শেষ কথা
দিনটা ভয়ঙ্কর একটা বৃষ্টির দিন, বিদ্যুৎ নেই সেই সকাল থেকে! একা একা মনটাও খারাপ! এখন বুঝতে পারছি মেসে থেকে পড়াশোনা করাটা কতটা কঠিন, আনন্দ আছে কষ্টও আছে, তা হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছি! বৃষ্টির দিন ভালো লাগে শাহিন থাকলে ,গল্প-ইয়ার্কি-ঠাট্টা করতে করতে কেটে যায়।শাহিন গত দু-দিন হল বাড়ি গেছে,ওর বাবার শরীর খারাপ! এখন আমাকে একাই থাকতে হয়, কিছুতেই সময় কাটতে চাইনা একা একা!
কেউ যেন সময় কে বেঁধে দিয়েছে লোহার শিকলে,
সন্ধ্যে নামার আগে মোবাইলে চার্জ শেষ, এই এবার পড়েছি মহাবিপদে!মোবাইল ছাড়া যে এক মুহুর্তও চলা যায় না! সন্ধ্যার পরপর একটু বৃষ্টি থামলে রামু কাকা একবার এসে একটা হারিকেন সামান্য কেরাসিন, আর খাবার জল দিয়ে গেল। চলে যাবার পর আবার প্রচণ্ড বৃষ্টি, সময় যত বাড়ছে ততো যেন বৃষ্টির তেজও বাড়ছে, ভেবেই নিয়েছি আজ রাতে আর কিছু খাবো না। তবু এই মুহুর্তে একটু গরম চা হলে বেশ জমে যায়, কিন্তু অলসতাটাও খুব কাজ করছে! অলসতা কাটিয়ে গুটি গুটি পা'য়ে স্টোভটা জ্বালিয়ে একটু আঁদা দিয়ে চা বানিয়ে ফেললাম। চা'য়ে যেই চুম্বন মেরেছি সেই চোখে সামনে পড়ে গেল বই মেলা থেকে কিনা আনা সেই ভূতের গল্পের বইগুলো, যা আমাকে প্রচণ্ড আগ্রহী করে তুলেছে। আমার একটা নেশা গল্প পড়ার নেশা ভাবতে পারেন। ছোট্ট বেলা থেকেই গল্প, উপন্যাসের রহস্য খুঁজে বেড়ায় , আর বৃষ্টি একটু রহস্যপূর্ণ করেও তুলেছে তাতে কোন সন্দেহ নেই! তাই বেশি ভাবনা চিন্তা না করে,পাতলা ব্ল্যাঙ্কেটটা পায়ে একটু জড়িয়ে নিয়ে হারিকেনের আলোই পড়তে শুরু করলাম।
এদিকে বৃষ্টি থামার কোন নাম গন্ধ নেই, গল্পের যত পড়ছি , ততো যেন তলিয়ে যাচ্ছি রহস্যের বেড়াজালে! অনেক দিন শত শত বই পড়েছি তবে আজকের মত আনন্দ কোন দিন পাইনি! বৃষ্টির সাথে হালকা ঝোড়ো বাতাসে জানলার ভিতরে ঢুকে আসার চেষ্টা করছে আমগাছটা, হঠাৎ ঘড়িতে রাত বারোটা বেজে উঠার ঢংঢং শব্দ শুনতে পেলাম , এতক্ষণ খেয়াল করিনি ঘড়ির দিকে, এবার খেয়াল এলো রাত অনেকটা হয়েছে । শুনতে পাচ্ছি পুরাতন দরজার সেই ভয়ঙ্কর কেচকুচ শব্দ, তাতে অবশ্য আমার ভয় হয়নি, কিন্তু কেন জানিনা ছোট্টবেলা থেকেই ভয় হয় শেয়ালের কান্না শুনলে, হঠাৎ পাশের গোরস্থানের থেকে শুনতে পেলাম এক দল শেয়ালের কান্না, তৎক্ষণাৎ শরীর লোম গুলো দাঁড়িয়ে গেল! আর বারবার মনে হচ্ছিলো হয়তো ছিঁড়ে খাচ্ছে দু-দিন আগে গলাই দড়ি দিয়ে মারা যাওয়া মৃত মহিলার শরীর! হারিকেনটা এক কোণে রেখে, বইগুলো গুটিয়ে ঘুমানোর চেষ্টা করছি, ঘুম আসেনা। আমার আবার ঘুম না আসলে একটা পুরাতন অভ্যাস আছে,নবলিপির কথা মনে করা। তাই তার কথাই ভাবতে শুরু করলাম। তাকে নিয়ে বিশেষ কিছু বলার নেই, কিন্তু তাকে খুব ভালো লাগে, শুধু দেখতে নয়,তার ভালো, খারাপ সব দিকই, আমার খুব পছন্দ! তার নিষ্পাপ চোখ, খোলা চুল, ঠোঁটের কোণের মিষ্টি হাসি,চোখের কাজল সবই যেন আমাকে দুর্বল করে তোলে। আমিও তাকে বলতে পারিনি, সেও আমাকে কোন দিন বলতে পারেনি, ভালোবাসার কথা!
এভাবেই চলে গেছে দু-জনের দেখতে দেখতে চারটা বছর!
কুকুরগুলো পাশের রাস্তায় ডেকে উঠার সাথে সাথেই
দরজার পাশটাই কে যেন দাঁড়িয়ে মনে হল;
ঘরটাতেও কেমন গাম্ভীর্য গাম্ভীর্য ভাব এসেছে, চোখ ফিরিয়ে দেখি কেউ নেই! আমি ভাবলাম মনের ভুল , চোখটা মুজেছি যেই, সেই যেন হঠাৎ বেজে উঠলো ঝুমুরের ঝুম ঝুম শব্দ! এবার চোখ খুলে হতবাক হয়ে তাকিয়ে থাকলাম, চিৎকার করে উঠতে চাইলেও চিৎকার করতে পারলাম না! সামনে এসে দাঁড়িয়ে নবলিপি হারিকেনের আলোয় স্পষ্ট মুখটা জ্বল জ্বল করে উঠেছে। আমি কোন কথা বলার আগেই, সে আমার চোখের দিকে তাকিয়ে, মৃদু মৃদু কন্ঠে বলে উঠলো, তুমি আমায় কত ভালোবাসো, কত ভালোবাসো, বল নাগো? তখন আমি হয়তো আর এ জগতে নেই! আমি কিছু বলার চেষ্টা করেও বলতে পারছি না, শরীর পাথর হয়ে এসেছে, মনে হচ্ছে চোখের সামনে যা হচ্ছে সব যেন সত্য! নবলিপির ঠোঁট, ভিজে চুল থেকে গড়িয়ে পড়ছে বৃষ্টির জল!
তার ভিজে শরীরের মিশে থাকা সুগন্ধ কাতর করে তুলেছে আমাকে! আমি নিজেকে সামলাতে পারছিনা,
নবলিপি এতক্ষণে এগিয়ে দিয়েছে তার ভিজে পাতলা কম্পিত ঠোঁট আমার ঠোঁটের দিকে। দুটো ঠোঁট মেশার পর হিম হয়ে আসা শরীরটা উষ্ণ হয়ে এসেছে! তারপর তার কোমল বৃষ্টিতে ভেজা কাঁপাকাঁপা শরীর যেন চিপটে লেগে যাচ্ছে আমার শরীরের সাথে, খোলা চুলগুলো আচড়ে পড়েছে মুখের উপর, আমিও তাকে
দুটি বাহুর মাঝে শক্তপোক্ত জড়িয়ে ধরেছি।
এভাবেই থাকতে চাই যেন বাকি জীবন ,কিছুক্ষণ পর
তিনটে বাঁজতে যাবে তখন নবলিপি বলে উঠলো তোমার সাথে আমার কিছু কথা আছে.. কিন্তু বহু বলার চেষ্টা করেও বলতে পারল না!.... আজও হৃদয় কাঁদে, কি বলতে চেয়ে ছিল সেদিন সে আমাকে ?
তারপর কি হয়েছিল,আমি কখন ঘুমালাম কিছু মনে নেই! সকালে ঘুম ভাঙলো দশটা নাগাদ। বিদ্যুৎ এসেছে,
ঘুম ঘুম চোখে,মোবাইলটা চার্জে বসালাম। লকটা খুলতেই দেখি, শাহিনের নম্বর থেকে দশ থেকে বারো বার কল এসেছে , আমি তৎক্ষণাৎ কলটা করলাম। অনেকক্ষণ পর কলটা ধরল শাহিন।শাহিন একটু মনমরা গলায় বললো, এই তুই বাড়ি চলে আয়!
আমি উওর করলাম, কেন কি হয়ছে? এমন বলছিস যে?
সে বলে উঠলো, কাল নবলিপি মারা গেছে
এক্সিডেন্টে!
মৃত্যুর আগে যত ক্ষণ বেঁচে ছিল ততোক্ষণ তোকে দেখবে, তোর সাথে কথা বলবে বলছিল!
অথচ তোর মোবাইল অফ, অবশেষে রাত তিনটে নাগাদ মারা গেছে
তুই আয় একবার শেষ দেখা দেখে যা ............!!
Comments & Reviews (0)
No comments yet :(