সিত্তুল মুনা হাসান ম্যাম'র "certainty and the self
Presenting" টপিকস এর উপর একটানা দুই ঘন্টার ক্লাস শেষ করে রুম থেকে নিশ্চুপে বের হয়ে পরলাম,কলা ভবনের পঞ্চম তলা থেকে টুকটুক করে নিচে নামতে শুরু করলাম, সামনে কাঠাঁল তলার দিকে অগ্রসরমান হলাম,মসজিদের সামনে বকুলের মিষ্টি গন্ধ আর ক্যান্টিনের পাশে কাঠবাদাম গাছটায় লাল পাতা গুলো ঝড়ে পরছে ... আমার উদ্দেশ্য ছিল টিএসসি যেয়ে মঈন মামার এক কাপ কড়া লিকারের চা খাবো।
আকাশ তখন নিশুতি অন্ধকার। ঠাণ্ডা একটা বাতাস আমার ভেতরটাকে ছুঁয়ে যাচ্ছে। হঠাৎ বাতাসের বেগ বাড়লো। শুরু হলো ধূলি ঝড়। আমি এক দৌড়ে ভাষা শহীদ রফিক ভবনের নীচে চলে গেলাম। একটু পরই ঝুম বৃষ্টি নামলো।
আমি ব্যাগ থেকে ছাতাটা বের করে খুলে মাথায় দিলাম, এরপর বাংলা ভবনের বাইরে পা রাখবো এমন সময় পেছন থেকে সুরেলা একটা নারী কণ্ঠ শুনতে পেলাম - " জাহিদ ! "
ঘাড় ঘুরিয়ে তাকালাম। সাদা শাড়ী পড়া, চুলে গুজাঁনো কাঠগোলাপ, ৪.৮ ইঞ্চি উচ্চতার, ধব ধবে ফর্সা এক হরিণী চোখী অচেনা তরুণী আমার দিকে হাসি হাসি মুখ করে তাকিয়ে আছে। ভাবলাম হয়তো , কোনো বন্ধুর বন্ধু হতে পারে, না আমারই কোন বান্ধবী হয় যার ব্যাপারে এই মুহূর্তে কোনো তথ্য মাথায় আসছে না।
কোমল গলায় বললাম- আমাদের কি আগে দেখা হয়েছিল?
:বাস্তবে একবারো না। ক্যানভাসে আপনার লেখা মাঝে মাঝে পাই। সেই সূত্রে দু একবার আপনার প্রোফাইল ঘাঁটা হয়েছিল।
: যাক লেখালিখির সিদ্ধান্তটা মনে হয় ভুল ছিল না।
:আচ্ছা একটা অনুরোধ। হুম...টিএসসি পর্যন্ত আপনার ছাতার নিচে যাওয়া যাবে ?"
:তবে চলুন আপনাকে পৌঁছে দিয়ে আসি। হাজার হোক আপনি আমার লেখার একজন পাঠক।
মেয়েটা এখন আমার ছাতার নীচে। মেয়েটার চুলের মিষ্টি গন্ধ নাকে এসে লাগছে। ছাতার নিচে গুঁটি সুটি পায়ে আমরা হেঁটে চলেছি। গায়ে গা যাতে না লাগে এজন্য নিজের শরীরের অর্ধেক ছাতার বাইরে বের করে রেখেছি। এখনো মেয়েটার পরিচয় জানতে চাই নি, জানতে ইচ্ছেও করছিল না। তবে মেয়েটাকে চমকে দিতে ইচ্ছে করছিল, কারন আমার পুরনো পাগলামির রোগটা ক্রমশ মাথা চাড়া দিয়ে উঠছে।
হঠাৎ করে মেয়েটাকে বললাম, আপনি ছাতাটা নিয়ে চলে যান। আমি আপাতত এই তুমুল বৃষ্টির আহবানকে উপেক্ষা করতে পারছি না। আমি এখন ভিজতে ভিজতে শান্ত চত্তরে গিয়ে বসবো। তারপর এক দৃষ্টিতে বৃষ্টি শেষ হওয়ার আগ পর্যন্ত আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকবো।
মেয়েটা মনে হয় কিঞ্চিত অবাক হল। চোখ বড় বড় করে কিছুক্ষণ আমার দিকে তাকিয়ে থাকলো।
:আপনি আসলেই এখন ভিজতে ভিজতে চলে যাবেন ?
:আমার মস্তিষ্ক মাঝে মাঝে আমাকে যা করতে বলে আমি সেটাই করি। "
: কিন্তু আপনার ছাতা ! "
:ক্যাম্পাস বেশি বড় না। পরে খুঁজে বের করে দিয়ে দেবেন না হয়! "
এই বলে আমি পুকুপুক করে হেঁটে শান্তচত্তরের দিকে ভিজতে ভিজতে চলে গেলাম। পেছনে তাকাই নি। যদিও তাকাতে ইচ্ছে করছিল !
শান্তচত্তরে বসে ঠাণ্ডায় কাপছি। বৃষ্টির বেগ তখনো কমে নি। ভেবেছিলাম শান্তচত্তরে বসে একটা নতুন গল্পের প্লট নিয়ে ভাববো। কিন্তু হাড় যেভাবে কাঁপছে, তাতে মনে হচ্ছে যেকোনো সময় ঠাণ্ডায় জ্বরে বেহুশ হয়ে যাবো। তবে আপাতত উঠে পড়ার চিন্তা করছি না। আমার চিন্তার সুতো ছিঁড়ে গেলো কানে নারী কণ্ঠের আওয়াজ শুনে...।
:আপনি তাহলে সত্যি এখানে আছেন !
আমাকে অবাক করে মেয়েটা এখন আমার পাশেই দাঁড়িয়ে আছে। মেয়েটাও কাক ভেজা হয়ে গেছে, হাতে আমার বন্ধ করা ছাতাটা।
:ও.. আপনি যাননি ?
:আপনি কি ভেবেছিলেন ক্যাম্পাসে আপনিই এক মাত্র প্রাণী যার পাগলামি করার রোগ আছে ?
: হাহা... প্রকৃতি তাহলে মাঝে মাঝে কল্পনার বিষয় বস্তু গুলোকে বাস্তবে এনে হাজির করে !
:স্বপ্নের মত কিছু বা সিনেমাটিক কিছু করার সাহস আসলে আমাদের সবার থাকে না।
:মন্দ বলেন নি। সৃষ্টি সুখের উল্লাসে সেই মাততে পারে যে তার খেয়াল খুশি মত চলতে পারে।
:এজন্যই বুঝি থর থর করে কাঁপতে কাঁপতেও রোম্যান্টিক হওয়ার চেষ্টা করছেন ?
: এই মুহূর্ত যদি শেষ না হয় তবে জ্ঞান হারানোর আগ পর্যন্ত রোম্যান্টিক হওয়ার চেষ্টা করবো।
আচমকা মেয়েটা আমার কাঁধে মাথা রাখলো। আমি কিছুটা হক চকিয়ে গেলাম। এখনকার অনুভূতিটাকে রবীন্দ্রনাথের ভাষায় সুখের মত ব্যথা বলা যেতে পারে। আমার হার্ট বিট বাড়ছে। রক্ত চলাচলের গতিও দ্রুত হয়ে গেছে। কিছু বলার চেষ্টা করছি, তবে মুখ দিয়ে একটা রা ও ফুটছে না।
মেয়েটাই নীরবতা ভেঙ্গে দিল - বেশি আনন্দে মারা যেতে ইচ্ছে করে কারো কারো। আমি হলাম সেই দলভুক্ত।
:আমি যদি ঠাণ্ডায় মারা যাই, তবে আমার প্রাণহীন দেহটা মনে হয় আপনার কোলেই লুটিয়ে পড়বে, তাই না?
:আমরা তার চেয়েও ভালো ভাবে মরতে পারি।
মেয়েটা আমার কাঁধ থেকে মাথা উঠিয়ে আমার চোখের দিকে এক দৃষ্টিতে থাকলো। আমার কেমন যেন ঘোর লাগা অনুভুতি হতে থাকলো। মেয়েটার ঠোঁটের কোণায় এক চিলতে হাসি ফুটে উঠেছে। মেয়েটা এখন অদ্ভুত ভঙ্গিতে হাসছে। আমার চার পাশ ক্রমেই ঝাপসা হতে লাগলো। মনে হচ্ছে অনেক দূর থেকে ভেসে আসছে সেই হাসির আওয়াজ। মেয়েটার অস্পষ্ট কথা কানে বাজছে - " আপনি আর আমি ! চলুন ! উঠে দাঁড়ান ! আমরা এখন মনের উল্লাসে হাসবো গাইবো।
আমি মন্ত্র মুগ্ধের মত উঠে দাঁড়ালাম তারপর মেয়েটার হাতে হাত রেখে ধীরে ধীরে ক্যাম্পাসের মাঝে। এখন আর কাপুনি আসছে না অবশ্য। আমরা হেঁটেই চলেছি সামনের দিকে। । আমি জানি না ! মেয়েটা জানে ! মেয়েটা আমার হাত আলতো করে ধরে সামনের দিকে টেনে নিয়ে যাচ্ছে।
হুট করে পেছন থেকে আসা একটা চিৎকারে আমি ভীষণ চমকে গেলাম। মনে হল আমার ঘোরটা কেটে গেছে। পেছনে তাকিয়ে দেখি রজতরেখা বাসের হেল্পার মামা ভয়ার্ত দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে আছে।
মামা ! কি করছেন আপনি ! গাজা বেশি খাইসেন নাকি আরেকটু হইলেই তো জান যাইতো আপনার !
ও .... ও ... ওই মেয়েটা .....
:মামা কই মাইয়া ? কোন মাইয়া?
আমি পাশে তাকিয়ে দেখি কেউ নেই। আমি একাই দাঁড়িয়ে কাপছি।
আমার সহ্য শক্তি একটু বেশি বলেই হয়তো তখনো জ্ঞান হারাই নি। কাঁপতে কাঁপতে ঠিকি শান্তচত্তর ছেড়ে গেটের দিকে এলোমেলো পায়ে এগুচ্ছিলাম। ঠিক তখনি সেই পরিচিত নারী কণ্ঠ শুনে আরেক বার চমকে উঠলাম। সব ঠিক আছে মি. কবি ?
:কে আপনি ! সত্যি করে বলুন ।
: সত্যি ! সেটা আবার কোথা থেকে আসবে। আমাকে স্রেফ আপনার গল্পের প্লটের একটা অংশ হিসেবে ধরে নিতে পারেন। হয়তো আমাদের আর দেখা হবে না।
আমি জবাবে কিছু বলতে যাব এমন সময় পেছন থেকে কেউ ডাকলো, তাকিয়ে দেখি তৃতীয় বর্ষের ছোট ভাই শিকদার সাকিব।
:ভাই আপনের এই অবস্থা কেন? আপ্নে তো রীতি মত কাপছেন ! ব্যাগ থেকে তো দেখছি ছাতাটা বের হয়ে আছে, মাথায় দেন নাই কেন?
: ছাতা ! আছে নাকি ! ছাতাটা দেখে ভেতর থেকে আরেক বার ধাক্কা খেলাম।
: ভাই বাসায় চলেন,আপনার অবস্থান খুবই খারাপ।
: আচ্ছা চল। পেছনে তাকিয়ে মেয়েটাকে দেখার চেষ্টা করলাম না কারন জানি মেয়েটা আরেকবার হাওয়ায় মিলিয়ে গেছে।
Comments & Reviews (0)
No comments yet :(