সালটা ১৯৫২ সালের ফেব্রুয়ারি মাসের শেষের দিক ।ফাগুন মাসে রক্ত জবা ফুটেছে পথের ধারে ধারে। তমাল একাদশ শ্রেণীতে পড়ে।কবি নজরুলের কবিতা গুচ্ছ সাহিত্য তার খুবই প্রিয়। সেচ ছোটবেলার কবি নজরুলের একটা কবিতা পড়ছে। যার শেষ লাইনটা হঠাৎ তার মনে দাগ কাটলো।শেষ লাইনটা ছিল -
"আমরা যদি না জাগি মা কেমনে সকাল হবে
তোমার ছেলে উঠলে গো মা রাত পোহাবে তবে। "
এ দুইটা লাইন পড়েছে হঠাত ভাবুক হয়ে পরলো। বেশ কিছুদিন ধরে মাতৃভাষা বাংলা নিয়ে আন্দোলন
করে চলেছে তারই মত কিছু যুবক। সেও সেই আন্দোলনে যোগ দিতে চায়। কিন্তু মায়ের জন্য পারে না। শেষের লাইন দুটো পড়ে তার মনে হতে লাগলো "আসলেই তো আমরা যদি মাতৃভাষার জন্য লড়াই না করি, তবে লড়াইটা করবে কে। আর কেই বা ছিনিয়ে আনবে বিজয়। আমরা লড়াই করলেই তো মাতৃভাষা বাংলাকে পাকিস্তান গোষ্ঠীর হাত থেকে ছিনিয়ে আনতে পারব " এগুলো ভাবতে ভাবতেই হঠাৎ মা ডাক দিল- "তমাল, এই তমাল। কিরে কথা বলছিস না কেন? "হঠাৎ তমাল তার ভাবনা থেকে বেরিয়ে আসলো। "ওফ! মা কি যে করো না তুমি। একটা গভীর বিষয় নিয়ে ভাবতে বসে ছিলাম। দিলেতো ভাবনা টা নষ্ট করে। "
মা প্রত্যুত্তরে বললেন, "কি করবো রে বাবা তোর মুখে মা ডাক্তার না শুনলে আমার ভালো লাগে না। এর জন্যই তো কিছুক্ষণ পরপর বারবার তোকে ডাকতে থাকে। "
তমাল বলল-"আচ্ছা মা এই ধরো কোনদিন যদি আর তোমাকে মা বলে ডাকতে না পারি,অন্য ভাষায় মা বলে ডাকি ,তখন তোমার কেমন লাগবে।"
আমাদের মা বললেন-"কি অলক্ষুণে কথা বলছিস তুই। বাংলা ভাষায় মা ডাকের সাথে যে আবেগ জড়িয়ে আছে, অন্য ভাষায় ডাকলে কিসে আবেগটা থাকবে আর? " তমাল সাথেসাথে প্রশ্ন করে বসলো-"তবে যে মা আমাকে মাতৃভাষার আন্দোলনে তুমি যোগ দিতে দিচ্ছনা। আমরা যদি লড়াই না করি তাহলে তো কোনদিনই আমরা মাতৃভাষা বাংলাকে ছিনিয়ে আনতে পারব না। তখন আমাদের অন্য ভাষায় কথা বলতে হবে।এটার তখন কিভাবে সহ্য করবা মা। মিনা পারবা বাংলায় কথা বলতে না পারবা বাংলা ভাষাটা শুনতে। "
মা বলল,"একুশে ফেব্রুয়ারি তে কতজন ছেলেকে তারা এভাবে মেরেছে তুই দেখেছিস? তোর যদি কিছু হয় আমি কি নিয়ে থাকবো বল বাবা। আর তুই একা আন্দোলনে যোগ না দিলে কিচ্ছু হবে না।তোর মত সব যুবক ছেলেরা তো যোগ দিচ্ছে। ওরা দেখবি ঠিকই মাতৃভাষা বাংলাকে ছিনিয়ে আনতে পারবে। "
তমাল বলে উঠলো-"মা তুমি এতটা স্বার্থপর কিভাবে হলে! আমি কিভাবে নিশ্চিত হচ্ছে যে ওরা বাংলা ভাষাকে ছিনিয়ে আনতে পারবে? অথবা অই লোক বল যথেষ্ট? তোমার মত এরকম সকল মা যদি আমাদের আটকে রাখে তাহলে আমরা কিভাবে মাতৃভাষা বাংলাকে ছিনিয়ে আনব! তবে তো আজীবন আমাদের এই পরাধীন থাকতে হবে মা।মনের ভাষায় কথা বলতে হবে।মাতৃভাষাযই যদি কথা বলতে না পারলাম এর চেয়ে তো মরে যাওয়াই ভালো। "
মা তমালের কথা শুনে চুপ করে রইলেন। বলে উঠলেন "কিন্তু বাবা তোর যদি কিছু হয় আমি কি নিয়ে বেঁচে থাকবো? " তমাল উত্তর দিল -" মাগো, দেশের জন্য তো মরেও শান্তি। সেদিন তুমি জানবে তোমার ছেলে দেশের জন্য শহিদ হয়েছে। তুমি দেশের মাটিতে বুক ফুলিয়ে বলবে আমার ছেলে দেশের জন্য প্রাণ দিয়েছে। এর যে চরম শান্তি কি আর কোথাও পাবে মা গো।তুমি যেমন আমার জন্মদাত্রী মা, এই দেশ আমার পালনকারী মা।বাংলা ভাষা আমার অক্সিজেন। মায়ের বিপদে ছেলে কি কখনো না গিয়ে থাকতে পারে! তুমিই বলো মা।আর যদি ভাষা আন্দোলনের না যায়, মাতৃভাষা বাংলাকে ছিনিয়ে আনতে না পারি,মানুষ তো বলবে কি এক কাপুরুষ ছেলে জন্ম দিয়েছ।এটা শুনে বেঁচে থাকতে পারবে তো তুমি মা।দোহাই লাগে মা তোমার আমাকে ভাষা আন্দোলনে যেতে দাও ।" এটা বলে তমাল মন খারাপ করে বসে রইল।
মা আর কোন বিরোধিতা করল না। সাথে সাথে বলে উঠলো -"কিরে মন খারাপ করে বসে রইললি কেন? উঠ রহিম চাচার কাছে যেতে হবে তো। "তমাল বলে উঠল" রহিম চাচার কাছে আবার এখন কেন যাবা?"মা বলল, "আরে পাগল ছেলে, শুনেছি রহিম চাচা নাকি কাল ভাষা আন্দোলনে যোগ দিতে ঢাকা যাবে। আমি ভাবছি রহিম চাচার সাথেই তোকে পাঠিয়ে দেবো।কি বলিস? "
মায়ের মুখে কথাগুলো শুনে তোমার মাকে জড়িয়ে ধরে আনন্দে কেঁদে ফেলল। আর মনে মনে শপথ নিল "দেশ এবং মাতৃভাষা উভয় পাকিস্তানি সৈন্যদের হাত থেকে ছিনিয়ে নিয়ে তবেই শান্তির নিশ্বাস ছাড়বে সে।
Comments & Reviews (0)
No comments yet :(