত্রী হোক বা যাই হোক না কেন, ওই মহিলা একটা বেড়ালের
মতো। ইঙ্গিত করছিলো যে তুমি পয়সা দিয়ে সম্ভ্রান্ত সোসাইটিতে ঢুকেছো।"
"উনি হয়তো খুব একটা
ভুল নন।"
"আর নিজের দিকে
দেখো,"
মিস ভিনের বলতে থাকলেন। "তুমি কি একজন গর্বিত ও
অহংকারী মহিলা হয়ে ফিরে এলে, যা তুমি হতেই পারতে? না, এখনো তুমি সেই আগের মতোই বিচক্ষণ আছো, যে কিনা ঠিকঠাক জুতো এবং
একজোড়া ভালো বালবৃজ্ঞান মোজা পরে। আমি গতকালই এলেন কে এই কথা বলছিলাম। 'এলেন,' আমি বললাম, 'মিস গ্রেকে দেখো।
উনি দেশের গন্যমান্য ব্যাক্তিদের সাথে ওঠা বসা করছিলেন, আর তার স্কার্ট কি তোমার মতো হাঁটুর ওপরে থাকে বা সে কি এমন সিল্কের মোজা পরে
যাতে সুতো খুলে গিয়ে লম্বালম্বি ফুটো দেখা যায়, আর সে কি আমার দেখা
সবচেয়ে জঘন্য জুতোটা পরে।
ক্যাথেরিন নিজের মনেই
একটুখানি হেসে নিলো;
মিস ভিনেরের বস্তাপচা সংস্কার অনুযায়ী চলাটা এখনো পর্যন্ত
তার পক্ষে যথেষ্ট মূল্যবান প্রমাণিত হয়েছে। বৃদ্ধা মহিলাটি আরো বাড়তি উৎসাহ নিয়ে
বলে যেতে থাকলেন।
"এটা একটা বড়ো
স্বস্তির বিষয় যে তোমার মাথাটা ঘুরে যায় নি। কয়েকদিন আগেই আমি আমার খবরের
কাটিংগুলো খুজছিলাম। আমার কাছে প্রচুর লেডি ট্যাম্পলিং এবং তাঁর যুদ্ধের হাসপাতাল
সম্পর্কে এবং আরো কত কির ওপর কাটিং আছে। কিন্তু ওগুলো নিয়ে আর আমি ঘাটাঘাটি করতে
পারি না। বাছা;
আমি চাই তুমি ওগুলো দেখো, তোমার চোখের অবস্থা আমার থেকে ভালো। ওগুলো সব লেখার টেবিলের ড্রয়ারে একটা
বাক্সের মধ্যে আছে।"
ক্যাথেরিন তার হাতের
চিঠিটার দিকে একবার তাকালো আর কিছু বলতে যাচ্ছিলো, কিন্তু থেমে গেলো,
আর লেখার টেবিলে গিয়ে কাটিংয়ের বাক্সটা বের করলো আর সেগুলো
দেখতে থাকলো। সেইন্ট মেরি মিডে ফিরে আসার পর থেকে সে মিস ভিনেরের আত্মসংযম এবং তেজ
দেখে বৃদ্ধা মহিলাটির প্রতি গভীর সহানুভূতিশীল হয়ে পড়েছে। সে অনুভব করেছিল যে সে
তার বৃদ্ধ বন্ধুর জন্য খুব অল্পই কিছু করতে পারবে, কিন্তু সে তার অভিজ্ঞতা থেকে জানে যে এই ছোট ছোট জিনিসগুলো এই বৃদ্ধ
মানুষগুলির কাছে কতখানি।
"এই যে একটা," সে অনতিবিলম্বে বললো। "ভিসকাউন্টেস ট্যাম্পলিং, যিনি কিনা নাইসে নিজের ভিলাতে অফিসারদের হাসপাতাল চালাচ্ছেন, একটা সাংঘাতিক ডাকাতির শিকার হয়েছেন, তাঁর বেশকিছু রত্ন চুরি
হয়ে গেছে। তাদের মধ্যে বেশকয়েকটা বিখ্যাত পান্না ছিল, যা ট্যাম্পলিং পরিবারের উত্তরাধিকার সূত্রে পাওয়া।"
"হয়তো নকল," মিস ভিনের বললেন,
"এইসব বেশির ভাগ সামাজিক মহিলাদেরই রত্নগুলো ঝুটো।"
"এই যে আরেকটা," ক্যাথেরিন বললো,
"ওনার একটা ছবি 'চমৎকার ভাবে ক্যামেরার
দ্বারা চর্চিত ভিসকাউন্টেস ট্যাম্পলিং ও তাঁর ছোট্ট মেয়ে লেনক্স'"
"আমাকে দেখতে দাও," মিস ভিনের বললেন,
"বাচ্ছাটার মুখটাতো ভালো করে দেখা যাচ্ছে না, দেখতে পাচ্ছ কি?
কিন্তু আমি বলবো এটাই বরং ভালো। পৃথিবীতে জিনিসপত্র বিপরীত
মুখী হয়,
সুন্দরী মায়েদের মেয়েরা জঘন্য দেখতে হয়। আমি বলবো ফটোগ্রাফারের মনে হয়েছিল মেয়েটির মাথার পেছনদিকটা
তোলাই তার পক্ষে সবথেকে ভালো হবে।
ক্যাথেরিন হাসলো।
"'রিভিয়েরাতে এই
মরসুমে আতিথেয়তার ক্ষেত্রে সবথেকে সেরা একজন হলেন ভিসকাউন্টেস ট্যাম্পলিং, যাঁর ক্যাপ মার্টিনে একটা ভিলা আছে। তাঁর তুতো বোন, মিস গ্রে,
যিনি খুব সাম্প্রতিক, প্রায় রূপকথার ঢঙে, এক বিশাল সম্পত্তির উত্তরাধিকারিণী হয়েছেন, তাঁর সাথে থাকছেন।'"
"এইটাই আমি
খুজছিলাম,"
মিস ভিনের বললেন, "আমি আশা করেছিলাম ওই কাগজগুলোতে তোমার একটা ছবি আছে যেটা আমি মিস করে গেছি, তুমি তো জানো ব্যাপারগুলো কেমন। মিসেস কেউ একজন অথবা অন্য কোন জোন্স-উইলিয়ামস, কোন একটা জায়গায় এক জায়গা থেকে অন্য কোনো জায়গায় যাওয়ার ফাঁকে, সাধারণত হাতে একটা ভাঁজ করা লাঠি নিয়ে আর এক পা শুন্যে তুলে। এটা নিশ্চই তাদের
কাছে একটা পরীক্ষা যে তাদের কেমন দেখতে লাগছে।"
ক্যাথেরিন কোন উত্তর দিলো
না। সে তার আঙ্গুল দিয়ে কাটিংগুলো সোজা করছিলো, আর তার মুখে একটা বিচলিত
এবং উৎকণ্ঠিত ভাব ছিল। তারপর সে দ্বিতীয় চিঠিটা খাম থেকে বার করে বিষয়বস্তুটা
আরেকবার পড়লো। আর তারপর তার বন্ধুর দিকে ফিরলো।
"মিস ভিনের? বলছিলাম কি - আমার একজন বন্ধু আছেন, যাঁর সাথে রিভিয়েরাতে
পরিচয় হয়েছিল,
উনি আমার সাথে দেখা করার জন্য এখানে আসতে খুব ইচ্ছুক?"
"একজন পুরুষ মানুষ?"
"হ্যাঁ।"
"কে তিনি?"
"উনি আমেরিকান
ধনকুবের,
মিস্টার ভ্যান আলদীনের সেক্রেটারি।"
"ওনার নাম কি?"
"নাইটোন, মেজর নাইটোন।"
"হুম, ধনকুবেরের সেক্রেটারি। আর এখানে আসতে চান। ক্যাথেরিন, এবার,
আমি তোমাকে কিছু কথা বলবো তোমারই ভালোর জন্য। তুমি একজন খুব
সুন্দর এবং বুদ্ধিমতী মেয়ে,
যদিও বেশিরভাগ বিষয়েই তোমার মাথা একদম সঠিক দিকেই আছে, কিন্তু বেশিরভাগ মহিলাই জীবনে একবার না একবার নিজেরই বোকামোর শিকার হয়। দশের মধ্যে একের সম্ভবনা যে এই পুরুষ মানুষটি তোমার
সম্পত্তির পেছনে পরে আছেন।"
ক্যাথেরিনের উত্তর দিতে
যাচ্ছিলো একটা ইশারায় তিনি সেটা থামিয়ে দিলেন। "আমি এইরকমই কিছু একটার জন্য
অপেক্ষা করে ছিলাম। একজন ধনকুবেরের সেক্রেটারি ঠিক কি? দশবারের মধ্যে নবার এমন একজন যুবক যে আরামের জীবন পছন্দ করে। একজন যুবক যাঁর
ব্যবহার খুবই ভদ্র আর সে বিলাসবহুল জীবন পছন্দ করে আর তার সাথে বুদ্ধিসুদ্ধি এবং
উদ্যোগহীন,
আর যদি ধনকুবেরের সেক্রেটারির থেকেও আরামের কোন কাজ থেকে
থাকে তা হলো একজন ধনী মহিলাকে তার সম্পত্তির জন্য বিয়ে করা। আমি বলছি না যে কোন
পুরুষ তোমাকে পছন্দ করতে পারে না। কিন্তু তুমি আর অল্প বয়স্ক নও, আর যদিও তোমার চেহারা খুবই সুন্দর তবুও তুমি ঠিক সুন্দরী বলতে যা বোঝায় তা নও, আর আমি তোমাকে এইকথাই বলবো যে, বোকার মতো কাজ করতে যেও
না; কিন্তু তুমি যদি এটা করতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ হও, তবে একটা বিষয়ের ওপর নজর
দিও যেন তোমার সম্পত্তি সঠিকভাবে তোমার নিয়ন্ত্রনেই থাকে। এবার, আমার বলা শেষ। তোমার কি কিছু বলার আছে?"
"কিছু না," ক্যাথেরিন বললো,
"কিন্তু উনি যদি আমার সঙ্গে এখানে দেখা করতে আসেন আপনি কি
কিছু মনে করবেন?"
"এ ব্যাপারে আমি
হাত ধুয়ে ফেলেছি,"
মিস ভিনের বললেন, "আমি আমার কর্তব্য করেছি, আর এবার যা হবে তার
দায়দায়িত্ব সব তোমার,
তুমি ওনাকে লাঞ্চ না ডিনারে ডাকতে চাও? আমি বলবো এলেন ডিনারটা সামলে দেবে - মানে, সে যদি বোধবুদ্ধি হারিয়ে
না বসে।"
"লাঞ্চটাই ভালো হবে," ক্যাথেরিন বললো,
"এটা আপনার অশেষ দয়া, মিস ভিনের। উনি আমাকে ফোন
করতে বলেছেন,
আমি সেরকমই করবো এবং বলবো যে উনি যদি আমাদের সাথে লাঞ্চ
করেন আমরা খুবই খুশি হবো। উনি শহর থেকে মোটরে আসবেন।"
"এলেন মোটামুটি
ঠিকঠাক ভাবে একটা গ্রীলড টমেটো দিয়ে স্টেক বানায়," মিস ভিনের বললেন,
"সেটাকে খুব একটা ভালো বলা যায় না, কিন্তু সে সেটা অন্য আর কিছুর থেকে ভালো বানায়। টার্ট বানানোটা মোটেই ভালো হবে
না কারণ পেস্ট্রির ব্যাপারে সে আবার আনাড়ি; কিন্তু অল্প ক্যাসেল
পুডিং হলে মন্দ হবে না,
আর আমি বলবো তুমি এবোট থেকে একটা সুন্দর দেখে স্টিলটনের
টুকরো কিনে আন্তে পারো। আমি বহুবার শুনেছি ভদ্রলোকেরা স্টিলটনের টুকরো পছন্দ করেন, আর বাবার ওয়াইনের বেশ কিছু পরে আছে, হয়তো, ঝকঝকে এক বোতল মোসলে।"
"আরে, না, মিস ভিনের,
এর সত্যি কোন প্রয়োজন নেই।"
"বাজে কথা, বাছা। খাবারের সাথে কোন পানিও না থাকলে কোন ভদ্রলোকই খুশি হন না। ওখানে কিছু
ভালো যুদ্ধের আগেকার হুইস্কিও আছে তোমার যদি মনে হয় উনি ওগুলো পছন্দ করবেন। এবার
তর্ক না করে যা বললাম তাই করো। ওয়াইন-সেলারের চাবি ড্রেসিং-টেবিলের নিচের দিকের
তিন নম্বর ড্রয়ারে আছে,
বাঁ দিকে দ্বিতীয় জোড়া মোজার ভেতরে।"
ক্যাথেরিন বাধ্য মেয়ের
মতো যে জায়গার ইঙ্গিত করা হলো সেই অবধি পৌঁছলো।
"এবার দেখো, দ্বিতীয় জোড়া কিন্তু,"
মিস ভিনের বললেন। "প্রথম জোড়াতে আমার হীরের দুল আছে আর
আমার ফিলিগ্রি ব্রোচ আছে।"
"ওহ," ক্যাথেরিন আচমকা অবাক হয়ে বললো, "আপনি কি চান এগুলো আমি গয়নার বাক্সে রেখে দি?"
"অবশ্যই না! এই
ধরণের জিনিসের ব্যাপারে আমার যথেষ্ট বুদ্ধি শুদ্ধি আছে, ধন্যবাদ।ভালো,
ভালো, আমার খুব ভালোভাবে মনে
আছে আমার বেচারি বাবা নিচের তলায় একটা সিন্দুক বানিয়েছিলেন। ভয়ঙ্কর খুশি হয়ে, তিনি আমার মাকে বললেন;
'মেরি, এবার থেকে, প্রত্যেক রাতে তুমি তোমার গয়নাগুলো বাক্সে ভোরে আমাকে দেবে আর আমি সেগুলো চাবি
দিয়ে রেখে দেব।'
আমার মা খুবই বুদ্ধিমতী মহিলা ছিলেন, আর উনি জানতেন ভদ্রলোকেরা তাদের কথামতো চলাকেই পছন্দ করেন, আর তিনি গয়নার বাক্সটা নিয়ে এসে বাবাকে দিলেন এবং কথামতো তিনি সেটা সিন্দুকে
চাবি বন্ধ করে রেখে দিলেন।
তারপর একদিন বাড়িতে চোর
এলো, আর অবশ্যই - স্বাভাবিকভাবেই - প্রথমেই তারা সিন্দুকের দিকে গেলো! এটা ছিল, সিন্দুক নিয়ে সারা গ্রামে আমার বাবার বড়াই করার ফল, যেগুলো শুনলে মনে হবে তিনি ওখানে রাজা সলমনের হীরেগুলো রেখে দিয়েছিলেন। তারা
সবকিছু চেঁচেপুঁছে নিয়ে গেলো, তারা রুপোর বড়ো মগগুলো
নিলো, রুপোর কাপগুলো,
আর উপহারের সোনার প্লেটগুলো যেগুলো বাবা উপহার পেয়েছিলেন, আর গয়নার বাক্সটাও নিলো।"
ঘটনাটা মনে করে তিনি একটা
দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। "আমার বাবা মায়ের গয়নাগুলো নিয়ে খুবই বিমর্ষ ছিলেন। ওখানে
একটা ভেনেটিয়ান সেট ছিল,
কয়েকটা খুব সুন্দর ক্যামিওস ছিল, আর কয়েকটা হালকা পিঙ্ক রঙের কোরাল, দুটি হীরের আংটি বেশ
বড়োসড়ো পাথরের সাথে। আর তারপর, অবশ্যই, আমার মাকে তাঁকে বলতে হলো যে, বুদ্ধিমতী মহিলা হিসেবে, তিনি তাঁর গয়নাগুলো একজোড়া অন্তর্বাসের ভেতর ঢুকিয়ে রেখেছিলেন, আর সেগুলো সেখানে এখনো নিরাপদেই আছে।"
"আর গয়নার বাক্সটা
পুরো খালি ছিল?"
"ওহ, না সোনা,"
মিস ভিনের বললেন, "তাহলে তো ওজনটা হালকা হয়ে যেত। আমার মা খুবই বুদ্ধিমতী মহিলা ছিলেন, তিনি সেটার ব্যবস্থাও করেছিলেন। তিনি তাঁর বোতামগুলো গয়নার বাক্সে রেখেছিলেন, আর ওটা ওগুলো রাখার জন্য খুবই সুবিধাজনক জায়গা ছিল। বুটের বোতামগুলো ওপরের
ট্রেতে, ট্রাউজারের বোতামগুলো দ্বিতীয় ট্রেতে, আর একদম তলার ট্রেতে
বিভিন্নধরনের বোতাম মেলানো মেশানো ছিল। অদ্ভুতভাবে আমার বাবা কিন্তু আমার মার ওপর
অত্যন্ত বিরক্ত হয়েছিলেন। তিনি বলেছিলেন যে তিনি প্রতারণা পছন্দ করেন না। কিন্তু
আমি আর তোমার সাথে বকবক করবো না; তুমি এখুনি গিয়ে তোমার বন্ধুকে
ফোন করো,
আর মনে করে একটা ভালো দেখে স্টেক এর টুকরো পছন্দ কোরো, আর এলেনকে বোলো সে যখন লাঞ্চ পরিবেশন করবে তার মোজায় যেন কোন ফুটো না
থাকে।"
"ওর নামটা এলেন না
হেলেন, মিস ভিনের?
আমি ভেবেছিলাম -"
"আমি আর সবার মতোই, 'হ' উচ্চারণ করতে পারি,
সোনা, কিন্তু চাকর বাকরদের
হেলেন নামটা ঠিক মানায় না। জানি না এইসব নিম্নবিত্ত শ্রেণীর মায়েদের আজকাল কি
হয়েছে।"
নাইটোন যখন কটেজে পৌঁছলো
তখন বৃষ্টি থেমে গেছে। ক্যাথেরিন যখন দরজার সামনে তাকে স্বাগত জানানোর জন্য
দাঁড়িয়েছিল হালকা রোদের আলো উজ্জ্বল ভাবে তার মাথার ওপরে পড়ছিলো। সে দৌড়ে
ক্যাথেরিনের কাছে চলে এলো,
অনেকটা অল্পবয়সী ছেলেদের মতো।
"বলছিলাম কি, আশা করি,
আপনি কিছু মনে করেন নি। এমনিই মনে হলো আপনার সাথে খুব
তাড়াতাড়ি দেখা হওয়াটা খুব প্রয়োজন। আশা করি আপনি আপনার যে বন্ধুটির সাথে থাকেন উনি
কিছু মনে করবেন না।"
"ভেতরে আসুন আর
ওনার সাথে পরিচয় করুন,"
ক্যাথেরিন বললো, "ওনাকে প্রথম দেখায় বেশ ভীতিকর মনে হলেও, আপনি খুব শীঘ্রই বুঝতে
পারবেন যে উনি পৃথিবীর সবথেকে নরম মনের অধিকারিণী।"
মিস ভিনের মহিমান্বিতের
মতো যেন সিংহাসনে বসে আছেন এরকম ভাবে বসার ঘরে বসে ছিলেন, তাঁর পরনে ক্যামেওস ধরণের গয়নার একটা পুরো সেট যা নাকি গভীর দূরদৃষ্টির ফলে
এতদিন ধরে পরিবারের মধ্যে সংরক্ষিত করে রাখা আছে। তিনি নাইটোনকে এমভাবে সম্মান এবং
কঠোর ভদ্রতার সাথে অভিবাদন করলেন যা হয়তো অনেক পুরুষকেই আশাহত করতো। যদিও, নাইটোনের আচরণে কিন্তু এমন একটা মনোমুগ্ধকর ব্যাপার ছিল, যা কেউ সহজে সরিয়ে রাখতে পারে না, আর প্রায় মিনিট দশেকের
মধ্যেই মিস ভিনের স্পষ্টতই গলে গেলেন। লাঞ্চ পর্ব খুব আনন্দের সাথেই মিটলো, আর এলেন,
অথবা হেলেন, ফুটোফাটা ছাড়া একজোড়া
নতুন মোজা পরে অসাধারণ ব্যাক্তিত্ব এবং কৃতিত্বের সাথে পরিবেশন করলো। পরে, ক্যাথেরিন এবং নাইটোন একটু হাঁটতে বেরোলো আর ফিরে এসে দুজনে মুখোমুখি বসে চা
খেলো, কারণ মিস ভিনের একটু শুতে গেছিলেন।
শেষঅব্দি গাড়িটা চলে
যাওয়ার পর ক্যাথেরিন ধীরে ধীরে ওপরের তলায় গেলো। মিস ভিনেরের ডাক শুনে সে ওনার
শোয়ার ঘরে ঢুকলো।
"বন্ধু চলে গেছে?"
"হ্যাঁ। আপনাকে
অসংখ্য ধন্যবাদ ওনাকে এখানে ডাকার অনুমতি দেওয়ার জন্য।"
"আমাকে ধন্যবাদ
দেওয়ার কিছু নেই। তুমি কি আমাকে ওই খিটখিটে বুড়িদের মতো মনে করো যারা কোনদিন কারো
জন্য কিছু করে না?"
"আমি মনে করি আপনি
আমার একজন অত্যন্ত প্রিয় মানুষ," ক্যাথেরিন আদুরের মতো
বললো।
"হুমফ," মিস ভিনের শান্তভাবে বললেন।
ক্যাথেরিন যখন ঘর থেকে
যাবার জন্য তৈরী হচ্ছিলো উনি আবার ডাকলেন।
"ক্যাথেরিন?"
"হ্যাঁ।"
"আমি তোমার যুবকটির
বিষয়ে ভুল ছিলাম। একজন পুরুষ মানুষ যখন কাউকে দেখানোর জন্য ভান করে তখন তারা খুবই
আন্তরিকতা এবং সাহসিকতা দেখানোর চেষ্টা করে আর ছোট ছোট বিষয়ে খেয়াল রাখার অভিনয়
করে আর একদম মনমুগ্ধকর ব্যবহার করে। কিন্তু একজন পুরুষ মানুষ যখন সত্যিকারে প্রেমে
পরে তখন সে একদম ভেড়া বনে যায়। আর, যখনি ওই যুবক তোমার দিকে
তাকাচ্ছিলো তাকে একটা ভেড়ার মতো লাগছিলো। আজ সকালে যা যা বলেছিলাম, সেসব কথা আমি ফিরিয়ে নিচ্ছি। উনি একদমই খাঁটি।"
চ্যাপ্টার ৩১
মিস্টার আরন্স
লাঞ্চ করলেন
মিস্টার জোসেফ আরন্স
প্রশস্তির সাথে "আঃ!" বললেন।
তিনি বড় মগটা থেকে একটা
লম্বা চুমুক দিলেন,
তারপর একটা দীর্ঘশ্বাসের সাথে সেটা নামিয়ে রাখলেন, ঠোঁটের ওপর থেকে ফেনাগুলো মুছলেন, তারপর উজ্জীবিত ভঙ্গিতে
টেবিলের উল্টোদিকে তাঁর আমন্ত্রণকারী, মসিয়েঁ এরকুল পোয়ারোর
দিকে তাকালেন।
মিস্টার আরন্স বললেন, "আমাকে একটা ভালো পোর্টারহাউস স্টেক দিন আর একটা বড় মগ ভর্তি পান করার মতো কোনো
পানিও দিন,
ব্যাস, তাহলেই যে কেউ আপনার
সস্তার ফরাসি গয়না ইত্যাদি কিনতে রাজি হয়ে যাবে, আর আপনার অরডুভরেস আর আপনার অমলেট, এবং আপনার ছোট ছোট
কোয়েলের টুকরোও কিনতে রাজি হয়ে যাবে। তিনি আবারও বললেন, "আমাকে একটা পোর্টারহাউস স্টেক দিন।"
পোয়ারো, যিনি নাকি একটু আগেই ওনার সেই অনুরোধ অনুযায়ী পদক্ষেপ নিয়েছেন, সহানুভূতিশীলভাবে হাসলেন।
"আর একটা স্টেক আর
কিডনি পুডিংএ কোনো ক্ষতি নেই," মিস্টার আরন্স বলতে
থাকলেন। "আপেল টার্ট,
হ্যাঁ, আমি আপেল টার্ট নেবো, ধন্যবাদ,
মিস,
আর একটা ক্রিমের জগ।"
খাওয়া দাওয়া চলতে থাকলো।
অবশেষে একটা লম্বা দীর্ঘশ্বাস নিয়ে, অন্যান্য বিষয়ের দিকে
মনোযোগ দেওয়ার আগে,
মিস্টার আরন্স চীজগুলো নিয়ে নাড়াচাড়া করার প্রস্তুতি হিসেবে
চামচ ও ছুরি নামিয়ে রাখলেন।
"মসিয়েঁ পোয়ারো, মনে হয় যেন,
আপনি বলেছিলেন সামান্য কিছু কাজের কথাও আছে," তিনি মন্তব্য করলেন। "আপনাকে যেকোনো রকম সাহায্য করতে পারলে নিশ্চিতভাবেই
আমি খুব খুশি হবো।"
"এটা আপনার অশেষ
দয়া,"
পোয়ারো বললেন। "আমি চিন্তা করছিলাম যে, 'যদি নাট্য পেশার বিষয়ে কিছু জানার হয় তাহলে একজনই আছেন যিনি নাকি এ বিষয়ে
সমস্ত কিছু জানেন আর তিনি হচ্ছেন আমার পুরোনো বন্ধু মিস্টার জোসেফ আরন্স।'"
"আর এটা আপনি কিছু
ভুল ভাবেন নি,"
মিস্টার আরন্স আত্মতুষ্টভাবে বললেন, "ভুত,
ভবিষ্যৎ অথবা বর্তমান যা কিছু হোক না কেন জো আরন্সই একমাত্র
মানুষ যে সব জানে।"
"নিশ্চিতভাবেই।
এবার মসিয়েঁ আরন্স,
আমি জানতে চাই যে, আপনি কিড বলে তরুণীটির
সম্পর্কে কি জানেন।"
"কিড? কিটি কিড?"
"কিটি কিড।"
"বেশ স্মার্ট একজন। পুরুষের ভূমিকায় অভিনয় করতে পারতো, গান এবং একটা নাচ - তার কথাই বলছেন তো?"
"তার কথাই।"
"সে ভীষণ স্মার্ট
ছিল। ভালো রোজগার করতো। তার কখনোই কাজের কমতি হতো না। বেশিরভাগই পুরুষের ভূমিকায়, কিন্তু,
সত্যি কথা বলতে কি, চরিত্র অভিনেতা হিসেবে
তার কোনো তুলনা নেই।"
"আমিও সেই রকমই
শুনেছি,"
পোয়ারো বললেন, "কিন্তু ইদানিং তো সে আর মঞ্চে আসছে না, আসছে কি?"
"না। হঠাৎই সব কাজ
ছেড়ে দিয়েছে। ফ্রান্সে গিয়ে ওখানেই একজন অভিজাত পুরুষের সঙ্গিনী হিসেবে আছে। আর
অনুমান করছি,
সেই কারণেই সে মঞ্চ ছেড়ে দিয়েছে।"
"এটা কতদিন আগেকার
ঘটনা?"
"দাঁড়ান, ভেবে দেখি। তা তিন বছর আগে হবে। আমি আপনাকে বলছি - তার চলে যাওয়াটা একটা
ক্ষতি।"
"সে কি খুবই চালাক
চতুর ছিল?"
"সে ভয়ঙ্কর রকমের
চালাক ছিল।"
"প্যারিসে তার যে
পুরুষ বন্ধু ছিল আপনি তার নাম জানেন না?"
"তিনি খুবই
মর্যাদাপূর্ণ একজন ব্যাক্তি, এটা আমি জানি। একজন
কাউন্ট - অথবা একজন মারকুইস কি? দাঁড়ান একটু ভেবে দেখতে
দিন, মনে হয় উনি একজন মারকুইস ছিলেন।"
"আর সেই থেকে আপনি
আর তার সম্পর্কে কিছু জানেন না?"
"না, আর কিছু না। কখনো দুর্ঘটনাক্রমেও তার সাথে আর দেখা হয় নি। আমি বাজি রাখছি সে
এখন বিদেশি রিসোর্ট গুলোতে অবসর কাটাচ্ছে। সারা জীবনের জন্য একজন মারকুইসের
সঙ্গিনী। এ নিয়ে আপনি কিটির বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ করতে পারবেন না। যতটা ভালোভাবে
সম্ভব ততটাই সে জীবনকে উপভোগ করছে।"
"ঠিক আছে," পোয়ারো চিন্তিতভাবে বললেন।
"দুঃখিত, মসিয়েঁ পোয়ারো,
আমি আপনাকে এর থেকে বেশি কিছু বলতে পারলাম না," অপরজন বললেন। "যদি আমার পক্ষে কিছু করা সম্ভব হয়, আমি আপনার জন্য করতে তৈরি। আপনি একবার আমার উপকার করেছিলেন।"
"আঃ, কিন্তু আমাদের মধ্যে শোধবোধ হয়ে গেছে; আপনিও, আমার উপকার করেছেন।"
"একটা উপকার আরেকটা
উপকারের প্রত্যাশা করে। হা,
হা!" মিস্টার আরন্স বললেন।
"আপনার পেশাটা
নিশ্চিতভাবে খুবই আকর্ষণীয়,"
পোয়ারো বললেন।
"মোটামুটি," মিস্টার আরন্স নিজের মতামত স্পষ্টভাবে বললেন না। "খারাপের সাথে ভালোটাও
আছে, সব ঠিকই আছে। যদি সব দিক থেকে দেখেন, তাহলে আমি খুব একটা খারাপ
কাজ করি না,
কিন্তু সবসময় আপনার চোখ আর কান খোলা রাখতে হবে। পরবর্তীতে
জনগণের চাহিদা কি হবে তা কেউ জানে না।"
"গত কয়েক বছরে নাচের
জনপ্রিয়তা বেড়েছে,"
পোয়ারো চিন্তিতভাবে অস্ফুট স্বরে বললেন।
"আমি এই রাশিয়ান
ব্যালেটা তেমন একটা পছন্দ করি না, কিন্তু জনগণ পছন্দ করে।
আমার জন্য ব্যাপারটা খুব উচ্চমার্গের।"
"রিভিয়েরাতে আমার
সঙ্গে একজন নৃত্যশিল্পীর পরিচয় হয়েছিল - মাদমোয়েজেল মিরেলে।"
"মিরেলে? সে সব দিক থেকেই অসাধারণ। তাকে দেওয়ার জন্য টাকার কোনো অভাব হয় না - যদিও, এটা বলা যায় যে,
মেয়েটা নাচতে পারে। আমি যদিও তার সঙ্গে তেমন কোনো কাজ করি
নি, কিন্তু শুনেছি তার সঙ্গে কাজ করাটা আতঙ্কের ব্যাপার। সবসময় মেজাজ এবং
গালাগাল।"
"হ্যাঁ," পোয়ারো চিন্তিত ভাবে বললেন, "হ্যাঁ, আমিও সেই রকমই ভেবেছিলাম।"
"মেজাজ!"
মিস্টার আরন্স বললেন,
"মেজাজ! তারা নিজেদের মধ্যে এই রকমটাই বলে বটে। আমার স্ত্রীও বিয়ের আগে একজন নৃত্যশিল্পী ছিলেন, কিন্তু আমি কৃতজ্ঞ যে তাঁর কোনো মেজাজ নেই। বাড়িতে কেউ মেজাজ চায় না, মসিয়েঁ পোয়ারো।"
"আমি আপনার সাথে
একমত, বন্ধু;
সেখানে এটা অপ্রাসঙ্গিক।"
"একজন মহিলার শান্ত
এবং সমবেদনশীল হওয়া উচিত,
আর ভালো রাধুনিও," মিস্টার আরন্স বললেন।
"মিরেলে খুব একটা
বেশি দিন হলো জনগণের সামনে আসে নি, ঠিক কিনা?" পোয়ারো প্রশ্ন করলেন।
"সব মিলিয়ে, আড়াই বছর মতো হবে,"
মিস্টার আরন্স বললেন, "কোনো এক ফরাসি ডিউকের হাত ধরে তার শুরু। শুনতে পাই সে এখন গ্রিসের প্রাক্তন
প্রধান মন্ত্রীর সঙ্গিনী। এই ধরণের লোকগুলো চুপি চুপি নিজেদের টাকা পয়সা সরিয়ে
ফেলে।"
"এটা আমার কাছে
একটা নতুন খবর,"
পোয়ারো বললেন।
"ওহ, সে নিজের পায়ের তলায় ঘাস গজাতে দেওয়ার মতো নয়। লোকে বলে তরুণ কেটারিং তার জন্য
নিজের বৌকে খুন করেছিল। আমি ঠিক এ ব্যাপারে নিশ্চিত নই। যাই হোক, সে এখন জেলে,
তবে মিরেলেকে তো তার নিজের কথাও ভাবতে হবে, আর এ ব্যাপারে সে ভালো রকমেরই স্মার্ট। লোকে বলে সে একটা পায়রার ডিমের সাইজের
রুবি পরে থাকছে - আমি নিজের চোখে কখনো পায়রার ডিম দেখি নি, কিন্তু গল্পের বইতে সবসময় এইরকমটাই বলা থাকে।"
"একটা পায়রার ডিমের
সাইজের রুবি!" পোয়ারো বললেন। তাঁর চোখগুলো সবুজ এবং বেড়ালের মতো হয়ে গেলো।
"খুবই আশ্চর্যজনক!"
"আমি আমার এক
বন্ধুর কাছ থেকে এটা শুনেছি," মিস্টার আরন্স বললেন।
"কিন্তু,
যতদূর আমি জানি, এটা একটা রঙিন কাঁচ হওয়াও
সম্ভব। এগুলো সবই একই রকম দেখতে, আর এইধরণের মহিলারা -
তারা তাদের গয়না নিয়ে বড় বড় গল্প বলে খালি। মিরেলে বড়াই করে একথাও বলে যে ওটার
ওপরে নাকি একটা অভিশাপ আছে। শুনেছি, সে ওটাকে 'হার্ট অফ ফায়ার,'
বলে।"
"কিন্তু, আমার স্মৃতিশক্তি যদি সঠিক হয়," পোয়ারো বললেন,
"'হার্ট অফ ফায়ার' নামের রুবিটি একটি
নেকলেসের কেন্দ্র পাথর।"
"ঠিক বলেছেন! বললাম
না মহিলারা তাদের গয়নার ব্যাপারে যা যা মিথ্যা বলে তার কোনো শেষ নেই? এটা একটাই পাথর,
একটা প্লাটিনামের চেইনের সাথে তার গলায় ঝোলানো থাকে; কিন্তু,
আগেই তো বলেছি, দশ ভাগের এক ভাগ সম্ভবনা
যে ওটা একটা রঙিন কাঁচ।"
"না," পোয়ারো নম্রভাবে বললেন,
"না - আমার কেন জানিনা মনে হচ্ছে ওটা রঙিন কাঁচ নয়।
চ্যাপ্টার ৩২
ক্যাথেরিন এবং
পোয়ারো নিজেদের মতামত নিয়ে তুলনামূলক আলোচনা করলেন
"আপনি বদলে গেছেন, মাদমোয়েজেল,"
পোয়ারো হঠাৎই বললেন। তিনি এবং ক্যাথেরিন স্যাভয়ে একটা ছোট
টেবিলে একে ওপরের উল্টোদিকে বসেছিলেন।
"হ্যাঁ, আপনি বদলে গেছেন,"
তিঁনি বলতে থাকলেন।
"কোন দিক থেকে?"
"মাদমোয়েজেল, এই সূক্ষ্ণ ব্যাপারগুলো যথাযথ ভাবে বোঝানো বেশ কঠিন।"
"আমার বয়স বেড়ে
গেছে।"
"হ্যাঁ, আপনার বয়স বেড়েছে। আর তাই বলে আমি কুঁচকোনো চামড়া বা চোখের পাশের চামড়ার ভাঁজ
দেখা যাচ্ছে সে কথা বলছি না। যখন আমি আপনাকে প্রথম দেখি, মাদমোয়েজেল,
তখন আপনি জীবনের একজন দর্শক ছিলেন। আপনার মধ্যে যেন পেছনের
সারিতে বসা নাটকের দর্শকের মতো একটা শান্ত, খুশি খুশি ভাব ছিল।"
"আর এখন?"
"এখন, আপনি আর দর্শক নন। হয়তো, আমি এখন যা বলছি, সেটা শুনতে বেশ অদ্ভুত লাগবে, কিন্তু এখন আপনাকে একজন
সতর্ক যোদ্ধার মতো লাগছে যিনি নাকি একটা কঠিন খেলা খেলছেন।"
"আমার বৃদ্ধা
কর্ত্রীকে সামলাতে মাঝে মাঝে বেশ বেগ পেতে হয়," ক্যাথেরিন একটা হাসির সাথে বললো, "কিন্তু আমি আপনাকে আস্বস্ত করছি যে আমি ওনার সাথে কোনো মারাত্মক
প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নামি না। আপনার ওনাকে একবার দেখতে আসা উচিত, মসিয়েঁ পোয়ারো। আমার মনে হয় আপনিই সেই সব মানুষদের মধ্যে একজন যিনি নাকি ওনার
সাহস এবং উদ্দীপনার মর্ম বুঝতে পারবেন।
রেস্তোরার পরিচারকটি
যতক্ষণ কুশলতার সাথে তাঁদের চিকেন এন ক্যাসারোলে পরিবেশন করছিলো ততক্ষন একটা
নীরবতা ছিল। সে চলে গেলে,
পোয়ারো বললেন:
"আপনি আমাকে আমার
বন্ধু হেস্টিংসের ব্যাপারে বলতে শুনেছেন? - সে যে কিনা আমাকে
একজন মানব ঝিনুক বলেছেন। ওহ, মাদমোয়েজেল, আমি আপনার মধ্যে আমার উপযুক্ত প্রতিদ্বন্দ্বী খুঁজে পেয়েছি। আপনি, আমার থেকে অনেক বেশি পরিমানে, নিজে নিজেই সবকিছু
করেন।"
"বাজে কথা," ক্যাথেরিন হালকা ভাবে বললো।
"এরকুল পোয়ারো কখনো
বাজে কথা বলে না। আমি যেমনটা বলছি সেটাই সত্যি।"
আবার একটা নীরবতা। পোয়ারো
একটা প্রশ্ন করে সেই নিরবতাটা ভাঙলেন:
"ফিরে আসার পর কি
আপনার সাথে আমাদের রিভিয়েরার কোনো বন্ধুর সাথে দেখা হয়েছে, মাদমোয়েজেল?"
"মেজর নাইটোনের সাথে
কয়েকবার দেখা হয়েছিল।"
"আ-হাঃ! তাই নাকি?"
পোয়ারোর ঝিকিমিকি করা
চোখে কিছু একটা ছিল যা দেখে ক্যাথেরিন তার চোখ নামিয়ে নিলো।
"তাহলে ভ্যান আলদীন
লন্ডনেই থাকছেন।"
"হ্যাঁ।"
"আমি তাহলে আগামীকাল
বা পরশু ওনার সাথে দেখা করার চেষ্টা করবো।"
"ওনার জন্য কি আপনার
কাছে কোনো খবর আছে?"
"একথা আপনার মনে হলো
কেন?"
"এমনিই - মনে
হলো।"
পোয়ারো ঝিকিমিকি চোখে তার
দিকে তাকিয়ে থাকলেন।
"আর, এবার,
মাদমোয়েজেল, আপনি আমাকে অনেক কিছু জিজ্ঞেস
করতে চান,
আমি বুঝতে পারছি। আর কেন নয়? দ্যা ব্লু ট্রেনের ঘটনাবলী কি আমাদের নিজস্য গোয়েন্দা কাহিনী নয়?"
"হ্যাঁ, কয়েকটা বিষয়ে আমি আপনাকে কিছু প্রশ্ন করতে চাই।"
"আচ্ছা?"
ক্যাথেরিন হঠাৎই একটা
দৃঢ়তার সাথে চোখ তুলে তাকালো।
"আপনি প্যারিসে কি
করছিলেন,
মসিয়েঁ পোয়ারো?"
পোয়ারো ঈষৎ হাসলেন।
"আমি রাশিয়ান
দূতাবাসে যোগাযোগ করছিলাম।"
"ওহ।"
"আমি বুঝতে পারছি
এটা থেকে আপনি কিছুই বুঝতে পারলেন না। কিন্তু আমি একজন মানব ঝিনুকের মতো আচরণ করবো
না। না, আমি আমার হাতের সমস্ত তাস টেবিলের ওপর রাখবো, যেটা নিশ্চিতভাবেই ঝিনুকেরা করে না। আপনি সন্দেহ করছেন, ঠিক কি না,
যে ডেরেক কেটারিংয়ের বিরুদ্ধে কেসের ব্যাপারে আমি সন্তুষ্ট
নই?"
"আমি এই কথাটাই
ভাবছিলাম,
আমি ভেবেছিলাম, নাইসে, আপনি কেস শেষ করে দিয়েছেন।"
"আপনি যা বোঝাতে চান
তার পুরোটা সবসময় বলেন না,
মাদমোয়েজেল। কিন্তু আমি সব কিছু স্বীকার করবো। আমি - আমার
তদন্ত - ডেরেক কেটারিংকে এখন সে যেখানে আছে তাকে সেখানে পৌঁছে দিয়েছে। আমি না
থাকলে আজও পরীক্ষক ম্যাজিস্ট্রেট নিরর্থক ভাবে এই অপরাধের দায় কমতে ডে লা রোচের
ঘাড়ে চাপানোর চেষ্টা করে যেত। ওহ, মাদমোয়েজেল, আমি যা করেছি তার জন্য আমি অনুতাপ করি না। আমার কেবল একটাই কর্তব্য - সত্যকে
খোঁজা, আর সেই পথই ডেরেক কেটারিংয়ের দিকে নির্দেশিত করেছে। কিন্তু সেটা কি সেখানেই
থেমে গেছে?
পুলিশ বলছে, হ্যাঁ, কিন্তু আমি,
এরকুল পোয়ারো, সন্তুষ্ট নই।"
তিনি হঠাৎই প্রসঙ্গটা
পরিবর্তন করলেন। "মাদমোয়েজেল, বলুন তো, গত কয়েকদিনের মধ্যে কি মাদমোয়েজেল লেনক্সের সঙ্গে কি আপনার কোনো কথা হয়েছে?"
"শুধু একটা ছোট
অসম্পূর্ণ চিঠি। মনে হয়,আমার ইংল্যান্ডে ফিরে আসার কারণে সে আমার ওপরে বেশ বিরক্ত।"
পোয়ারো মাথা নাড়লেন।
"যে রাতে মসিয়েঁ
কেটারিং গ্রেফতার হন সেই রাতে ওনার সঙ্গে আমার একটা আলোচনা হয়েছিল। অনেক দিক থেকেই
সেটা বেশ একটা আকর্ষণীয় আলোচনা ছিল।"
আবার তিনি চুপ করে গেলেন।
ক্যাথেরিন তাঁর চিন্তা ধারাকে ব্যাহত করলো না।
"মাদমোয়েজেল," তিনি অবশেষে বললেন,
"আমি এখন একটা সংবেদনশীল জায়গায় পৌঁছেছি, কিন্তু তা সত্ত্বেও আমি আপনাকে এই কথাগুলো বলবো। আমার মনে হয়, কেউ একজন আছেন যিনি মসিয়েঁ কেটারিংকে ভালোবাসেন - যদি ভুল হয় আমাকে শুধরে
দেবেন - আর শুধুমাত্র তাঁর জন্য - বলতে গেলে - তাঁর জন্যই কামনা করছি যেন আমি
সত্যি প্রমাণিত হই এবং পুলিশ ভুল প্রমাণিত হয়। আপনি কি জানেন সেই একজন কে?"
কিছুক্ষন চুপ করে থাকার
পর, ক্যাথেরিন বললো,
"হ্যাঁ - মনে হয় আমি জানি ।"
পোয়ারো টেবিলের ওপর দিয়ে
তার দিকে ঝুকে এলো।
"আমি সন্তুষ্ট নই, মাদমোয়েজেল;
না,
আমি সন্তুষ্ট নই। সূত্র, মূল সূত্র, সবই সোজাসুজি মসিয়েঁ কেটারিংয়ের দিকে নির্দেশ করছে। কিন্তু একটা জিনিস আছে যা
এখনো হিসেবের বাইরে রয়ে গেছে।"
"আর সেটা কি?"
"মৃতার বিকৃত মুখটা।
মাদমোয়েজেল,
আমি শতবার নিজেকে প্রশ্ন করেছি, 'ডেরেক কেটারিং কি সেই ধরণের মানুষ যে কিনা খুন করার পর এই রকম নির্মম ভাবে
প্রচন্ড আঘাত করতে পারে?
এর শেষ ফল কি হবে? এটা কোন উদ্দেশ্যেই বা
পূরণ করবে?
এটা কি মসিয়েঁ কেটারিংয়ের মেজাজের একটা সম্ভাব্য পরিণতি হতে
পারে? আর, মাদমোয়েজেল,
এই প্রশ্নগুলোর উত্তর একদমই সন্তষজনক নয়। বারংবার আমি এক
জায়গাতেই ফিরে গেছি - 'কেন?'
আর একমাত্র এইগুলোই আমার সমস্যার সমাধান করতে সাহায্য করতে
পারে।"
তিনি এক ঝটকায় তাঁর
পকেট-বুকটা বার করে আনলেন আর সেটা থেকে কিছু একটা বের করে তাঁর তর্জনী এবং বুড়ো
আঙুলের মাঝে ধরলেন।
"আপনার মনে আছে কি, মাদমোয়েজেল?
আপনি আমাকে এই চুলের টুকরোগুলো রেলের কামরার ভেতর কার্পেট
থেকে তুলতে দেখেছিলেন।"
ক্যাথেরিন সামনে ঝুকে
চুলের টুকরোগুলো ভালোভাবে পর্যবেক্ষণ করলো।
পোয়ারো ধীরে ধীরে বেশ
কয়েকবার তাঁর মাথা নাড়ালেন।
"এগুলো থেকে আপনি যে
কিছুই বুঝতে পারেন নি,
সেটা আমি বুঝতে পারছি, মাদমোয়েজেল। কিন্তু তা
সত্ত্বেও - আমার কেন যেন মনে হচ্ছে যে আপনি অনেক কিছুই দেখতে পাচ্ছেন।"
"আমার কিছু ধারণা
আছে,"
ক্যাথেরিন ধীরে ধীরে বললো, "খুব অদ্ভুত ধারণা। আর সেই কারণেই আমি আপনাকে জিজ্ঞেস করেছিলাম যে আপনি
প্যারিসে কি করছিলেন,
মসিয়েঁ পোয়ারো।"
"যখন আমি আপনাকে
চিঠিটা লিখেছিলাম -"
"রিট্জ থেকে?"
পোয়ারোর মুখে একটা অদ্ভুত
হাসি খেলে গেলো।
"হ্যাঁ, আপনার কথা অনুযায়ী,
রিট্জ থেকে। একজন ধনকুবের যদি খরচাটা দেন - মাঝে মাঝে আমি
বিলাসিতা করি।"
"রাশিয়ার
দূতাবাস।" ক্যাথেরিন ভুরু কুঁচকে বললো, "না, এটা কোথা থেকে এলো বুঝতে পারছি না।"
"এটা সরাসরি আসে নি, মাদমোয়েজেল। আমি একটি বিশেষ খবরের জন্য ওখানে গেছিলাম। আমি একজন নির্দিষ্ট ভদ্রলোকের সঙ্গে দেখা করি এবং তাঁকে ভয়
দেখাই - হ্যাঁ,
মাদমোয়েজেল, আমি, এরকুল পোয়ারো,
তাঁকে ভয় দেখাই।"
"কিসের পুলিশের?"
"না" পোয়ারো
শুষ্কভাবে বললেন,
"তার থেকেও একটা মারাত্মক অস্ত্র - সাংবাদিকদের ভয়।"
তিনি ক্যাথেরিনের দিকে
তাকালেন আর সে মাথাটা ঝাকিয়ে, তাঁর দিকে তাকিয়ে হাসলো।
"আপনি তাহলে আর
ঝিনুকে পরিণত হওয়ার দিকে ফিরে যাচ্ছেন না, মসিয়েঁ পোয়ারো?"
"না, না! আমি আর কোনো রহস্য তৈরি করতে চাই না। দেখুন, আমি আপনাকে সব কিছুই বলবো। আমি সন্দেহ করছিলাম এই লোকটি মসিয়েঁ ভ্যান আলদীনের
রত্নগুলো বিক্রি করার ব্যাপারে সক্রিয়ভাবে যুক্ত ছিল। আমি তাকে এই ব্যাপারে চাপ দি, আর শেষপর্যন্ত তার থেকে আমি পুরো গল্পটাই উদ্ধার করতে পারি। আমি জানতে পারি
রত্নগুলো কোথায় হাত বদল হয়েছিল, আর আমি একটি লোকের
ব্যাপারেও জানতে পারি,
যে কিনা বাইরে রাস্তায় এমাথা থেকে ওমাথা পায়চারি করছিলো -
যার মাথায় বয়স্ক মানুষদের মতো সাদা চুল ছিল, কিন্তু যে নাকি যুবকদের
মতো হালকা এবং সতেজ পদক্ষেপের সাথে হাটছিলো - আর আমি নিজের মনেই সেই লোকটির একটি
নাম দিয়েছি - নামটা হলো 'মসিয়েঁ লে মারকুইস'"
"আর এবার আপনি
লন্ডনে মিস্টার ভ্যান আলদীনের সাথে দেখা করতে এসেছেন?"
"শুধুমাত্র সেই
কারণেই নয়। আমার অন্য কাজও আছে। লন্ডনে আসার পর থেকে আমি আরো দুজন মানুষের সাথে
দেখা করেছি - একজন থিয়েটারের এজেন্ট এবং একজন হারলে স্ট্রিটের ডাক্তার। তাঁদের
প্রত্যেকের কাছ থেকে আমি কিছু নির্দিষ্ট তথ্য পেয়েছি। সেগুলো এক জায়গায় করুন, মাদমোয়েজেল,
আর দেখুন তো আমি তাদের থেকে যে সিদ্ধান্তে পৌঁচচ্ছি আপনিও
কি সেখানেই পৌঁচচ্ছেন।"
"আমি?"
"হ্যাঁ, আপনি। আমি আপনাকে একটা কথা বলবো, মাদমোয়েজেল। আমার মনে
প্রথম থেকেই একটা সন্দেহ ছিল যে ডাকাতি এবং খুন কি একই লোকে করেছে। দীর্ঘ সময় ধরে
আমি এব্যাপারে নিশ্চিত ছিলাম না -"
"আর এখন?"
"আর এখন আমি
জানি।"
সেখানে একটা নীরবতা নেমে
এলো। তারপর ক্যাথেরিন তার মাথাটা তুললো। তার চোখ দুটো চক চক করছিলো।
"আমি আপনার মতো
বুদ্ধিমান নই,
মসিয়েঁ পোয়ারো। আপনি আমাকে যা যা বলছেন তার অর্ধেকও আমায়
কোনো দিক নির্দেশ করছে বলে মনে হচ্ছে না। যে ধারণাগুলো আমার হয়েছিল তা একেবারেই
অন্য দৃষ্টিকোণ থেকে এসেছিলো -"
"আঃ, কিন্তু সবসময় এই রকমটাই হয়," পোয়ারো শান্তভাবে বললেন।
"একটা আয়না সত্যিটা দেখায়, কিন্তু এক এক জন এক এক
জায়গায় দাঁড়ায় আয়নাতে দেখার জন্য।"
"আমার ধারণা
অযৌক্তিক হতে পারে - তারা হয়তো আপনার থেকে একেবারেই অন্যরকম, কিন্তু -"
"হ্যাঁ?"
"আমাকে বলুন, এগুলো কি আপনাকে কোনোরকম ভাবে সাহায্য করবে?"
তিঁনি তার বাড়িয়ে দেওয়া
হাত থেকে খবরের কাগজের একটা কাটিং নিলেন। সেটা পড়ে, মুখ তুলে,
তিঁনি গম্ভীরভাবে মাথা নাড়লেন।
"আপনাকে যে কথা
বললাম, মাদমোয়েজেল একজন আয়নাতে দেখার জন্য বিভিন্ন কোনে দাঁড়াতে পারে, কিন্তু একই আয়নাতে একই জিনিস প্রতিফলিত হয়ে আসবে।"
ক্যাথেরিন উঠে দাঁড়ালো।
"আমাকে এবার যেতে হবে,"
সে বললো, "আমার ট্রেনের সময় হয়ে
গেছে, মসিয়েঁ পোয়ারো -"
"হ্যাঁ, মাদমোয়েজেল।"
"এটা - এটা আর
বেশিদিন চলা উচিত হবে না,
আপনি বুঝেছেন তো। আমি - আমি আর বেশিদিন টানতে পারবো
না।"
তার গলাটা ভেঙে গেলো।
তিঁনি তার হাতে আস্বাসের
চাপড় দিলেন।
"সাহস, মাদমোয়েজেল,
এখন আপনার ব্যার্থ হলে চলবে না; অন্তিম পরিণতি খুব কাছেই।"
চ্যাপ্টার ৩৩
একটা নতুন তত্ত্ব
"স্যার, মসিয়েঁ পোয়ারো আপনার সাথে দেখা করতে চান।"
"ধুর, আবার সেই লোকটা!" ভ্যান আলদীন বললেন।
নাইটোন সংবেদনার সাথে
নীরব থাকলো। ভ্যান আলদীন চেয়ার থেকে উঠে এদিক থেকে ওদিক পায়চারি করতে থাকলেন।
"আশা করি তুমি আজ
সকালে অভিশপ্ত খবরের কাগজটা পড়েছো?"
"আমি একবার চোখ
বুলিয়েছিলাম,
স্যার।"
"এখনো উদ্দমের সাথে
ওটা নিয়ে পরে আছে।"
"আমারও সেটাই আশঙ্কা, স্যার।"
ধনকুবেরটি আবার বসে পড়লেন, আর হাত দিয়ে নিজের কপালটা চেপে ধরলেন।
"আমার যদি এ
সম্পর্কে কোনোরকম কোনো ধারণা থাকতো," তিনি গর্জাতে থাকলেন,
"আমি ভগবানের নাম শপথ করে বলছি যে ওই বেটে খাটো বেলজিয়ানটিকে
কখনই সত্যিটা উদ্ধার করতে বলতাম না। রুথের খুনিকে খুঁজে বের করবে - এইটুকুই আমি
ভেবেছিলাম।"
"আপনি আপনার জামাই
কে কি বিনা শাস্তিতে মুক্ত হয়ে ঘুরে বেড়াতে দিতেন?"
ভ্যান আলদীন একটা
দীর্ঘশ্বাস ফেললেন।
"আমি আইনকে নিজের
হাতে নেওয়াটা পছন্দ করতাম।"
"আমার মনে হয় না
সেটা খুব একটা বুদ্ধিমানের মতো কাজ হতো বলে, স্যার।"
"যা হোক - তুমি কি
নিশ্চিত ওই লোকটা আমার সঙ্গে দেখা করতে চায়।"
"হ্যাঁ, মিস্টার ভ্যান আলদীন,
উনি খুব জরুরি ভিত্তিতে দেখা করতে চান।"
"তাহলে আমার মনে হয়
তাঁর সাথে দেখা করতে হবে। তিঁনি চাইলে আজ সকালেই আস্তে পারেন।"
ধনকুবেরের ঘরে পোয়ারো যখন
পৌঁছলেন তখন তিঁনি বেশ তরতাজা এবং স্ফূর্তিময়। তিঁনি যেন ধনকুবেরের আচরণে ভদ্রতার
কোনোরকম কমতি দেখতে পেলেন না, আর বিভিন্ন বিষয় নিয়ে বেশ
প্রফুল্ল মনে কথা বলতে লাগলেন। তিঁনি বললেন যে যে তিঁনি লন্ডনে তাঁর ডাক্তারকে
দেখাতে এসেছেন। তিঁনি একজন নামকরা সার্জনের নাম বললেন।
"না, না, যুদ্ধের ব্যাপার নয় - আমার পুলিশে কাজ করার একটা স্মৃতি। একটা বদমাস উত্তর
আমেরিকান গুন্ডার একটা গুলি।"
তিঁনি তাঁর বাম কাঁধে হাত
দিলেন এবং বাস্তবিকই কেঁপে উঠলেন।
"আমি সবময় আপনাকে
একজন ভাগ্যবান মানুষ হিসেবেই দেখি, মসিয়েঁ ভ্যান আলদীন, আপনি ঠিক আমাদের আমেরিকান ধনকুবেরদের সম্পর্কে যে সব জনপ্রিয় ধারণা আছে
সেরকমটা নন। পেটের সমস্যায় শহীদ।"
"আমি বেশ শক্ত
পোক্ত।" ভ্যান আলদীন বললেন, "আমি খুব সাধারণ জীবন যাপন
করেছি, জানেন তো;
সরল,
সাধা সিধা আর কখনোই প্রাচুর্যের মধ্যে নয়।
"আপনি মিস গ্রের
সাথে দেখা করেছিলেন,
তাই না?" পোয়ারো নিষ্পাপ মুখে
সেক্রেটারিটির দিকে ঘুরে প্রশ্ন করলেন।
"আমি - হ্যাঁ; ওই একবার দুবার,"
নাইটোন বললো।
নাইটোন একটু লজ্জা পেলো
আর ভ্যান আলদীন অবাক হয়ে চিৎকার করে উঠলেন।
"মজার কথা তুমি তো
আমাকে কখনো জানাও নি যে ওর সাথে তুমি দেখা করেছো, নাইটোন?"
"আমি ভাবতে পারি নি
যে এ ব্যাপারে আপনি আগ্রহী হবেন, স্যার।"
"আমি ওই মেয়েটাকে
খুব পছন্দ করি,"
ভ্যান আলদীন বললেন।
"এ যেন হাজার বেদনার
সমান যে উনি আবার নিজেকে সেইন্ট মেরি মিডে ডুবিয়ে দিয়েছেন।" পোয়ারো বললেন।
"এটা ওনার খুব
সুন্দর একটা সিদ্ধান্ত,"
নাইটোন একটু উত্তপ্ত ভাবে বললো, "খুব কম মানুষই আছেন যারা ওখানে গিয়ে বদমেজাজি বৃদ্ধাদের, যাঁদের সাথে ওনার কোনো রক্তের সম্পর্কই নেই, তাঁদের দেখাশোনা করবেন।"
"আমি চুপ করলাম," পোয়ারো বললেন,
তাঁর চোখ একটু ঝিকমিক করে উঠলো। "কিন্তু তা সত্ত্বেও
আমি বলবো এটা দুঃখের। আর মেসিউ, আসুন, এবার আমার কাজের কথা বলি।"
অন্য দুই জনই তাঁর দিকে
কিছুটা অবাক হয়ে তাকালো।
"আমি যা বলতে চলেছি, তাতে আপনারা আশ্চর্য বা শংকিত হবেন না। মসিয়েঁ ভ্যান আলদীন, ধরে নিন,
যে মোটের ওপর ডেরেক কেটারিং তাঁর স্ত্রীর খুনটা করেন নি?"
"কি?"
দুজনেই অবাক ভাবে শুন্য দৃষ্টিতে
তাঁর দিকে তাকিয়ে থাকলো।
"আমি বলছি, ধরে নিন,
ডেরেক কেটারিং তাঁর স্ত্রীর খুনটা করেন নি।"
"আপনি কি পাগল হলেন, মসিয়েঁ পোয়ারো?"
ভ্যান আলদীন কথাটা বললেন।
"না," পোয়ারো বললেন,
"আমি পাগল নই। হয়তো উন্মাদ - কিছু কিছু লোক অন্তত তাই বলে; কিন্তু আমার পেশার দিক থেকে দেখতে গেলে, লোকে যা বলে, একদম 'সঠিক জায়গায়'। আমি আপনাকে প্রশ্ন করছি, মসিয়েঁ ভ্যান আলদীন, আপনি কি খুশি হবেন না দুঃখ পাবেন যদি আমি আপনাকে কেসটা আসলে কি হবে সে কথা বলি?"
ভ্যান আলদীন তাঁর দিকে
তাকিয়ে থাকলেন। "স্বাভাবিকভাবেই, আমার খুশি হওয়া উচিৎ," তিঁনি অবশেষে বললেন। "এই চর্চাটা কি শুধুমাত্র অনুমানের ওপর ভিত্তি করে, মসিয়েঁ পোয়ারো,
না কি এর পেছনে কোনো তথ্য প্রমান আছে?"
পোয়ারো ওপরের দিকে তাকিয়ে
থাকলেন।
"একটা হালকা মতো
সম্ভাবনা আছে,"
তিনি শান্তভাবে বললেন, "যে শেষ পর্যন্ত এটা কমতে ডে লা রোচেও হতে পারেন। অন্তত আমি তাঁর আলিবাইটা
ভাঙতে সফল হয়েছি।"
"আপনি এটা কিভাবে
পারলেন?"
"আমার নিজস্ব পদ্ধতি
আছে। কিছু কিছু ছোট ছোট কৌশলের প্রয়োগ, ছোট ছোট চালাকি - আর কাজ
হয়ে যায়।"
"কিন্তু রুবিগুলো," ভ্যান আলদীন বললেন,
"কাউন্টের কাছে যে রুবিগুলো ছিল সেগুলো তো নকল।"
"আর এটা পরিষ্কার যে
রুবিগুলো না থাকলে সে এই অপরাধটা করতোই না। কিন্তু আপনি একটা জিনিস খেয়াল করছেন না, মসিয়েঁ ভ্যান আলদীন। রুবিগুলোর ব্যাপারটা,
কেউ তাঁর আগেই সেরে ফেলতে পারে।"
"কিন্তু এটা একদম
নতুন একটা তত্ব,"
নাইটোন চেঁচিয়ে উঠলো।"
"আপনি কি সত্যি এই
সব আজগুবি কথাবার্তায় বিশ্বাস করেন, মসিয়েঁ পোয়ারো?" ধনকুবেরটি জানতে চাইলেন।
"ব্যাপারটা এখনো
প্রমাণিত হয় নি,"
পোয়ারো শান্তভাবে বললেন, "এটা এখনো চিন্তা ভাবনার স্তরেই আছে, কিন্তু আমি আপনাকে বলছি, মসিয়েঁ ভ্যান আলদীন,
এই তথ্যগুলোর তদন্ত হওয়া প্রয়োজন। আপনার আমার সাথে দক্ষিণ
ফ্রান্সে গিয়ে এই কেসের ঘটনাস্থলে যাওয়া উচিত।"
"আপনি কি সত্যি
সত্যি মনে করেন যে এটার প্রয়োজন আছে - মানে, আমার যাওয়া উচিত।"
"আমার মনে হয় এটা
আপনার নিজে থেকেই চাওয়া উচিত," পোয়ারো বললেন।
তাঁর গলায় একটা ভর্ৎসনার
সুর ছিল যা অপরজন অবহেলা করতে পারলো না।
"হ্যাঁ, হ্যাঁ,
অবশ্যই," তিনি বললেন, "আপনি কখন রওনা হতে চান,
মসিয়েঁ পোয়ারো?"
"এখন আপনি খুবই
ব্যাস্ত,
স্যার," নাইটোন বিড়বিড় করে বললো।
কিন্তু ধনকুবেরটি তাঁর
নিজের মনকে এখন তৈরি করে নিয়েছেন, আর তিঁনি তার আপত্তিটা
হাতের ভঙ্গিমায় সরিয়ে দিলেন।
"আমার মনে হয় এইটাই
আগে করা উচিত,"
তিঁনি বললেন, "ঠিক আছে,
মসিয়েঁ পোয়ারো, আগামী কাল, কোন ট্রেনে?"
"আমরা দ্যা ব্লু
ট্রেনেই যাবো।" পোয়ারো হেসে বললেন।
চ্যাপ্টার ৩৪
আবার দ্যা ব্লু
ট্রেনে
ট্রেনটা মাঝে মাঝে যাকে 'ধনকুবেরদের ট্রেন'
বলা হয়, ভয়ঙ্কর গতিতে একটা বাঁক
ঘুরছিলো। ভ্যান আলদীন,
নাইটোন এবং পোয়ারো একসাথে চুপ চাপ বসেছিলেন।
নাইটোন এবং ভ্যান আলদীন
পাশাপাশি দুটো জোড়া কম্পার্টমেন্টে ছিলেন, যেমনটা রুথ কেটারিং এবং
তাঁর পরিচারিকা তাঁর সেই দুৰ্ভাগ্যপূর্ণ যাত্রার সময় ছিলেন। পোয়ারোর কম্পার্টমেন্টটা
একই কোচে আরো একটু এগিয়ে।
ভ্যান আলদীনের জন্য এই
সফরটা বেশ যন্ত্রণাদায়ক,
মর্মান্তিক সব স্মৃতিগুলো ফিরে ফিরে আসছিলো। পোয়ারো এবং
নাইটোন তাঁকে বিরক্ত না করে মাঝে মাঝে নিচু স্বরে কথা বলছিলেন। ট্রেনটা যখন ধীরে
ধীরে ঘোরানো পথ ধরে গারে ডি লিওনে পৌঁছলো, পোয়ারো হঠাৎই সক্রিয় ভাবে
তৎপর হয়ে উঠলেন।ভ্যান আলদীন বুঝলেন তাঁর ট্রেন সফরের একটা উদ্দেশ্য হচ্ছে অপরাধের
ঘটনাটা পুনরনির্মাণ করা। পোয়ারো নিজেই প্রত্যেকটা চরিত্র করে দেখাচ্ছিলেন। পরিচারিকার ভূমিকায়, তিনি তাড়াতাড়ি নিজের
কম্পার্টমেন্টে দরজা বন্ধ করে বসলেন, মিসেস কেটারিং, তাঁর স্বামীকে চিনতে পেরে অবাক এবং কিছুটা উদ্বিগ্ন হলেন, আর ডেরেক কেটারিং আবিষ্কার করলেন তাঁর স্ত্রীও একই ট্রেনে চলেছেন। তিঁনি
বিভিন্ন সম্ভবনা পরীক্ষা করে দেখলেন, যেমন একজন লোকের পক্ষে
দ্বিতীয় কম্পার্টমেন্টে লুকিয়ে থাকার সব থেকে শ্রেষ্ঠ উপায় কি
তারপর হঠাৎই তাঁর মাথায়
যেন একটা বুদ্ধি খেলে গেলো। তিঁনি ভ্যান আলদীনের বাহু চেপে ধরলেন।
"হা ঈশ্বর, কিন্তু এটার ব্যাপারে তো আমি আগে ভাবি নি! আমরা আমাদের যাত্রা প্যারিসেই শেষ করবো।
তাড়াতাড়ি,
তাড়াতাড়ি, আমাদের এখুনি নামতে
হবে।"
সুটকেসগুলো নিয়ে তিঁনি
দ্রুত ট্রেন থেকে নেমে গেলেন। ভ্যান আলদীন এবং নাইটোন অত্যাচর্য হলেও, অনুগতর মতো তাঁকে অনুসরণ করলেন। একবার পোয়ারোর কার্যক্ষমতা সম্পর্কে একটা
ধারণা করবার পর ভ্যান আলদীন সেটা থেকে সহজে সরে আসার লোক নন। গেটে তাঁদের আটকানো
হলো। তাঁদের টিকিট যে কর্তব্যরত ট্রেনের কন্ডাক্টরের কাছে জমা ছিল, যে কথাটা তাঁরা তিনজনেই ভুলে গিয়েছিলেন।
পোয়ারোর ব্যাখ্যা খুবই
দ্রুত, সাবলীল এবং আবেগপূর্ণ ছিল, কিন্তু পাথরের মতো
মুখওয়ালা কর্তৃপক্ষের ওপর তার কোনো প্রভাব দেখা গেলো না।
"এসব ছাড়ুন," ভ্যান আলদীন হঠাৎ করে বললেন। "মনে হচ্ছে আপনি কোনো তাড়াহুড়োর মধ্যে আছেন, মসিয়েঁ পোয়ারো। ঈশ্বরের দোহাই ক্যালিস থেকে যা ভাড়া হয় দিয়ে দিন, আর চলুন আপনি যেখানে নিয়ে যেতে চান আমরা সেইদিকে রওনা হই।"
কিন্তু, পোয়ারো বন্যার মতো কথার তোর হঠাৎই থেমে গেলো, আর তাঁকে দেখে মনে হলো যেন তিঁনি মানুষ থেকে পাথরের মূর্তিতে পরিণত হয়েছেন।
তাঁর হাতগুলো এখনো অত্যুৎসাহী ভঙ্গিতে ছড়ানো ছিল, আর সেইরকমই রয়ে গেলো হঠাৎ প্যারালাইসিসে আক্রান্ত হওয়ার মতো।
তিঁনি শুধু বললেন, "আমি একজন মূর্খে পরিণত হয়েছি, এছাড়া, আমি আমার মাথাটাও আজকাল ঠিক রাখতে পারছি না। চলুন ফিরে যাই আর শান্তভাবে আমরা
আমাদের সফর চালিয়ে যাই। ভাগ্য ঠিক থাকলে ট্রেন এখনো ছেড়ে যায় নি।"
তাঁরা একদম শেষ মুহূর্তেই
পৌঁছলেন,
তাঁদের তিন জনের মধ্যে সব শেষে নাইটোন তার সুটকেস নিয়ে
লাফিয়ে উঠতেই ট্রেন চলতে শুরু করলো। কন্ডাক্টরটি বেশ আবেগপূর্ণ ভাবে তাঁদের এই
কাজের ব্যাপারে আপত্তি জানালেও, তাঁদের মালপত্র আবার
তাঁদের কম্পার্টমেন্টে ফিরিয়ে নিয়ে যেতে সাহায্য করলো। ভ্যান আলাদিন কিছু বললেন না, কিন্তু তিনি পরিস্কারভাবেই পোয়ারোর এই অদ্ভুত কান্ড কারখানায় বেশ বিরক্ত।
দু এক মুহূর্তের জন্য
নাইটোনের সাথে যখন তিঁনি একান্তে ছিলেন তখন মন্তব্য করলেন:
"এটা বুনো হাঁসের
পেছনে দৌড়োনোর মতো ব্যাপার হয়ে যাচ্ছে। লোকটা নিজের ওপর নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলেছে।
একটা বিন্দু পর্যন্ত ওনার মাথা বেশ ভালো কাজ করে, কিন্তু কোনো মানুষ যদি মাথা খারাপ করে ভয়ার্ত খরগোশের মতো ছোটাছুটি করে তবে
কোনো পার্থিব লাভ হয় না।"
দু এক মুহূর্ত পরেই
পোয়ারো তাঁদের সামনে উপস্থিত হলেন, শোচনীয়ভাবে ক্ষমা
প্রার্থনা করতে লাগলেন এবং পরিষ্কার ভাবে এতটাই বিমর্ষ যে কোনো কঠিন কথা বলা
অনাবশ্যক।
ভ্যান আলাদিন গম্ভীর মুখে
তাঁর মার্জনা ভিক্ষা শুনলেন, কিন্তু কোনো ব্যাংগাত্মক
মন্তব্য করার থেকে নিরস্ত থাকলেন।
তাঁরা ট্রেনেই ডিনার
সারলেন, আর তারপর,
তাঁদের দুজনকে কিছুটা অবাক করে দিয়ে, পোয়ারো প্রস্তাব দিলেন যে তাঁরা তিন জনেই যেন ভ্যান আলদীনের কম্পার্টমেন্টে
গিয়ে বসেন।
ধানকুবেরটি কৌতুহলী চোখে
তাঁর দিকে তাকালেন।
"আপনি কি আমাদের কাছ
থেকে কিছু লোকাচ্ছেন,
মসিয়েঁ পোয়ারো?"
"আমি?" পোয়ারো নিষ্পাপ বিস্ময়ে নিজের চোখ খুলে বললেন। "কিন্তু বুদ্ধিটা দারুন
তো।"
ভ্যান আলদীন কোনো উত্তর
দিলেন না,
কিন্তু তিঁনি সন্তুষ্ট ছিলেন না। কন্ডাক্টরকে বলা হলো
বিছানা করতে হবে না। এতে সে কোনো রকম আশ্চর্য হলেও ভ্যান আলদীন তাকে যা বিপুল
পরিমান টিপ্ দিয়েছিলো তাতে সে আর মুখ খুললো না। তিন জন মানুষ চুপ চাপ বসে থাকলেন। পোয়ারোকে অস্থির এবং অশান্ত মতো লাগছিলো। এবার তিঁনি
সেক্রেটারিটির দিকে ঘুরলেন।
"মেজর নাইটোন আপনার
কম্পার্টমেন্টের দরজাটা ছিটিকিনি দিয়ে বন্ধ করা আছে তো? মানে,
করিডোরের দিকের দরজাটা।"
"হ্যাঁ, আমি তো নিজেই একটু আগে গিয়ে ছিটকিনি লাগিয়ে এলাম।"
"আপনি কি নিশ্চিত?" পোয়ারো বললেন।
"যদি বলেন, আমি গিয়ে আর একবার দেখে আস্তে পারি।" নাইটোন হাসতে হাসতে বললো।
"না, না, আপনাকে কষ্ট করতে হবে না। আমি নিজে গিয়ে দেখে আসবো।"
তিনি দুই কম্পার্টমেন্টের
মদ্ধিখানের দরজাটা দিয়ে গেলেন এবং দু এক সেকেন্ডের মধ্যে, মাথা নাড়তে নাড়তে ফিরে এলেন।
"হ্যাঁ, হ্যাঁ,
একদমই আপনি যা বলেছিলেন সেরকমটাই। আপনি নিশ্চই একজন বৃদ্ধ
মানুষের উল্টোপাল্টা কাজকর্ম মার্জনা করবেন।"
তিঁনি মদ্ধিখানের দরজাটা
বন্ধ করে দিলেন এবং ডান দিকের কোনায় নিজের জায়গায় গিয়ে বসলেন।
কয়েক ঘন্টা কেটে গেলো। তিনজন মানুষই ঝিমোতে লাগলেন, আর অস্বস্তির কারণে চমকে চমকে জেগে উঠতে লাগলেন।
সম্ভবত আগে কখনোই তিনজন
মানুষ সবথেকে বিলাসবহুল ট্রেনে নিজেদের বার্থ বুক করেছেন, আর তারপর তাঁরা সেই সুবিধা ভোগ করেন নি এমনটা ঘটে নি।
কিছুক্ষন অন্তর অন্তরই
পোয়ারো তাঁর ঘড়ির দিকে তাকাচ্ছিলেন, তারপর মাথা নেড়ে আবার
তন্দ্রায় ডুবে যাচ্ছিলেন। একবার তিঁনি তাঁর সিট থেকে উঠে মদ্ধিখানের দরজাটা খুললেন, তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে পাশের কম্পার্টমেন্টটা দেখলেন, তারপর আবার মাথা ঝাঁকাতে ঝাঁকাতে নিজের সিটে ফিরে এলেন।
"ব্যাপারটা কি?" নাইটোন ফিস ফিস করে জিজ্ঞেস করলো, "কিছু একটা ঘটবে বলে আপনি অনুমান করছেন, তাই না?"
"আমি যথেষ্ট সাহসী," পোয়ারো স্বীকার করলেন,
"আমার সমস্ত স্নায়ু সতর্ক হয়ে আছে। একটা সামান্য শব্দেও আমি
লাফিয়ে উঠছি।"
নাইটোন হাই তুললো।
"সবথেকে অস্বছন্দকর
সফর,"
সে বিড়বিড় করে বললো, "আশা করি আপনি ঠিক কি করছেন সে সম্পর্কে আপনার ধারণা আছে, মসিয়েঁ পোয়ারো"
সে নিজেকে যতটা সম্ভব
ভালোভাবে গুছিয়ে নিয়ে আবার ঘুমে ঢলে পড়লো। পোয়ারো যখন চোদ্দোতম বারের জন্য ঘড়ির
দিকে তাকালেন,
তখন সে এবং ভ্যান আলদীন দুজনেই ঘুমে ঢুলছিলেন, তিঁনি ঝুকে পরে ধনকুবেরটির কাঁধে একটা চাপড় দিলেন।
"এঃ? কি হয়েছে?"
"আর পাঁচ দশ মিনিটের
মধ্যেই, মসিয়েঁ,
আমরা লিয়োন্সে পৌঁছবো।"
"হা ঈশ্বর!"
ঢিমে আলোতে ভ্যান আলদীনের মুখ ফেকাসে এবং ম্লান লাগছিলো। "তাহলে ঠিক এই সময়েই
বেচারি রুথকে খুন করা হয়েছিল।"
তিনি সোজা সামনের দিকে
তাকিয়ে বসে থাকলেন। তাঁর ঠোঁটদুটো ঈষৎ
মোচড়ানো ছিল,
আর তাঁর মন চলে গিয়েছিলো সেই হৃদয়বিদারক ঘটনার দিকে যা তাঁর
জীবনকে চিরদুঃখী করে দিয়েছে।
ব্রেকের স্বভাবসিদ্ধ
লম্বা তীক্ষ্ণ আর্তনাদের মতো একটা আওয়াজ পাওয়া গেলো, আর ট্রেনের গতি ধীরে হতে হতে লিয়োন্সে প্রবেশ করলো। ভ্যান আলদীন জানলার কাঁচ
নামিয়ে ঝুকে বাইরে দেখতে লাগলেন।
"আপনার নতুন তত্ব
যদি সঠিক হয় - তাহলে খুনি ডেরেক ছিল না, এখানেই কি সেই লোকটা
ট্রেন থেকে নেমে যায়?"
তিনি কাঁধের ওপর দিয়ে মুখটা ঘুরিয়ে প্রশ্ন করলেন
তাঁকে কিছুটা অবাক করে
দিয়ে পোয়ারো নিজের মাথাটা নাড়লেন।
"না," তিনি চিন্তিত ভাবে বললেন, "কোনো পুরুষ ট্রেন থেকে
নেমে যায় নি,
কিন্তু আমার মনে হয় - হ্যাঁ, আমার মনে হয়,
একজন মহিলা এ কাজ করতে পারে।"
নাইটোন হাঁ করে খাবি
খাওয়ার মতো বাতাস গিললো।
"একজন মহিলা?" ভ্যান আলদীন তীক্ষ্ণ স্বরে প্রশ্ন করলেন।
"হ্যাঁ, একজন মহিলা,"
পোয়ারো তাঁর মাথা নেড়ে জানালেন। "আপনার হয়তো স্মরণে
নেই, মসিয়েঁ ভ্যান আলদীন,
কিন্তু মিস গ্রে তাঁর সাক্ষ্যদানের সময় জানিয়েছিলেন যে টুপি
এবং ওভারকোট পড়া একজন যুবক প্লাটফর্মে নেমেছিলেন হাত পা ছাড়ানোর জন্য। আমার, আমি মনে করি সেই যুবক আসলে খুব সম্ভবত একজন মহিলা।"
"কিন্তু কে সে?"
ভ্যান আলদীনের মুখে একটা
অবিশ্বাসের ছায়া,
কিন্তু পোয়ারো গুরুত্বসহকারে এবং স্পষ্টভাবে উত্তর দিলেন।
"তার নাম - অথবা যে
নাম সে বেশ কিছু বছর যাবৎ পরিচিত ছিল - তা হলো কিটি কিড, কিন্তু আপনি,
মসিয়েঁ ভ্যান আলদীন, তাকে অন্য একটা নাম চেনেন
- সেটা হলো অ্যাডা ম্যাসন।
নাইটোন লাফিয়ে উঠে
দাঁড়ালো।
"কি?" সে চিৎকার করে বললো।
পোয়ারো চটপট তার দিকে
ঘুরলো।
"আঃ! - আমি জিনিসটা
ভুলে যাওয়ার আগে।" তিনি নিজের পকেট থেকে চট করে একটা জিনিস বের করে এগিয়ে
ধরলেন।
"আসুন একটা সিগারেটে
নিন - আপনার নিজের সিগারেট-কেস থেকে। প্যারিসে ঘোরানো পথ থেকে ট্রেনে চাপার পর এটা
ট্রেনে ফেলে আসাটা আপনার খুবই অসাবধানীর মতো একটা কাজ হয়ে গিয়েছে।
নাইটোন স্তম্ভিত হয়ে তাঁর
দিকে তাকিয়ে দাঁড়িয়ে রইলো। তারপর সে একটু নড়াচড়া করতে যেতেই, পোয়ারো হাত তুলে ইশারায় তাকে সাবধান করলেন।
"না, নড়বেন না,"
তিনি একটা রেশমী গলায় বললেন, "পাশের কম্পার্টমেন্টের দরজাটা খোলা আছে, আর এই মুহূর্ত থেকে আপনি
ওদিক থেকে নজরবন্দি আছেন। আমরা যখন প্যারিস ছাড়াচ্ছিলাম তখন আমি করিডোরের দিকের
দরজার ছিটকিনিটা খুলে দিয়ে আসি, আর আমাদের পুলিশ বন্ধুদের
ওখানেই সতর্ক থাকতে বলা আছে। আর একথা আশা করি আপনার জানা আছে যে, ফরাসি পুলিশ আপনাকে বেশ জরুরি ভিত্তিতেই খুঁজছে, মেজর নাইটোন - অথবা আমরা কি বলতে পারি - মসিয়েঁ লে মারকুইস?"
চ্যাপ্টার ৩৫
ব্যাখ্যা
"ব্যাখ্যা?"
পোয়ারো হাসলেন। তিঁনি
ধনকুবেরটির নেগ্রেস্কোর ব্যাক্তিগত সুইটে তাঁর লাঞ্চ টেবিল তাঁর উল্টোদিকে
বসেছিলেন। তাঁর সামনে একজন নির্ভার কিন্তু বিভ্রান্ত ব্যাক্তি বসে ছিলেন। পোয়ারো
তাঁর চেয়ারে হেলান দিয়ে বসলেন, তাঁর ছোট সিগারেটাগুলোর
একটা ধরালেন,
অরে চিন্তিত মুখে ওপরের দিকে চেয়ে থাকলেন।
"হ্যাঁ, আমি আপনাকে ব্যাখ্যা দেব। এটা এমন একটা ব্যাপার থেকে শুরু হয়েছিল যা আমাকে
প্রথমথেকে বিভ্রান্ত করেছিল। আপনি জানেন কোন ব্যাপারটা? মুখ বিকৃত করার ব্যাপারটা। অপরাধের তদন্তের ক্ষেত্রে এটা খুব একটা অস্বাভাবিক
কোন ব্যাপার নয় আর সঙ্গে সঙ্গে এটা একটা প্রশ্ন খাড়া করে দেয়, পরিচিতির প্রশ্ন। স্বাভাবিক ভাবে এটাই প্রথম বিষয় যা আমার মাথায় এসেছিলো। মৃতা
মহিলা কি সত্যিই মিসেস কেটারিং? কিন্তু এটার কোন বাস্তব
ভিত্তি পাওয়া গেলো না,
কারণ মিস গ্রের সাক্ষ্য খুবই ইতিবাচক এবং বিশ্বাসযোগ্য ছিল, তাই আমি এই চিন্তাটা সরিয়ে রাখলাম। মৃতা মহিলা রুথ কেটারিংই ছিলেন।"
"আপনি প্রথম কখন
পরিচারিকাটিকে সন্দেহ করতে শুরু করলেন?"
"খুব একটা বেশিদিন
আগে থেকে নয়,
কিন্তু বিশেষ একটি ছোট বিষয় আমার নজর তার দিকে ঘুরিয়ে দিলো।
রেলের কামড়াতে পাওয়া সিগারেটে-কেসেটা, আর যেটা সম্পর্কে সে
বলেছিলো যে মিসেস কেটারিং সেটা তাঁর স্বামীকে উপহার দিয়েছিলেন। আর এটা, আপাতদৃষ্টিতে,
তাঁদের মধ্যেকার সমীকরণ দেখলে, অসম্ভব একটা ব্যাপার। এটাই আমার মনে অ্যাডা ম্যাসনের বিবৃতির সত্যতা সম্পর্কে
একটা সন্দেহ জাগিয়ে তোলে। যদি এটা বিবেচনা করা হয় যে, সে তার মালকিনের সাথে শুধুমাত্র দু মাস কাটিয়েছিলো, তাহলে এটা একটা সন্দেহজনক তথ্য। নিশ্চিতভাবেই এটা মনে হয় যে তার অপরাধের সঙ্গে কোন সম্পর্কই
ছিল না যেহেতু তাকে প্যারিসেই নামিয়ে দেওয়া হয়েছিল আর তার পরেও অনেকেই মিসেস
কেটারিংকে জীবিত দেখেছিলেন,
কিন্তু -"
পোয়ারো সামনে ঝুঁকে এলেন, তিঁনি খুব জোরালো ভাবে তর্জনীটি তুললেন আর খুব জোরে জোরে ভ্যান আলদীনের সামনে
সেটা নাড়াতে লাগলেন।
"কিন্তু আমি একজন
দুঁদে গোয়েন্দা। আমি সন্দেহ করি। কোন কিছুই এবং কেউই আমার সন্দেহ থেকে বাদ যায় না।
আমাকে যা বলা হয় তার কিছুই আমি বিশ্বাস করি না। আমি নিজেকেই প্রশ্ন করলাম: আমরা
কিভাবে বুঝলাম যে অ্যাডা ম্যাসনকে প্যারিসেই নামিয়ে দেওয়া হয়েছিল? আর প্রথমে এই প্রশ্নের উত্তর পুরোপুরি সন্তোষজনক বলেই মনে হয়েছিল। আপনার
সেক্রেটারির তথ্য প্রমাণ ছিল, মেজর নাইটোন, একজন পুরোপুরি বাইরের লোক যার সাক্ষ্য একদমই নিরপেক্ষ হওয়া উচিত, আর মৃতা মহিলা নিজে ট্রেনের কন্ডাক্টরের সাথে কথা বলেছিলেন। কিন্তু আমি শেষ
বিষয়টা এখনকার জন্য এখান থেকে সরিয়ে রাখছি, কারণ একটা অদ্ভুত চিন্তা
- একটা চিন্তা যা কিনা হয়তো অসাধারণ এবং অসম্ভব - আমার মনে গড়ে উঠছিলো। যদি কোন
একটা আপাত সুযোগে এটা সত্যি হয়, তবে ওই সাক্ষ্যটা অর্থহীন
হয়ে যায়।
"আমি আমার তত্ত্বের
মূল বাধাটার দিকে নজর দিলাম। মেজর নাইটোনের বিবৃতি যে দ্যা ব্লু ট্রেন প্যারিস
ছেড়ে যাবার পর ওনার সাথে অ্যাডা ম্যাসনের রিট্জে দেখা হয়েছিল। এটা প্রথমে অকাট্য
বলেই মনে হয়েছিল,
কিন্তু তথ্যগুলো ভালো করে পরীক্ষা করার পর, আমি দুটো জিনিস লক্ষ্য করলাম। প্রথমত, অদ্ভুতরকম কাকতালীয় ভাবে, সেও,
ঠিক দু মাস আগেই আপনার কাছে কাজে যোগ দিয়েছিলো। দ্বিতীয়ত, তার নামের আদ্যাক্ষর ও এক - 'K.' ধরা যাক - খালি ধরে নেওয়া
যাক - যে রেলের কামরায় পাওয়া সিগারেট-কেসটা ওনার। তাহলে, যদি অ্যাডা ম্যাসন এবং সে দুজনে মিলে কাজটা করে থাকে, তাহলে আমরা যখন তাকে সিগারেট-কেসটা দেখালাম এবং সে ওটা চিনতে পারলো, সে কি ঐরকমই আচরণই করবে না, যে রকমটি সে করেছিল? প্রথমে,
অবাক হয়ে গেলো, তারপর তাড়াতাড়ি একটা নতুন
বিশ্বাসযোগ্য তত্ব খাড়া করলো যাতে দোষটা মিস্টার কেটারিংয়ের ওপর চাপিয়ে দেওয়া যায়।
অবশ্যই এটা মূল পরিকল্পনায় ছিল না। কমতে ডে লা রোচেকেই বলির পাঁঠা বানানোর কথা ছিল, কিন্তু যদি সে তার অ্যালিবাই প্রমান করতে সক্ষম হয়, তাই অ্যাডা ম্যাসনও খুব নিশ্চিতভাবে তাঁকে শনাক্ত করতে পারবে না। এখন আপনি যদি
আবার সেই সময়ে ফিরে যান,
আপনার একটা উল্লেখযোগ্য ঘটনার কথা মনে পড়বে যা কিনা সেই
সময়ে ঘটেছিলো। আমি অ্যাডা ম্যাসনকে ভেবে দেখার জন্য বলেছিলাম যে সে যে লোককে
দেখেছে সেটা কমতে ডে লা রোচে নন, ডেরেক কেটারিংকে ছিলেন।
সেই সময় সে যেন দ্বিধাগ্রস্ত ছিল, কিন্তু আমি হোটেলে ফিরে
যাওয়ার পর,
আপনি আমাকে টেলিফোন করেন এবং বলেন যে সে আপনার কাছে এসেছিলো, এবং চিন্তা ভাবনা করে বলেছে যে সে এখন প্রায় নিশ্চিত যে লোকটা মিস্টার
ক্যাটারিংই ছিলেন। আমি এইরকমই কিছু একটা আশা করেছিলাম। তার দিক থেকে এই হঠাৎ
নিশ্চয়তার পেছনে একটাই ব্যাখ্যা থাকা সম্ভব। আপনার হোটেল থেকে আমার চলে আসার পর, কারো সঙ্গে নিশ্চই সে আলোচনা করেছে, আর কারো কোনো নির্দেশ
পেয়ে সে সেইমতোই আচরণ করেছে। কে তাকে এই নির্দেশগুলো দিলো? মেজর নাইটোন। আর আরেকটা ছোট বিষয় আছে, যার কোনো অর্থ নাও থাকতে পারে, আবার থাকতেও পারে। একবার
কথায় কথায় নাইটোন ইয়র্কশায়ারে যে বাড়িতে থাকতো সেখানে একটা গয়নার ডাকাতির কথা
বলেছিলো। হয়তো শুধুমাত্র একটা কাকতালীয় ঘটনা - হয়তো একটা শৃঙ্খলের একটা ছোট
অংশ।"
কিন্তু আরেকটা ব্যাপার যা
আমি বুঝতে পারছি না,
মসিয়েঁ পোয়ারো। মনে হয় আমি বেশ মাথা মোটা, না হলে হয়তো আগেই বুঝতে পারতাম। প্যারিসে লোকটা কে ছিল? কমতে ডে লা রোচে অথবা ডেরেক কেটারিং?"
এটাই পুরো ঘটনার সরলতম
বিষয়। কোনো লোকই ছিল না। আঃ - হায়রে দুনিয়া! - আপনি এই পুরো ঘটনার ধূর্ততাটা বুঝতে
পারছেন না! কার কথায় আমরা জেনেছিলাম যে ওখানে একজন লোক ছিল? খালি অ্যাডা ম্যাসনের। আর আমরা অ্যাডা ম্যাসনকে বিশ্বাস করেছিলাম নাইটোনের
সাক্ষ্যের কারণে যে তাকে প্যারিসে নামিয়ে দেওয়া হয়েছিল।"
"কিন্তু, রুথ নিজে কন্ডাক্টরকে বলেছিলো যে সে তার পরিচারিকাকে প্যারিসে নামিয়ে দিয়ে
এসেছে,"
ভ্যান আলদীন দ্বিধাগ্রস্ত ভাবে বললেন।
"আঃ! আমি এই
ব্যাপারটায় আসছি। এব্যাপারে আমাদের কাছে মিসেস কেটারিং নিজে প্রমান হিসেবে আছেন, কিন্তু,
অন্যদিকে, আমরা সত্যি সত্যি তিনিই
কিনা তার কোনো প্রমান পাই নি, কারণ একজন মৃতা মহিলা
কখনও কোনো প্রমান পেস করতে পারেন না। এটা ওনার পেস করা কোনো প্রমান নয়, বরং ট্রেনের কন্ডাক্টরের পেস করা প্রমান - পুরো আলাদা একটা ব্যাপার।"
"তাহলে আপনি কি মনে
করছেন লোকটা মিথ্যা কথা বলেছিলো?"
"না, না, একদমই না। সে সেটাই বলেছিলো যেটাকে সে সত্যি বলে মনে করেছিল। কিন্তু যে মহিলা তাকে
বলেছিলো যে সে তার পরিচারিকাকে প্যারিসে নামিয়ে দিয়েছে সে মিসেস কেটারিং ছিল
না।"
ভ্যান আলদীন তাঁর দিকে
তাকিয়ে থাকলেন।
"মসিয়েঁ ভ্যান আলদীন, ট্রেন গারে ডি লিওনে পৌঁছনোর আগেই রুথ কেটারিং মারা গেছেন। ওটা অ্যাডা ম্যাসন, একদম তার মালকিনের স্বতন্ত্র পোশাকে সেজে ছিল, যে একটা ডিনার বাস্কেট কেনে এবং যে কন্ডাক্টরকে প্রয়োজনীয় বিবৃতিটি দেয়।"
"অসম্ভব!"
"না, না, মসিয়েঁ ভ্যান আলদীন,
অসম্ভব নয়। নারীরা, আজকাল এতটাই একইরকম দেখতে
লাগেন যে তাঁদের মুখের বদলে তাঁদের পোশাক দেখে চিনতে হয়। অ্যাডা ম্যাসনের আর আপনার
মেয়ের উচ্চতা একই ছিল। ওই বিলাসবহুল পশমের কোটটা পরনে ছিল আর ছোট চাইনিজ বার্ণিশ
লাল রঙের হ্যাট যা তার চোখের ওপর চেপে বসানো ছিল, আর কানের ওপর কয়েকটা লালচে রঙের পাকানো চুল, এটা কোনো আশ্চর্যের ব্যাপার নয় যে কন্ডাক্টরটি ধোঁকা খেয়ে গেছিলো। আপনার
নিশ্চই মনে আছে,
সে আগে কখনো মিসেস কেটারিংয়ের সাথে কথা বলে নি। একথা সত্যি
যে সে কয়েক মুহূর্তের জন্য পরিচারিকাটিকে দেখেছিলো যখন সে টিকিটগুলো তাকে দেয়, কিন্তু তার প্রভাবটা খুবই সাধারণ এবং দুর্বল ছিল, কালো পোশাক পরিহিতা একজন নারী। সে যদি অস্বাভাবিক বুদ্ধিমান একজন মানুষ হতো, তাহলে অন্তত এতদূর অবধি বলতে পারতো যে মালকিন এবং পরিচারিকাকে একই রকম দেখতে
ছিল, কিন্তু সে যে এরকম কিছু চিন্তা করবে সেটাই খুব অস্বাভাবিক একটা ব্যাপার। আর
মনে রাখবেন,
অ্যাডা ম্যাসন, বা কিটি কিড, একজন অভিনেত্রী,
আর নিজের চেহারা এবং গলা মুহূর্তের মধ্যে বদলে ফেলতে পারতো।
না, না, মালকিনের পোশাকে পরিচারিকাটিকে যে সে চিনতে পারবে এমন কোনো ভয়ই ছিল না, কিন্তু একটা ভয় ছিল যে যখন দেহটা আবিষ্কার হবে সে হয়তো বুঝতে পারবে যে ইনি সেই
মহিলা নন যার সঙ্গে তার গত রাত্রে কথা হয়েছিল। আর এবার আমরা মুখ বিকৃত করার কারণটা
বুঝতে পারলাম। অ্যাডা ম্যাসনের জন্য সবথেকে বড় বিপদ ছিল ট্রেন প্যারিস ছাড়ার পর
মিস গ্রে যদি তার কম্পার্টমেন্টে আসেন, আর সেই সমস্যার সমাধানের
জন্য সে ডিনার বাস্কেটের অর্ডার দেয় এবং নিজের কম্পার্টমেন্টের দরজা বন্ধ করে
রাখে।"
"কিন্তু রুথকে কে
মারলো এবং কেন?"
"প্রথমে, এটা মনে রাখবেন যে অপরাধটার পরিকল্পনা এবং কার্যকর করেছিল দুজনে মিলে - নাইটোন
এবং অ্যাডা ম্যাসন,
একসাথে কাজ করছিলো। নাইটোন সেদিন আপনার কাজে প্যারিসে ছিল।
ট্রেন প্যারিসে ঢোকার আগে ঘোরানো পথের কোন এক জায়গা থেকে সে ট্রেনে চড়েছিল। মিসেস
কেটারিং হয়তো অবাক হয়েছিলেন, কিন্তু কোনো সন্দেহ করেন
নি। সম্ভবত জানলার বাইরে কোনো কিছুর দিকে সে তাঁর দৃষ্টি আকর্ষণ করে, আর তিঁনি যখন সেটা দেখতে যান সেই সুযোগে সে তাঁর গলায় দড়ির ফাঁসটা লাগিয়ে দেয়
- আর দু এক সেকেন্ডের মধ্যে পুরো ব্যাপারটা ঘটে যায়। কম্পার্টমেন্টের দরজাটা ভেতর
থেকে বন্ধ করে দেওয়া হয়,
আর সে এবং অ্যাডা ম্যাসন নিজেদের কাজ শুরু করে দেয়। তারা
মৃতা মহিলার ওপরের জামা কাপড়গুলো খুলে নেয়। ম্যাসন এবং নাইটোন দেহটা একটা
কার্পেটের মধ্যে পাকিয়ে পাশের কম্পার্টমেন্টে ব্যাগ এবং সুটকেসের সাথে সিটের ওপর
রাখে। নাইটোন রুবিগুলো সমেত গয়নার বাক্সটা নিয়ে ট্রেন থেকে নেমে যায়। যেহেতু
অপরাধটা আরো প্রায় বারো ঘন্টা পরে ঘটেছে বলে ধরে নেওয়া হবে সে সম্পূর্ণ রূপে
নিরাপদ, আর তার সাক্ষ্য এবং সাজানো মিসেস কেটারিংয়ের কন্ডাক্টরের সাথে কথোপকথন তার
সহযোগীর জন্য অকাট্য অ্যালিবাই তৈরি করে দেবে।"
"গারে ডি লিওনে
অ্যাডা ম্যাসন একটা ডিনার-বাস্কেট নেন, তারপর কম্পার্টমেন্টের
টয়লেটে ঢুকে সে তারতারি তার মালকিনের পোশাক পরে নেয়, দুটো নকল লালচে পাকানো চুল লাগায়, আর যতটা সম্ভব তাঁর মতো
করে প্রসাধন করে নেয়। যখন কন্ডাক্টরটি বিছানা করতে আসে, সে তাকে পরিচারিকাকে প্যারিসে নামিয়ে দেওয়ার তৈরি করা গল্পটা বলে, আর কন্ডাক্টরটি যখন বিছানা করছিলো সে দাঁড়ানো অবস্থায় জানলা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে
থাকে, যাতে তাঁর পেছনদিকটা করিডোরের দিকে থাকে যেখান দিয়ে লোকজন চলাচল করছিলো। এটা একটা
বুদ্ধিমানের মতো সাবধানতা,
কারণ, আমরা জানি, অন্য আরো সব যাত্রীদের মধ্যে মিস গ্রে একজন যিনি ওখান দিয়ে যাচ্ছিলেন, এবং উনি দিব্বি দিয়ে বলবেন যে ওই সময় মিসেস কেটারিং বেঁচে ছিলেন।"
"বলে যান," ভ্যান আলদীন বললেন।
"লিওনে ঢোকার ঠিক
আগে, অ্যাডা ম্যাসন তার মালকিনের দেহটা বাঙ্কে সাজিয়ে রাখে, মৃতা মহিলার পোশাকগুলো ভাঁজ করে বাঙ্কের এক ধারে রাখে, আর নিজে পোশাক পাল্টে পুরুষের পোশাক পরে ট্রেন থেকে নামার জন্য তৈরি হয়। যখন
ডেরেক কেটারিং তাঁর স্ত্রীর কম্পার্টমেন্টে ঢোকেন, আর ভাবেন,
যে তিঁনি তাঁর স্ত্রীকে বার্থে ঘুমিয়ে থাকতে দেখেছেন, ততক্ষনে ঘটনাস্থল সাজানো হয়ে গেছে, আর অ্যাডা ম্যাসন পাশের
কম্পার্টমেন্টে লুকিয়ে আছেন এবং সবার চোখে ধুলো দিয়ে ট্রেন থেকে নেমে যাওয়ার জন্য
অপেক্ষা করছেন। কন্ডাক্টরটি লিওনে প্লাটফর্মে নামতেই, সে ও নেমে পরে,
পেছনে ঝুঁকে ভান করে যেন টাটকা বাতাস নিচ্ছে। যেই মুহূর্তে সে বুঝতে পারলো যে তার দিকে কেউ তাকাচ্ছে না, সে তাড়াতাড়ি প্লাটফর্ম পরিবর্তন করে অন্য প্লাটফর্মে চলে গেলো, এবং প্রথম যে ট্রেনটা এলো সেটা ধরে প্যারিসের রিট্জ হোটেলে পৌঁছে গেলো। তার
নাম সেখানে তার আগের রাতেই নাইটোনের এক মহিলা সঙ্গিনী একটা ঘর নেওয়ার জন্য
রেজিস্টার করে রেখেছিলো। তার সেখানে কিছুই করার ছিল না, শুধু শান্তভাবে আপনার আসার অপেক্ষা করা ছাড়া। রত্নগুলো কখনোই তার কাছে ছিল না।
সেগুলো নাইটোনের কাছে ছিল। তার ওপরে কোনো সন্দেহ ছিল না, আর আপনার সেক্রেটারি হিসেবে, সে ওগুলো নিয়ে নাইসে আসে
কেউ কিছু জানতে পাড়ার ন্যূনতম ভয় ছাড়াই। সেগুলো মসিয়েঁ পাপপুলাউসের কাছে পাচার
করার সমস্ত পরিকল্পনা আগে থেকেই করা ছিল আর শেষ মুহূর্তে ম্যাসনকে দায়িত্ব দেওয়া
হয় সেগুলো গ্রিক ভদ্রলোকটির হাতে তুলে দেওয়ার জন্য। সবমিলিয়ে, একটা খুব সুন্দরভাবে পরিকল্পিত এক সফল অভিযান, যা মারকুইসের মতো এই খেলার এক মহারথীর কাছ থেকে আশা করা যায়।"
"আর আপনি সত্যিই মনে
করেন যে রিচার্ড নাইটোন একজন দাগি অপরাধী, যে এই কাজ বছরের পর বছর
ধরে করে আসছে?"
পোয়ারো মাথা নাড়লেন।
"মারকুইস নামের
ভদ্রলোকটির একটা বড় সম্পদ হচ্ছে তার শান্ত এবং বিনীত আচরণ। আপনিও তার এই মধুর
ব্যবহারের শিকার হয়ে তাকে এই অল্প পরিচয়েই নিজের সেক্রেটারি হিসেবে নিযুক্ত
করেন।"
"আমি শপথ করে বলতে
পারি সে কখনই এই পোস্টের ব্যাপারে আগ্রহ দেখায় নি," ধনকুবেরটি চিৎকার করে বললেন।
"এটা খুব চতুরতার
সাথে করা হয়েছে - এতটাই চতুর ভাবে যে আপনার মতো মানুষ যার অন্য মানুষকে চেনার এতো
অভিজ্ঞতা তিঁনিও ধোঁকা খেয়ে গেছেন।"
"আমি ওর প্রাক
পরিচয়গুলোও যাচাই করেছিলাম। লোকটার প্রমাণপত্রগুলো অসাধারণ।"
"হ্যাঁ, হ্যাঁ,
এগুলোও খেলার একটা অংশ। রিচার্ড নাইটোন হিসেবে তার জীবনে
কোনো কলঙ্ক নেই। সে ভালো ঘরে জন্মেছে, যোগা-যোগ ভালো, যুদ্ধের সময় দেশের সম্মানজনক সেবা করেছে, আর সবমিলিয়ে যে কোনো
সন্দেহের ওপরে;
কিন্তু যখনি আমি এই রহস্যময় মারকুইসের ব্যাপারে তথ্য সংগ্রহ
করছিলাম,
তখন আমি বেশ কয়েকটা বিষয়ে সাদৃশ্য দেখতে পেলাম। নাইটোন
ফরাসি ভাষা ফরাসিদের মতো বলে, সে আমেরিকা, ফ্রান্স এবং ইংল্যান্ডে একই সময়ে উপস্থিত ছিল যখন সেখানে মারকুইসের কান্ড
কারখানা চলছিল। মারকুইসের ব্যাপারে শেষ খবর পাওয়া যায় যখন সে সুইজারল্যান্ডে
কয়েকটা গয়নার ডাকাতি চালাচ্ছিল আর সুইজারল্যান্ডেই আপনার সাথে মেজর নাইটোনের প্রথম
পরিচয় হয়;
আর এটা একেবারে সেই সময়ে যখন আপনার বিখ্যাত রুবিগুলো কেনার
ব্যাপারে গুজবগুলো প্রথম শোনা যায়।"
"কিন্তু খুনটা কেন?" ভ্যান আলদীন ভাঙা গলায় বিড়বিড় করে বললেন। "একজন বুদ্ধিমান চোর নিশ্চিত
ভাবেই ফাঁসির দড়িতে নিজের গলাটা না দিয়ে খালি রত্নগুলো চুরি করতে পারতো।"
পোয়ারো তাঁর মাথা
ঝাঁকালেন। "এটাই মারকুইসের প্রথম খুন নয়। সে সহজাতভাবেই একজন খুনি; সে এটাও বিশ্বাস করে যে, অপরাধের কোনো চিহ্ন রাখা
চলবে না। মৃত পুরুষ বা মহিলা কোনো সাক্ষ্য দিতে পারবে না।"
"মারকুইসের বিখ্যাত
এবং ঐতিহাসিক রত্নগুলোর প্রতি একটা তীব্র আবেগ ছিল। সে নিজেকে আপনার সেক্রেটারির
পদে প্রতিষ্ঠিত করে আর নিজের সহযোগীকে আপনার মেয়ের পরিচারিকা বানায়, যার কাছে শেষপর্যন্ত রত্নগুলো পৌঁছবে আন্দাজ করে, আগে থেকেই নিজের পরিকল্পনা তৈরী করেছিল। আর যদিও এটা বেশ পরিপক্ক এবং বেশ
চিন্তাভাবনা করে বানানো একটা পরিকল্পনা, তবুও প্যারিসে যে রাত্রে
আপনি রত্ন গুলো কেনেন,
সে রাত্রে দুটো উত্তর আমেরিকান গুন্ডাকে ভাড়া করে আপনার ওপর
রাস্তায় ছিনতাই করার চেষ্টা করার সহজ পথ নিতেও সে দ্বিধাগ্রস্ত হয় নি। পরিকল্পনাটা
ব্যার্থ হয়,
আমার মনে হয়, তাতে সে মোটেই খুব একটা
অবাক হয় নি। এই পরিকল্পনাটা, তার মনে হয়েছিল একেবারেই
নিরাপদ। রিচার্ড নাইটোনের ওপর কেউ কোনো সন্দেহই করতে পারবে না। কিন্তু প্রত্যেক
মহান পুরুষদের মতো - আর মারকুইস একজন মহান পুরুষ ছিলেন - তার দুর্বলতাও ছিল। সে
সত্যি সত্যি মিস গ্রের প্রেমে পরে যায়, আর সন্দেহ করে ডেরেক
কেটারিংয়ের প্রতি তাঁর দুর্বলতা, তাই যখনি সুযোগ আসে সে
অপরাধের সব দায় তাঁর ওপরে চাপানোর লোভ থেকে নিজেকে নিবৃত্ত করতে পারে না। আর এবার, মসিয়েঁ ভ্যান আলদীন,
আমি আপনাকে খুব অদ্ভুত একটা ঘটনার কথা বলতে চলেছি। মিস গ্রে
কখনোই একজন কাল্পনিক গালগল্প করার মতো মহিলা নন, তবুও তিঁনি স্থির ভাবেই বিশ্বাস করেন যে তিঁনি একদিন মোন্টে কার্লোর ক্যাসিনো
গার্ডেনে তাঁর পাশে আপনার মেয়ের উপস্থিতি অনুভব করেছেন, নাইটোনের সাথে একটা লম্বা হাঁটাহাঁটি করার ঠিক পরেই। তিঁনি বলেছেন, যে তিঁনি নিশ্চিত ছিলেন, মৃতা মহিলা তাঁকে জরুরি
ভিত্তিতে কিছু বলতে চাইছিলেন, আর এটা হঠাৎই তাঁর মনে হয়
যে মৃতা মহিলা বলতে চাইছিলেন যে নাইটোনই তাঁর খুনি! ব্যাপারটা এতটাই অদ্ভুত যে সেই
সময়ে মিস গ্রে এব্যাপারে কাউকেই কিছু বলেন নি। কিন্তু এটার সত্যতার ব্যাপারে তিঁনি
এতটাই নিশ্চিত ছিলেন যে তিঁনি এটা নিয়ে নিজের মতো এগোতে থাকেন - যেটাকে পরিকল্পনাহীন
বলে মনে হতে পারে। তিঁনি নাইটোনের প্রস্তাবে তাকে নিরুৎসাহ করেন না, আর তিঁনি এমন ব্যবহার করতে থাকেন যেন তিঁনি ডেরেক কেটারিংয়ের অপরাধের ব্যাপারে
নিশ্চিত।"
"অসাধারণ," ভ্যান আলদীন বললেন।
"হ্যাঁ, এটা বেশ অদ্ভুত ব্যাপার। এগুলো ঠিক ব্যাখ্যা করা যায় না। ওহ, ভালো কথা,
আর একটা ছোট বিষয় যা আমাকে বারবার হতচকিত করে দিয়েছে। আপনার
সেক্রেটারি লক্ষণীয় ভাবেই খোঁড়াতো - যুদ্ধের সময় পাওয়া একটা আঘাতের কারণে। আর
মারকুইস একদম লক্ষণীয় ভাবেই খোঁড়ায় না।
এটা একটা বিশাল প্রতিবন্ধক ছিল। কিন্তু লেনক্স ট্যাম্পলিং একদিন কথা প্রসঙ্গে
জানান যে নাইটোনের খোঁড়ানোটা ওই সার্জেন, যিনি তাঁর মায়ের
হাসপাতালে এই কেসের দায়িত্বে ছিলেন, তাঁর কাছেও অবাক হওয়ার
মতো বিষয় ছিল। এটাই ছদ্মবেশের সন্দেহটা জাগিয়ে তোলে। আমি যখন লন্ডনে গিয়েছিলাম, তখন ওই সার্জেনের সাথে দেখা করি, আমি তাঁর কাছ থেকে বেশ
কিছু প্রযুক্তিগত বিবরণ পাই যা আমার সন্দেহকে বিশ্বাসে পরিণত করে। আমি সেই
সার্জেনের নাম গত পরশুদিন নাইটোনের হিয়ারিঙের সময় সময়ে উল্লেখ করেছি। সাধারণভাবে
এটা নাইটোনের উল্লেখ করার কথা যে তিঁনি যুদ্ধের সময়ে তার চিকিৎসা করেছিলেন, কিন্তু সে কিছুই বলে নি - আর এই ছোট্ট বিষয়টা, আর কিছু না হলেও,
আমাকে শেষ চূড়ান্ত আশ্বাসটা দিয়েছে যে অপরাধের ওপর আমার
তত্ত্বটা একদম সঠিক। মিস গ্রেও, আমাকে খবরের কাগজের একটা
কাটিং দিয়েছেন,
যেখানে দেখা যাচ্ছে নাইটোন যখন ওখানে ছিল লেডি
ট্যাম্পলিংয়ের হাসপাতালে একটা ডাকাতি হয়েছিল। আমি যখন তাঁকে প্যারিসে রিট্জ থেকে
চিঠি দি তখন তিঁনি বুঝতে পারেন যে আমিও একই রাস্তায় হাঁটছি।
"ওখানে তদন্তের সময়ে
কিছু সমস্যা হয়েছিল,
কিন্তু আমি যা চাইছিলাম তা পেয়ে যাই - এই প্রমান যে অ্যাডা
ম্যাসন অপরাধের পরদিন সকালে পৌঁছয় আগেরদিন রাতে নয়।"
একটা লম্বা নীরবতা, তারপর ধনকুবেরটি টেবিলের অপরপ্রান্তে পোয়ারোর দিকে তাঁর হাত বাড়িয়ে দিলেন।
"আশা করি আপনি জানেন
যে আমার কাছে এটা কতখানি,
মসিয়েঁ পোয়ারো," তিঁনি ফ্যাঁসফ্যাঁসে গলায় বললেন। "আমি সকালে আপনাকে একটা চেক পাঠাচ্ছি, কিন্তু পৃথিবীতে কোনো চেক একথা ব্যাক্ত করতে পারবে না যে আপনি আমার জন্য যা
করেছেন সে সম্পর্কে আমার অনুভব ঠিক কি রকম। আপনিই শ্রেষ্ঠ, মসিয়েঁ পোয়ারো। চিরকালের জন্য, আপনিই শ্রেষ্ঠ।"
পোয়ারো উঠে দাঁড়ালেন; তাঁর বুক ফুলে উঠলো।
"আমি কেবল মাত্র
এরকুল পোয়ারো,"
তিঁনি বিনীতভাবে বললেন, "তবুও,
যেরকমটা আপনি বললেন, আমার দিক থেকে আমি একজন
বড় মানুষ,
আপনার দিক থেকে আপনিও একজন বড় মানুষ। আমি খুশি এবং তৃপ্ত যে
আমি আপনার সেবা করতে পেরেছি। এবার এই সব ঘোরাঘুরির ফলে যা ক্ষতি হয়েছে সেগুলো
মেরামত করতে যাবো। হয়! আমার অসাধারণ জর্জেস আজ আমার সঙ্গে নেই।"
হোটেলের লাউঞ্জে তাঁর
সঙ্গে একজন বন্ধুর দেখা হয়ে গেলো - প্রবীণ মসিয়েঁ পাপপুলাউসের সাথে, পাশে তাঁর মেয়ে জিয়া।
"আমি ভেবেছিলাম আপনি
নাইস থেকে চলে গেছেন,
মসিয়েঁ পোয়ারো," গোয়েন্দাটির ভালোবাসার সাথে বাড়িয়ে দেওয়া হাতটা ধরে গ্রীকটি বিড়বিড় করে বললেন।
"কাজ আমাকে ফিরতে
বাধ্য করলো,
হে প্রিয় মসিয়েঁ পাপপুলাউস,"
"কাজ?"
"হ্যাঁ, কাজ। আর কাজের কথা বলতে গেলে, আশা করি আপনার স্বাস্থ
এখন ভালো আছে,
হে প্রিয় বন্ধু?"
"অনেকটা ভালো। সত্যি
বলতে কি,
আগামী কাল আমরা প্যারিস ফিরে যাচ্ছি।"
"এই সুসংবাদটা শুনে
আমি আনন্দিত। আশা করি,
আপনি প্রাক্তন গ্রিক মন্ত্রীটিকে পুরোপুরি সর্বশান্ত করে
দেন নি।"
"আমি?"
"আমি মনে করি যে
আপনি ওনাকে খুব চমৎকার একটা রুবি বিক্রি করেছেন যেটা - কঠোরভাবে আমাদের মধ্যেই কেবল - নৃত্যশিল্পী, মাদমোয়েজেল মিরেলে ব্যবহার করছেন।"
"হ্যাঁ," মসিয়েঁ পাপপুলাউস বিড়বিড় করে বললেন, "হ্যাঁ,
এরকমটাই।"
"বিখ্যাত 'হার্ট অফ ফায়ার'
এর মতো রুবি কি?"
"নিশ্চিতভাবেই, কিছু বিষয়ে সাদৃশ্য আছে," গ্রীকটি সরলতার সাথে
বললেন
"রত্নের ওপর আপনার
হাত অসাধারণ,
মসিয়েঁ পাপপুলাউস। আমি আপনাকে অভিনন্দন জানাচ্ছি। আপনি এতো
তাড়াতাড়ি প্যারিস ফিরে যাচ্ছেন বলে আমি নিঃসঙ্গ হয়ে পড়লাম মাদমোয়েজেল জিয়া। এখন
আমার কাজটাও শেষ হয়ে গেছে বলে আপনার সাথে আরো বেশি সময় কাটানোর আশা
করেছিলাম।"
"কাজটা কি ছিল সেটা
জিজ্ঞেস করলে কি অবিবেচকের মতো হবে?" মসিয়েঁ পাপপুলাউস প্রশ্ন করলেন।
"একেবারেই না, একেবারেই না,
মাত্র কিছুদিন আগেই আমি মারকুইসকে ধরতে সফল হয়েছি।"
মসিয়েঁ পাপপুলাউসের মুখ
থেকে বিদগ্ধ ভাবটা সরে গিয়ে একটা চিন্তিত ভাব ফুটে উঠলো।
"মারকুইস?" তিঁনি বিড়বিড় করে বললেন, "এটা আমার শোনা শোনা লাগছে
কেন? না - ঠিক মনে করতে পারছি না।"
"আপনি পারবেন না, আমি নিশ্চিত,"
পোয়ারো বললেন। "আমি একজন খুব নামকরা অপরাধী এবং রত্ন
ডাকাতের কথা বলছিলাম। সে এই কিছুদিন হলো একজন ইংরেজ মহিলা, মাদাম কেটারিংয়ের খুনের ব্যাপারে গ্রেফতার হয়েছে।"
"তাই নাকি? কি অদ্ভুত এই ব্যাপার স্যাপারগুলো!"
তারপর খুব মার্জিতভাবেই
বিদায়ের ব্যাপারটা চুকলো,
আর পোয়ারো যখন শুনতে পাওয়ার মতো দূরত্বের বাইরে। মসিয়েঁ পাপপুলাউস
তাঁর মেয়ের দিকে ফিরলেন।
"জিয়া," তিঁনি অনুভূতির সাথে,
বললেন, "এই লোকটা অশুভ।"
"আমি ওনাকে পছন্দ
করি।"
"আমি নিজেও ওনাকে
পছন্দ করি,"
মসিয়েঁ পাপপুলাউস স্বীকার করলেন, "কিন্তু,
তা সত্ত্বেও, এই লোকটা অশুভ।"
চ্যাপ্টার ৩৬
সমুদ্রের ধারে
লতানে গাছগুলোর গুলোর
মরসুম প্রায় শেষে হয়ে এসেছে। বাতাসে তাদের মৃদু গন্ধটা এখন অমনোরম। গোলাপি
জেরানিয়ামের জোড়া এখন লেডি ট্যাম্পলিংয়ের ভিলার ছাদ, সিঁড়ি,
ব্যালকনির রেলিং জুড়ে লাগানো হয়েছে, আর নিচের কার্নেশনের ঝাড় থেকে জোরালো, মিষ্টি সুগন্ধ ভেসে আসছে।
ভূমধ্যসাগর এখন গভীর নীল। পোয়ারো ছাদের ওপর লেনক্স ট্যাম্পলিংয়ের সাথে বসে ছিলেন।
তিনি একই গল্প যেটা দু দিন আগে ভ্যান আলদীনকে শুনিয়েছেন সেটাই সবেমাত্র বলা শেষ
করলেন। লেনক্স সম্পূর্ণ মনোযোগ দিয়ে তাঁর কথা শুনছিলো। তার ভুরুগুলো কোচকানো এবং
চোখ ছল ছল।
তিনি শেষ করলে সে শুধু
প্রশ্ন করলো: "আর ডেরেক?"
"তাঁকে গতকাল ছেড়ে
দেওয়া হয়েছে।"
"আর তিনি গেছেন -
কোথায়?"
"কাল রাতেই তিনি
নাইস ছেড়ে রওনা দিয়েছেন ।"
"সেইন্ট মেরি মিডের
উদ্দেশ্যে?"
"হ্যাঁ, সেইন্ট মেরি মিডের উদ্দেশ্যে।"
কিছুক্ষন নীরবতা।
"ক্যাথেরিনের
সম্পর্কে আমার ধারণা ভুল ছিল।" লেনক্স বললো, "আমি ভেবেছিলাম উনি ডেরেকের জন্য চিন্তিত নন।"
"উনি খুবই চাপা
স্বভাবের। উনি কাউকেই বিশ্বাস করেন না।"
"উনি আমাকে বিশ্বাস
করতে পারতেন,"
লেনক্স একটু তিক্ততার সাথে বললো।
"হ্যাঁ," পোয়ারো গম্ভীর ভাবে বললেন, "উনি আপনাকে বিশ্বাস করতে
পারতেন। কিন্তু মাদমোয়েজেল ক্যাথেরিন তাঁর জীবনের বেশিরভাগ সময়টা অন্যের কথা শুনে
কাটিয়েছেন,
আর যাঁদের কথা শোনাটাই অভ্যাস তাঁদের পক্ষে কথা বলতে পারাটা
সহজ নয়; তাঁরা তাঁদের দুঃখ আনন্দ সবই নিজেদের মধ্যে রাখেন কাউকে বলেন না।"
"আমি একটা গাধা
ছিলাম,"
লেনক্স বললো, "আমি ভেবেছিলাম উনি সত্যি সত্যি নাইটোনকে পছন্দ করেন। আমার ব্যাপারটা বোঝা উচিত
ছিল। মনে হয় আমি এরকমটা ভেবেছিলাম কারণ - আসলে, আমি এরকমটাই আশা
করেছিলাম।"
পোয়ারো তার হাতটা ধরলেন
এবং একটা বন্ধুত্বপূর্ণ চাপ দিলেন। "সাহস, মাদমোয়েজেল," তিনি আস্তে করে বললেন।
লেনক্স একদম সোজা
সমুদ্রের দিকে তাকিয়ে রইলো,
আর তার মুখে, দৃষ্টিকটু কাঠিন্যের জায়গায়
সেই মুহূর্তে একটা বিষাদময় সৌন্দর্য ফুটে উঠলো।
"ওহ, আচ্ছা,"
সে অবশেষে বললো, "এটা সম্ভবও হতো না। ডেরেকের পক্ষে আমার বয়স অনেকটা কম: উনি একটা বাচ্ছা ছেলের
মতো যার বয়স বাড়ে নি। উনি ম্যাডোনার স্পর্শ চান।"
একটা লম্বা নীরবতা, তারপর সে তাড়াতাড়ি এবং আবেগপ্রবণ ভাবে তাঁর দিকে ঘুরলো। "কিন্তু আমি
সাহায্য করেছিলাম,
মসিয়েঁ পোয়ারো - সামান্য হলেও, আমি সাহায্য করেছিলাম।"
"হ্যাঁ, মাদমোয়েজেল। আপনিই আমাকে সত্যির প্রথম আভাসটা দিয়েছিলেন যখন বলেছিলেন যে
অপরাধী সেই ট্রেনেই সফর করছিলো এমনটা নাও হতে পারে। তার আগে, ঘটনাটা ঠিক কি ভাবে ঘটেছে আমি তা বুঝতে পারছিলাম না।"
লেনক্স একটা গভীর স্বাস
নিলো।
"আমি খুব খুশি," সে বললো,
"যাই হোক না কেন, এটা একটা উল্লেখযোগ্য
ঘটনা।"
তাঁদের পেছন দিকে অনেক
দূর থেকে একটা ইনজিনের হুইসিলের লম্বা আর্তনাদ শোনা গেলো।
এটাই সেই অভিশপ্ত দ্যা
ব্লু ট্রেন,"
লেনক্স বললো, "ট্রেনগুলো নিরন্তর চলতেই থাকে, তাই না, মসিয়েঁ পোয়ারো?
মানুষ মারা যায়, খুন হয়, কিন্তু তারা একই রকম ভাবে চলতে থাকে। আমি উল্টোপাল্টা বকছি, কিন্তু আপনি জানেন আমি কি বোঝাতে চাইছি।"
"হ্যাঁ, হ্যাঁ,
আমি জানি। জীবন একটা ট্রেনের মতো, মাদমোয়েজেল। চলতেই থাকে। আর এটা এরমকম বলেই এটা ভালো।"
"কেন?"
"কারণ ট্রেন
শেষপর্যন্ত তার যাত্রার শেষ সীমানায় পৌঁছয়, আর এর ওপরে আপনার ভাষায়
একটা প্রবাদ আছে,
মাদমোয়েজেল।"
"'প্রেমিক প্রেমিকার মিলনেই যাত্রার সমাপ্তি হয়।'" লেনক্স হেসে উঠলো,
"আমার দিক থেকে কিন্তু এটা সত্যি হতে যাচ্ছে না।"
"হ্যাঁ, হ্যাঁ,
এটা সত্যি। আপনি অল্পবয়স্ক,
আপনি নিজেকে যতটা ভাবেন তারথেকেও অনেকটা অল্পবয়স্ক। ট্রেনের
ওপর বিশ্বাস রাখুন,
মাদমোয়েজেল, কারণ মঙ্গলময় ঈশ্বর এটা
চালাচ্ছেন।"
আবার ট্রেনের হুইসিল শোনা
গেলো।
"ট্রেনের ওপর
বিশ্বাস রাখুন,
মাদমোয়েজেল, "পোয়ারো আবার বিড়বিড় করে বললেন, "আর এরকুল পোয়ারোর ওপর বিশ্বাস রাখুন। সে সব জানে।"
Comments & Reviews (0)
No comments yet :(