সেই কবেকার কথা, এখনো চোখের সামনে জ্বল জ্বল করে ভেসে ওঠে সেই চোখ। সম্ভবত সেই প্রথমবার আমার স্বামীর সঙ্গে দক্ষিণেশ্বরে যাওয়া কোন এক কল্পতরু উৎসবে। প্রভাতে সদ্য গঙ্গা স্নানে সূর্য্য প্রণাম সেরে মা ভবতারিণীর মন্দিরে শ্রদ্ধানিবেদনে তৈরি হচ্ছি, এমন সময় অদ্ভুত এক কন্ঠ আমার কানে এলো। অতি দীর্ঘ তীক্ষ্ণ আওয়াজ যেন কর্ণমূলের হৃদপিণ্ড ফুড়ে বিঁধে যাচ্ছে বল্লমএর মতো। মুহুর্তে আমি চোখ ফিরিয়ে দেখলাম দশ-বারো বছরের একটা বাচ্চা, অনাহারে অবহেলায় অনিদ্রায় মুখখানা একেবারে শুকিয়ে গেছে। শুষ্ক চর্ম, রুক্ষ চুল, জীর্ণ বস্ত্র, মলিন বদন, চোখ দুটো যেন কোটর থেকে চামড়ার পর্দা ছিঁড়ে উদিত ঊষার মতো ঠিকরে বেরিয়ে আসতে চাইছে। হাতে অ্যালুমনিয়ামের ভাঙা বাটি, করুণ কন্ঠে অনর্গল বলে চলেছে, "মা, কিছু দিয়ে যা, বাবু দুটো টাকা হবে!" আমি আমার স্বামীর কাছ থেকে পাঁচটা টাকা নিয়ে তার বাটিতে দিয়ে যথারীতি পুজোর জন্য দাঁড়িয়ে পড়লাম ভক্তদের লাইনে। চারিদিকে থিক থিক জনতার ভীড়, উপছে পড়া কোলাহল, বিশেষ দিন বলে হয়তো ভক্তদের ঢল নেমেছে মা ভবতারিণীর অঙ্গনে। হাজার মানুষের শতসহস্র লোচন নীলপদ্মের মতো ঠিকরে পড়ছে ঝলক, তার মাঝেও সেই অনাহুত চোখ দুটো আমায় যেন অনুসরণ করে চলেছে। চোখের সামনে মায়ের মুখ আর পিছনে ফেলে আসা সেই অদ্ভুত করুন চোখের দৃষ্টি যেন মিলেমিশে একাকার হয়ে যাচ্ছে। ভীড় ঠেলে এগিয়ে গেলাম মায়ের মুখের সামনে। কিছুতেই মায়ের পুজায় মনোনিবেশ করতে পারছিনা, পারছিনা চরণে আত্মনিবেদন করতে। মায়ের মুখের মধ্যেও যেন ফুটে উঠছে সেই চোখের প্রতিচ্ছবি। আমি উচাটন মন নিয়ে মায়ের পুজো শেষ করে ত্রস্ত ছুটলাম ঘাটের দিকে। ব্যার্থ হলাম, কারণ সেখানে তখন কেউ ছিলনা। ভেবেছিলাম তার বাটিতে আরও কয়েকটি টাকা দিয়ে কুশল জানতে চাইব, কিন্তু হলো না, খানিকটা ঔদাসীন্যতা নিয়ে বাড়ি ফিরলাম। আজও আমি দক্ষিণেশ্বরে গেলে ঘাটের পাশের সেই জায়গাটা আমার দৃষ্টি টানে। মনে ক্ষীণ আশা, যদি দেখা হয়, সেদিনের না কথা যদি বলার সুযোগ পাই ! হয়তো এখন সে অনেক বড় হয়েছে, হয়তো সে ভিক্ষাবৃত্তি ছেড়ে দিয়েছে! কিন্তু আমায় ছাড়েনি। সেই চোখ আজ ও আমায় তাড়া করে ফেরে। আর আজও আমি শত চোখের মাঝে খুঁজি সেই চোখ।
Comments & Reviews (0)
No comments yet :(