A‡cÿv
KvwbR dv‡Zgv ivweZv
জিনিয়া অনেক্ষন যাবত ছোট পুকুর টার সামনে বেঞ্চিতে বসে আছে। নার্স ৩বার এসে বলে গেছেঃ আজ বৃষ্টি নামবেনা, তুমি ভেতরে চলে এসো।
কিন্তু জিনিয়ার দৃঢ় বিশ্বাস বৃষ্টি নামবে। কারন ও জানে ওর মন একবার যা বলে তাই হয়। আর হলো ও তাই। ৫ মিনিট না যেতেই ঝুম বৃষ্টি শুরু হলো। জিনিয়া লক্ষ করলো ৪ তলা থেকে নার্স ওর দিকে তাকিয়ে আছে। কিন্তু এতো নিচ থেকে নার্সের মুখের অভিব্যক্তি ও ঠিক বুঝতে পারলোনা।
জিনিয়া বেঞ্চের উপর বসে এক দৃষ্টিতে পানির উপর বৃষ্টির ফোটা পড়ার দৃশ্য দেখছে। এক জায়গায় বসে বসেই ও ভিজে নিচ্ছে। বৃষ্টি শেষ না হওয়া পর্যন্ত ও এভাবেই বসে রইলো। বৃষ্টি শেষ হলে ও পুকুরের টলটলে জলের ভিতর ওর প্রতিবিম্ব দেখতে পেলো। জলের মধ্যেও ও ঠিক ওর লাল গাল দুটো লক্ষ্য করলো, সেই সাথে লেপ্টে থাকা কপালে হালকা বাদামি চুল। ওর নাকের ডগা থেকে পানির ফোটা সোজা ওর প্রতিবিম্বের উপর পড়লো। জলের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে হঠাৎ ওর মাথায় ব্যাথা অনুভূত হলো। ও ধীরে ধীরে উঠে ওর কেবিনে গেলো। একটা নার্স ওর সামনে পড়লে ও জিজ্ঞেস করলোঃ নার্স, আমার আম্মু কোথায় ?
নার্স তোতলাতে তোতলাতে বললোঃ তো-তোমার আম্মু?
t হ্যা আম্মু না এখানেই ছিলো?
t ও হ্যা দাড়াও আমি দেখছি।
এই বলে নার্স দ্রুত চলে গেলো। জিনিয়া ভেজা কাপড় ছেড়ে ওর মায়ের জন্য অপেক্ষা করতে লাগলো। ওর মাথা ব্যাথা ক্রমশ বাড়তেই লাগলো। ওর মায়ের হাতে মালিশ না করানো পর্যন্ত এই ব্যাথা ভালো হবেনা। প্রায় আধ ঘন্টা পর ওর মা এলো।
t কোথায় গিয়েছিলে?
জিনিয়া শুয়ে থাকা অবস্থায় জিজ্ঞেস করলো।
ওর মা কাদঁতে কাদঁতে ওর কাছে এসে বললোঃ তুমিই বলেছিলে…তৎক্ষনাৎ চোখের পানি মুছে বললোঃ তুমি নিচে বসেছিলে তাই ডাকিনি। আমি একটু কাজে বাইরে গিয়েছিলাম।
t কাদঁছো কেনো আম্মু, আমি তো এখন সুস্থ আছি। শুধু মাথাটা একটু ব্যাথা করছে। মালিশ করে দিবে?
জিনিয়ার মা কিছুক্ষন মালিশ করার পরই ওর চোখ বন্ধ হয়ে এলো। জিনিয়া ঘুমিয়ে গেলে ওর মা ডাক্তারের রুমে গেলো আলাপ করতে। জিনিয়ার হঠাৎ এমন আচরনে সে খুব কষ্ট পেয়েছে। ডাক্তারকে দেখে মনে হলো যেনো সে তার জন্যেই অপেক্ষা করছিলো। জিনিয়ার মা বিচলিত হয়ে চেয়ারে বসলো। ডাক্তারই প্রথম বললোঃ জিনিয়া কি আবারো আপনাকে দেখে অদ্ভুদ আচরন করেছে?
t না এখন ও স্বাভাবিক আছে।কিন্তু ডাক্তার, ওর এরকম করার মানে কি?ওর কেনো মনে হলো যে আমি ওকে মেরে ফেলবো?
ডাক্তার চিন্তিত ভাবে বললোঃ আমি এই বিষয় নিয়েই এতাক্ষন ভাবছিলাম। একটা বিষয় বুঝতে পারলাম যে ভবিষ্যতে ও এরকম আচরন আবারো করতে পারে।
জিনিয়ার মা আতংকিত হয়ে বললোঃ কি বলছেন!
t ঠিকই বলছি। আপনি বলেছিলেন যে কিছুদিন আগে জিনিয়া স্কুলে যাওয়ার কথা বলছিলো অথচ অসুস্থতার কারনে গত ৭মাস ধরে ওর পড়ালেখা বন্ধ?
t হ্যা, সেদিন হঠাৎ করে ও ওর ব্যাগে বই খাতা গোছাচ্ছিলো আর বলছিলো কালকে সকাল ৮টায় ক্লাস, ওকে যেনো ঘুম থেকে ডেকে দেই।
t পরের দিন সে সত্যিই ক্লাসে গেয়েছিলো?
t না। সকালে উঠে ও ক্লাসের ব্যাপারে ভুলেই গিয়েছিলো।
ডাক্তার মাথা দুলিয়ে বললোঃ হুম, আর আজ আপনাকে দেখে ভয় পাচ্ছিলো। তার ধারনা আপনি তার ক্ষতি করবেন তাইতো?
জিনিয়ার মা মাথা নাড়লো।
ডাক্তার আবার বললোঃ আচ্ছা আমাকে একটা কথা বলুন, অতীতে আপনার আর ওর মধ্যে এমন কিছু ঘটেছিলো?
জিনিয়ার মা যেনো কথাটা শুনে আৎকে উঠলেন। তিনি কিছু বললেন না, নীরবে কাদঁতে লাগলেন।
t আমার ধারনা জিনিয়ার মস্তিষ্কের রোগ ধীরে ধীরে ডিমেনশিয়ায় রূপ নিচ্ছে।
t ডিমেনশিয়া? সেটা কি জিনিস? জিনিয়ার মা মুখ তুলে বললেন।
t বর্তমানের কিছু জিনিস ভুলে যাওয়া অথবা ধীরে ধীরে স্মৃতি নষ্ট হয়ে যাওয়া যাকে আমরা মেডিকেলের ভাষায় ডিমেনশিয়া বলে থাকি।
t তার মানে ও সব কিছু ভূলে যাবে?
t সব কিছু ভুলে যাবে তা নয়। ব্যাপার টা এমন যে সে তার বর্তমান অস্তিত্ব সম্পর্কে ভূলে যাবে এবং তার মনে হবে যে সে অতীতে অবস্থান করছে। যেমনটি সে মনে করেছিলো যে সে এখনো স্কুলের ছাত্রী। এবং আপনাকে ভয় পাওয়ার বিষয় টা।
t তাহলে এটা কিভাবে ভালো হবে ডাক্তার?
t ডিমেনশিয়ার কোনো চিকিৎসা নেই। একবার ডিমেনশিয়া হলে সেটা দিনে দিনে ভয়ংকর রুপ নেয়। এক সময় রোগী সব স্মৃতি নষ্ট ও হয়ে যেতে পারে। তাই এখন থেকেই ওর প্রতি যত্নশীল হওয়া উচিত।
ডাক্তারের রুম থেকে বের হবার পর জিনিয়ার মা নানান বিষয়ে ভাবতে লাগলেন। জিনিয়ার জন্মের ৭ বছর পর হঠাৎ তার মাথায় সমস্যা দেখা দিয়েছিলো। জিনিয়াকে দেখলেই নাকি তিনি ওর গলা টিপে ধরতেন। আরো অনেক অদ্ভুদ কান্ডকলাপ করতো। এ কারনে জিনিয়াকে প্রায়ই ওর মায়ের কাছ থেকে দুরে সড়িয়ে রাখা হতো। এসবই মানুষের মুখে শুনেছে জিনিয়ার মা। তার ওই সময়ের কথা কিছুই মনে নেই। অনেকে বলতো জিনিয়ার মায়ের উপর ভূতের আছড় পড়েছে কেউ কেউ বলতো সে পাগল হয়ে গেছে। হুজুরের পড়া পানি আর ডাক্তারের ঔষুধ দুটোই তাকে খাওয়ানো হতো। অবশেষে তিনি সুস্থ হয়ে উঠেন। তবে কি সেই ৯ বছর আগের ভয়টা এখনো জিনিয়ার মধ্যে কাজ করছে ? চোখের পানি মুছে তিনি জিনিয়ার কেবিনে গেলেন। জিনিয়া তখন ব্যাগ গোছাতে ব্যস্ত। তিনি জিনিয়ার সামনে গিয়ে বললেনঃ একি, তুমি ব্যাগ গোছাচ্ছো কেনো?
t আমরা বাসায় যাবো না?
t না তুমি এখনো সুস্থ হওনি।
t আম্মু আমি এখন সুস্থ। এতোদিন হাসপাতালে থাকলে আরো অসুস্থ হয়ে পড়বো।
t এই নিয়ে তুমি ৩ বার এমন করছো জিনিয়া। তুমি ভালো করেই জানো এখানে তোমার জন্য ভালো ট্রিটমেন্টের ব্যবস্থা আছে।
t কিন্তু ডাক্তার আংকেল বলেছে আমার ভালো লাগলে বাড়ি ঘুড়ে আসতে পারি।
জিনিয়ার মা আর মেয়ের সাথে কথা বাড়ালেন না। হাসপাতাল থেকে বাড়ি-বাড়ি থেকে হাসপাতাল এভাবেই জিনিয়ার দিন কাটছে। প্রায় ২ সপ্তাহ পর জিনিয়া বাড়ি গেলো। বাড়িতে ঢুকে প্রথমেই ওর সাথে আলামিনের দেখা হলো। আলামিন ওদের উপর তলায় থাকে। এতোদিন পর ছেলেটাকে দেখে ওর মন খুশিতে নেচে উঠলো। আর আলামিন অন্যান্য সময়ের মতোই সোজা জিনিয়ার পাশ দিয়ে চলে গেলো যেনো জিনিয়া অদৃশ্য কোনো বস্তু। তবু জিনিয়া কিছু মনে করেনা। ওর সাথে আলামিনের কথা তো দূরের কথা, কখনো চোখাচোখি ও হয়নি। জিনিয়া কখনো সরাসরি ওর দিকে তাকাতে সাহস করেনি তবুও ছেলেটিকে ও ভিষন পছন্দ করে।
ঘড়ে গিয়ে জিনিয়া ওর আব্বুকে দেখে জড়িয়ে ধরলো। মায়ের চেয়ে ওর আব্বুকে জিনিয়া বেশি ভালোবাসে। ওর মায়ের অসুস্থতার সময় ওর আব্বুই ওকে আগলে রেখেছিলো। জিনিয়া ওর আব্বুকে দেখে খুশিতে বলতে লাগলোঃ বলো তো আব্বু মাত্র আমি কাকে দেখলাম?
t তোমার ক্রাশ কে?
জিনিয়া লাফিয়ে বললোঃ একদম ঠিক বলেছো। কিন্তু উনি হয়তো জানে ও না আমি কতোদিন পর বাড়ি ফিরলাম।
ওর আব্বু হেসে বললোঃ তুমি কি চাও আমি তোমার ক্রাশকে গিয়ে জানাই?
t উফ আব্বু তুমি আমার ইজ্জত প্লাস্টিক করে দিবে।
এই বলে জিনিয়া ফ্রেশ হতে গেলো। এতোদিন পর বাড়ি আসা উপলক্ষে জিনিয়ার বাবা নিজ হাতে সব রান্না করে জিনিয়াকে খাওয়ালেন। পরদিন জিনিয়া ছাদে গেলো সময় কাটানোর জন্য। ওর অসুস্থতার কারনে পড়ালেখা থেকেও ওকে দূরে থাকতে হচ্ছে। কিছু পড়লেও সেটা দ্রুত ভুলে যায়। পড়ালেখা থেকে দূরে থাকায় জিনিয়া অবশ্য মনে মনে খুশিই হয়েছিলো। ও ভেবেছিলো এখন শান্তিতে গল্প উপন্যাসের বই পড়া যাবে। কিন্তু যখন দেখলো যে ও পড়ার সময় গল্পের কাহিনী গুলো ও ভুলে যাচ্ছে তখন ও প্রচণ্ড আঘাত পায়। মাঝে মাঝে মনে হয় ওর মস্তিষ্ক যেনো সম্পূর্ণ খালি হয়ে যাচ্ছে।
অনেকদিন পর ছাদে উঠে ও এপাশ ওপাশ ঘুড়তে লাগলো। কিছুক্ষন পরই ছাদে আলামিন এলো। জিনিয়াকে দেখে আলামিন ছাদের অন্য পাশে চলে গেলো আর জিনিয়া সেই এক জায়গাতেই দাঁড়িয়ে রইলো। ও ভুলেই গিয়েছে আজকে শুক্রবার। আলামিনের অফ ডে। ও একবার ভাবলো ছাদ থেকে চলে যাবে আবার ভাবলো এতোদিন পর এসেছি আরেকটু থেকেই যাই। তবু আলামিনকে দেখলেই ওর কেমন ভয় ভয় করে। সবসময় মুখটা গম্ভীর করে রাখে। জিনিয়া আকাশের দিকে চেয়ে আগের দিনের কথা ভাবতে লাগলো যখন ও স্কুলে যেতো। আলামিন যেই সময়ে অফিস যেতো, জিনিয়া ঠিক সেই সময়ে স্কুলের জন্য বের হতো। ও কয়েকদিন বাসস্ট্যান্ড পর্যন্ত আলামিনের পিছু পিছু গিয়েছে, আলামিনের বড় বড় কদমের সাথে তাল মিলিয়ে দ্রুত হেটেছে। তারপর আবার উল্টো দিকে স্কুলে চলে যেতো। কিন্তু আলামিন হাটার সময় কখনো পিছু ফেরেনি, আর বুঝতেও পারেনি কেউ ওর পিছু নিচ্ছে। জুম্মার নামাজের সময় হলে জিনিয়া বারান্দায় দাঁড়িয়ে আলামিনের যাওয়া দেখতো। ওর ইচ্ছে করলো আবারো আলামিনের পিছু নিয়ে বাসস্ট্যান্ড পর্যন্ত যেতে। এসব ভাবতে ভাবতে জিনিয়া নিচে নামতে গেলো। আলামিন অনেক আগেই ছাদ থেকে নেমে গেছে।
পরের কয়েকদিন পর্যন্ত জিনিয়ার শরীর ভালোই ছিলো। মাঝে মাঝে মাথা ব্যাথা করা, মাথা ঘুড়ানো, বমি হওয়া এসব স্বাভাবিক ছিলো। এসব জিনিস জিনিয়া গত ৮ মাস ধরে সহ্য করে আসছে। মাথা ব্যাথা হলে ও ওর মায়ের পায়ে মাথা রেখে শুয়ে পড়ে আর ওর মা মাথায় মালিশ করে দেয়। সেদিন ও জিনিয়া ওর মায়ের পায়ে মাথা রেখে শুয়ে ছিলো আর ওর মা মাথা-ঘাড় মালিশ করে দিচ্ছিলো। হঠাৎ করে জিনিয়া চোখ খুলে ধড়মড় করে উঠে বসলো। ওর মা কে দেখে ওর চোখে মুখে আতংক ছড়িয়ে পড়লো। ও চিৎকার করে ওর আব্বুকে ডেকে বলতে লাগলোঃ আব্বু, আম্মু আমাকে গলা চেপে মেরে ফেলছে। ওর চিৎকার শুনে ওর আব্বু অন্য ঘড় থেকে দৌড়ে এলো। ওর মা কেঁদে কেঁদে বললোঃ এসব কি বলছো জিনিয়া, আম্মু তোমাকে মারবে কেনো।
জিনিয়া এক ঝটকায় ওর মায়ের হাত সরিয়ে ওর আব্বুর পাশে গিয়ে দাড়ালো। ওর আব্বু ইশারা দিয়ে ওর মা কে চলে যেতে বললো। ওর মা মুখ চেপে কাঁদতে কাঁদতে বের হয়ে গেলো। জিনিয়ার মাথাটা দপদপ করতে লাগলো। ও দৌড়ে ছাদে চলে গেলো। এই মাত্রই একটা বড় ধরনের বিপদ থেকে বেচে গেছে ও। আরেকটু হলে ওর মা ওকে গলা চেপে মেরেই ফেলতো। ও মনে মনে ভাবতে লাগলো কবে আম্মু স্বাভাবিক হবে, কবে ওকে কাছে নিয়ে আদর করবে। কাঁদতে কাঁদতে ওর হেচকি উঠে গেলো ওদিকে আলামিন যে ওর দিকে অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে ও খেয়ালই করেনি। একটু পর চোখ মুছতে গিয়ে লক্ষ করলো একটু দূরে আলামিন ওর দিকে চেয়ে আছে। আলামিন কে দেখে ওর কান্না যেনো আরো বাড়তে লাগলো। আলামিন কিছু বুঝতে না পেরে চোখ সড়িয়ে নিলো তবুও কৌতুহলের বশে জিজ্ঞেস করলোঃ আপনার কি কোনো সমস্যা হয়েছে?
জিনিয়া কিছু বললো না শুধু মাথা নাড়লো। এটাই আলামিন আর জিনিয়ার মধ্যে প্রথম কথোপকথন। জিনিয়া কিছু একটা বলতে গেলো তখনি ওর আব্বু ছাদে এলো।
t নিচে এসো জিনিয়া, সন্ধ্যা হয়ে যাচ্ছে।
জিনিয়া ভয় মাখা কন্ঠে বললোঃ আম্মু?
t সব ঠিক আছে, চলো।
জিনিয়া ওর আব্বুর সাথে নিচে যেতে যেতে বললোঃ আব্বু, আম্মুকে হাসপাতালে পাঠানো দরকার।
জিনিয়ার আব্বু ওকে আস্বস্ত করে বললোঃ হ্যা মা কালই পাঠাবো।
সেদিন রাতে জিনিয়ার মা ওর সামনেই এলোনা। ভাবলো সকালে হয়তো সব ঠিক হয়ে যাবে। পরের দিন সকালে জিনিয়া ওর স্কুল ব্যাগ, ইউনিফর্ম আর বই খাতা খুজতে লাগলো। জিনিয়ার মা জানতো যে ও আবারো এমন করতে পারে তাই তিনি সব সড়িয়ে রেখেছিলেন। আজ যখন জিনিয়া সেসব খুজছিলো তখন ওর আব্বুই সব বের করে দিলো। ওর মা বাধা দিতে গেলে তিনি গতকাল বিকেলে ডাক্তারের সাথে হওয়া কথাগুলো তাকে বললেন। কাল যখন জিনিয়ার ডিমেনশিয়া হয় তখন তিনি ডাক্তারকে ফোন দেন। ডাক্তার বলেছেনঃ এ সময়ে জিনিয়া যেটাকে বাস্তব আর সত্যি ভাবে, ওকে সেভাবেই ভাবতে দেয়া উচিত। বাধা না দিয়ে ও যা করছে তাই করতে দেয়া উচিত। তারপর এক সময় ও নিজেই ওর বাস্তব জগতে ফিরে আসবে। তবে এই অবস্থায় হাসপাতালে ভর্তি রাখারই পরামর্শ দিয়েছেন ডাক্তার।
জিনিয়া রেডি হয়ে বাইরে বেড়িয়ে ভাবছিলো আলামিন ওর অফিসের জন্য বেড়িয়ে গেছে কিনা আর অমনি আলামিন বাসা থেকে বের হয়ে এলো। আলামিন ওকে পাশ কাটিয়ে চলে যেতে লাগলো। জিনিয়া তৎক্ষনাৎ ওর পিছু হাটতে শুরু করলো। ওদিকে ওর আব্বু যে ওকে পিছন থেকে নজরে রাখছে সেদিকে ও খেয়ালই করেনি। জিনিয়া আলামিনের দ্রুত পায়ের সাথে তাল মিলিয়ে রীতিমত দৌড়াতে লাগলো। কিছুদূর যাওয়ার পর আলামিন হঠাৎ ওর হাটার গতি কমিয়ে পিছে ঘুড়ে তাকালো। জিনিয়ার দিকে তাকিয়ে বললোঃ এতো তাড়াহুড়োর কি আছে, আস্তে হাটুন।
জিনিয়া এ কথা ছুনে প্রায় হোচট খেতে যাচ্ছিলো। ও কিছু না বলে আস্তে আস্তে আলামিন কে পাশ কাটিয়ে যেতে লাগলো। আলামিন ওর পাশাপাশি হাটতে হাটতে আবার বললোঃ এতক্ষন আমাকে ফলো করে এখন আমাকেই পাশ কাটিয়ে চলে যাচ্ছেন!
জিনিয়া ইতস্তত করে বললোঃ আ-আমি আপনাকে কেনো ফলো করতে যাবো। আমিতো স্কুলে যাচ্ছি।
t হুম জানি, আমাকে ফলো করে বাস স্ট্যান্ড পর্যন্ত যাওয়া হয় তাইতো?
জিনিয়া ওর কথা শুনে ভীষন ভয় পেয়ে গেলো কিন্তু প্রকাশ করলো না। একদিকে ভয়, অন্যদিকে আলামিন ওর এতো কাছ থেকে ওর সাথে কথা বলছে সেই আনন্দে ও উত্তেজিত হয়ে পড়লো। ও ভাবলোঃ যা হবার হবে, আজ ওকে সত্যি কথা টা বলবেই।
ও মাথা নেড়ে বললোঃ আসলে….হ্যা আমি প্রতিদিন ফলো করি…
বলেই জিনিয়া লজ্জায় মাথা নিচু করে ফেললো।
আলামিন মাথা দুলিয়ে বললোঃ অনেকদিন পর স্কুল যাওয়া হচ্ছে বুঝি?
t হ্যা আসলে এতোদিন….জিনিয়া আর বলতে পারলো না। ও মনে করতে পারলোনা শেষ কবে ও স্কুল গিয়েছিলো আর কেনো এতোদিন পর যাচ্ছে। ভাবতে ভাবতে ওর মাথা ঘুড়তে লাগলো। ও মাথায় হাত দিয়ে হঠাৎ দাঁড়িয়ে পড়লো। আলামিন ওকে থামতে দেখে বললোঃ কোনো সমস্যা?
তখনি পিছন থেকে ওর আব্বু এসে ওর সামনে দাড়ালো। জিনিয়া ওর আব্বুকে দেখে বললোঃ আব্বু, কোথায় যাচ্ছি আমরা? হাসপাতালে?
t হ্যা মা তোমাকে তো আজ ভর্তি করানোর কথা।
কথা বলতে বলতে জিনিয়ার আব্বু আড়ালে আলামিনকে দাড়ানোর জন্য চোখ দিয়ে ইশারা করে জিনিয়াকে নিয়ে একটু পিছে চলে গেলো।
ও বাড়ির দিকে তাকিয়ে বললোঃ আম্মু আসছেনা কেনো?
t তাইতো, এতো দেরি করছে কেনো। চলো তো গিয়ে দেখি
তিনি জিনিয়াকে সামনে হাটতে বলে আলামিনের কাছে গিয়ে বললোঃ জিনিয়া যদি তোমাকে উল্টাপাল্টা কিছু বলে থাকে তাহলে কিছু মনে নিয়ো না বাবা।
আলামিন এতোক্ষন কি হলো কিছুই বুঝতে পারলো না। ও বললোঃ না না ঠিক আছে কিন্তু ও আবার বাড়ি যাচ্ছে কেনো? ও তো স্কুলে যাচ্ছিলো।
t ও আর স্কুলে যাবেনা বাবা। তোমার অফিসের দেরি হয়ে যাচ্ছে তুমি যাও। আর সময় হলে বাসায় এসে আমার সাথে একটু দেখা করে যেও।
জিনিয়া একটু দূরে দাঁড়িয়ে এতোক্ষন ওর আব্বুর সাথে আলামিনের কথা বলা দেখছিলো। ওর আব্বু কাছে এলে উত্তেজিত হয়ে জিজ্ঞেস করলোঃ তুমি ক্রাশের সাথে কি কথা বলছিলে আব্বু?
t এই একটু দরকারি কথা বললাম।
t কি দরকারি কথা বলো না, বলো না..
t বলেছি যে, আমার মেয়েকে সুস্থ করে বাড়ি এনে তোমার সাথে বিয়ে দিবো। তোমার কি কোনো আপত্তি আছে?
জিনিয়া এ কথা শুনে হাসতে হাসতে গড়িয়ে পরলো।
t যাও আব্বু তুমি যে কি বলো না।
হাসি থামিয়ে জিনিয়া আবার বললোঃ ইশ আমি একটু কথা বলতে পারলাম না ক্রাশের সাথে। উনি আমার সামনে দাঁড়িয়ে ছিলো আমি একটু ভালো করে দেখতেও পারলাম না। আব্বু আমি আবার কবে বাসায় আসবো?
ওর আব্বু জিনিয়ার মাথায় হাত বুলিয়ে সামনে যেতে যেতে বললোঃ যখন তুমি একেবারে সুস্থ হবে তখন।
জিনিয়া পিছে ফিরে দূরে আলামিনের যাওয়ার পথে তাকিয়ে ভাবলোঃ আবার কবে আলামিনের সাথে দেখা হবে? আবার কি কখনো ও আলামিনের পিছু নিয়ে স্কুলে যেতে পারবে? আলামিন হয়তো কখনওই জানতে পারবেনা ও কতোবার ওকে পিছু করেছে, কতো শুক্রবার ছাদে ওর দেখা পাওয়ার জন্য অপেক্ষা করেছে। ভাবতে ভাবতে ও ওর আব্বুর হাত ধরে হাটতে লাগলো।
Comments & Reviews (0)
No comments yet :(